পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হিন্দী আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 204 view(s)
  • লিখেছেন : অনিন্দিতা দে
"Why do you need to speak in Bengali?" এই প্রশ্নটির মুখোমুখি আমিও হয়েছিলাম কয়েকমাস আগে। এক নেপালী ছাত্রের বক্তব্য ছিল—এটা ভারত। রাষ্ট্রভাষা হিন্দী। তোমরা বাংলাদেশিদের মতো বাংলা বলো কেন? হিন্দী আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়, তা অধিকাংশ মানুষই জানে না। একটা মিথ্যেকে সত্যি মেনে, ভুল ধারণাকে পাশবালিশ করে জড়িয়ে আমরা বেঁচে আছি নির্বিকারভাবে।

সালটা ২০২৩। সকাল নটা।  রাজকুমার রাওয়ের আসার কথা আমাদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। আমরা ব্যাজার মুখে আলোচনা করছি—সেলিব্রিটিদের তো কোন সময়জ্ঞান থাকে না। সেই দু -তিন ঘন্টা দেরী করে আসবে, অপেক্ষা করে গোটা সকালটা নষ্ট হবে, ইত্যাদি। এমন সময় ক্যাম্পাসে তিনটে গাড়ি ঢুকল। হইহই রব উঠল—এসে গেছে, এসে গেছে। আমি আড়চোখে ঘড়ি দেখলাম। এক মিনিটও লেট নয়। এমনও হয়!

সেদিন তার বিয়ে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাজকুমার রাও বলেছিলেন—স্ত্রী বাঙালি হওয়ার সুবাদে বাংলাটা তিনি ভালোই বোঝেন। ঝরঝরে বাংলায় কথা বলতে পারেন না যদিও। তবে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি - চলচ্চিত্রের প্রতি তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। কথাপ্রসঙ্গে উঠে এসেছিল সত্যজিৎ রায়ের নামও। অন্য সেলিব্রিটিদের মতো রসগোল্লা, 'আমি তুমাকে বালোবাসি' আর নলেন গুড়ের স্টিরিওটাইপের পুনরাবৃত্তি করেন নি রাজকুমার। 

আসলে 'ক্লাস' ব্যাপারটা মানুষের ব্যবহারে প্রতিফলিত হয়। জাতীয় মঞ্চে নিজের ভাষায় প্রশ্ন শুনে যখন প্রসেনজিৎ বিব্রত বোধ করলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এলেন রাজকুমার। সাংবাদিককে "Why do you need to talk in Bengali" প্রশ্নটি করে প্রসেনজিৎ যখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, সেই হাসিতে কেউ যোগ দিল না। অপ্রস্তুত সাংবাদিককে "That's ok. We will translate" বলে আশ্বস্ত করলেন রাজকুমার। সাংবাদিকের করা প্রশ্নগুলো তিনি হিন্দীতে অনুবাদ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিতেই সভাঘর মুখরিত হল করতালিতে। প্রসেনজিৎ ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে উত্তর দিতে গিয়ে যখন বুঝলেন ঠিক জুত করতে পারছেন না, কথা বলা শুরু করলেন ভুলভাল ইংরেজিতে। নিজের অভিনীত চরিত্র সম্পর্কে তেমন কিছুই বললেন না। শুধু 'cult character', 'cult cinema' গোছের শব্দগুলো বেশ কয়েকবার শোনা গেল তার মুখ থেকে। '২২ শে শ্রাবণ' তাও মেনে নেওয়া যায়, কিন্ত ' দশম অবতার ' cult cinema? মানছি তার কারণে একসময় বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যে কারণে প্রসেনজিৎ নিজেকে ইন্ডাস্ট্রি বলে দাবি করে থাকেন প্রায়শই। কিন্তু একজন সুপারস্টারের কী নিজের ভাষার প্রতি এমন মনোভাব হওয়া উচিত? এদিকে তার অভিনীত  "২২শে শ্রাবণ" ছবিরই বিখ্যাত সংলাপ—"বাংলা ভাষা আর মটন কষা নিয়ে চ্যাংড়ামো নয়।"

