পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

দক্ষিণ ভারত কি পারবে, কংগ্রেসকে লড়াইতে ফিরিয়ে আনতে?

  • 13 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 686 view(s)
  • লিখেছেন : মানস ঘোষ
সাম্প্রতিক পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আবার মনে হলো, বিজেপি’র সোসাল এঞ্জিনিয়ারিং কতটা শক্তিশালী। যদিও দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানাতে তাঁরা পরাজিত হয়েছে, কিন্তু সেখানেও তাঁদের আসন বেড়েছে। যে কথাটা এই নির্বাচনকে মাথায় রেখে বলা উচিৎ, তা হলো রাহুল গান্ধীও নিজেকে পাপ্পু ইমেজ থেকে বার করে গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠছেন দ্রুত। তিনি পরিশ্রম করছেন। কিন্তু তিনি কংগ্রেসের বৃদ্ধ নেতাদের কড়া হাতে মোকাবেলা করতে পারেননি। সেই জন্যেই একটা প্রশ্ন করা জরুরি, দক্ষিণ ভারত কি পারবে, কংগ্রেসকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনতে?

১।

মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা ও মিজোরামে বিধানসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক ফলাফল প্রমাণ করল বিজেপি’র সোসাল এঞ্জিনিয়ারিং কতটা শক্তিশালী। শেষোক্ত দুটি রাজ্যে বিজেপি হেরেছে কিন্তু সিট বাড়াতে সফল হয়েছে। মিজোরামে তারা মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ২টি আসন লাভ করেছে, একটি আসনে তারা দ্বিতীয় হয়েছে। অন্যদিকে কংগ্রেসের ভোট প্রায় ২১ শতাংশ কিন্তু আসন পেয়েছে মাত্র ১টি। ২০১৮’র নির্বাচনের তুলনায় দুটি জাতীয় দলেরই ভোট কমেছে, কংগ্রেসের কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ ও বিজেপি’র কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কমে ৫ থেকে হয়ে গেছে ১। অথচ বিজেপির ভোট কমলেও আসন বেড়েছে। আর এটা হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে মণিপুরকে কেন্দ্র করে প্রবল বিজেপি-বিরোধী হাওয়ার মধ্যে। জনরোষের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপির জাতীয় নেতারা মিজোরামে প্রবেশ করতেই পারেননি, এমনকি স্থানীয় বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও কোনো আঞ্চলিক দল এক মঞ্চে বসতে সাহস করেনি।

এই সাফল্য আসছে কেবল সঠিক কৌশলগত রণনীতি’র জোরে। এইরকম বিরুদ্ধ হাওয়ায়, যেখানে মোদী ম্যাজিক বা ডাবল ইঞ্জিন সরকার কোনোটাই কাজ করছে না, ভোটের শতাংশও কমেছে, সেখানেও বিজেপি’র আসন সংখ্যা ১ থেকে হয়েছে ২! আসলে বিজেপি খুব কৌশলে উদ্বাস্তু-বিরোধী নীতিকে এখানে কাজে লাগাতে সক্ষম হল। জো, কুকি ও বার্মার চিনি উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানিয়েছে মিজোরামে রাজ্যের সবচেয়ে বড় দল এমএনএফ। কংগ্রেসও যে উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতিশীল তা রাহুল গান্ধীর উত্তরপূর্ব নীতিতে পরিষ্কার। মিজোরাম একটি বর্ডার স্টেট। সেখানে অভিবাসন-বিরোধী ও উদ্বাস্তু-বিরোধী প্রচার সহজেই জনপ্রিয় হতে পারে। এটা বিজেপির থেকে ভালো কেউ বোঝেনা।

