পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চাষের রাজনীতির দুই দিক: সংঘপরিবার ও নকশালবাড়ি

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 207 view(s)
  • লিখেছেন : দেবজিৎ ভট্টাচার্য
গণহত্যার ফুলকপি চাষের ইতিহাসের সাথে অনেকেই পরিচিত হয়েছেন এ বছরের (২০২৫) মে মাসে। যখন অসংসদীয়, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মীদের গণহত্যার মধ্যেই সাধারণ সম্পাদককে হত্যা করা হল। তখন কুখ্যাত গণহত্যাকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মিম হাজির হল, হাসি মুখে ফুলকপি হাতে। ফুলকপির তলায় লেখা ছিল, 'রেস্ট ইন পিস নকশালিজম'। নকশাল রাজনীতির সংসদীয় ধারার অন্যতম প্রধান শক্তি সিপিআই(এমএল)(লিবারেশন) বিবৃতি দিয়ে সমালোচনা করেছিল।

বিহার বিধানসভা নির্বাচন শেষে কয়েক লক্ষ জনগণ বেনাগরিক হলেন। বিজেপি তার সংসদীয় বিরোধীদের প্রায় দুরমুশ করে একচ্ছত্রভাবে পাল্লা ভারী করেছে। জোট সঙ্গী নীতিশকে সম্পূর্ণভাবে পকেটে পুড়েছে। বিহার নির্বাচন থেকে সমাজ বিজ্ঞানীরা পেলেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভারতীয় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব উপহার - জনগণ হলেন একজন 'ভোটার', একজন ভোটার আদপে একজন 'নাগরিক', এর বেশি কিছু নয়। দেশের প্রত্যেক জনগণ প্রজা নয়, বরং, এক-একজন নাগরিক। নাগরিকের সন্মান, মৌলিক অধিকার তখনি পাবেন যখন সে আগে একজন ভোটার হবেন। অর্থাৎ, এস.আই.আর রাস্তা বানালো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও আঁটসাঁট করে আগলে রাখবার, নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোন প্রকারে আঘাত আসতে না দেওয়ার। এটি হলে তাঁর বা তাঁদের বা সেই গোষ্ঠীর জমানত বাজেয়াপ্ত, সরকারি সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত ও সর্বোপরি নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল পরিমাণে থেকে গেলো। যার প্রকৃত অর্থ দাঁড়ালো - আজকের আধুনিক বিশ্বে সরাসরি নির্বাচনকে বন্ধ না করে, ঘুরিয়ে বন্ধ করবার পথে অনেকখানি এগানো। আসলে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাবান শ্রেণির মধ্যকার সব থেকে হিংস্র অংশের ও বর্ণের দখলেও আনা হল। যেমনটা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের সংবিধান বলেছে। তাই বিহার বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় নিশ্চিন্তে কয়েক লক্ষ আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও মুসলীম জনগণ বাদ পড়লেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী শক্তি দুর্দান্ত ফলাফল করেছে। জনগণ যে শুধুই একজন ভোটার, এই অংকে জনগণকে দেখবার রাজনীতি ভারতীয় নির্বাচনে ইতিহাস থেকে চলছে, কম-বেশি প্রতিটি সংসদীয় রাজনৈতিক দলই তা করছে। যারা কেবলই নির্বাচনের খেলাতে মাতাল হয়ে আর.এস.এস ও বিজেপি, সংঘ পরিবারের গণহত্যার ফুলকপি চাষের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জমিতে সার, জল, আলো ইত্যাদি দিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে গণহত্যার চাষের রাজনীতি বিকশিত হয়েছে।

