পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গুগল – ফেসবুক এবং জিও এঁরাই কি তবে আসল নিয়ন্ত্রক?

  • 16 July, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2420 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
একজন মানুষ যখন গুগলে কিছু জিনিস খোঁজেন, সেটা হয়ে যায় সেই মানুষটির ব্যবহারের মাপকাঠি। এরপর সেই ব্যবহার দিয়ে মানুষটিকে চেনা হয়, ঠিক একই রকম ভাবে অ্যামাজন বা ফেসবুকে একজন মানুষ যা যা করেন ঠিক সেইরকম ভাবেই তাঁর পছন্দ অপছন্দগুলো জানা হয়ে যায় ওই কোম্পানি বা কর্পোরেটদের, সেইমতো পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ করা হয় মানুষদের।

দিনটা ছিল জানুয়ারী মাসের ৩০ তারিখ, সাল – ১৯৩৩। জার্মানির ক্ষমতায় এসেছেন অ্যাডলফ হিটলার। তাঁর ক্ষমতায় আসার পিছনে অন্যতম যে বিষয়টি কাজ করেছিল তা হল তাঁর ইহুদীদের প্রতি বিদ্বেষ। কিন্তু এই পুরো বিদ্বেষের পিছনে আরও একটি ব্যাপার ছিল, তা হল একটি আমেরিকান কোম্পানির নিজস্ব লাভের অঙ্কও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। কোম্পানিটির নাম –ইন্টারন্যাশানাল বিজনেস মেশিন বা আইবিএম এবং কোম্পানির মালিকের নাম ছিল থমাস জে ওয়াটসন। যদি কেউ ভেবে থাকেন যে হিটলার একাই তাঁর ইহুদী নিধন কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন তাহলে তিনি ভুল ভাবছেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডাক্তার, উকিল, পুলিশ, বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদেরা এবং অবশ্যই ওই আমেরিকান কোম্পানি।

তারপর আমরা বহু বছর পেরিয়ে এসেছি। সেই ভয়ঙ্কর ইতিহাসের কথা স্মরণ করতেও আমাদের ভয় লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে যা চলছে তা কি কোনও অংশে হিটলারের জার্মানির থেকে আলাদা? যখন হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন, নাজি বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল ৬০ লক্ষ ইহুদীদের চিহ্নিত করা। নাজি বাহিনীর কাছে শুধুমাত্র ইহুদী ধর্মাবলম্বী চিহ্নিত করাটাই একমাত্র কাজ ছিল না, যারা বৈবাহিক সুত্রে ইহুদী, বা ধর্ম বদল করে যারা খ্রিষ্টান হয়েছেন তাঁদের চিহ্নিত করাটাও একটা অন্যতম কাজ ছিল। কিন্তু সেই সময়ে তো কম্পিউটার বা অন্য কোনও স্মার্ট ফোন ছিল না, তাই সেই সময়ে আইবিএম এই কাজটা করেছিল হিটলারের হয়ে, একটি বড় যন্ত্রের সাহায্যে, যার নাম হলেরিথ মেশিন।

গত কয়েক বছরে কী হয়েছে আমাদের দেশে ?

