পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গ্রামবাংলার রাজনীতি (প্রথম অংশ)

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 203 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থ সারথি
পশ্চিমবঙ্গের নিচুতলার মানুষের মধ্যে সংসদীয় দলগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সংগঠন সম্ভবত সারা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এরাজ্যের গ্রামাঞ্চলে পার্টি-রাজনীতির প্রভাব কতটা গভীর তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৮-পরবর্তী কয়েক বছরের রক্তক্ষয়ী গ্রাম দখলের সংঘর্ষে যা পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা-কেশপুর থেকে শুরু হয়ে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামবাংলার রাজনীতি নিয়ে চার পর্বের লেখার এটি প্রথম পর্ব।

পশ্চিমবঙ্গকে বুঝতে হলে তার গ্রামকে বুঝতে হবে। আর গ্রামবাংলাকে বুঝতে হলে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে গ্রামবাংলার রাজনীতি। ভারতবর্ষে ১৯৬০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে যে বিপ্লবী রাজনীতির অভ্যুদয় হয়, সেই মাওবাদী রাজনীতিতে গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাও জে দং যেভাবে চিনা সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ করে শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করার কাজকে ‘বিপ্লবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং সর্বপ্রথম এই কাজ সম্পন্ন করে, এই বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করেই যেভাবে পরবর্তীকালে চিন বিপ্লবের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে ব্রতী হয়েছিলেন, ভারতের মাওবাদীরা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই এদেশের সমাজকে বিশ্লেষণ করা এবং বিপ্লবের রণনীতি-রণকৌশল স্থির করার চেষ্টা করছেন। এই পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক শ্রেণী বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিপ্লবের শত্রু-মিত্র নির্ধারকভাবে নির্ণীত হয়। মাও-এর ভাষায়,

‘প্রকৃত শত্রুদের থেকে প্রকৃত মিত্রদের আলাদা করে চেনার জন্য আমাদের অবশ্যই চিনা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিপ্লবের প্রতি তাদের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গির একটা সাধারণ বিশ্লেষণ করতে হবে’।

এই বিশ্লেষণ-পদ্ধতি অনুযায়ী সমাজের প্রতিটি শ্রেণী তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী বিপ্লবের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করে। মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলি (পেতিবুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী) দোদুল্যমান থাকে, এবং বিপ্লবের জোয়ার-ভাঁটা অনুযায়ী কখনো বিপ্লবের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু বিপ্লবের মূল শত্রু জমিদার ও মুৎসুদ্দি শ্রেণীগুলি এবং প্রধান মিত্র সর্বহারা ও আধা-সর্বহারা শ্রেণীগুলির অবস্থান বিপ্লবের গোটা পর্যায়কাল জুড়ে মোটামুটি একই থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীগুলির অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে বিপ্লবের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করার এই পদ্ধতি ভারতীয় সমাজে কতটা প্রযোজ্য?

প্রাক-বিপ্লব চিনা সমাজের সাথে বর্তমান ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন বড় বড় পার্থক্যগুলোর মধ্যে একটা হল, এদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংসদীয় ব্যবস্থার সুবাদে সমাজের গভীরে রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক পার্টি-রাজনীতির অনুপ্রবেশ। সংসদীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে সদা-ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো এখানে নিজ নিজ রাজনীতি আর আদর্শকে সামনে রেখে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ঢুকে পড়ে এবং মানুষকে তাদের রাজনীতির পেছনে জড়ো করার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। যেহেতু এদেশে প্রতিটি মানুষেরই ভোটাধিকার আছে, তাই সংসদীয় ক্ষমতা দখলের এই প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ না হলেও একটা বড় অংশের মানুষ জড়িয়ে পরেন। সংসদীয় ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে প্রতিযোগী প্রধান দলগুলোকে যদি এদেশে শাসকশ্রেণীর তথা বড় বুর্জোয়া বড় জমিদার শ্রেণীগুলির প্রতিনিধি হিসাবে ধরে নিই, তাহলেও তাদের প্রভাব কিন্তু ওই উচ্চ শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বিপরীতে, তারা একটা বড় অংশের শ্রমজীবী তথা নিম্নবর্গের মানুষকে প্রভাবিত করে এবং কমবেশি নিজ নিজ রাজনীতি ও দলের পেছনে তাদের একাংশকে সমাবেশিতও করে।