গণহত্যার ফুলকপি চাষের ইতিহাসের সাথে অনেকেই পরিচিত হয়েছেন এ বছরের (২০২৫) মে মাসে। যখন অসংসদীয়, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মীদের গণহত্যার মধ্যেই সাধারণ সম্পাদককে হত্যা করা হল। তখন কুখ্যাত গণহত্যাকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মিম হাজির হল, হাসি মুখে ফুলকপি হাতে। ফুলকপির তলায় লেখা ছিল, 'রেস্ট ইন পিস নকশালিজম'। নকশাল রাজনীতির সংসদীয় ধারার অন্যতম প্রধান শক্তি সিপিআই(এমএল)(লিবারেশন) বিবৃতি দিয়ে সমালোচনা করেছিল। তার ছয় মাসে বাদে ছিল বিহার বিধানসভা নির্বাচন। হয়তো, এই দেখে আদিবাসী, নিম্নবর্ণ, মুসলমানেরা খানিক ভরসা পেয়েছিল। লড়াইয়ের জোর জুগিয়েছিল। 

ফুলকপি চাষের রাজনীতির সাথে মুসলমানদের পরিচিতি ভয়াবহ আতঙ্কের, ঐতিহাসিকভাবে। কংগ্রেসের রাজীব গান্ধীর আমলে ভাগলপুরে কয়েকটি গ্রামে মুসলমান নারী, শিশু, পুরুষ সমেত মোট ১৯৮১ জনকে হত্যা করে গণহত্যার ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর, ভয়ংকর সংগঠিত শক্তি হিসেবে উঠে আসে আর.এস.এস ও বিজেপি তথা সংঘপরিবার। সালটা ১৯৮৯, অক্টোবরের শেষ সময়। হত্যার পর লাশগুলোকে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, গবেষক জিতেন্দ্রনারায়ণ। গবেষণাপত্রে বর্ণনা দিয়েছেন যে, ২৯শে অক্টোবর রাতে স্থানীয় থানার তত্ত্বাবধানে লাশগুলো পুকুর থেকে তুলে আশপাশের চাষের খেতে পুঁতে দেওয়া হয়। ৩০শে অক্টোবর 'কৈরি'দের (যাঁরা কৃষিকাজে পারদর্শী) নিয়ে এসে ওই জমিতে ফুলকপি আর সর্ষের বীজ বোনা হয়। কয়েক সপ্তাহ পরে যখন লোগাঁয়(ভাগলপুরে একটি গ্রাম) নিয়ে তদন্ত শুরু হয়, সেখানে তখন লাশের স্তূপের ওপরে শীতের নতুন সবজি গজিয়ে উঠেছে, ফুলকপি জন্মেছে। তৎকালীন সময়ে এই মুসলমান গণহত্যার ফুলকপি চাষের রাজনীতির কারিগর মূলত, আর.এস.এস ও বিজেপি সমেত সংঘপরিবার এবং কংগ্রেসের রাজীব গান্ধীর পুলিশ-প্রশাসন। এমনটাই সব ক্ষেত্রে উঠে এসেছে। দীর্ঘ আঠারো বছর পরে ভাগলপুর আদালত ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে, যাঁদের মধ্যে এই সমস্ত দলের নানা নেতা, কর্মী ও সেই সময়কার পুলিশ-প্রশাসনের প্রধানেরা রয়েছেন। ঘটনার প্রায় উনিশ বছর পরে ২০০৮ সালে 'হিন্দুস্তান টাইমস' পত্রিকা এই নিয়ে একটা বিস্তারিত প্রতিবেদন করে। এক গ্রামবাসী, প্রত্যক্ষদর্শী সাকিনা বিবি বলেন - "আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীরা যে এরকম কিছু করতে পারে, তা এখনো বিশ্বাস হয় না। এখানে এখনও যে সবজি চাষ হয়, সেগুলোতে যেন লাশের গন্ধ লেগে থাকে"। 

সংসদীয় রাজনীতিতে লাশের গন্ধের গণহত্যা রাজনীতি চাষের খেলা বহু পুরোনো। আবার অনেক কিছু নতুনও। দিনে দিনে উন্নত হয়েছে। বর্তমানে আরও উন্নতমানের গণহত্যার রাজনীতি চাষের ধারা চালু হয়েছে। লাশের হিসেব রেখে গণহত্যার রাজনীতি চাষ করার কথা সংবিধানে লেখা নেই। কিন্তু, বাস্তবের মাটিতে লাশের রাজনীতিতে তা লেখা হয়েছে, গণহত্যার রাজনীতির নিজস্ব গতি রয়েছে। ঠিক যেমনটা প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব গতি থাকে। এদেশে আর.এস.এস ও বিজেপি সমেত সংঘপরিবার এই গণহত্যার লাশের রাজনীতি চাষের মাথা। এরা যেই দিকে ছোটাচ্ছে বাকিরা ধরাশায়ী হয়ে সেইদিকে ছুটছে। এখন সশস্ত্র ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব গোষ্ঠীর দ্বারা গণহত্যা, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সেনাবলের জোরে গণহত্যার পাশাপাশি নোট বন্দি, লকডাউন ও কাগজ খোঁজার পেছনে দৌড় করিয়ে নিঃশব্দে গণহত্যার লাশের রাজনীতির চাষ চলছে সংসদীয় গণতন্ত্রে। যেমন, এখন এস.