ধীরে ধীরে একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গুজরাট, মুজফফরনগর, ভাগলপুর, কাসগঞ্জ,বসিরহাট কালিয়াচক,এরকম ছোট ছোট দাঙ্গার খবর আমরা ইতিমধ্যেই শুনে নিয়েছি, যদিও এর মধ্যে গুজরাট ছিল সবচেয়ে বড় , যাতে বহু মুসলমান মানুষকে চিহ্নিত করে মারা হয়। আফরাজুল,জুনেইদ, পেহেলু খান বা উমর খানদের মতো ঘটনা, মানে চিহ্নিত করে মারার ঘটনাও আমাদের দেশ দেখে ফেলেছে।এর সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে আধারের মাধ্যমে মানুষকে চিহ্নিতকরণের কাজ, আপনি কোথায় থাকেন, অঞ্চলটা মিশ্র কিনা? বয়স কত? ফেসবুক বা টুইটার-এ কী পোস্ট করেন, সেটা কি সরকারবিরোধী?
খেয়াল করে দেখুন অর্থনীতি মোটামুটি তলানিতে, চাকরি নেই, লোকের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটির জন্য। মানুষ ধুঁকছেন। এর মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে নেমে এসেছে করোনার থাবা। মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত আতঙ্কিত। তাই এখন বিশ্বের বেশ কিছু বড় কোম্পানি একযোগে বলা শুরু করেছে যে করোনা মোকাবিলায় তাঁরা যোগ দিতে চায়। আসলে তাঁদের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। তাঁরা মানুষকে রোবট হিসেবে দেখতে চায়। তাদের ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে স্রেফ কিছু তথ্যের মাধ্যমে। ধরুন আপনি ফেসবুক করেন। তার মধ্যে দিয়ে আপনি কী পছন্দ করেন সেটা বহু মানুষ যেমন বুঝতে পারে, তেমন ফেসবুকের মালিক জুকেরবার্গ বা গুগলের সুন্দর পিচাইও বুঝতে পারেন, আপনি অনলাইনে কী কিনছেন কিংবা অ্যামাজন থেকে বা গুগলে কী খুঁজছেন, সেটা যদি বোঝা যায় তাহলে আপনাকে বা আমাকে সেদিকে চালনা করা আরও সহজ হয়ে যায়। এর প্রমাণও আছে। আপনি কোনোদিন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে কিছু একটা পণ্য কয়েকবার দেখলেন, পরদিন থেকে সেগুলোর আরও বেশি করে বিজ্ঞাপন আসতে থাকে। আজকে আমরা যেটা গুগলে খুঁজি কাল তাই দিয়েই গুগল আপনাকে খুঁজে নেয়। এটাকেই বলে সারভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম, যার কথা হার্ভাডের অধ্যাপক তাঁর ‘ দি এজ অফ সারভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম’ গ্রন্থে লিখেছেন আমরা প্রযুক্তিকে বিজ্ঞান বলে ভুল করি, আর প্রযুক্তি আমাদের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে আমাদেরই ওপর নজরদারি চালানোর কথা ভাবছে।

আজকের সময়ে আমেরিকাতে কী হচ্ছে ?


ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জুকেরবার্গ বিদেশী একটি সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয়তে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন। উনি বলেছেন যে যেহেতু এই মুহূর্তে সরকারগুলো ভাবছে কী করে এই করোনাকে মোকাবিলা করবে, তাই ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারে, কোথায় ভেন্টিলেটর লাগবে, কোথায় পিপিই লাগবে, কাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, বা কোন অঞ্চলকে করোনামুক্ত বলা যাবে, এই সমস্ত বিষয়ে নাকি ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম সাহায্যে আসতে পারে। সমস্ত অঞ্চলের সমস্ত তথ্য যেহেতু সরকারের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তাই এই কোটি কোটি মানুষের তথ্য যা ফেসবুকের কাছে সবসময়ে থাকে তা দিয়ে এই করোনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় বলে জুকেরবার্গ তাঁর অভিমত জানিয়েছেন। কিছুদিন আগে থেকেই ফেসবুক আমেরিকা জুড়ে একটা সমীক্ষা চালায় কারনেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষকদের সহযোগিতায়, তাতে করোনা সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হয় , কে কিরকম অনুভব করছেন শারীরিকভাবে, কারুর জ্বর আছে নাকি,কারুর স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি কেমন বা কাশি আছে কি না, ইত্যাদি প্রশ্ন রাখা হয়। যদিও জুকেরবার্গ লিখেছেন যে কোনও তথ্যই তাঁদের কাছে রাখা হয়নি, কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি আরও কিছু কথা লিখেছেন। তিনি বলেছেন যে এইরকম কোনও সমীক্ষা বা স্যাম্পেল সার্ভের মাধ্যমে এটা বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে আগে থেকেই যে নিউ- ইয়র্ক শহরের প্রায় ২-৩ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন এবং তার জন্যে সরকারের প্রস্তুত থাকা উচিত।