"Why do you need to speak in Bengali?" এই প্রশ্নটির মুখোমুখি আমিও হয়েছিলাম কয়েকমাস আগে। এক নেপালী ছাত্রের বক্তব্য ছিল—এটা ভারত। রাষ্ট্রভাষা হিন্দী। তোমরা বাংলাদেশিদের মতো বাংলা বলো কেন? হিন্দী আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়, তা অধিকাংশ মানুষই জানে না। একটা মিথ্যেকে সত্যি মেনে, ভুল ধারণাকে পাশবালিশ করে জড়িয়ে আমরা বেঁচে আছি নির্বিকারভাবে। 

ইদানিং ক্যাবে বাংলা গান চালালে দেখেছি অনেক অবাঙালি ড্রাইভার অসন্তুষ্ট হয়ে তারস্বরে চালিয়ে দেয় হিন্দী বা ভোজপুরি গান। রবীন্দ্রসংগীত চাপা পড়ে যায় ' ললিপপ লাগেলু ' র চিৎকারে। বাংলায় কথা বলার অপরাধে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ি শ্রমিকদের বাংলাদেশি মনে করে চুড়ান্ত হেনস্থা করা হয়। তবুও আমাদের কোন হেলদোল নেই। 

প্রসেনজিৎকে একা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে লাভ নেই। তিনি অন্তত চিঠি লিখে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। আসল কথাটা হচ্ছে, আমরা সবাই সমদোষে দুষ্ট। এত হীরে মানিক ছড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে। তবু আমরা বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়ি না। রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভুল করে দু লাইন বাংলা বলে ফেললে লজ্জায় মুখ লুকাই। ইস্কুলজীবনে আমার বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রীতির কথা শুনলে বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষক বিদ্রূপের হাসি হেসে সিংহ সেজে চিড়িয়াখানায় খেলা দেখানোর গল্প করতেন। আমি বাড়ি এসে লুকিয়ে কাঁদতাম।

আমি মফস্বলের বাংলা মিডিয়াম ইস্কুলে পড়াশুনা করেছি— এটা বলতে আমি একটুও কুন্ঠাবোধ করি না। এখন যদিও অধিকাংশ বাবা-মাই বাচ্চাকে পাঠান ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে। বাংলা সেখানে তৃতীয় ভাষা। বাচ্চারা বাংলায় কথা বললে আক্ষরিক অর্থেই জরিমানা দিতে হয় সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাড়িতেও তারা কথা বলে অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষায়। 

"— মাম্মা, হোমওয়ার্ক ফিনিশ করে ওয়াটার ড্রিঙ্ক করেছি। আয়াআন্টির সাথে প্লেগ্রাউন্ডে যাই এবার?

— বহুত আচ্ছা বেটা। আমব্রেলা নিয়ে যাও। রেন হতে পারে।"

এই প্রজন্মের বাচ্চারা এক পাতা বাংলা পড়তে গেলে সাড়ে সাতবার হোঁচট খায়। ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিতে হয় বাংলা শব্দের অর্থ। কিন্ত তারা দু লাইন ইংরেজি বলতে পারলেই মধ্যবিত্ত বাবা - মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। বাংলা না জানা প্রসঙ্গে বলে — কী হবে শিখে? চাকরির ইন্টারভিউতে তো সেই ইংলিশেই কথা বলতে হবে। 

নিজের ভাষার প্রতি এই অবজ্ঞা যে আমাদের অশিক্ষার দীনতাকেই প্রকাশ করে, সেটুকু বোঝার ক্ষমতা তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের কেন নেই কে জানে! চীন - জাপান - ফ্রান্স অবধিও যাওয়ার দরকার নেই, দক্ষিণ ভারতে গিয়ে দেখুন, খুব দরকার ছাড়া ওরা মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে চায় না। অথচ ওদের পড়াশোনা, পাণ্ডিত্যের গভীরতা দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। 

এ কোন অবক্ষয়ের পথে চলেছি আমরা বাঙালিরা? শিকড়বিহীন গাছের আয়ু কতটুকুই বা হয়? এভাবে চলতে থাকলে কবিগুরুর ভাষার ভবিষ্যৎ কী? 

অনেক হয়েছে। নিজের জাতিসত্ত্বার প্রতি বাঙালির একটু আবেগপ্রবণ হওয়া দরকার এবার। নইলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে বাংলা হয়ে যাবে বিলুপ্তপ্রায় ভাষা। 

 

0 Comments

Post Comment