পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ইতিহাসের আলোকে: আগে ধর্মীয় হিংসা, পিছে রাজনীতি

  • 28 October, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 386 view(s)
  • লিখেছেন : দেবজিৎ ভট্টাচার্য
ইতিহাস বিকৃত করবার পেছনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মূল লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার ও ভারতীয় রাজনীতির সুদূর ভবিষ্যতেও আধিপত্য কায়েম রাখবার স্বপ্ন। ফলে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সহ আরও নানা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি দেশ ভাগ করে স-শরীরে ভারত ছেড়ে গেলেও, সংবিধানে তথাকথিত স্বাধীন ভারতবাসী পেল ধর্মকে রাষ্ট্রের প্রসারিত ও নিয়ন্ত্রিত করবার ক্ষমতা। ধর্মকে ধরে রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতি করবার আইনি জোর।


"ব্রিটিশরা আমাদের ইতিহাস বিকৃত করে দেখাল: হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ চিরন্তন, মুসলমানরা এদেশে আক্রমণ করে হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছে। এই অর্ধসত্য, মিথ্যা প্রচারে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকরা প্রকৃত সত্যকে অনুচ্চারিত রেখে দেয়। হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত সৃষ্টি রূপায়িত হয়েছে স্থাপত্য(কুতুব মিনার, তাজমহল), সঙ্গীত ও সাহিত্যে। মির্জা গালিব, তানসেন, আমির খুশরু ভারতের নিজস্ব হয়ে ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন - এ সত্য ইংরেজরা চেপে রেখেছেন।"

 'সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ' প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত, এই কয়েকটি শব্দ কিংবা লাইন বলে দেয় ভারতের ধর্মীয় হিংসার পেছনকার ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক ইতিহাস কেমন ছিল।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতকে শাসন করতে যে 'বিভেদ নীতি' ব্যবহার করেছিল, তার প্রথম পর্যায় শুরু হয়  ইতিহাসকে বিকৃত করবার মধ্যে দিয়ে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদেরা সতেরশো শতকের শেষ সময়, আঠারোশো শতকের শুরুর সময় থেকে দেখান যে, ভারতের ইতিহাস তিন ধরনের; এক, প্রাচীন বা হিন্দু যুগ; দুই, মধ্য বা মুসলীম যুগ; তিন, আধুনিক বা ব্রিটিশ যুগ। এ নিয়ে তাঁরা ১৮১৬-১৭ সালে একটি বই প্রকাশ করেন, সেখান থেকে ভারতীয় সমাজে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মীয় হিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, দাঙ্গা ও গণহত্যা। 'মুসলমান যুগ' অনুসারে দেখানো হয়, সে-সময়কার শাসকশ্রেণীর প্রত্যেকেই ছিলেন মুসলমান এবং শোষিত সকল শ্রেণীই ছিল হিন্দু ধর্মের লোকেরা। পরর্বতীকালে কিছু ভারতীয় ইতিহাসবিদদের গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, যে, মুসলীম শাসনকালে বহু হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায় শাসকশ্রেণীর অংশ, জমিদারও ছিলেন।

গবেষক ও লেখিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য জানান, পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে ‘হিন্দু’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় একবারও ব্যবহৃত হয়নি। ‘হিন্দু’ শব্দটি পাওয়া যায় ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের দ্বিতীয় কৃষ্ণদেব রায়ের ‘সত্যমঙ্গল’ তাম্রপটে। এখানে পাওয়া যায় বিজয়নগরের রাজাকে ‘হিন্দুরায় সুরতরাণা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিষয়টি আরও একটু বিস্তৃত করে বলা যায় যে, ১৮১৬-র আগে হিন্দু নামে কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে (১৮১৬) রাজা রামমোহন রায় প্রথম Hinduism শব্দটি ধর্মীয় অর্থে ব্যবহার করেন। এর পূর্বে শব্দটার কোনও ধর্মীয় ব্যঞ্জনা ছিল না।

এ রকমের ইতিহাস বিকৃত করবার পেছনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মূল লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার ও ভারতীয় রাজনীতির সুদূর ভবিষ্যতেও আধিপত্য কায়েম রাখবার স্বপ্ন। ফলে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সহ আরও নানা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি দেশ ভাগ করে স-শরীরে ভারত ছেড়ে গেলেও, সংবিধানে তথাকথিত স্বাধীন ভারতবাসী পেল ধর্মকে রাষ্ট্রের প্রসারিত ও নিয়ন্ত্রিত করবার ক্ষমতা। ধর্মকে ধরে রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতি করবার আইনি জোর।

