বিপন্ন আরাবল্লি। ‘খনিজের জাদুঘর’ নিয়ে কিসের বিতর্ক? কেন চর্চায় সুপ্রিম কোর্টের রায়? কেনই বা চলছে নাগাড়ে আন্দোলন? আরাবল্লী পাহাড়ের নিচে মজুদ খনিজ ভান্ডার দখল করার কর্পোরেট বাহিনীর চাপে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার পাহাড়ের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। এবং এই সংজ্ঞায় সম্মতি জানায় সুপ্রিম কোর্টের একটি অতি সাম্প্রতিক রায়। যার মূল কথা:
শুধুমাত্র ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট জমিকেই আরাবল্লী পাহাড় হিসেবে গণ্য হবে। দুই বা তার বেশি ১০০ মিটার-উচ্চতা-বিশিষ্ট পাহাড় যদি ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকে, তবেই সেটাকে আরাবল্লী পর্বতমালা বলা হবে।
এই নতুন সংজ্ঞা আগে থেকে চলা ইকোলজিক্যাল সংরক্ষণ নীতির চেয়ে অনেকটাই সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ। এতে মূলত অনেক ছোট পাহাড়, ঢাল, টিলা ও জলবায়ু-সংবেদনশীল অঞ্চলের সুরক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ, ১০০ মিটারের কম উচ্চতা হওয়ায় বহু পাহাড় বা টিলা “অসুরক্ষিত” হয়ে পড়বে। অর্থাৎ সরকার বাহাদুর বা হাঙর কর্পোরেটের দল যখন তখন আইনিভাবেই এইগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে।
এর ফলে রাজস্থান, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের এক বড় অংশ হিট ট্র্যাপ জোনে পরিণত হবে। আরাবল্লী পাহাড়কে নিশ্চিহ্ন করে দিলে এইসব অঞ্চলগুলোর জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে পুরোটাই থর মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাপমাত্রা মাত্রাছাড়া হবে। জলের সংকট তীব্রতর হবে। ধূলো, ধোঁয়ার দূষণে আকাশ বাতাস বিপর্যস্ত হবে। হাজার লক্ষ মানুষ বসতবাড়ি জমিজমা হারিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক বা খনিজ উত্তোলন ও কারখানার সস্তা শ্রমিক হবেন। কেউ বা হবেন কর্পোরেট বাবুদের গাড়ির ড্রাইভার বা খালাসি। মা বোনেরা নিজেদের প্রকৃতি কেন্দ্রীক জীবনযাপন থেকে উদ্বাস্তু হয়ে গৃহপরিচারিকার দলে নাম লেখাতে বাধ্য হবেন। অনেককেই থালা বাটি হাতে রাস্তায় নামতে হবে। জীবনের প্রবাহ থেকে হারিয়ে যাবেন অসংখ্য মানুষ। স্বাভাবিক ভাবেই কয়েকটি রাজ্য জুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।
আন্দোলনের হাল হকিকত:
সুপ্রিম রায়ের পরেই পরিবেশ কর্মী, স্থানীয় গ্রামবাসী এবং নাগরিক সমাজ ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন: নতুন এই সংজ্ঞায় মহাগুরুত্বপূর্ণ আরাবল্লীর বেশির ভাগ অংশই সেন্সিটিভ লাইনের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে মাইনিং, নির্মাণ ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকবে। পাশাপাশি পরিবেশ, জলবায়ু, বায়ুদূষণ, মরুদ্যানের সম্প্রসারণ, জলের স্তরের অনেক নিচে নেমে যাওয়া থেকে শুরু করে কয়েক হাজার হেক্টর বনাঞ্চলের অপমৃত্যু ঘটবে।
অথচ এই আরাবল্লি পাহাড় উত্তর ভারতের “সবুজ ফুসফুস”। যা বেশ কয়েকটি রাজ্যের প্রণবায়ুর যোগানদার। দিল্লী-NCR-এর বাতাস ও ভূ-জলের জন্য এর ভূমিকা অপরিহার্য।