পশ্চিমবঙ্গের নিচুতলার মানুষের মধ্যে সংসদীয় দলগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সংগঠন সম্ভবত সারা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এরাজ্যের গ্রামাঞ্চলে পার্টি-রাজনীতির প্রভাব কতটা গভীর তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৮-পরবর্তী কয়েক বছরের রক্তক্ষয়ী গ্রাম দখলের সংঘর্ষে যা পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা-কেশপুর থেকে শুরু হয়ে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাস্তবত, পশ্চিমবঙ্গে এই এলাকা দখলের লড়াই-এর সূত্রপাত হয় ১৯৭০-এর দশকের গোড়া থেকেই এবং ১৯৭৭-পরবর্তী পর্বে তা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রূপে বারবার ফেটে পড়ে। বহু ক্ষেত্রেই বামফ্রন্টের শরিক দলগুলো একে অপরকে উচ্ছেদ করে এলাকা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। সুন্দরবন অঞ্চলে সিপিএম ও আরএসপি-র মধ্যে দীর্ঘ সংঘর্ষ এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকটি থানা এলাকায় এসইউসি-র সাথে সিপিআই(এম)-এর ধারাবাহিক সংঘর্ষ চলেছে বহু বছর ধরে। এগুলোর মধ্যে গড়বেতা-কেশপুরে সিপিএম-এর সাথে তৃনমূল কংগ্রেস-বিজেপি জোটের এলাকা দখলের লড়াই ছিল সবচেয়ে সংগঠিত ও সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী।

এখানে গ্রাম দখলের লড়াইয়ে কখনো কখনো হাজার বা তার বেশি মানুষকে জড়ো করা হয়, যাদের বেশিরভাগই নিম্নশ্রেণীর। তাদের সবাই যে স্বেচ্ছায় ওই লড়াইতে যুক্ত হয়েছেন তা যেমন নয়, তেমনি তাদের সবাইকে যে ধরেবেঁধে আনা হয়েছে, তাও সঠিক নয়। এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবী রাজনীতির হস্তক্ষেপ এই এলাকার মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণে কতটা তারতম্য আনতে পারে, কতটা নিম্নবর্গের মানুষকে তার পক্ষে টেনে আনতে পারে, তার একটা পরীক্ষামূলক দৃষ্টান্ত গড়বেতায় ওই পর্বে জনযুদ্ধ দলের কাজকর্ম আমাদের সামনে হাজির করে। সংক্ষেপে, গড়বেতায় তৃণমূল-বিজেপি দলের আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ দল সংঘর্ষে নামলে ওই অঞ্চলের গরিব মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দেন এবং জনযুদ্ধ দলের লড়াইয়ে একটা মাত্রায় সামিলও হন। কিন্তু এই লড়াইয়ের ফলে বিজেপি-তৃণমূল জোট হটে যাওয়ার পর যখন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সিপিআই(এম) ও জনযুদ্ধ দল মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন আর নিম্নশ্রেণীর সেই ব্যাপক সমর্থন জনযুদ্ধ দল পায় না। নিম্নশ্রেণীর একটা অংশ সিপিআই(এম)-এ ফিরে যায়, একটা অংশ নিস্ক্রিয় হয়ে যায় আর ক্ষুদ্র একটা অংশ বিপ্লবী দলের পক্ষে থাকে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সিপিএম-এর যৌথ আক্রমণের মুখে বিপ্লবী দলকে পিছু হটে আসতে হয়। 