২।

কিন্তু এত কিছু’র পরেও প্রশ্ন থাকে বিজেপি বাস্তবে কতটা সর্বভারতীয় চরিত্রের দল। দক্ষিণ ভারত থেকে তারা হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে অথবা ছোট দল থেকে বড় দল হতে পারছে না। কর্ণাটকের পর তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের জয় দক্ষিণ ভারতে বিজেপির জন্য ভালো বার্তা নয়। বিশেষত, ইতিহাসে বেশ কয়েকবার দেখা গেছে উত্তর ভারত কংগ্রেসকে যখন প্রত্যাখ্যান করেছে দক্ষিণ ভারত কংগ্রেসকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে জনতা পার্টির বিরাট সাফল্যের অধিকাংশটাই কিন্তু উত্তর ভারত থেকে এসেছিল। ৪১% ভোট পেয়ে তাদের আসন সংখ্যা ছিল ২৯৫। অন্যদিকে কংগ্রেসের সামগ্রিক ভরাডুবির পরও ১৫৪টা আসনের প্রায় সবকটি এসেছিল দক্ষিণ ভারত থেকে। তারা পেয়েছিল ৩৪% ভোট। ১৯৮০’র নির্বাচনে দক্ষিণে আধিপত্যের সঙ্গে উত্তরের অনেকগুলি আসন পুনরুদ্ধার করে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে ৪২% ভোট ও ৩৫৩টি আসন নিয়ে।   

এই ইতিহাসটা বিজেপি মাথায় রাখে। তাই তারা হিন্দি-হিন্দু মতাদর্শকে আরো বেশি করে প্রচার করে চলেছে যাতে উত্তর ভারতে কোনোভাবেই কংগ্রেস আর দাঁত ফোটাতে না পারে। হিসেবটা কংগ্রেসেরও মাথায় নেই তা নয়। ইন্দিরা গান্ধীর জন্য যা ছিল চিকমাগালুর রাহুল গান্ধীর জন্য তাই হয়েছে ওয়েনাড়। কেরালার ওয়েনাড় থেকে রাহুল গান্ধীর প্রার্থী হওয়া, দক্ষিণ ভারতের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গেকে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি করা এবং ভারত জোড়ো যাত্রায় দক্ষিণ ভারতে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস আগে দক্ষিণ তারপর উত্তর নীতি নিয়েছে। তারা ইতিহাস থেকে বুঝেছে অস্ত্বিত্বরক্ষার লড়াইয়ে দক্ষিণ ভারত তাদের বিরাট ভরসা।

সেদিক থেকে বলতে গেলে কর্নাটক ও তেলেঙ্গানার নির্বাচন জেতা তাদের কাছে কাঙ্খিত ফল। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে তাদের কৌশল সফল হয়েছে। কিন্তু সেই সাফল্য তারা উত্তর ভারতে একেবারেই প্রসারিত করতে পারল না। ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কারণ প্রথমত, তাঁর বিরোধীরা অন্তর্কলহে লিপ্ত হয়ে ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত তারা আর্থিক ক্ষমতা ও কৌশলের দিক দিয়ে দূর্বল প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী যে ইতিবাচক রাজনীতির উদাহরণ দেখিয়েছিলেন তাই নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিল। তৃতীয়ত, তিনি দ্রুত কংগ্রেসের পুরনো নেতৃত্ব পরিবর্তন করে নতুন নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন সাহসের পরিচয় দিয়ে। চতুর্থত, ইন্দিরা গান্ধী ৬০ বছর বয়সে যে পরিশ্রম করেছিলেন উত্তর ভারত পুনরুদ্ধার করতে তা তুলনারহিত। ১৯৭৭-এ বিহারের বেলচিতে জোতদারদের হাতে দলিত গণহত্যার প্রতিবাদে যেভাবে ও যত দ্রুত তিনি ঘটনাস্থলে পৌছেছিলেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। অথচ তার মাত্র ছ’মাস আগেই কংগ্রেস করুণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে বিহারে। বিহার শরিফে পৌঁছে ইন্দিরা দেখেন বিহারের নেতারা তাঁর জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছে। তিনি বলেন, ওসব পরে হবে, আমারা যাত্রা করি, একমুহূর্ত সময় নষ্ট করা চলবে না। জিপ কিছুদূর গিয়ে কাদায় আটকে গেল। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন কাদার উপর দিয়ে, বললেন দরকার হলে সারারাত হেঁটেও বেলচি পৌঁছুতে হবে। শেষে একটা হাতি পাওয়া গেল। হাওদাবিহীন সেই হাতিতে চড়ে ঝঞ্ঝা’র রাত ও খরস্রোতা নদী পারিয়ে তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলির কাছে হাজির হলেন। নিজে ৬০ বছর বয়সে এই অসাধ্যসাধন করে তাকিয়ায় বসে রাজনীতি করা কংগ্রেস নেতাদের কাছে সাফ বার্তা দিলেন, খাটতে না পারলে নেতৃত্ব থেকে বিদায় হও। তাঁর দল বুঝে গেল বুড়ো কংগ্রেস নেতাদের সামনে চুপ করে থাকা বা চ্যাংড়া পুত্রের যথেচ্চাচার সহ্য করা গুঙ্গি গুড়িয়া এ নয়, ইনি অন্য মানুষ।