অনেক শহর ও গ্রামে সড়কপথ জুড়ে হাজার হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থান, প্রতিবাদ, মিছিল চলছে। স্থানীয় মানুষ ধর্মঘটের পথেও হাঁটছেন। সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন (#SaveAravalli) শুরু হয়েছে। এই প্রচারে ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক বড় অংশের মানুষ সামিল হয়েছেন। যথারীতি আন্দোলন ভাঙতে পুলিশ বাহিনী সক্রিয়। তবুও এই আন্দোলন চলবে। দাবানলের মতো এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে শহর থেকে গ্রামে গঞ্জে মফস্বলে, দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায়। তাহলে হয়তো বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত করে দেওয়া প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা করে মানবসভ্যতাকে এই নীল গ্রহে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ ও দাবিসমূহ:
রাজস্থানের জয়পুর, উদয়পুর এবং হরিয়ানার গুরগাঁও সহ বহু জায়গায় স্থানীয় নাগরিক সরাসরি বিক্ষোভ করছেন। বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচী চলছে লাগাতার। পরিবেশ কর্মী, ছাত্র-যুব সমাজ, অ্যাক্টিভিস্টরা একত্রিত হয়েছেন। অনেকেই দাবী করছেন – আরাবল্লীকে পুরোপুরি “Ecologically Critical Area (ECA)” ঘোষণা করা হোক। অনলাইনেও #SaveAravalli টপ ট্রেন্ডিং হয়েছে। দেশের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্র ও নিউজ চ্যানেল খবর পরিবেশন করতে বাধ্য হয়েছে।
আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ বিরক্ত। তাঁরা তীব্র আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রাজস্থানের বংশওয়াড়া, ডুঙ্গরপুর ইত্যাদি এলাকায় আদিবাসীরা স্বভাবিকভাবে আরাবল্লীকে নিজের সাংস্কৃতিক ও জীবনধারার অংশ বলে দেখেন। তাঁরা সরকারের বন উজাড়, খনন ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র করেছেন।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই রায়কে সরকারের পরিবেশ নীতি লঘু করার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছে এবং উচ্চ আদালতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা তুলে ধরে পুনর্বিবেচনা দাবি করছে। অনেক নেতা মন্তব্য করেছেন –“উচ্চ আদালতের এই রায় পরিবেশের জন্য একটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত”।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া:
সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে যে, প্রায় ৯০% এরও বেশি অঞ্চল সুরক্ষিত থাকবে, এবং নতুন খনি বা নেতিবাচক পরিবেশ-কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। সরকারের প্রতিনিধিরা বলছে – “বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সরকারের দাবি মেনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদ্দেশ্য হল ইকোসিস্টেমকে বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে নিরাপদ রাখা”।
কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির নেতাদের এইসব আশ্বাসবানী শুনলে ঘুড়ায় ও হাসবে। আসলে
পেয়ারের বেনিয়াদের সেবা করতে করতে কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ বেহায়া নির্লজ্জ দু-কান-কাটা হয়ে পড়েছে। রাজার কাপড় যে খুলে গেছে, সেটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে।
আরাবল্লি পাহাড় কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আরাবল্লি পর্বতমালা উত্তরভারতে ২০০ কোটি বছর ধরে ভূ-প্রাকৃতিক বাফার জোন হিসেবে কাজ করছে। ভাবতেও অবাক লাগে যে, এই দুইশো কোটি বছরের পাহাড়ের ভূগোল ইতিহাস ভবিষ্যত নির্ধারন করছে মাত্র দুইশো বছরের ‘প্রগতিশীল’ মানুষ। হায়রে আমার সভ্য মানুষ। একেই নাকি বলে সভ্যতা!
