পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এক অন্য পুজোর গল্প…

  • 02 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1023 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমিতা আলম
পুজোর দিনগুলোতে টিউবলাইটের নিয়ন আলোতেও দেখতে পেতাম চেনা, অচেনা মুখগুলোতে খুশির ঝলকানি। এক পোয়া জিলিপি আর আড়াইশো মিহিদানা এই দুটো ছিলো মাস্ট বাই এর লিস্টে প্রথম দিকে। আমার পাড়ার কারো বাড়িতে তখন মূল ফটক বা দরজা ছিলো না। একটা বাড়িতে ঢুকলে ,সব বাড়ি বেড়িয়ে পাড়ার শেষ বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যেত। হাটখোলা মন। খিড়কি, দরজা বিহীন। ঠাকুর দেখে ফিরলেই আমার নানীর প্রথম প্রশ্ন, কী আইনছেন মোর তানে? এক অন্য পুজোর গল্প...

নানি বলতেন যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আজকাল বড্ড মনে বাজে কথাটা। বয়স বাড়ছে নাকি হিরায়েত, নস্টালজিয়ায় দিন গুজার। পুরোনো সব ভালো মনে হয় এখন, নতুনের জাঁকজমকের মাঝে অন্তঃসারশূন্য একাকীত্ব।
দুপুরের চড়া রোদেও যেন সবুজ, নরম মেঘের গন্ধ। আর মন জুড়ে ছুটি, ছুটি ভাব। হালকা , হিমেল বাতাসে খোলা বইয়ের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে খুঁজছি সেই পাথরের রাস্তা, আর গ্রামের শেষে বাজারে ঢোকার আগে টিনের চালা আর বেড়া দেওয়া ঠাকুর ঘরে চরম ব্যস্ততা।

ঠাকুর আসছে। বাড়িতে সাজো সাজো রব। ঘর পরিষ্কার করা, নারকেলের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু রাত জেগে বানানো। পাঁচ খালা আর তাদের ছেলেমেয়েরা আসতো পুজোর ছুটিতে। এই ছিল পুজো শুরুর আগের দিনগুলোর দৃশ্য।

তারপর সব পরিচিত দৃশ্যগুলো মুছে যেতে লাগলো এক এক করে। ঠিক ম্যাজিশিয়ানের ভ্যানিশ বলার মতো নয়। খুব ধূর্ত আর্টিস্টের সুচারু ডাস্টার দিয়ে মুছে ফেলা। হিন্দু খতরে মে হ্যায় থেকে পীরের মাজারে যাওয়া হারাম -  সব ন্যারেটিভে   পুজোগুলো কেমন তোমার না আমার এই ফিসফিসানি থেকে এখন কান পাতলেই শুনতে পাই, পূজা ওদের, আমাদের নয়।

এমনটা ছিলো না কিছু বছর আগেও। ভাদই ধানের(ভাদ্র মাসে যে ধান হয়) শীষ চুপ করে কেটে বিক্রি করা টাকা আর জল্পেশ মেলা(উত্তরবঙ্গের এক বিখ্যাত মেলা, শিবরাত্রি উপলক্ষে হয়) থেকে কেনা মাটির মাছের পেট চিরে বের করা খুচরো পয়সা গুনে ঠিক করা, নবমী থেকে ভাণ্ডানী কোন মেলায় কত খরচ করতে হবে। আমার গ্রামের বান্ধবীদের কাছে আমি ছিলাম , ধনীলোক। আমায় বাড়ি থেকে টাকা দিতো বলে। আমাদের , ছোটদের থাকতো পূজোর প্রতিটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা। আর মা ও মাসীদের, ভারতী মাসী ও আরতি মাসীদের বাড়িতে যাওয়া আর জমজমাট গল্প।

পুজোর দিনগুলোতে টিউবলাইটের নিয়ন আলোতেও দেখতে পেতাম চেনা, অচেনা মুখগুলোতে খুশির ঝলকানি। এক পোয়া জিলিপি আর আড়াইশো মিহিদানা এই দুটো ছিলো মাস্ট বাই এর লিস্টে প্রথম দিকে। আমার পাড়ার কারো বাড়িতে তখন মূল ফটক বা দরজা ছিলো না। একটা বাড়িতে ঢুকলে ,সব বাড়ি বেড়িয়ে পাড়ার শেষ বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যেত। হাটখোলা মন। খিড়কি, দরজা বিহীন। ঠাকুর দেখে ফিরলেই আমার নানীর প্রথম প্রশ্ন, কী আইনছেন মোর তানে?(কী এনেছিস আমার জন্য)। তাই জিলিপি আর মিহিদানা। তখন এত জান্নাতে যাওয়ার অভিধানের বাড়াবাড়ি ছিল না। জান্নাতের সঠিক রাস্তা কী হবে, এই নিয়ে উত্তপ্ত বাতাসে মসজিদগুলো গরম ছিলো না। তাই আমার সত্তর বছর বয়স্ক নানি যেমন ঈদে ঈদী দিতেন, দুর্গা পুজোতেও বরাদ্দ থাকতো আমাদের জন্য, "ঠাকুর দেখিবার পাইসা।" কেউ বলেনি তখন, "ঠাকুর দেখিবার যামো" এই কথাটি হারাম।

ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা হতো, হরিসভার মাঠে। সেই প্রতিযোগিতায় নাম ঘোষণা হতো মাইকে। তখন আমার অনেক গ্রামের বান্ধবীর নাম শুনতে পেতাম। বেমানান মনে হয়নি কোনোদিন। পুজো সবার এটাই জানতাম, এখনও জানি।

গ্রামের হাটগুলোও তখনও এত ম্রিয়মাণ হয়ে যায়নি। বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি- এর ট্যাগ লাইনের ফাঁদে তখনও আমরা পা দিইনি। বিশ্বকর্মা পুজো থেকে আস্তে আস্তে শুরু হতো কাপড়ের দোকানে ভিড়। ষষ্ঠীর আগে অব্দি চলতো। মোবাইলের স্ক্রিনে তখন ভেসে উঠতো না জামা, জুতোর ছবি। জামা হাতে ধরে, সুতি নাকি পলিয়েস্টার , এই নিয়ে এক প্রস্থ বাক্যবিনিময় করে, পাকা খরিদ্দার আমাদের বাবারা জামার দরদাম করতেন। ম্যানিইকুন দামের ট্যাগের ফাঁস ঝুলিয়ে উদাসীন দাঁড়িয়ে থাকতো না তখন। নতুন জামা বালিশের পাশে রেখে ঘুম, স্বপ্ন লেপ্টে নতুন জামার গন্ধে। এড টু কার্ট অথবা বাই নাউ এই শব্দগুলো এখন খেঁকিয়ে হাসে ছোট দোকানদারদের দেখে। আর বড়, দৈত্য মলগুলো বন্ধ হতে বসা "কাপড় হাটি" গুলোর অন্ধকার মুছে দেয় আলোর রোশনাই - এ।

রেজ্জাক মামার ভ্যান ছিলো আমাদের রিজার্ভ করা। নবমী আর দশমী গ্রামের পুজো, দশমীর পরের দিন ভাণ্ডানী মেলা, তারপর কালী পুজোর মেলা দেখে তবেই শেষ। টিউব লাইটের আলো থেকে বেরিয়ে যখন বাড়ির দিকে ফিরতাম , মনে মনে আউড়াতাম, আসছে বছর আবার হবে।
এভাবে বছর জমতে জমতে একদিন চুল পেকে গেলো। টিউবলাইটগুলো খসে গিয়ে বড় বড় লাইটিংয়ের গেট হলো। অনেক দূর থেকেও দেখতে পাওয়া যায় পূজোর আলো।
সেই আলো কি আলোকিত করছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে চলা অন্ধকারকে? পাড়ায় খিড়কি হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে লোহার গেট। আমার বন্ধুর স্ট্যাটাসে জ্বলজ্বল করে, হিন্দু খতরে মে হ্যায়। আমার মেয়ে জিজ্ঞেস করে, মা আমার বান্ধবী বলেছে পুজো আমাদের না, পুজোয় যাওয়া হারাম। হারাম কী মা?

আমি গল্প শোনাই আমার মেয়েকে। বলি পূজোর মেলা থেকে এবার আমরা আলো কিনবো। সেই আলো দিয়ে আমরা সবাই বসে মাল্টিপ্লিকেশন শিখব। হ্যাঁ আমার মেয়ে গুণ বলেনা, তাঁর বান্ধবীরাও জানেনা গুণ কী! আমি শোনাই আমার নানার(মায়ের বাবা) কথা আর তাঁর বন্ধু ক্ষেত্রমোহন চৌধুরীর কথা। শুক্রবার আর বৃহস্পতিবারের হাটের কথা। হাটের সওদার কথা। নাড়ুর গল্প আর জীবনের গল্প।

গল্প কি বাঁচিয়ে রাখে আমাদের? ডাস্টার মুছে ফেলছে সব গল্পকে।আমার গল্পগুলোও ঢেকে দিচ্ছে। আমি দেখতে পাই সব যেন দলা পাকিয়ে ফিরে আসছে পেটের মধ্যে,  গলার স্বর আরো উঁচু করি।
যা বলছি আমার মেয়ে তা শুনতে পাচ্ছে তো? জানি না।

ভোরবেলা মেয়ে ডেকে তোলে, মা ঐ শোনো ঢাকের সুর। আজান হচ্ছে, টিভিটা চালাও। মহালয়া দেখবো।
আশ্বস্ত হলাম। গল্পগুলো পৌঁছচ্ছে সঠিক ঠিকানায়।

ছবি ঃ পার্থ দাশগুপ্ত

0 Comments

Post Comment