৩।

রাহুল গান্ধীও নিজেকে পাপ্পু ইমেজ থেকে বার করে গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠছেন দ্রুত। তিনি পরিশ্রম করছেন। কিন্তু তিনি কংগ্রেসের বৃদ্ধ নেতাদের কড়া হাতে মোকাবেলা করতে পারেননি। গেহলত ও কমলনাথের সামনে তিনি অসহায় দর্শক হয়ে থেকেছেন। তিনি চেষ্টা করেও শচীন পাইলটের মতো তরুণ নেতাদের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তর করতে পারেননি। সেদিক থেকে মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে পরাজয় হয়ত তাঁর সুবিধা করে দেবে। তাঁকে শক্ত হাতে নতুন নেতৃত্বের হাতে ব্যাটন তুলে দিতে হবে। তাতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি হবে কিন্তু এই অপ্রিয় কাজটা তাঁকে করতেই হবে। যদিও সাফল্য অর্জনের কাজটা আজ অনেক বেশি কঠিন, তাঁর প্রতিপক্ষ সাংগঠনিকভাবে ও কৌশলগতভাবে নিখুঁত, তারা নিক্তি মেপে নির্বাচন লড়ে। সবচেয়ে বড় কথা ইন্দিরার কংগ্রেস ও জনতা পার্টির মধ্যে মতাদর্শগত বিশেষ পার্থক্য ছিল না। উভয়ই ছিল সমাজতন্ত্র ঘেঁষা গণতান্ত্রিক দল। তাই মেরুকরণের সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল না। ১৯৭৭-এ ভোট পড়েছিল জরুরি অবস্থা তথা সঞ্জয় গান্ধীর অনাচারের বিরুদ্ধে, কংগ্রেসের মতাদর্শের বিরুদ্ধে ততটা নয়। লড়াইটা আজ অনেকগুণ কঠিন কারণ লিবারাল মতাদর্শ নিয়ে কংগ্রেসের পক্ষে উগ্র দক্ষিণপন্থি মেরুকরণের রাজনীতিকে মোকাবেলা করা পাহাড় নড়ানোর মতই শক্ত কাজ। দক্ষিণপন্থি ডিস্কোর্সের একটা চটজলদি পপুলার আবেদন থাকে। তাকে ভোটের বাক্সে সংখ্যায় হারানো সহজ নয়। অর্থাৎ কংগ্রেসকে তার পপুলার আপিল বাড়াতে হবে। একমাত্র উপায় রাহুল গান্ধীর উত্তর ভারত জুড়ে পদযাত্রা করা। অন্যকোনো অস্ত্র তাদের হাতে নেই। রাহুল গান্ধীর উচিৎ ছিল ইতমধ্যেই তা করা, বা প্রথম পর্বের ভারত জোড়ো যাত্রায় আরো বেশি সময় উত্তর ভারতে ব্যয় করা।

তবে কংগ্রেস যে চূড়ান্ত ব্যর্থ এই বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে তা কিন্তু নয়। কিছু কমেছে, তবু তারা কিন্তু তাদের ভোট পারসেন্টেজ মোটামুটি ধরে রাখতে পেরেছে। মধ্যপ্রদেশে কমেছে ০.৪৭ শতাংশ, রাজস্থানে ০.০৩ শতাংশ এবং ছত্তিশগড়ে কমেছে ০.৩৬ শতাংশ ভোট। বিশেষ করে রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে এন্টি-ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টরে এটুকু ভোট কমা প্রত্যাশিত ছিল। কংগ্রেসের নির্বাচনী পারফর্মেন্স কমবেশি স্টেডি হয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাব দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। অর্থাৎ তাদের লড়াই করার জমি ভোটাররা দিয়েছেন। এদেশের সবাই বিজেপি হয়ে গেছে এরকম হতাশার কারণ নেই। সেরকম হলে তো বিজেপি অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেত। তা হয়নি, বরং কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক মোটামুটি অক্ষত আছে। তাহলে বিজেপি’র ভোট কোথা থেকে এলো? এত বড় জয় কিভাবে সম্ভব হল? মূলত তাদের বর্ধিত ভোট এসেছে ভাসমান ভোটারদের অংশ থেকে, আর এসেছে ছোটদলগুলির ভোটের অংশ থেকে। এটাই সফল মেরুকরণের সাফল্য। সঙ্গে মোদী ম্যাজিক। দেখা যায় রাজনীতির নক্ষত্রদের ব্যক্তিগত ক্যারিস্মা সবচেয়ে দ্রুত ও চটজলদি প্রভাব ফেলে এই ভাসমান ভোটারদের মধ্যে।

দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রদেশে বিজেপি’র ভোট শতাংশের হিসেবে বেড়েছে ৮.৯১, সেখানে বসপা জোট ও অন্যান্যদের ভোট কমেছে যথাক্রমে ২.৮১ ৫.৭০= ৮.৫১ শতাংশ। ছত্তিশগড়ে বিজেপি বেড়েছে ১৩.২২ শতাংশ, সেখানে বসপা জোট ও অন্যান্যদের ভোট কমেছে যথাক্রমে ১.৫৭ ১১.২৯= ১২.৮৬ শতাংশ। রাজস্থানে বিজেপি ভোট শতাংশের হিসেবে বেড়েছে ৩.৫৪, সেখানে বসপা জোট ও অন্যান্যদের ভোট কমেছে যথাক্রমে ২.০১ ১.৫০= ৩.৫১ শতাংশ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে বিজেপি বিপুল জয় পেয়েছে বসপা-সহ ছোটদলগুলির ভোট তাদের ঝুলিতে যাওয়ায়। এখানেই বিজেপির অংক ও সোসাল এনজিনিয়ারিঙের সাফল্য।

এরকম নয় যে এই ভোট কংগ্রেসের দিকে টানার কোনো উপায় নেই। রাহুল গান্ধীকে হিসেব করে আরো সক্রিয় হতে হবে উত্তর ভারতে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা বড় মানসিক বাধা রয়েছে ভোটারদের দিক থেকে। তা হল এই ভোটের বেশিরভাগ অংশটা মন্ডল-পরবর্তি দলগুলির ভোট। ফলে এই ভোট ঐতিহসিকভাবে কংগ্রেস-বিরোধী ভোট। তার একটা প্রবণতা রয়ে গেছে অ-কংগ্রেস হবার দিকে। তাই দেখা গেছে সপা বা বসপার সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হলেও সেই ব্যবস্থা দলের নিচুস্তরের কর্মি ও তাদের ভোটাররা মেনে নিতে দ্বিধান্বিত থাকেন। বিজেপি’র সৌভাগ্য হল কাঁশিরাম ও মুলায়েম সিং-এর মতো নেতা আর নেই যাঁরা তাঁদের অনুগামিদের মতাদর্শগতভাবে মনুবাদী দলের বিরোধীতায় সংহত রাখতে পারবেন। ফলে সেই ভোট মতাদর্শ থেকে আলগা হয়ে চলে যাচ্ছে বিজেপির দিকে। বিহারের ক্ষেত্রে কিন্তু চিত্রটা একটু অন্যরকম। লালুপ্রসাদ অসুস্থ তথাপি তিনি মতাদর্শগতভাবে সক্রিয়। সেখানে নীতিশকুমারের উপস্থিতিও কাজ করছে। সামাজিক ন্যায় ও মনুবাদ-বিরোধীতার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এখনো বিহারে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছেন এঁরা। বিহারের রাজনীতিতে উগ্র দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকে মোকাবেলা করে সামাজিক ন্যায় ও রুটি-কাপড়া-মকান-শিক্ষা-কাজের পক্ষে জনমত গঠনের কাজটাকে সফলভাবে করতে সাহায্য করছে সে রাজ্যের সজীব বাম-রাজনীতি। যেটা উত্তরপ্রদেশ, মধ্যমধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে মাওবাদীদের প্রভাব থাকলেও গণসংগঠনের অভাবে জনমতকে তারা সংগঠিত করতে পারে না।

