পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভারত জোড়ো যাত্রায় সিপাহি বিদ্রোহের আদিবাসী নায়ক

  • 24 January, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 754 view(s)
  • লিখেছেন : শান্তনু ভট্টাচার্য
বিজেপি আরএসএস পরিচালিত সরকার তার কর্পোরেট বান্ধবদের কাছে দেশের জল, জমি, জঙ্গল - সবকিছু বেচে দিয়ে এদেশের নাগরিকদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাগুলো, যা আসলে এদেশের জনগনের সম্পত্তি, মায় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবকিছুই এর মধ্যেই বেচে দিয়েছে তারা। এদেশের প্রকৃত মালিক আদিবাসীদের ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ বা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ নেই। কর্পোরেটমুখী অপউন্নয়নের স্বার্থে বলি দেওয়া হচ্ছে দেশের অরণ্য পাহাড় - সব কিছু।

ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্যপ্রদেশ চ্যাপটারে মালওয়া – নিমার অঞ্চলের বুরহানপুর, খান্দোয়া, খারগোন,  ইন্দোর হয়ে উজ্জয়িনী- মোটামুটি এই ছিল রাহুল  গান্ধীর নির্ধারিত রুট। মধ্যপ্রদেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে উল্লিখিত অঞ্চলগুলিতে আরএসএস যথেষ্ট  শক্তিশালী, আছে ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস। নভেম্বরের ২৫ তারিখে যাত্রা পৌঁছে গেল খারগোনের মোরটাক্কা গ্রামে, ভিল উপজাতির  অবিসম্বাদিত নায়ক তাঁতিয়া ভিলের জন্ম স্থানে। খান্দোয়া-খারগোন অঞ্চলে প্রায় ২১শতাংশ মানুষ ভিল জনজাতিভুক্ত। দক্ষিণ মধ্যপ্রদেশের প্রান্তিক মানুষজন তাঁদের প্রিয় নায়ক তাঁতিয়া ভিলকে মামা বলে সম্বোধন করেন। 

 

   ২৬ শে নভেম্বর মোরটাক্কা গ্রামে এক জনসভায় রাহুল গাঁধী বললেন, তাঁতিয়া মামা শুধু বীরতার প্রতীকই নন, তিনি ছিলেন এক বৈপ্লবিক ভাবনা ও মতাদর্শের প্রতিনিধি। তাঁতিয়া মামার জন্মদিন ছিল ২৬-শে জানুয়ারি ১৯৪২, এর আট বছর পরে ওই দিনেই, স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, যা এক উল্লেখযোগ্য সমাপতন। ওই মতাদর্শ অনুসারে  'আদিবাসী' কথাটির অর্থ, "এই ভারতবর্ষের প্রথম বাসিন্দা তাঁরাই ছিলেন, তখন এই দেশে আর কেউ থাকতো না, অর্থাৎ এই দেশের প্রকৃত মালিক তাঁরাই। তাঁতিয়া মামার ভাবনা অনেক কিছু বলতে চায়।" তাঁতিয়া মামা আদিবাসী বিদ্রোহ ও ভয়ডরহীন আজাদির লড়াইয়ের এক নাম। ওই অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী উপনিবেশবাদী কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিয়েছিলেন।" তিনি এমন একজন নেতা, যাঁর আদর্শ গড়ে উঠেছিল আদিবাসীদের প্রতি প্রেম, ভালবাসা ও অধিকারের লড়াইয়ের পরম্পরার মধ্যে দিয়ে। এর বিপরীতে আদিবাসীদের 'বনবাসী' বলে সম্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী  এক ভয়ঙ্কর ভাবনা আমদানি করছেন। যদি আপনারা দেশের আসল মালিক হন তাহলে এদেশের জল, জমি ও জঙ্গলের উপর আপনাদেরই অধিকার বর্তায়। অন্যদিকে  'বনবাসী' তকমা দিয়ে বিজেপি সরকার আপনাদের এই সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়।" বিজেপি আরএসএস পরিচালিত সরকার তার কর্পোরেট বান্ধবদের কাছে দেশের জল, জমি, জঙ্গল - সবকিছু বেচে দিয়ে এদেশের  নাগরিকদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাগুলো, যা আসলে এদেশের জনগনের সম্পত্তি, মায় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবকিছুই এর মধ্যেই বেচে দিয়েছে তারা। এদেশের প্রকৃত মালিক আদিবাসীদের ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ বা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ নেই। কর্পোরেটমুখী অপউন্নয়নের স্বার্থে বলি দেওয়া হচ্ছে দেশের অরণ্য পাহাড় - সব কিছু। "অরণ্য - পাহাড় যদি না থাকে তাহলে বিজেপি কথিত 'বনবাসী' রা কোথায় যাবেন? তাই বিজেপি -আরএসএস'র  ভয়ঙ্কর চক্রান্তের আর একটি দিক হল আদিবাসীদের বেঘর করে কর্পোরেটদের দাসে পরিণত করা।" বীরসা মুণ্ডা, তাঁতিয়া মামা' রা দেশের স্বাধীনতার জন্যে জীবন বলিদান দিয়েছিলেন অন্যদিকে আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে পেছন থেকে ছুড়ি মেরেছিল। আরএসএস'র ওই ভাবনাই বীরসা মুণ্ডা, তাঁতিয়া মামা দের নিধনের জন্যে দায়ী;- বললেন রাহুল। 

