পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ইতিবৃত্ত: সঠিক প্রচেষ্টা না প্রহসন ?

  • 24 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1603 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থ সারথি রায়
করোনা ভাইরাস থেকে দুর্ভিক্ষে বেশি মানুষ মারা যাবেন। তাই এই লকডাউন থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোনো দরকার এবং তার জন্য দরকার একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা যার মূলে থাকবে অনেক বেশি সংখ্যক এবং সঠিকভাবে করা পরীক্ষা যার দ্বারা সংক্রমিত মানুষদের দ্রুত চিহ্নিত করে আলাদা করার ব্যবস্থা করা যাবে।

কোভিড ১৯ করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় ভারতে যে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম সংক্রমণের পরীক্ষা হয়েছে সেটা আজ প্রায় সর্বজনবিদিত। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকরা বলছেন যে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো , এবং তার দ্বারা যারা সংক্রামিত তাদের চিহ্নিত করে আলাদা করা দরকার, এখন অবধি ভারতে দশ লক্ষ মানুষ পিছু মোটে ১৫৭ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। যেখানে পৃথিবীর যে সব দেশ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় কিছুমাত্র সাফল্য পেয়েছে, যেমন জার্মানী বা দক্ষিন কোরিয়া, তারা সবাই প্রায় দশ লক্ষ মানুষ পিছু ১৪০০০ থেকে ১৫০০০ পরীক্ষা করেছে। ভারতের ক্ষেত্রে এত কম সংখ্যার পরীক্ষার একটা প্রধান কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ভারপ্রাপ্ত সংস্থা আই সি এম আর বলেছে পরীক্ষার কিটের অপ্রতুলতা ও যা কিট হাতে আছে তা শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই বিষয়ে দুটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার:

প্রথমত ভারতে কোন সময়েই এই কিটগুলির কমতি ছিল না এবং

দ্বিতীয়ত বিদেশ থেকে আমদানী করা এই কিট নির্ভরতা।

এই বিষয়ে বলা দরকার যে এই কিটগুলি যে পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নির্ধারণ করে তাকে বলে রিভার্স ট্রানস্ক্রিপশন - পলিমারেজ চেইন রিএ্যাকসন। এটি কোন বিশেষ বা কঠিন পদ্ধতি নয়, ভারতের বহুলসংখ্যাক গবেষণাগারে এই পদ্ধতি প্রতিদিন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আই সি এম আর, বা ভারত সরকার, হাতে পুরো ফেব্রুয়ারী মাসটি থাকা স্বত্তেও ভারতীয় গবেষণাগারগুলিকে কাজে লাগিয়ে এই পদ্ধতিতে করােনাভাইরাস পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে নি। তার বদলে আই সি এম আর কতগুলি বিদেশি কোম্পানীর কিট দিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতিকে মান্যতা দেয়, এবং এই নিদারুণ কিট নির্ভরতা সৃষ্টি করে। এর পিছনে আমার মনে হয় বৈজ্ঞানিক থেকে ব্যবসায়িক কারণ বেশি ছিল, কারণ এই কিট প্রস্তুতকারী ও আমদানীকারী সংস্থাগুলি এর দ্বারা বিরাট মুনাফা করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