এই প্রসঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে, মাও যে দং যেভাবে চিনা সমাজে শ্রেণীগুলির অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে বিপ্লবের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ণয় করেছিলেন এবং যা সেদেশের বৈপ্লবিক কাজকর্মের অগ্রগতিতে সঠিক বলে প্রতিপন্ন হয়েছিল, ভারতীয় সমাজ তথা পশ্চিমবঙ্গের সমাজকে সেই একই ফরমূলায় ফেলে বিশ্লেষণ করা যাবে কিনা। ভারতের যেসব অঞ্চলে গ্রামস্তরে রাষ্ট্র এবং সংসদীয় পার্টি-রাজনীতির অনুপ্রবেশ তুলনামূলক কম বা নগণ্য, সেখানে শ্রেণীগুলির অর্থনৈতিক অবস্থানের সাথে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের একটা পরিমাণে সাযুজ্য পাওয়া যেতে পারে। সেই সকল স্থানে (যেমন বিহার-ঝাড়খণ্ড বা দণ্ডকারণ্যে) মাওবাদী অনুশীলন একটা পরিমাণে সাফল্য পেতেই পারে। কিন্তু এই ধরনের সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে সাধারনীকরণ করে ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রয়োগ করতে গেলে, তার ফল যে বিষময় হতে পারে, সেটাও বিচার করা দরকার।

আসলে, সমস্যাটা এদেশে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশের সাথে যুক্ত। প্রাক্-বিপ্লব চীনে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ ছিল অত্যন্ত নিম্ন স্তরে। সেখানে গ্রামাঞ্চলে যুদ্ধবাজ সামন্তপ্রভুদের আধিপত্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক জাগরণ বিপ্লবের গতি-প্রকৃতিকে নির্ধারণ করেছিল। সেখানে সুতীব্র শ্রেণি নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রেণিগত প্রতিরোধ ছিল অনেকটাই সরাসরি, নগ্ন পীড়নের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া কৃষকদের সামনে প্রতিবাদের আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।

ব্রিটিশ আমলে বাংলার গ্রামরাজনীতি

কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বিকাশ হয়েছে সম্পূর্ণ অন্যভাবে। এখানে যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে জমির ওপর জমিদারদের মালিকানা-স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের সর্বনাশের পথ খুলে দিয়েছিল, সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরাই একের পর এক কৃষক বিদ্রোহের মুখে পড়ে ১৮৫৯ সালে খাজনা আইন ও ১৮৮৫ সালে প্রজাস্বত্ব আইন চালু করে জমিদারদের মালিকানার অধিকারকে খর্ব না করেও কয়েকশ্রেণীর প্রজাদের জমিতে ভোগদখলের অধিকার সুরক্ষিত করে এবং খাজনা বৃদ্ধির ব্যাপারটা কয়েকটি শর্ত দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করে। বিশ শতকের প্রথম এবং দ্বিতীয় দশক থেকে সার্ভে ও সেটলমেন্ট রিপোর্টগুলোতে বাংলার চাষীদের ওপর ক্রমবর্ধমান শোষণ-নিপীড়নের ছবি বেরিয়ে আসে এবং চাষীদের দুরবস্থা নিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের ‘উৎকণ্ঠা’ও প্রকাশ পায়। ১৯২০-এর দশকে বাংলার বিধান পরিষদের নির্বাচন হয়। এবং এই সময় থেকেই অবিভক্ত বাংলার গ্রামাঞ্চলে সংগঠিত রাজনীতির অনুপ্রবেশ দ্রুত বেড়ে চলে। কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন ও ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলনে এবং মুসলিমদের খিলাফৎ আন্দোলনে ব্যাপক পরিমাণে বাংলার কৃষকরা অংশগ্রহণ করেন।