কতজন এটা খেয়াল করেছেন যে এই ফেসবুক রিলায়েন্স জিওর ১০ শতাংশ শেয়ার কিনেছে? আর কেনই বা কিনেছে? এর পাশাপাশি আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ৭৫০০০ কোটি টাকা ভারতের ডিজিটাইসেশনের জন্য গুগল বিনিয়োগ করবে ঘোষণা করে। জানা যায়, তার অর্ধেক জিও কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধিতে ব্যয় করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে গুগলের ঘোষণা ছিল, কোটি কোটি ভারতবাসী যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, যাঁদের কাছে এখনও ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছয়নি, তাঁদের কাছে গুগল পৌঁছবে, কিন্তু কিভাবে হওয়া উচিত ছিল এটা? সরকারী যে বিএসএনএল আছে, তার মাধ্যম দিয়েই কি এই পরিষেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো যেত না? কিন্তু তা না করে একটি বেসরকারী সংস্থাকে এই সুবিধা কেন পাইয়ে দেওয়া হল? এই করোনা সংক্রমণের সময়ে যখন বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, বহু পরিযায়ী শ্রমিক সব হারিয়ে ঘরে ফিরছেন তখন এই বেসরকারী সংস্থার কর্ণধার মুকেশ আম্বানি দেশের সবচেয়ে এবং বিশ্বের অন্যতম ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই রিলায়েন্স গ্রুপের অন্যতম মুখ নীতা আম্বানি বলেছেন যে তাঁরাও করোনার বিরুদ্ধে লড়তে চান, এবং প্রতিষেধক আবিস্কার হলে তাঁরা প্রত্যেকটি মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেবেন। এখন প্রশ্ন হল যে এই প্রতিষেধক কি তাঁরা বিনা পয়সায় পৌছবেন ? না সেটা পরিষ্কার নয়, কিন্তু এটা কি কখনো সম্ভব যে তাঁরা বিনা লাভে দেশের সেবা করবেন? তাঁদের কি আর কোনও উদ্দেশ্য আছে? অবশ্যই আছে। ওই ফেসবুক,গুগল, অ্যামাজন বা অ্যাপেল এর মতো কোম্পানিগুলো চায় আমি আপনি ওদের হাতের পুতুল হয়ে উঠি। সেই জন্যই মোদী সরকার চাইছে সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণ করতে। করোনার চিকিৎসাতে যে ওষুধ লাগে, কিংবা যে পরীক্ষা করতে হয় তাতেও শোনা যাচ্ছে আধার লাগবে। এই আধারের সমস্ত তথ্য যাতে এই বড় কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যায়, যার মাধ্যমে আমাকে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ হয়ে যাবে। মোদী সরকারের প্রয়োজন একটা পুলিশি রাষ্ট্র, যা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করবে, যার মাধ্যমে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে সেই মানুষরূপী বিপুল সংখ্যক রোবটদের। এবং ধীরে ধীরে আমরা ক্রীতদাসে পরিণত হবো, এবং আমাদের নিজেদেরও কোনও সরকার থাকবে না, থাকবে একটা বাছাই করা শক্তি যার মাধ্যমে এই কাজটা করা হবে। যদি আধারযুক্ত ভোট দেওয়ার যন্ত্র চালু করা যায় তাহলে তাহলে সহজেই বোঝা যাবে আপনি কাকে দিতে পারেন বা কাকে ভোট দিলেন। আবার আপনাকে ভোট ব্যবস্থা থেকে বাতিল করে দেওয়াও তাদের পক্ষে সহজ হবে। আপনি তো এখন শুধু একটা সংখ্যা মাত্র। আপনাকে মুছে ফেলা তো একটা ছোট্ট কাজ।

এই মুহূর্তে দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করে থাকেন , আরও বেশি মানুষকে এই ডিজিটাল পরিষেবার আওতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই এই বড় কোম্পানিগুলো ভারতের মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বহুদিন আগে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত মানুষের সহায় আর মানবজাতি যাতে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে ধর্ম হল সেই আফিম। আজকেও কি তাই বলা যায়? আজকেও কি সেই ধর্মের ধব্জাধারীরাই নিয়ন্ত্রক? মন্দির, মসজিদ, গির্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনের প্রধান অর্থাৎ পুরোহিত, ইমাম বা পাদ্রীরাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন? নাকি আজকের সময়ে এই নিয়ন্ত্রকের ভুমিকা নিয়েছেন অন্য কেউ বা অন্য কিছু? সেটা কি স্মার্টফোন? সেই নিয়ন্ত্রণকে আরও নিরঙ্কুশ করতেই কি জিও, ফেসবুক এবং গুগলের এই এতো বিনিয়োগ ? হিটলারকে সহায়তা করেছিলেন আইবিএম এবং তাঁর কর্ণধার হোয়াটসন, মোদীকে কি সহায়তা করবে মুকেশ আম্বানি?

0 Comments

Post Comment