পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ: উত্তর না মেলা পাটিগণিত

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 200 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
লালকেল্লা, তাজমহল, নিজামউদ্দিন আউলিয়া আজও সংঘের তথাকথিত সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। তাই আজ সুলতানি ও মুঘল যুগকে মুছে ফেলার এত তৎপরতা। কৌশলটা হল ব্রিটিশ বিরোধী গৌরবময় স্বাধীনতার লড়াইটাকে মুছে ফেলে, মানুষকে সংশয়াকুল করে তোলা এবং এক প্রাচীন, কষ্টকল্পিত সনাতন ভারতের ছবি প্রতিষ্ঠা করা। কাজটা কঠিন কিন্তু সংঘ প্রকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য জরুরি বটে।

সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ভারতের মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন যা দেশজুড়ে বহুমানুষের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।অনেকে সংঘপ্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ' উষ্ণ ' সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, নিজের গদি বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর এটা বাধ্যতা।এই ভাবনার মধ্যে খানিক সত্যতা থাকলেও মূল বিষয়টা হল স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের উদযাপনের সময় থেকে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন শাসক দল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আরএসএসের আত্মিক সম্পর্ক নিয়ে রীতিমত প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। সংঘের বিভিন্ন শাখা সংগঠন একটি পরিকল্পিত রোডম্যাপকে অনুসরণ করে এই প্রচার সংঘটিত করছেন। এখন প্রশ্ন হল মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু বৈদিক যুগে অনুষ্ঠিত হয় নি,আধুনিক যুগে ইতিহাস চর্চা মূলত বস্তুগত প্রমাণ নির্ভর তাই এক্ষেত্রে আরএসএসের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রমাণ বিরোধীরা অবশ্যই চাইবে।একথা সবার জানা যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ তো করেই নি বরং তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বিভিন্ন সময়ে ইংরেজদের পক্ষাবলম্বন করেছিল।এমনকি দেশ যখন স্বাধীন হল তখন তারা লিখিত ভাবে ভারতের সংবিধান ও জাতীয় পতাকার প্রতি তাদের অনাস্থা ব্যক্ত করেছিল।এটাও বহু আলোচিত যে স্বাধীনতার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে আরএসএসের সদর দপ্তরে কখনো জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় নি। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে আরএসএস যেভাবে নিজেকে একজন আম ভারতীয়ের স্বপ্নের উত্তরাধিকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়,সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নেওয়া এক বাধ্যতা।এই বাধ্যতার কারণ হল আজও আমাদের দেশে কর্তৃত্বের প্রশ্নটির নৈতিকতার বিচারে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়।বর্তমান নিবন্ধে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আরএসএসের ভূমিকার মূল্যায়ণ করতে চাই।এক্ষেত্রে প্রথমে বলে নেওয়া দরকার যে এই নিবন্ধে মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে কয়েকটি মাপকাঠি ঠিক করা হয়েছে।প্রথমত কোন প্রেক্ষাপটে ও কেন আরএসের জন্ম হল।বিশেষ করে মনে রাখতে হবে যে তখন আরেকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু মহাসভা রীতিমতো সক্রিয়। দ্বিতীয়ত আরএসএস সেই উত্তাল সময়ে স্বাধীনতার লড়াইকে কিভাবে দেখত এবং তার নিজের সংগঠন ও ক্যাডারদের সে কিভাবে পরিচালিত করত।তৃতীয়ত কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেশজোড়া গণ আন্দোলনের মূর্ত রূপ আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আরএসএসের ভূমিকা কি ছিল! চতুর্থত স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষপর্বে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে রাজনীতি চালিত হতে শুরু করল এবং দেশভাগের দাবি উঠল তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের রাজনৈতিক অবস্থান কি ছিল! পঞ্চমত আজকের দিনে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস তথা গান্ধী - নেহেরুর ভূমিকাকে কমিয়ে দেখাতে যে নামগুলোকে সংঘপরিবার সামনে আনছে সেই সুভাষ চন্দ্র  বসু,বল্লভভাই প্যাটেল,সর্দার ভগৎ সিং দের সঙ্গে আরএসের সম্পর্ক কেমন ছিল! ষষ্ঠত সংঘ পরিবার যে গুটিকয়েক নামকে তাদের স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসাবে প্রচার করে অর্থাৎ বি আর সাভারকর,শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং কিছুটা হলেও অটল বিহারী বাজপেয়ী -- এই তথাকথিত আইকনেরা স্বাধীনতা যুদ্ধে কি ভূমিকা নিয়েছিলেন! সপ্তমত আজ কিভাবে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য সংঘ ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে এক নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাইছে।