আই.আর-এর দ্বারা বি.এল.ও থেকে নিরীহ জনগণকে হত্যা করা হচ্ছে। সংসদীয় রাজনীতিতে আরও অনেক বেশি বিকশিত, উন্নতমানের লাশের রাজনীতি বা গণহত্যার রাজনীতির চাষের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে, বিগত দশ বছরে। যেখানে পাহাড় থেকে সমতল, গ্রাম থেকে শহর - যে কারোরই বিচার ব্যবস্থার প্রতিও আস্থা রাখবার ন্যূনতম জায়গা নেই। কয়েক হাজার আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও মুসলমান তথা নিরীহ শ্রমজীবী জনগণ নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছেন প্রতিদিন, দেশের নানা প্রান্তে। হিসেব রক্ষকরা তাঁদের হিসেব করছেন, কোথাও খুলি ধরে, অথবা, কোথাও ভোটার হিসেবে। কখনও সংখ্যা কমিয়ে, অথবা, কখনও সংখ্যা বাড়িয়ে। দেশের সকল জনগণ, নাগরিক আজ স্রেফ সংখ্যায় পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রের কাছে। ফলে দেশের নাগরিককে হত্যা করা হচ্ছে, এই টুক কথা কোনো সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখে নেই, নির্বাচনী ইশতেহারে থাকবার জায়গা নেই। তবে কী প্রতিটি সংসদীয় রাজনৈতিক দল এদেশের নাগরিককে 'প্রজা' মনে করে? সকল প্রজাকে কী ধীরে ধীরে ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করা হচ্ছে?

এই গণহত্যার চাষের ধারা অব্যাহত রাখতে, জনগণের বিকল্প ব্যবস্থার প্রতিরোধের রাজনীতির নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে আর.এস.এস ও বিজেপি, সংঘপরিবার প্রথমে মাওবাদীদের বেছে নিয়েছে। এরপর নকশালপন্থী বাকি গোষ্ঠীগুলোর পালাও আসতে পারে। সংঘপরিবার প্রথম থেকে ঘোষিত ও অঘোষিতভাবে প্রধান শত্রু হিসেবে বিপ্লবী কমিউনিস্ট ও আদিবাসী, নিম্নবর্ণ, মুসলমানদের চিহ্নিত করেছে। যারই নজির হিসেবে আদিবাসীদের সমস্ত সম্পদ লুঠ করতে, আদিবাসী অঞ্চলে সিপিআই(মাওবাদী) পার্টির সাধারণ সম্পাদককে হত্যা করে গণহত্যার ফুলকপি চাষের ছবি দেওয়া হল - আদিবাসী অঞ্চলে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের গণহত্যা ও ভাগলপুরে মুসলমানদের গণহত্যাকে এক হিসেবে দেখাতে, তা সকলের সামনে তুলে ধরতে। এগুলো তাদের মতাদর্শগত কাজ ও প্রচার, যা তারা উৎসাহ, আনন্দ ও উৎসবের সাথে করে। ঠিক সেই সময় নকশালপন্থী ধারার অন্যতম প্রধান সংসদীয় গোষ্ঠী সিপিআই(এমএল)(লিবারেশন) যতটা তৎপরতার সাথে বিবৃতি পেশ করেছিল, পরবর্তীতে সেই বিবৃতির ধারা ধরে রেখে বাস্তবের মাটিতে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের রাজনীতিতে উঠে আসতে পারত। কিন্তু, তা হয়নি, পরের সময়ে লিবারেশনও মাঠে মারা পড়েছে। বিহার বিধানসভা নির্বাচন শেষে কয়েক লক্ষ আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও মুসলমান তথা শ্রমজীবী জনগণ বেনাগরিক হয়েছেন, বিজেপির একচ্ছত্রভাবে বিজয়ে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অসমের বিজেপি মন্ত্রী পুনঃরায় ভাগলপুর গণহত্যার ফুলকপি চাষের রাজনীতি ধারা উস্কে দিয়ে টুইট করলেন। গণহত্যার চাষের রাজনীতিকে স্বীকৃতি দিয়ে সংসদীয় নিবার্চনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গণহত্যার