১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নিয়োজিত জন কার কমিটি সুপারিশ করে যে, ফসলের ভাগ দেয় এমন সকল চাষী, যারা নিজেদের বীজ ও গরু দিয়ে চাষ করেন এবং নিজেরাই ফসল কী হবে তা স্থির করেন, তাদের প্রজা হিসাবে গণ্য করা উচিত। এই সুপারিশ আইনে পরিণত হলে ভাগচাষীদের প্রজা হিসাবে মান্যতা দিতে হবে, এই ভয়ে জমিদার ও জোতদাররা বিরাট আপত্তির ঝড় তোলে এবং বহু সংখ্যক বর্গাদারকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯১৯-২০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকার বর্গাদারদের নাম রেকর্ড করার কাজ শুরু করে। শুধু ঢাকা জেলাতেই ৭৭,০০০ বর্গাদারের নাম প্রজা হিসাবে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু এরপর এইসব নথিভুক্ত বর্গাদারদের এত ব্যাপক পরিমাণে উচ্ছেদ করা শুরু হয় যে, এই প্রক্রিয়া ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯২৮ সালে সংশোধিত আকারে প্রজাস্বত্ব বিল ব্রিটিশ সরকার বিধান পরিষদের অনুমোদনের জন্য হাজির করলে, তার ওপর ভোটাভুটিতে প্রজাস্বত্ব অধিকারকে ঘিরে বাংলার রাজনীতিতে একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বরাজ্য দলের হিন্দু নেতারা যখন প্রায় সকলেই জমিদারদের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ান, তখন মুসলিম প্রতিনিধিরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে বর্গাদার ও গরীব কৃষকদের স্বার্থে বিভিন্ন সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বর্গাদারদের নাম রেকর্ড করা শুধু নয়, তাদের প্রজাস্বত্ব দেওয়ার বিষয়টি ব্রিটিশই প্রথম প্রস্তাব করে, যা আজও কার্যকর হয়নি। 

১৯২০-এর দশকেই সংগঠিত রাজনীতি কীভাবে বাংলার কৃষক সমাজকে প্রভাবিত করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৯২৬-২৭ সালে পূর্ববাংলার পাবনা বরিশাল প্রভৃতি কিছু জেলায় মূলত হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে মুসলিম কৃষক সমাজের বিক্ষোভ দাঙ্গার আকারে ফেটে পড়ার ঘটনায়। এইসব ঘটনার পেছনে বাংলার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদেরই সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি, ১৯১৯-২১ সালে ইউনিয়ন বোর্ড-বিরোধী আন্দোলনে, ১৯৩০-৩১ সালে লবন আইন ভাঙার আন্দোলনে বা ১৯৪২-৪৩ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে প্রধানত মেদিনীপুর জেলায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে কৃষকদের রাষ্ট্র-বিরোধী প্রতিরোধ প্রায় গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। অর্থাৎ ১৯৪৬-৪৯ সালে তেভাগার দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রথম বড় আকারে কৃষক আন্দোলন ফেটে পড়ার বহু আগেই বাংলার গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেস, কৃষক প্রজা পার্টির মতো রাজনৈতিক দলগুলি ভালমাত্রায় কৃষকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে এবং তাদের আন্দোলনে সমাবেশ করতেও সক্ষম হয়।

  ব্রিটিশ রাষ্ট্রও জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে। জমিদারদের স্বার্থ ক্ষুন্ন না করেও ব্রিটিশ সরকার প্রজাদরদী হওয়ার ভান করে এবং তাদের এই ভূমিকাও কৃষকদের একটা মাত্রায় প্রভাবিত করে। ১৯৩০ সালে পূর্ববাংলার কিশোরগঞ্জে মুসলিম প্রজারা যখন হিন্দু জমিদার ও মহাজনের বাড়ি আক্রমণ ও লুঠ করে, তখন তাদের বলতে শোনা যায়, ‘সরকার আমাদের ১৫ দিনের জন্য স্বরাজ দিয়েছে’। মুসলিম মৌলভিরা তাদের সেরকমই বুঝিয়েছিল। বাস্তবত, ব্রিটিশ প্রশাসন আইন অমান্য আন্দোলন থেকে মুসলিম প্রজাদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য ঢাকায় সেবছর দাঙ্গা বাধলে মুসলিমদের পক্ষ নেয়, যাতে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হিন্দু ‘ভদ্রলোক’দের ধাক্কা দেওয়া যায়।

এইসব টুকরো টুকরো ঘটনাবলীকে জুড়লে ১৯২০-৩০-এর দশকে বাংলার গ্রামাঞ্চলের যে ছবিটি আমরা পাই, তার সাথে তৎকালিন চিনা গ্রামসমাজের বিস্তর ফারাক নজরে পড়ে। কৃষকদের ওপর জমিদারদের অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষেত্রে ভারত এবং চীন এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে খানিক মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও, বাংলার গ্রামসমাজে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রজাস্বত্ব আইন মারফত সংস্কারের প্রভাব এবং নানান রাজনৈতিক পার্টির অনুপ্রবেশ ও প্রভাব লক্ষণীয় মাত্রায় পৌঁছে যায় ওই সময়েই। অর্থাৎ সেই আমলেই গ্রামবাংলায় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক (রাষ্ট্রের সাথে দর-কষাকষিতে লিপ্ত) রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব এবং কৃষকদের বড় আকারে সমাবেশিত করার ক্ষমতা চিনা গ্রামসমাজের থেকে এদেশের গ্রামসমাজের পার্থক্য সূচিত করেছিল।  