এর পরে আই সি এম আর মার্চ মাসের শেষ অবধি খুব কম সংখ্যক সরকারী পরীক্ষাগারকে এই পরীক্ষা করার জন্য স্বীকৃতি দেয়। তারপর যখন দেখা গেল যে এই অত্যন্ত কম সংখ্যক পরীক্ষাগার দ্বারা এই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন তারা কতগুলি বেসরকারী সংস্থা কে এই পরীক্ষা করার জন্য স্বীকৃতি দেয়। এবং এই পরীক্ষার দাম ধার্য্য হয় ৪৫০০ টাকা। এখন আমি অনেক হিসাব করেও কিছুতেই এই পরীক্ষার দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি কিভাবে হয় বুঝতে পারছি না। তারপর বোঝা গেল যে দাম ৪৫০০ টাকা কেন হল ... এই দামটি সরকার ধার্য করেনি, করেছে একটি কমিটি যেটা এই বেসরকারী সংস্থাগুলির প্রতিনিধিদের দিয়েই বানানো ছিল, যার প্রধান ছিলেন বায়োকেম কোম্পানীর মালিক কিরণ মজুমদার শ৷ এবং সরকার বিনা বাক্যব্যয়ে এদের ধার্য করা দামই মেনে নিয়েছে। এবং সুপ্রিম কোর্ট যখন বিনা পয়সায় পরীক্ষা করার রায় দিয়েছে, তখন এক দিনের মধ্যে যখন এই কোম্পানীগুলি তার বিরুদ্ধে আবেদন করে তখন তাদের হয়েই ওকালতি করেছে। এবং সুপ্রিম কোর্ট ও তা মেনে নিয়েছে। এখানেও তার মানে বেসরকারী সংস্থার মুনাফাই মূখ্য, পরীক্ষা করাটা গৌন। একেই হয়ত বলে ‘ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম’, মানুষের বিপদের সুযােগ নিয়ে পুঁজিবাদ।

এখন ভারতে এত কম পরীক্ষার সংখ্যার আসল কারণ কি সেটা বোঝা মুশকিল। এটা মোটেই বলা হচ্ছে না যে ভারতের প্রতিটি মানুষকে করােনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করা দরকার। যেটা দরকার সেটা হচ্ছে যে অঞ্চলে সংক্রমণ ধরা পড়ছে সেখানে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করা, এবং সেই অঞ্চলে যাদের রোগের কোন উপসর্গ নেই তাদের মধ্যেও একটা বড় সংখ্যাকে পরীক্ষা করার, কারণ রোগের উপসর্গ না থাকলেও সংক্রামিত হলে তারা সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু সেটাও করা হচ্ছে।

এর আসল কারণ বলে মনে হয় যে সংক্রমণের আসল সংখ্যা যাতে না জানা যায় সেই প্রচেষ্টা। এবং এই বিষয়ে কিছু রাজ্য আবার অন্যদের থেকে এগিয়ে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ। ভারতে যেখানে দশ লক্ষ মানুষ পিছু গড়ে পরীক্ষার সংখ্যা হচ্ছে ১৫৭, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সেটা ৩৩৷ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্য সমস্ত পদক্ষেপ, যথা করোনা ভাইরাসে মৃত্যুকে অন্য কারণে মৃত্যু বলে দেখানো ইত্যাদি, থেকে মনে হয় যে সত্যি করেই আসল অবস্থা কে গোপন করার চেষ্টা চলছে। এবং একটি সরকারী কমিটি অনুমোদন না করলে কোন রোগীর স্যাম্পেল পরীক্ষার জন্য পাঠানো যাচ্ছে না। এটি একটি অত্যন্ত মারাত্মক পদক্ষেপ, কারণ এই ভাইরাস সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝা ও তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আসল তথ্য পাওয়া একেবারেই জরুরি, কারণ এই ভাইরাস সম্পকে আমাদের আগের কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাই কোন অবস্থাতেই তথ্য গােপন করা বা ভুল তথ্য দেওয়া উচিৎ হবে না।

করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে এই প্রহসনের মধ্যে নবতম সংযোজন হল র‍্যাপিড টেস্ট। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি এমনভাবে র‍্যাপিড টেস্ট সর্ম্পকে জনসমক্ষে বলছিল যেন সেটি শুরু হলে সব সমস্যার অবসান হবে, হাজার হাজার মানুষের পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু যেটা তারা বলেনি সেটা হল যে এই র‍্যাপিড টেস্ট আদতে ডায়াগনাস্টিক টেস্টই নয়। এটি মানুষের রক্তে দুটি অ্যান্টিবডির মাত্রা দেখে যার মধ্যে একটি অ্যান্টিবডি কোন সংক্রমণের পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে তৈরী হয় ও অন্যটি সংক্রমণের চোদ্দ থেকে কুড়ি দিন পড়ে তৈরী হয় এবং অনেকদিন থাকে। এই পরীক্ষায় সেহেতু ‘ফলস পজিটিভ' অর্থাৎ এখন সংক্রমণ না থাকলেও পজিটিভ, ও ‘ফলস নেগেটিভ’ অর্থাৎ সংক্রমণ থাকলেও নেগেটিভ ফল আসার সম্ভাবনা প্রবল। কারুর সংক্রমণের পর প্রথম পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষাটি হলে তাতে নেগেটিভ ফল পাওয়া যাবে, যদিও সে তখন। অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। অন্যদিকে কারুর এক মাস আগে সংক্রমণ হয়ে এখন সেরে গিয়ে থাকলেও তার পজিটিভ ফল পাওয়া যেতে পারে। তাই র‍্যাপিড টেস্টে কারুর পজিটিভ ফল এলে আর টি - পি সি আর পদ্ধতিতে তার আবার পরীক্ষা করার দরকার হবে। র‍্যাপিড টেস্টের কার্যকারিতা হচ্ছে কোন মহামারীর শেষ ভাগে, যখন এ পরীক্ষা দ্বারা বোঝা যায় যে কতজন মানুষের মধ্যে এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি তৈরী হয়েছে, এবং তা ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা ‘যৌথ অনাক্রম্যতা’ জন্য যথেষ্ট কিনা। এইসব জানা স্বত্তেও লক্ষ লক্ষ র‍্যাপিড টেস্ট কিট আমদানী করা হয়েছে এবং রাজ্যগুলি তা পেয়েছে। এখন এগুলি দিয়ে কি করা হবে তার ঠিক নেই, আই সি এম আর আপাতত এই পরীক্ষা বন্ধ রাখতে বলেছে ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এই নিয়ে আই সি এম আর কে দোষারােপ করছে। তার মধ্যে সঠিক তাপমাত্রায় না রাখলে এই কিটগুলি শীঘ্রই খারাপ হয়ে যায়, এবং এখন যেরকম গরম পড়তে আরম্ভ করেছে তা হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।

| সেহেতু প্রথম থেকেই অত্যন্ত কম সংখ্যায় পরীক্ষা করার পর, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামত ও জনমতের চাপে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়েও, পরীক্ষা নিয়ে একটি প্রহসনই চলছে, যেন একটি ছেলে ভোলানো খেলা চলছে। প্রতিদিন একটি করে নূতন পরীক্ষার পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, তাই নিয়ে সংবাদমাধ্যমে জোর আলোচনা চলছে, এবং তারপরে সেটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যেমন। পশ্চিমবঙ্গ সহ কয়েকটি রাজ্য সরকার হঠাত ঘোষণা করল যে একেকজন রোগীর স্যাম্পেল এককভাবে নয়, একাধিক স্যাম্পেল ‘পূল’ করে পরীক্ষা করা করা হবে। এতে সময় ও পয়সা দুই বাচে, কিন্তু যেটা বলা দরকার সেটা হচ্ছে যেখানে সংক্রমণ চলছে সেখানে এই ‘পূল’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করার কোন লাভ নেই, কারণ প্রতিটি পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসবে এবং তখন আবার প্রতিটি রোগীর স্যাম্পেল আলাদাভাবে পরীক্ষা করতে হবে। পূল’ পদ্ধতিতে পরীক্ষা কাজে লাগে সেইসব জায়গায় যেখানে সংক্রমণের খবর নেই, সেখানে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে নেগেটিভ এলে সেইসব অঞ্চলকে সংক্রমণমূক্ত ঘোষণা করে লকডাউনের আওতা থেকে বের করে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা বোঝা মুশকিল যে যখন সংক্রমনের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান তখন কাদের নির্দেশে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এটি আমাদের স্পষ্ট করে বোঝা উচিৎ যে লকডাউন আমাদের দেশের গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে যে বিভীষিকা নিয়ে এসেছে তা আর বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এরপর করোনা ভাইরাস থেকে দুর্ভিক্ষে বেশি মানুষ মারা যাবেন। তাই এই লকডাউন থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোনো দরকার এবং তার জন্য দরকার একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা যার মূলে থাকবে অনেক বেশি সংখ্যক এবং সঠিকভাবে করা পরীক্ষা যার দ্বারা সংক্রমিত মানুষদের দ্রুত চিহ্নিত করে আলাদা করার ব্যবস্থা করা যাবে।

0 Comments

Post Comment