রাজনীতির চাষকে আরও প্রসারিত করতে। এতে লিবারেশন দলটিরও দায় রয়েছে, এ কথা লিবারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বেরও অস্বীকার করবার জায়গা নেই। অথচ, সেই সময়ের ভুলগুলোকে শোধরানোর বদলে তারা এই সংসদ-মুখী রাজনীতির একই ধারা অব্যাহত রাখলেন, এই দিকেই আরও এগিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। এ বিষয়ে খোলসা করেছেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, এক সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারের(নাগরিক.নেট-এ অর্ক ভাদুড়ীকে দেওয়া সাক্ষাৎকার।) মাধ্যমে। সেইখানে তিনি জানিয়েছেন, 'দেশ জুড়ে নির্বাচনকে আন্দোলনে পরিণত করার কথা'। প্রশ্ন হল - নির্বাচন ও  জনগণের আন্দোলন কী একই রাজনৈতিক লাইনে বইতে পারে? আন্দোলন যদি নির্বাচন-মুখী হয়ে ওঠে তাহলে সেই ধরে এই দেশের নিম্নবর্ণ, আদিবাসী ও মুসলমান তথা শ্রমজীবী জনগণের লাভ কী হবে? তাদের সম্পূর্ণ অধিকার হাসিল হবে কী ভাবে? যেখানে বিহারের বেনাগরিক করবার বিধানসভা নির্বাচন প্রায় প্রমাণিত করে দিয়েছে যে, আর.এস.এস ও বিজেপি, সংঘ পরিবার রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করে ফেলেছে। এস.আই.আর সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত করেছে যে, এদেশে ন্যূনতম গণতন্ত্রের স্থান নেই। কারণ, যেই দেশে ন্যূনতম 'গণতন্ত্র' রয়েছে, সেই দেশে ন্যূনতম 'আইনের শাসন' থাকবে। রাতারাতি জনগণের আইনি প্রমাণপত্রগুলো - আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি বাতিল হয়ে যেতে পারে না। শাসক শ্রেণির এক অংশ এ কাজ করলে বাকি অংশ এর বিরুদ্ধে তীব্রতর প্রতিবাদ জানাবে। এক্ষেত্রে, এটি বাস্তবে সম্পূর্ণ করতে পুরোপুরিভাবে অসহযোগিতা করবে, প্রয়োজনে নির্বাচন বয়কটের পন্থা নেবে। ইতিহাসে কোনো দেশেই এমন ধরনের নৃশংস, ভয়াবহ ঘটনার উদাহরণ নেই। আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণায় রাষ্ট্রের মধ্যেকার প্রধান নেতৃত্বকারী শ্রেণির সকল অংশের সহায়তায়(প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) এই ধরনের চরম বিশৃঙ্খলতার জায়গা নেই। ফ্যাসিবাদের ধরনও এমন নয়, যেখানে শাসক শ্রেণিগুলোর সব অংশই এতে অংশগ্রহণ করবে, নিজেদের ব্যাপক পরিমাণের ক্ষতির পরেও। প্রশ্ন, তাহলে এই দেশের নির্বাচন কারা অনুষ্ঠিত করছে, কাদের স্বার্থে? নির্বাচনকে আন্দোলনে পরিণত করলেও-বা কার লাভ হবে? আদেও কী তা সম্ভব হবে? বরং, এতে জনগণের আন্দোলনগুলোকে একটা গণ্ডির ভেতরে বেঁধে ফেলা হবে নাতো, যা আদতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদকে গোটা দেশ জুড়ে চূড়ান্ত পর্যায় উত্তীর্ণ হতে। এ নিয়ে গভীরতার সাথে লিবারেশনের নেতৃত্বে থেকে সকল প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তি, ব্যক্তি, ছোট ছোট বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর ভাবা উচিৎ।