আসলে রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা বা খুব বেশি হলে রাষ্ট্রের সংস্কার সাধনে ব্রতী পার্টি-রাজনীতির অনুপ্রবেশ ওই সময় থেকেই বাংলার গ্রামসমাজের চালচিত্র বদলাতে শুরু করে। গ্রাম সমাজে তাদের প্রভাব, এবং সীমিত মাত্রায় হলেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ গ্রামস্তরে রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোটাকে পুনর্বিন্যস্ত করতে শুরু করে। আগের মতো শুধু জমিদারশ্রেণিকেই নয়, বরং জোতদার, ধনী কৃষক ও অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিগুলিকেও একটা পরিমাণে রাষ্ট্র-কাঠামো অঙ্গীভূত করে নেয় এবং তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য একটা পরিসর তৈরি করে। অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন উচ্চ শ্রেণিগুলির নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে লড়াই করা, বিতর্ক করা এবং আইনি গণ্ডির মধ্যে আন্দোলন করার একটা জায়গা রাষ্ট্র নিজেই তৈরি করে দেয়। আমরা দেখলাম, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার পর্যন্ত প্রজাস্বত্ব বিল নিয়ে বিতর্কে বিধান পরিষদের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে সকলের মতামত নিয়ে তারপর ভোটের মাধ্যমে প্রজাস্বত্ব বিল গ্রহণ করছে। জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং ভাগচাষীদের পক্ষে একটা শক্তিশালী কণ্ঠস্বর বিধান পরিষদে শোনা যাচ্ছে। বিধান পরিষদে শুধু জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব থাকলে এটা সম্ভব হতো না।

তেভাগা-পূর্ববর্তী কৃষক আন্দোলনে সংগঠিত রাজনীতির প্রভাবের কিছু চিত্র বিনয়ভূষণ চৌধুরীর ‘সংগঠিত রাজনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ’ প্রবন্ধটিতেও পাওয়া যায়। পূর্ববাংলায় যেভাবে মুসলিম রাজনীতির প্রভাবে মুসলিম ভাগচাষীদের মধ্যে হিন্দু জমিদার-বিরোধী বিক্ষোভ ফেটে পড়েছিল, প্রায় একইভাবে মালদার সাঁওতাল ভাগচাষীরা, যারা সদ্য সেই সময়ে হিন্দুত্ব ও ‘হিন্দু রাজনীতি’-র প্রভাবে এসেছিল, ১৯৩২ সালের আন্দোলনে তাদের মধ্যে তীব্র মুসলিম জমিদার-বিরোধী মনোভাব ফুটে উঠেছিল।... ভাগচাষীদের আন্দোলনে অন্য ধরনের সংগঠিত রাজনীতি যথা কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির রাজনীতিরও ভূমিকা ছিল। 

এইভাবে, গ্রামবাংলার রাজনৈতিক জীবনে সংগঠিত রাজনীতির প্রভাব যে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল সেই ১৯২০-৩০-এর দশক থেকেই, তার যথেষ্ট প্রমাণ কৃষক আন্দোলনের গবেষকদের লেখা থেকে পাওয়া যায়।

(চলবে) 

চীনা সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণ- মাও জে দং নির্বাচিত রচনাবলী-১ম খণ্ড (ইং), পৃ-১৩

ঐ. (পৃ-১৩)

Partha Chatterjee, Bengal 1920-1947- (P-49)

ঐ. (P-92)

ঐ, (P-138)

'সংগঠিত রাজনীতি' ও কৃষক বিদ্রোহ, বিনয়ভূষণ চৌধুরী, অনীক, মার্চ-এপ্রিল ১৯৯৭ (পৃ-১৫)

0 Comments

Post Comment