এরপর ঘটে গেল একের পর এক ধর্মীয় হিংসা, দাঙ্গা ও গণহত্যা। যেগুলির পেছনে লুকিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক স্বার্থ। আজকের ভারতে চিত্র সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতার চরিত্র, এ বাংলা তার অংশ।

আজ এঁদের লক্ষ্য আইনি ও লিখিতভাবে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা, যে সমাজের প্রধান রক্ষক হবেন, সামন্ততন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র; যাঁরা 'নয়া ভারত'-এর নাম দিয়ে নয়া ঔপনিবেশিক ধরণে এ দেশকে চালনা করছেন, সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থে সমাজে নিজেদের মতাদর্শগত আধিপত্যের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন। এ ধারণার অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদ গোলওয়ালকার, "We or Our Nationalhood Defined"(১৯৩১) গ্রন্থে লিখেছেন: "হিন্দুস্তানের অ-হিন্দু জনগণকে হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি (race) এবং সংস্কৃতির মহিমা প্রচার ব্যতীত অন্য কোনও ধারণা বর্জন করতে হবে। অর্থাৎ তাদের কেবল এই দেশ ও তার যুগযুগান্তরব্যাপী ঐতিহ্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করলেই হবে না, বরং তার পরিবর্তে ভালোবাসা ও আরাধনার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে— এক কথায় তাদের হয় বিদেশি হয়ে থাকা বন্ধ করতে হবে, অথবা তারা এদেশে থাকতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে হিন্দুজাতির অধীনস্থ হয়ে, কোনও কিছু দাবী না করে, কোনও বিশেষ সুবিধার দাবিদার না হয়ে, কোনও পক্ষপাতমূলক আচরণের দাবিদার না হয়ে তো বটেই— এমনকি নাগরিক অধিকারের দাবিদার না হয়ে।"

এমন রাজনৈতিক মতাদর্শের মূখ্য ভূমিকায় রয়েছে, 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ'(আরএসএস একটি 'অরাজনৈতিক' সংগঠন)। এ দল ১৯২৫ সালে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়, পরবর্তীকালে এর প্রধান হন গোলওয়ালকার। প্রথম থেকে অনুসরণ করতেন, ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে, নকল করতেন মুসোলিনি, হিটলারের সাংগঠনিক কার্যাবলী, প্রক্রিয়াকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভারত ছেড়ে যাওয়ায় এঁরা তীব্র বিরোধিতাও করেন। বরং ব্রিটিশদের তৈরি বিকৃত ইতিহাস হিসেবে ভারতের প্রধান শত্রু মনে করেন, অহিন্দু তথা মুসলমানদের। আর ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব মতাদর্শ অনুসারে দেশ ও সমাজের অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন, অব্রাহ্মণ, দলিত, আদিবাসী ও নারী সমাজকে। বর্তমানে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর প্রধান ভূমিকায় রয়েছে, এঁদের তৈরি মতাদর্শের রাজনৈতিক দল, বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যিনি এবং তাঁর দল আজ স্বঘোষিতভাবে ভারতের সংখ্যাগুরুর ধর্ম এবং রাজনীতির সম্পূর্ণ মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের জোরে। সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত, দেশের বৃহৎ পুঁজিপতি --- টাটা, আম্বানি, আদানি, বিড়লা প্রভৃতি ব্যবসায়ীগোষ্ঠীগুলি আরএসএসকে বার্ষিক কয়েক হাজার কোটি টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন। এ সংগঠনের নানা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের আচাঁর, অনুষ্ঠানে 'অতিথি' হিসেবেও আসেন এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর লোকেরা, দেশের নামকরা বিজ্ঞানী, তদন্তকারী অফিসার, সেনা প্রধান, আমলা, বিচারপতিগণ। এমনকি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক হিংসার ফসল, রামমন্দির উদ্বোধনেও ছিলেন, এঁরা অনেকে। ফলে এখন ধর্মীয় হিংসাগুলি রাষ্ট্রের ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৯৮ সালে ২৭শে এপ্রিল প্রকাশিত "আউটলুক" পত্রিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালে আরএসএসের ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ প্রসারের শাখা সংগঠনের সংখ্যা ছিল ১১০০, তা ১৯৯৮ সালে প্রায় ৪০০০০ ছুঁয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপির মোদি সরকার ক্ষমতায় আসবার পরে যা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেতে বাধ্য।