৪  

মন্ডল-পরবর্তি ওবিসি ও দলিত ভোট যাতে কংগ্রেসে ফিরে আসে বা অন্তত ইন্ডিয়া জোটের দিকে থাকে, তার চেষ্টা বিরোধীদের করতে হবে। একথা বুঝেই রাহুল গান্ধী জাতি-গণনা’র উপর এতটা গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইন্ডিয়া জোট-সঙ্গী নীতিশ কুমার বিহারে জাতি-গণনা শেষ করেছেন, কিন্তু আপাতত তার সুফল তেমন এলো না দেখা যাচ্ছে। তার একটা বড় কারণ কমলনাথের মতো নেতাদের গা-জোয়ারি, এই পরীক্ষা আরো ভালোভাবে হতে পারত যদি মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে সপা, বসপা ও অন্য দলিত-আদিবাসী-বহুজন দলগুলির সঙ্গে শক্ত নির্বাচনী জোট গড়ে তোলা হত। রাজস্থানে সিপিএমের জেতা আসনও কংগ্রেস ছাড়তে রাজি হয়নি। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে সেকুলার ভোট ভাগাগাগির কারণে অল্প মার্জিনে তারা পরাজিত হয়েছে । বিরোধীদের মধ্যে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার রাজনীতির ফয়দা তুলেছে বিজেপি। কংগ্রেস, আপ, টিএমসি, বসপা ও সপাকে বুঝতে হবে এভাবে চললে তাদের সমূহ বিপদ। এতে কংগ্রেসের ক্ষতি হবে, আরও বড় কথা আঞ্চলিক বা ছোটদলগুলির ভোটব্যাঙ্ক ধীরে ধীরে বিজেপি গ্রাস করে নেবে।

তেলেঙ্গানার ছবিটা অবশ্য একটু অন্যরকম। সেখানেও কংগ্রেসের আচরণ সিপিআই-এর প্রতি মোটেই সহনশীল ছিল না। তারা জোটসঙ্গীকে তাদের দাবিমত আসনের প্রায় কিছুই দেয়নি। তবে সিপিআই যেহেতু মতাদর্শ-প্রধান দল তাই তাদের ভোট যেখানে তাদের প্রার্থি নেই সেখানেও জোটসঙ্গী ও সেকুলার কংগ্রেসের পক্ষে গেছে। এরই সঙ্গে কংগ্রেসের জাতি গণনার প্রতিশ্রুতি সেখানে ভালো ফল দিয়েছে। অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন, যেখানে অম্বেদকারাইট মুভমেন্ট বা জাতি-সচেতনতা দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত হয়েছে সেখানে জাতি-গণনার গুরুত্ব মানুষকে বোঝানো সম্ভব। দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে সেটা হয়েছে। কিন্তু যেসব অঞ্চলে জাতি-সচেতনতার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে বা কখনো গড়ে ওঠেনি সেখানে এই ইস্যুতে পলিটিক্যাল মোবিলাইজেশন আশু সম্ভব নয়। তার জন্য সময় লাগবে, পরিশ্রম করতে হবে রীতিমত। ভোটের মুখে জাতি-গণনার কথা বললেই দলিত-ওবিসি ভোটার দলে দলে এসে ভোট দেবেন না। কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের সুযোগ আছে জাতি-গণনার সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে সেই সাফল্যকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার। না হলে মুখের কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। বিশেষত উত্তর ভারতে মন্ডল ভোট যেহেতু চরিত্রগতভাবে কংগ্রেস-বিমুখ, তাকে কনভিন্স করতে কংগ্রেসকে অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হবে। আর সেটা না পারলে উত্তর ভারতে বিজেপিকে হারানো সম্ভব নয়। তবে কেবল জোট রাজনীতি দিয়ে কাজটা হবে না, বরং কংগ্রেসের উচিৎ জোট সঙ্গীদের সাথে এককাট্টা হয়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়া এবং যৌথ কর্মসূচী তৈরি করা। সেটা করতে পারলে তবেই উত্তর ভারতে মন্ডল ভোটের একটা অংশ কংগ্রেসের প্রতি সদয় হবে। তাতে ভবিষ্যতে ভোটের অংক পাল্টাবে তাদের অনুকূলে।         

                                            

0 Comments

Post Comment