মরুভূমির বিস্তার আটকানো, বৃষ্টির ধারা নামিয়ে আনা, জল সংগ্রহ, মাটির জল পুনরায় সংরক্ষিত করা, বায়ুর গুণমান ঠিক রাখা অর্থাৎ এককথায় দেশের এক বড় অংশের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে আরাবল্লী পাহাড়। বহু নদীর এবং ভূপৃষ্ঠের জলাধারের উৎস এই আরাবল্লি পর্বতশ্রেণী। স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ও বনাঞ্চল রক্ষার ক্ষেত্রে এক অপূর্ব ভূমিকা পালন করে এই পাহাররাজি।
এই পর্বতশ্রেণী উত্তর-পশ্চিম ভারতের গুজরাট থেকে শুরু করে রাজস্থান, হরিয়ানা হয়ে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত। বয়সের দিক থেকে হিমালয়ের তুলনায় অনেক প্রাচীন হলেও পরিবেশগত গুরুত্বের দিক থেকে আরাবল্লীর ভূমিকা আজও অপরিসীম। এই পর্বতশ্রেণী একদিকে যেমন মরুকরণের অগ্রগতি রোধ করে, অন্যদিকে তেমনি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলচক্র নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরাবল্লি অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র প্রধানত শুষ্ক ও অর্ধ-শুষ্ক প্রকৃতির। এখানে শুষ্ক পর্ণমোচী বন, কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়, তৃণভূমি এবং শিলাময় পাহাড়ি পরিবেশ একসঙ্গে বিদ্যমান। অল্প বৃষ্টিপাত ও দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এই বাস্তুতন্ত্র মাটি সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে কাঁটাযুক্ত বনভূমি ও তৃণভূমি মরুকরণ প্রতিরোধে কার্যকর প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে।
আরাবল্লি পর্বতশ্রেণীর উদ্ভিদজগৎ বৈচিত্র্যময়, যা পরিবেশের সঙ্গে সুসমন্বিত। এখানে ধাও, খেজুর, বাবুল, নীম, পালাশ ও বেলের মতো গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। এই উদ্ভিদগুলি খরা সহনশীল এবং অল্প জলেই টিকে থাকতে সক্ষম। এছাড়াও গুলঞ্চ, অশ্বগন্ধা, ও সাফেদ মুসলির মতো বহু ঔষধি উদ্ভিদ এই অঞ্চলে জন্মায়, যা স্থানীয় মানুষের জীবনযাপন ও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
প্রাণিজগতের দিক থেকেও আরাবল্লী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে চিতল, সাম্বর হরিণ, নীলগাই, চিতা বিড়াল, শিয়াল, হায়েনা ও নেকড়ের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। একসময় চিতা এখানে বিচরণ করলেও বর্তমানে তা বিলুপ্ত। পাখিজগতে ময়ূর, ঈগল, শকুন, বাজপাখি, বাবুই পাখি ও বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি আরাবল্লীর জীববৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সাপ, গিরগিটি ও অন্যান্য সরীসৃপও এই বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মানব সমাজের সঙ্গেও আরাবল্লির সম্পর্ক গভীর। ভীল, মিনা ও গরাসিয়া প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে আসছে। তাঁদের জীবনধারা মূলত কৃষি, পশুপালন ও বনজ সম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অথচ সবদিক দিয়েই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়কে ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে দিতে নখ দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কর্পোরেট বাহিনী ও তাদের সেবাদাস কেন্দ্রীয় সরকার। আজ আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। জনগণের এই লড়াই আন্দোলনের সংহতিতে আমাদের পথে নামাটা ভীষণ জরুরী। প্রকৃতি পরিবেশ, পাহাড়, বনাঞ্চল, জলের ভাণ্ডার রক্ষা করা সহ স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন যাপন স্বাভাবিক পথে বয়তে দেওয়ার স্বার্থে কথা বলার সময় এসেছে। সমাজবদ্ধ মানুষের এটা সামাজিক দায়। নীরব থাকা আজ অপরাধ।