১৯২৫ সালের বিজয়া দশমীতে, যেদিন ' রাম অসুরদের রাজা রাবণকে হত্যা করেছিলেন ', সেদিন কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, বি এস মুঞ্জে,এল ভি পরাঞ্জপে, বাবারাও সাভারকার ও বি বি থলকার একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গঠন করেন।এই বৈঠকের আগে হেডগেওয়ার রত্নগিরিতে সাভারকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।সাভারকারের জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর বলেছেন মহান হিন্দু নেতা ও অনমনীয় ঋজু জাতীয়তাবাদী ডঃ হেডগেওয়ার হিন্দু জাতির সর্বাঙ্গীন উন্নতির লক্ষ্যে হিন্দু যুবকদের উদ্যমকে রক্ষা ও পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন।তিনি সাভারকারের ' হিন্দুত্ব ' পুস্তিকাটি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন।সুতরাং আরএসএস প্রতিষ্ঠার পিছনে সাভারকরের অবদান ছিল স্পষ্ট। সংঘ প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যাকে মেনে নেওয়া হয় সেই হেডগেওয়ার ১৯২০ সালে নাগপুরে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন এবং ১৯২২ সালে মহারাষ্ট্রের প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে অসন্তুষ্ট হলেও ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন।হেডগেওয়ারের জীবনীকার সি পি ভিশিকর কীভাবে হেডগেওয়ার আরএসএস স্থাপনায় উদ্বুদ্ধ হলেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন : " মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশে ( জাতীয়তাবাদের)  উদ্দীপনা ঠান্ডা মেরে গেল এবং এই আন্দোলনের ফলে সমাজ- জীবনে যে অশুভ দিকগুলি জন্ম নিয়েছিল তা ভয়ানকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াল।জাতীয় সংগ্রামের ঢেউ স্তিমিত হয়ে পড়লে পারস্পরিক মন্দ ইচ্ছাগুলি এবং ইর্ষা সামনে চলে এল। চতুর্দিকে ব্যক্তিগত ঝগড়াঝাঁটি বেধে গেল।বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে গেল।ব্রাহ্মণ - অব্রাহ্মণ সংঘাত নগ্ন হয়ে উঠল।কোনও সংগঠনই পূর্ণাঙ্গ ও ঐক্যবদ্ধ থাকল না।অসহযোগের দুগ্ধে সঞ্জীবিত হয়ে যবন সর্প বিষাক্ত শব্দে হিস হিস শব্দে দেশে দাঙ্গায় প্ররোচনা দিতে লাগল "। এভাবে আমরা বলতে পারি যে মুসলমানদের ' বিষাক্ত সাপ ' হিসাবে চিহ্নিত করে,তাদের বিরুদ্ধে অশেষ ঘৃণা ও বিদ্বেষ বর্ষণ করে এবং শূদ্র- অতিশূদ্র জনগণের মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়ে হেডগেওয়ার ও আরও চারজন হিন্দু মহাসভার নেতা আরএসএস গঠন করলেন।