 

   ১৯ শতকে খান্দোয়া, পাতালপানি, নিমার ইত্যাদি অঞ্চল গুলিতে ছিল দিগন্ত বিস্তৃত পর্ণমোচি বৃক্ষের ঘন অরণ্য । উপনিবেশবাদীদের নজর ছিল ওই অরণ্য সম্পদের দিকে, দোসর ছিল স্থানীয় জমিদার ও সাহুকার জমি হাঙররা। সময়টা ১৮৫৭ সাল, উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বিউগলের আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছিল মধ্যপ্রদেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত  উল্লিখিত বনাঞ্চলে। উত্তর ভারতে সিপাহিদের পরাজয় বা দিল্লির পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওই মহাবিদ্রোহ শেষ হয়ে যায়নি, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জনজাতিদের সশস্ত্র উথ্থানের মধ্যে দিয়ে। মালওয়া- নিমার করিডোরে নামমাত্র শাসক ছিলেন কুখ্যাত টোকোজি রাও হোলকার, যাঁর রক্ষাকর্তা ছিল দখলদার ব্রিটিশ শাসক ও তাদের আইন আদালত । তাঁর অধীনস্থ জমিদার - শাহুকারদের বল্গাহীন শোষন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়েন প্রান্তিক জনজাতির মানুষরা। নেতা ছিলেন তাঁতিয়া ভিল। ১৮৭৮ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানি শাসন অস্বীকার করে জনজাতিদের  স্বাধীন রাজ কায়েম করতে সক্ষম হন তিনি। ভিল যোদ্ধাদের তিরের নিশানায় ছিল ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনী। ১৮৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হন তাঁতিয়া ভিল এবং ৪-ঠা ডিসেম্বর তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল পাতালপানি রেলওয়ে স্টেশনের সংলগ্ন এলাকায়। তাঁতিয়া ভিল ছিলেন গরীবের মসিহা, রবিনহুড নামে তাঁর পরিচিতি ছিল ব্রিটিশ সাংবাদিকদের কাছে। এখনও পর্যন্ত পাতালপানি স্টেশন অতিক্রম করার সময়ে রেলের গতি মন্থর করে দেন চালকরা ; ওই মহা বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। 

   

       কংগ্রেসের আদিবাসী নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেকে পাশে নিয়ে রাহুল গান্ধী দাবি জানালেন ওই অমর্যাদাকর 'বনবাসী' শব্দ প্রয়োগের জন্যে প্রধান মন্ত্রী হাতজোড় করে ক্ষমা চান দেশবাসীর কাছে। মোরটাক্কা গ্রামের ওই জনসভায় এর আগেই সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশটি পাঠ ও ব্যাখ্যা করে শোনান শ্রী মল্লিকার্জুন খাড়গে, যেখানে সাম্য, স্বাধীনতা, মৈত্রী ও গণতন্ত্রের কথা লেখা আছে, সীমাহীন বঞ্চনা বা বৈষম্যের কথা নেই। বাস্তবে যূগের পর যূগ পার হয়ে গেলেও  "বৈষম্যের পাঁচিল কোন রাষ্ট্রই ভেঙে ফেলতে পারেনি। তবে রাষ্ট্র তার কড়া নজরদারি পাহারায় সন্তদের (স্ট্যান স্বামি দের) গোপনে বৈষম্য দূর করার সংকল্প রুখে দেওয়ার অকৃপণ প্রচেষ্টা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে।" - লিখেছেন শ্রীমতী কোয়েল সাহা, ২২শে ডিসেম্বর রবি বারোয়ারি, অন্যসময় পত্রিকা ।() অংশটি লেখকের সংযোজন। 

 

    সর্বশেষ খবর অনুযায়ী গত ৪-ঠা ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শিবরাজ সিং চৌহান ইন্দোরে ঘোষনা করলেন যে পাতালপানি রেলওয়ে স্টেশন অতঃপর 'তাঁতিয়া মামা' রেল স্টেশন - বলে পরিচিত হবে, সেইসঙ্গে ইন্দোরে কেন্দ্রীয় বাস স্ট্যাণ্ডের নাম ও পরিবর্তন করে তাঁতিয়া মামার নামে করা হল। এই পদক্ষেপ গুলো আসলে জনজাতির মানুষ গুলোর প্রতি সীমাহীন বঞ্চনার ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা কারন ইতিমধ্যেই তারা রোহিত ভেমুলা, স্ট্যান স্বামি দের রক্তে তাদের হাত রঞ্জিত করেছে। এর পাশাপাশি আমরা এটাও দেখেছি যে উড়িষ্যার গোণ্ড জনজাতির মানুষরা তাদের বনভূমি, খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ পাহাড় ও সংস্কৃতি রক্ষার মরণপণ লড়াইয়ে রুখে দিয়েছিলেন পস্কো কোম্পানির আগ্রাসী 'উন্নয়নের' অভিযান; তৈরি হয়েছিল নয়া কোম্পানি রাজ বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতি- '' গাঁও ছোড়ব নেহি, জঙ্গল ছোড়ব নেহি.... ।" 

 

0 Comments

Post Comment