বাংলাও এরই মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুন্ধতী মুখার্জী 'বিবিসি বাংলা'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, "শুধু যে রামনবমী পালনের হিড়িক বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে - তা নয়। এখানে হনুমান মন্দির আর পুজোর চল যেমন বেড়েছে, তেমনই মূলত মহারাষ্ট্রে যে গণেশ চতুর্থী পালন করা হত, সেটাও পশ্চিমবঙ্গের পাড়ায় পাড়ায় করা হচ্ছে। অযোধ্যার রামমন্দির আন্দোলন বা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়েও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী পালনের এরকম ধুম পড়েনি। এই যে রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী এসব বেড়েছে গত কয়েক বছরে, তার পেছনে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব রাজনীতির একটা অবদান তো আছেই। কিন্তু একই সঙ্গে বলব গত দশ বছরে এধরণের আরও অনেক পুজো বেড়ে গেছে। আসলে ধর্মটাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় স্তরে ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটা উপায় হয়ে গেছে এগুলো। ধর্মকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষকে জড়ো করছে ওইসব ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিরা। তারা নিশ্চিতভাবেই রাজনীতির মানুষ।"

বাংলার এ পর্বে নয়া যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে রামনবমী কমিটি, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব সমিতি, শাখা সংগঠনগুলি তৈরি হওয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের উর্বর জমির প্রস্তুতে। ২০১৮ সালে, এ ধরনের কমিটি ও শাখা সংগঠনগুলির দ্বারা রামনবমীকে কেন্দ্র করে আসানসোলের মুসলমান শ্রমজীবী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ঘটে গেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের ভয়াবহ ঘটনা। প্রাণ গেছে ইমামের তরুণ পুত্রের। পরবর্তী সালগুলিতে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে, নানা সংখ্যালঘু,  দলিত, আদিবাসী, শ্রমজীবী অঞ্চল জুড়ে। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে 'নয়া ভারতে'র শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-মন্ত্রীরা। তবে বাংলার বুকে এই ধর্মীয় হিংসার নয়া সূচনা, রামনবমী অথবা রাম-রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও তা এখন বাঙালির শ্রেষ্ঠ 'উৎসব' দুর্গাপুজোর দুয়ারে।

বাংলাবাসীর এ মর্মান্তিক চিত্র দেখবার দুর্ভাগ্যের মাত্র কয়েকদিন পেরিয়েছে। হাওড়ার বাগনানের কমলপুর হাটের 'ব্যবসায়ী সমিতি'র দুর্গাপুজো, প্রতি বছর হাটের মধ্যে হয়। বাজারটাই সেই পুজোর মণ্ডপ। পুজোর পাঁচদিন নানা সংস্কৃতি অনুষ্ঠান থাকে। এ বছর তাঁরা সারা বাজার জুড়ে মনিষীদের ছবি সাঁটেন। সেখানে মুসলমান ধর্মের পয়গম্বর নবীজীর ছবি সেঁটে দেন। ইসলাম ধর্মানুসারে নবীজির ছবি হয় না। ফলে তাঁর আসল কোন ছবি নেই। বাজার কমিটি ইন্টারনেট থেকে ছবি নামান। অষ্টমীর রাত থেকে এ ছবি সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করে। আওয়াজ তোলা হয়, "নবী মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র সেঁটে তাঁকে অপমান করেছে, পুজো কমিটি। এদের শাস্তি দিতে পথে নামতেই হবে।" তৎক্ষণাৎ, মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সেই ছবি নিয়ে আপত্তি আসবার পরে বাজার কমিটি তা সরিয়ে দেন, ক্ষমাও চান। লাভ হয় না কিছুই, ততক্ষণে গোটা অঞ্চল জুড়ে ধর্মীয় হিংসার পরিবেশের ভিত্তি প্রস্তুত। থানায় ডেকে হিন্দু-মুসলমানের মীমাংসার সময় বাইরে বৃহৎ আকারের জটলা পাকে। শ্লোগান ওঠে, বাজার কমিটি সভাপতি গ্রেপ্তারের দাবিতে। হামলা হয় থানায়, হামলার শিকার হন সেখানকার স্থানীয় ইমামও। ভাংচুর চলে পাশের একটি প্যান্ডেলে, ভাসানের মূর্তির উপরে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা জানান, এই আক্রমণকারী লোকেরা বাইরে থেকে এসেছে, হামলা, ভাংচুর করে পালিয়েছে। পরের দিন পুলিশ তাঁদের কিছুজনকে গ্রেপ্তারও করেন। এখন স্থানীয়রা হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছেন, আক্ষেপ, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। অর্থাৎ, নবী মুহাম্মদের ছবি রাখাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় হিংসার সূত্রপাত, পরবর্তীকালে তা গিয়ে পড়ে কয়েকজন বাইরের আক্রমণকারীর জন্যে গোটা সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘাড়ে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন, রাজ্যের বিরোধী দলের (বিজেপি) নেতা-মন্ত্রীরা। সমাজে সংখ্যাগুরু ধর্মীয়হিংসাকে গেঁড়ে দিতে তাঁরা খোলাখুলি বলেন কিংবা প্রচার করেন, 'পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা আক্রান্ত', অথবা 'পশ্চিমবঙ্গ মুসলীম রাষ্ট্র হওয়ার পথে'। তাঁদের পেটোয়া কিছু সংবাদমাধ্যমও রং চড়িয়ে পরিবেশন করেন, তুলনা টানেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু 'হিন্দু নির্যাতনে'র ঘটনাগুলির সাথে। ফলে উত্তেজনা বাড়ে, সে অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেকার ধর্মীয় বিশ্বাসে চিড় ধরে। পরবর্তীকালে এই ধর্মীয় অবিশ্বাসে আগুনে খানিক ঘি'য়ের ছিটে পড়লেই যে কোন প্রকারের ভয়াবহ ধর্মীয় হিংসার ঘটনা ঘটতে পারে।