সংঘের নামকরণে ' হিন্দু ' নামের পরিবর্তে রাখা হল ' রাষ্ট্রীয় ' শব্দ, কেননা হেডগেওয়ারের মতে হিন্দু ও রাষ্ট্রীয় শব্দ সমার্থক।সংঘের পতাকা হিসাবে বেছে নেওয়া হল ' ভগবান রামের ঝান্ডা' অর্থাৎ  ' ভাগোয়া ধ্বজ ' যা শিবাজি ব্যবহার করেছিলেন। এটা আরেকবার বলে নেওয়া প্রয়োজন যে আরএসএস হিন্দু জাতির কথা বলে এসেছে তাই তাদের কাছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ অর্থহীন,তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে। ' হিন্দু নেশন ' এর গঠনকারী উপাদান সম্বন্ধেও গোলওয়ারকর তার দৃষ্টিভঙ্গী ব্যক্ত করেছেন।যেমন তাঁর মতে একটি ' নেশন ' গঠনের পাঁচটি উপাদান আছে; ' দেশ,জাতি,ধর্ম,সংস্কৃতি ও ভাষা ': " এই দেশে, হিন্দুস্থানে, হিন্দু জাতি (রেস) তার হিন্দু ধর্ম,হিন্দু সংস্কৃতি  এবং হিন্দু ভাষা ( সংস্কৃতের স্বাভাবিক পরিবার ও তদ্ভূত ভাষাগুলি) নেশনের ধারণাকে সম্পূর্ণ করেছে "। সাভারকর বলেছিলেন হিন্দু জাতি চার হাজার বছর ধরে এদেশে বাস করছে।এই সময়কালটা বোঝা জরুরি কারণ সংঘের পরাধীনতার ধারণার ন্যারেটিভ এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে।তাই হিন্দু জাতীয়তার আলোকেই সংঘ ব্রিটিশদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করেছে।

একজন মাধ্যমিক স্তরের স্কুল পড়ুয়াকে যদি ভারতের স্বাধীনতার লড়াই নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখতে বলা হয় তবে সে নিশ্চিতভাবে শুরু করবে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দিয়ে,তারপর আসবে দাদাভাই নৌরজি সহ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষদের লিখিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের কথা,জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন,বাংলা- বিহার- মহারাষ্ট্রের লড়াইয়ের ঝটিকা কেন্দ্র হয়ে ওঠা,সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন,জালিওয়ানলাবাগ হত্যাকান্ড,বরদৌলি সত্যাগ্রহ, মহাত্মা গান্ধীর অভিভাবকত্বে গড়ে ওঠা অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ভগৎ সিং, মাস্টারদা সূর্য সেন,নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ, নৌবিদ্রোহের কথা।কিন্তু আমরা যদি এই ঘটনাগুলোর দিকে চোখ ফেরাই তাহলে দেখব স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে ' ঘর ঘর তিরঙ্গার ' শ্লোগান দিচ্ছেন সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার শাখা সংগঠনগুলোর নাম ও নিশান কোথাও নেই।এটা কোন রহস্য নয়,মোদ্দা কথাটা হল এই সংঘীরা কোন ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করত না,এদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মুসলিম প্রভুত্বের আতঙ্ক ছড়িয়ে হিন্দু সমাজকে গেরুয়া ঝান্ডার তলায় সমাবেশিত করা।

ঔপনিবেশিক পর্বে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ ইংরেজদের গোলামি থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতৃত্বরা কি ভূমিকা নিয়েছিল তার কিছু কিছু উদাহরণ এখানে উপস্থিত করা হল,মনে রাখতে হবে এই তালিকা কালানুক্রমিক নয়। * আরএসএস প্রতিষ্ঠার দু বছর পরে দেশজুড়ে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।সংঘ তাতে অংশ নেয় নি।এর কিছুদিন পরে ডিসেম্বর (১৯২৯) কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং পূর্ণ স্বরাজকে লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করেন।ঠিক হয় ২৬ জানুয়ারি দিনটি ( ১৯৩০) স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালিত হবে।গোটা দেশে এই কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়।নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে ঘোষণা করলেও আরএসএস সেইদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করে তাদের ভাগোয়া ঝান্ডা উত্তোলন করে।এটাই ছিল বরাবর সংঘের কৌশল,একদিকে জাতীয়তাবাদী সেজে থাকা,অন্যদিকে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা।* বিষয়টা আরো গুরুতর আকার ধারণ করে ১৯৩০ সালে গান্ধীজি যখন লবণ সত্যাগ্রহের (আইন অমান্য আন্দোলন) ডাক দেন।আরএসএস কর্তৃক প্রকাশিত হেডগেওয়ারের জীবনী অনুসারে সমস্ত শাখাগুলোকে জানানো হয় যে সংঘ এই সত্যাগ্রহে অংশ নেবে না।কিন্তু সংঘের অনুগামীদের একটা বড় অংশের আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ দেখে বলা হয় সদস্যরা নিজ দায়িত্বে অংশ নিতে পারেন। হেডগেওয়ার ব্যক্তিগত ভাবে আন্দোলনে অংশ নেন এবং জেলে যান।অবশ্য তার এই জেলে যাওয়া নিয়ে তার জীবনীকার বলেছেন,হেডগেওয়ারের উদ্দেশ্য ছিল এই সুযোগে স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষদের মধ্যে সংঘের মতাদর্শ প্রচার ( " the confidence that with a freedom loving,self-sacrificing and reputed group of people inside with him there,he would discuss the sangh with them and win them over for its work")। এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে কংগ্রেস নেতৃত্ব সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক গৃহীত একটি রেজেলিউশন যাতে বলা হয় কংগ্রেস সদস্যরা কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের সদস্য হতে পারবেন না।

*রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের কোন সুযোগ হাতছাড়া করে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ভারতীয়দের সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই সোজাসুজি ভারতকে যুদ্ধের  অংশীদার ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার তখন হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রকৃত চরিত্র উন্মোচিত হয়।প্রতিবাদে বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার থেকে কংগ্রেস পদত্যাগ করে।স্বাভাবিক ভাবে শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার মত সাম্প্রদায়িক শক্তি।হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রাণপুরুষ সাভারকর ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে ভাইসরয় লিনলিথগোকে লিখিত এক পত্রে বলেন হিন্দু ও ব্রিটিশদের বন্ধু হওয়া উচিত এবং কংগ্রেসের শূন্যস্থান হিন্দু মহাসভা পূরণ করতে তৈরি। এমনকি এইসময় ' Militarise Hinduism ' এর শ্লোগান দিয়ে দলে দলে হিন্দুদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।বলা হয় এর ফলে মুসলমানদের প্রভাব সেনাবাহিনীতে কমবে। *১৯৪০ সালের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক নথিতে দেখা যাচ্ছে যে আরএসএস নেতৃত্ব তৎকালীন হোম সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করেছেন এবং বলেছেন," promised the secretary to encourage members of the Sangh to join the civic guards in greater numbers"।

*এরপর আসে ঐতিহাসিক ' ভারত ছাড়ো ' আন্দোলন। এই আন্দোলনের ঘোষণার আগেই জুন মাসে (১৯৪২) যখন ব্রিটিশ নীতির কারণে বাংলায় ভয়ঙ্কর মন্বন্তর হয়েছে,লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন তখনও গোলওয়ারকর ব্রিটিশদের দোষী করতে রাজী হন নি।এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যে তিনি বলেন " Sangh does not want to blame anybody else for the present degraded state of the society.when the people start blaming others,then there is basically weakness in them"।*ভারত ছাড়ো আন্দোলনে আর কোন পর্দা না রেখে সংঘ গান্ধীজির বিরোধিতায় নেমে পড়ে।সংঘ তার তরুন সদস্যদের বারবার সতর্ক করে এই বলে যে আগামীর বড় লড়াইয়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নথিতেও তার সাক্ষ্য মেলে: "At meeting of the Sangh during the disturbances (1942), speakers urged the members keep aloof from the congress movement and these instructions were generally observed"।*নৌ বিদ্রোহের সময়ও আমরা একই ছবি দেখতে পাই।নৌবাহিনীর যারা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন,তাদের অবিবেচক বলে সমালোচনা করেন হিন্দু মহাসভা ও সংঘ নেতৃত্ব।