ভারতে চাষের রাজনীতিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সাথে জুড়ে ছিল নকশালবাড়ি। নকশালবাড়ির কৃষি বিপ্লবী রাজনীতি রাষ্ট্র ক্ষমতাকে অনুৎপাদক শ্রেণির হাত থেকে মুক্ত করে উৎপাদক বা উৎপাদনশীল শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের বীজ বপন করেছে, প্রকৃত কৃষকের হাতে জমির সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়ার উপরে দাঁড়িয়ে। এটিই সচেতন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রথম দেখায় যে, চাষ করা কৃষকের হাতে জমির সম্পূর্ণ অধিকার গেলে, কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পেলে তবেই কৃষি ভিত্তিক দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠা সম্ভব। যা আসলে এই সমাজে জনগণের প্রয়োজনকেন্দ্রিক উন্নয়নের রাজনীতি জন্ম দিতে পারে, নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। তবেই জল-জমি-জঙ্গল-খনিজ সম্পদ ও প্রতিটি নিপীড়িত জাতির ভাষা-সংস্কৃতি দীর্ঘস্থায়ীভাবে রক্ষা করা সম্ভব, বিদেশি লুণ্ঠন ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের হাত থেকে। এই পথ ধরে এগিয়েছে ভারতের মাওবাদী রাজনীতি। ছত্তিশগড় থেকে অন্ধ্র, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের বহু এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল বিকল্প সমাজ বা নতুন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ব্যবস্থার সরকার বা জনতনা সরকার। যেখানে জমিদার নেই, ভূমিহীন কৃষক ছিল না, বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ নেই, ঠিকাদারি প্রথা নেই, বরং, প্রতিটি উৎপাদনের উপরে আছে কেবল উৎপাদকের অধিকার - বিকল্প সমাজ বা নতুন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকার বা জনতনা সরকার(আর.পি.সি) পরিচালনার মাধ্যমে। এর উপরে দাঁড়িয়ে জনগণের যুদ্ধকে আরও দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে, আরও প্রসারিত করতে মাওবাদীরা তৈরি করেছিল - দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, সেখানকার আঞ্চলিক ভাষাগুলোতে সকলের পড়বার সুযোগ, ছোট ছোট চিকিৎসা ক্ষেত্র, দেশীয় প্রযুক্তির দ্বারা নানা উন্নতমানের অস্ত্র, জি.পি.এস প্রভৃতি। মাওবাদীরা দেখিয়েছে যে, নকশালবাড়ির চাষের রাজনীতি এদেশে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলবার প্রকৃত রাজনীতি, যা সংসদীয় গণহত্যার রাজনীতি চাষের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করছে। ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে কৃষকের জমির উপরে সম্পূর্ণ অধিকার ও ফসলের সম্পূর্ণ অধিকারের জায়গা নেই, শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারেরও জায়গা নেই, রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে মেয়েদের জায়গাও অত্যন্ত পরিমাণে কম রয়েছে। সেইখানে মাওবাদীদের বিকল্প সমাজ ব্যবস্থা বা নতুন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকার বা জনতনা সরকারের বিপ্লবী রাজনীতিতে মেয়েদের সদস্য সংখ্যা বেশি, মেয়েদের জমির উপরে মালিকানা রয়েছে ও প্রতিটি উৎপাদনে পুরুষের পাশাপাশি সমান অধিকার আছে, গণমুক্তি গেরিলা ফৌজেও মেয়েদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ষাট শতাংশ ছিল। এই সমগ্র বিষয় আজকের দিনের 'কাগার' অপারেশন আরও ভালোভাবে স্পষ্ট করেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি মাওবাদী হত্যার পেছনে আসলে দেশের উৎপাদনশীল বীর মেয়েদের ও আদিবাসী, নিম্নবর্ণকে হত্যার সুপরিকল্পনা রয়েছে। মাওবাদী পার্টি, গণমুক্তি গেরিলা ফৌজ ও বিকল্প সমাজ বা নতুন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকার বা জনতনা সরকারের(আর.পি.সি) পরিচালনার ক্ষেত্রে উচ্চপদে নিম্নবর্ণ, আদিবাসী ও মেয়েদের স্থানই বিপুল পরিমাণে রয়েছে, যাঁরা সকলেই শ্রমজীবী। এসব আজ সকলের সামনে প্রকাশ্যে, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমের দৌলতে ব্যাপকভাবে উঠে আসছে। 