অবশ্য এ নিয়ে কোন প্রকারের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি রাজ্য সরকারকে। অথবা রাজ্যে শাসকের রাজনৈতিক দলের কোন নেতাকে। উল্টে তাঁরাও এই একই পথে, ধর্মীয় হিংসার পেছনে শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক অঙ্ক সাজিয়েছেন, যার শুরু পুজোর ক্লাব-কমিটিগুলিকে অনুদান দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অনুদানপ্রাপ্ত পুজো ক্লাব-কমিটিগুলি শাসকদলের রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মঞ্চ। প্রশ্রয়প্রাপ্ত নেতারা, পুজো মণ্ডপগুলিকেও রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন; মণ্ডপ লাগোয়া ব্যানার, হোর্ডি-এ, পোষ্টারের বয়ানে, তা স্পষ্ট। আবার এঁরা রাম-নবমীতে অনেক জায়গায় অস্ত্র প্রদর্শনে মিছিল বের করতে সহায়তা করছেন, কোথাও নিজেরাই দলগতভাবে মিছিল বের করেছেন, এবছর থেকে রাম-নবমীতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটিও ঘোষণা করেছেন। আবার তিনি সুবিধা মতন ক্ষমতা ধরে রাখতে কখনো কখনো মুসলমানদের ধর্মীয় ভাবাবেগেও রাজনৈতিক ভাগ বসিয়ে, শাসকশ্রেণীর ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী রাজনীতির স্বার্থবহনে ধর্মীয় মেরুকরণের জমি পোক্ত করেছেন।

তাই এমন হিংসাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখে আশঙ্কা রয়ে যায়; হাওড়ার ঘটে যাওয়া ধর্মীয় হিংসার ঘটনার পিছে গভীর রাজনৈতিক অংকের। সে হিসেবনিকেষ সঠিক মাত্রায় বুঝে, বাংলার ভবিষ্যতের সমাজ নিয়ে সচেতনতা অবলম্বন করা সময়ের প্রয়োজন। আসলে ভারতের শাসকশ্রেণীর ইতিহাস থেকে বর্তমান, ধর্মীয় রাজনীতি-- ধর্মীয় হিংসা-- ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব রাজনীতি-- ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক হিংসা, এ চক্রে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে।

1 Comments

Babul Banerjee

29 October, 2024

নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় মনোজ্ঞ প্রতিবেদন। তবে দু একটা ব্যাপারে আমার ইমেলে দেবজিৎ বাবুর দু একটি মতামত জানতে পারলে সুবিধা হতো। ১. বৌদ্ধদের রমরমায় সন্ত্রস্ত বৈদিক ক্ষত্রিয় শটি ব্রাহ্মণ বর্ণের সহায়তায় গুপ্রযুগেই (আনুমানিক ৩৬৫ AD) এই মনুবাদী অনুশাসনের উত্থান ঘটান - যেটা আজকের হিন্দুত্ববাদীরা প্রবল প্রচারে নেমে পড়েছেন। তখনও হিন্দু কথাটার প্রচলন না হলে ওই ধর্মকে কি নামে ডাকা হতো ? ২. আজকে রাষ্ট্র ও ধর্মের মিলিত ষড়যন্ত্রে সংবিধানকে কেন দায়ী করা হচ্ছে। আমি ভারতের সংবিধান খুঁটিয়ে পড়েছি - এহেন অনুমতি কোথাও সরাসরি দেওয়া হয় নি। যদি আজ সাংবিধানিক কাঠামোয় তার অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে তবে তার মূলে আছে সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক দুর্বলতা - আমাদের সংবিধানকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ধন্যবাদ।

Post Comment