সংঘের সময় এসে গেল ১৯৪৪-৪৫ সময় পর্ব থেকে যখন মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের দাবি জোরালো হয়ে উঠল।হিন্দু মহাসভা ও আরএসের নেতারা হিন্দুদের ' রক্ষক ' হিসাবে আবির্ভূত হলেন।স্বাধীনতার প্রাক ও পরমুহূর্তে বক্তৃতা ও সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে এই দুটো সংঘটন কিভাবে বিষ ছড়িয়েছে তার অজস্র প্রমাণ পরবর্তী কালে ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করেছেন।১৯৪৭ সালে আগস্টের মাঝামাঝি সংঘের মুখপত্র অর্গানাইজারের একটা সংখ্যায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকাকে নাকচ করলেন,তার পরবর্তী ৫০ বছর সংঘ কখনো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে নি। ৪৭' সালের আগস্ট মাসের পর থেকে দিল্লি সহ গোটা উত্তর ভারতে একের পর এক সরকার বিরোধী ও গান্ধী বিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে গান্ধী হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হল।১৮ ডিসেম্বর গোলওয়ারকার ৫০,০০০ সংঘ স্বেচ্ছাসেবকের উপস্থিতিতে দিল্লির সরকারকে শয়তান দ্বারা চালিত ও অভারতীয় বললেন।গান্ধী হত্যার তিনদিন আগে হিন্দু মহাসভার মোহান্ত দিগবিজয়নাথ গান্ধীকে পাকিস্তানে পাঠাবার নিদান দিলেন।৩০ জানুয়ারি গান্ধী খুন হলেন।কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবককে সংঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন।২৫,০০০ সদস্যকে জেলে পাঠানো হল। আততায়ী নাথুরাম গডসেকে তাদের সদস্য বলে স্বীকার করল না সংঘ।যদিও নাথুরামের দাদা ও গান্ধী হত্যার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত গোপাল গডসে তিরিশ বছর পরে জেল থেকে বেরিয়ে ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে নাথুরাম,গোপাল,দত্তাত্রেয় ও গোবিন্দ-- গান্ধী হত্যার সঙ্গে জড়িত চারজনই সংঘ সদস্য ছিলেন।পরবর্তীতে কৌশল হিসাবে হিন্দু মহাসভা নিজেদের বিলীন করে দেয় এবং শ্যামাপ্রসাদ জনসংঘ স্থাপন করেন।দেশব্যাপী প্রতিকূল অভিঘাতে আরএসএসও কিছুদিনের জন্য নিজেদের সংগঠনের কাজ স্থগিত করে।

নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বহুধা স্রোতে বিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের যে সমস্ত নামগুলোকে আজ সংঘ কংগ্রেসের প্রতিস্পর্ধায় স্থাপন করতে চায় তাদের সঙ্গে সংঘের সম্পর্কের ইতিহাস জানা জরুরি।উত্তর ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব ভগৎ সিং ও তার দুই সাথী সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসির পর গোটা দেশ যখন প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল তখন সংঘ সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছিল।এমনকি হেডগেওয়ারের নির্দেশ ছিল কোন কর্মসূচি না নেওয়ার।এমনকি পরে গোলওয়ারকর লেখেন যে ভগৎ সিং কখনো যুব সমাজের আদর্শ হতে পারে না কারণ তারা লক্ষ্য পূরণে অসফল।বাঞ্চ অব থটসে গোলওয়ারকর বলছেন: " It is clear that those who are unsuccessful in their lives must have serious flaw.How can a person who himself is a failure give light to others and show them the way? "।সংঘের মতাদর্শগত শূন্যতা এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় কারণ সংঘীদের আদর্শ গ্রন্থ গীতাতে বলা হয়েছে কর্ম করো,ফল নিয়ে ভাবিত হয়ো না।সুভাসচন্দ্র বসু হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন।এক্ষেত্রে একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার।ফরোয়ার্ড ব্লক গঠনের পর্বে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণের জন্য সুভাষ অকংগ্রেসি বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন।তিনি আরএসের নাম শুনেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধিতা করবেন না, এই কারণে তৎকালীন সংঘ প্রধান হেডগাওয়ার জ্বরের অজুহাতে সুভাষের সঙ্গে দেখা করেন নি,এমনকি তার বার্তার উত্তর দেন নি।এমনকি সংঘ পরিবারের অধুনা আরাধ্য পুরুষ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরোধী ছিলেন না কিন্তু সংঘের ব্যাপারে তার বিরক্তি কখনো গোপন করেন নি।গান্ধী হত্যার পরে সর্দার প্যাটেল জওহরলাল নেহেরুকে স্পষ্ট ভাষায় বলেন : " It was a fanatical wing of Hindu Mahasbha directly under Savarkar that [ hatched] the conspiracy and saw it though"।

আজকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে যে গুটি কয়েক নাম সংঘ তাদের পক্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে চিহ্নিত করতে চাইছে ( এবারে ভারত সরকারের বিজ্ঞাপনে সবার উপরে সাভারকারের ছবি রয়েছে) তাদের অতীত তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। সাভারকার সশস্ত্র বিপ্লবী হিসাবে তার জীবন শুরু করেন এবং আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত হন।সেখানে যাওয়ার পর তার প্রায় নব্বই ডিগ্রি পরিবর্তন হয় এবং প্রাণে বাঁচতে একের পর এক মার্জনা পত্র ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন।সমস্যা হল এগুলো শুধু একজন বিপ্লবী ভেঙে পড়া নয়,একই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি সাভারকারের দেশপ্রেমিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ তুলে দেয়।মুচলেকা পর্বের পর রত্নগিরিতে থাকা ও পরে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই চলেন। বিপ্লবী ভগৎ সিং ও সাভারকারের পার্থক্যটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ছিলেন ব্রিটিশ অনুগত একজন উপাচার্য যিনি বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়ার কারণে বাঙালি ছাত্রদের বেত্রাঘাত করেন।রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী শ্যামাপ্রসাদ ১৯৪২ সালে ব্রিটিশরা কংগ্রেসের উপর তীব্র আক্রমণ চালাচ্ছে তখন বাংলার প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন।আদর্শহীন ও চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিন্ধ ও উত্তর - পশ্চিম প্রদেশে সরকার চালিয়েছে। বাংলা ভাগের সমর্থনে একের পর এক সভা করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। অটলবিহারী বাজপেয়ীকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে চালানোর সংঘ পরিকল্পনা বুমেরাং হয় কারণ সরকারি নথি থেকে প্রমাণিত হয় যে ছাত্রাবস্থায় বাজপেয়ী ব্রিটিশ দের পক্ষে ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেন।

লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম যে স্বাধীনতা সংগ্রামে সংঘের ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করা সমস্যার।এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে সংঘের আরেকটা চেষ্টা হল স্বাধীনতার লড়াইয়ের ন্যারেটিভটা বদলে দেওয়া।ব্রিটিশ দের ১৯০ বছরের শাসনকাল আমাদের পরাধীনতার কাল-- এই সত্যটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য তারা মুসলিমদের বহিরাগত,আক্রমণকারী এবং আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী বলে চিহ্নিত করতে চায়।এই অঙ্ক মেনে বলা হচ্ছে ভারত ১২০০ বছর পরাধীন ছিল। এমনকি ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন রাজনাথ সিং বলেন পৃথ্বিরাজ চৌহানের পর প্রথমবার দিল্লির তখতে একজন হিন্দু বসলেন।এই ন্যারেটিভটাকে জল- বাতাস দেওয়ার জন্য স্বাধীন হিন্দু নায়ক প্রয়োজন যারা হিন্দুদের মুসলমান দাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।শিবাজী, রাণা প্রতাপ, হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য, লচিত বরফুকন আজ সেই নায়কের অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এসেছেন।সমস্যা হল ব্রিটিশরা চলে গেলেও ভারতের পরিচিতির মধ্যে মুসলিম চিহ্ন স্পষ্ট। লালকেল্লা, তাজমহল, নিজামউদ্দিন আউলিয়া আজও সংঘের তথাকথিত সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। তাই আজ সুলতানি ও মুঘল যুগকে মুছে ফেলার এত তৎপরতা। কৌশলটা হল ব্রিটিশ বিরোধী গৌরবময় স্বাধীনতার লড়াইটাকে মুছে ফেলে, মানুষকে সংশয়াকুল করে তোলা এবং এক প্রাচীন, কষ্টকল্পিত সনাতন ভারতের ছবি প্রতিষ্ঠা করা। কাজটা কঠিন কিন্তু সংঘ প্রকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য জরুরি বটে।

0 Comments

Post Comment