নকশালবাড়ি রাজনীতির বাকি ধারার গোষ্ঠীগুলো এতদিন আলাদা আলাদা রাজনৈতিক অনুশীলন করেছে। তাদের রাজনীতির মূলে এখনও পর্যন্ত চাষের রাজনীতির কথাই রয়েছে। যে যে জায়গা তারা এখনও পর্যন্ত নিজেদের ন্যূনতম শক্তি ধরে রেখেছে সেগুলোও পূর্বের কৃষি বিপ্লবী সংগ্রামের ফসল। যদিও বর্তমানের বাস্তবে রাজনৈতিক অনুশীলনে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে বহু ভিন্নতা দেখা গেলেও, কোনো প্রকারের বিকল্প ব্যবস্থার ভ্রূণ না গড়ে তুলতে পারলেও লিখিতভাবে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক ধারাই বহন করছে প্রত্যেকে। 'অপারেশন কাগার'-এর গোটা সময় জুড়ে প্রত্যেক গোষ্ঠী এক হয়ে রাস্তায় নেমেছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে মাওবাদীদের বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে। ফলে অনেকে, অনেক সহানুভূতিশীল জনগণ বহু আশা নিয়ে বলছেন, 'মাওবাদী গণহত্যা নকশালপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে পুনঃরায় এক করে দিতে পারে'। চাষের রাজনীতিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের রাজনীতি, সমাজ পরিবর্তনের(উৎপাদন সম্পর্ক) রাজনীতির সাথে জুড়ে ফেলার কারিগর, ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাজনীতির শিক্ষক - চারু মজুমদার সেই সত্তরের দশকের শুরুতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সকল প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির মধ্যকার বিপ্লবী অংশকে নৈতিকতার সাথে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলবার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, "জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ"। এটাই হল, নকশালবাড়ি বিপ্লবী রাজনীতির অন্যতম প্রধান শিক্ষা - ব্যাপক জনগণের স্বার্থে, বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের গণহত্যার রাজনীতি, সংসদীয় গণহত্যার নির্মম নিষ্ঠুরতা চরম পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের শেষে বিজেপি মন্ত্রীর ফুলকপি চাষের কথা মনে করিয়ে দেওয়া কিন্তু তারই ইঙ্গিত বহন করছে। এখন প্রকৃত নকশালপন্থী গোষ্ঠীগুলোর এক হওয়া, নকশালবাড়ি ক্ষমতা দখলের মৌলিক রাজনীতিকে সামনে রেখে বৃহত্তর ঐক্য গড়বে। অথবা, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পারস্পরিকভাবে সেই প্রস্তুতি নেবে। এ আশা করা কী অনুচিৎ হবে? সংসদীয় গণহত্যার চাষের রাজনীতির বিপরীতে শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে আছে নকশালবাড়ির প্রতিবাদী, প্রতিরোধী, ক্ষমতা দখলের বিকল্প ব্যবস্থার জনবাদী রাজনীতি। নির্মম নিষ্ঠুরতার সমস্ত জনবিরোধী শক্তিগুলোকে পরাস্ত করতে পারে। ইতিহাস তার সাক্ষী রয়েছে।

0 Comments

Post Comment