পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উত্তর কাশীতে সুড়ঙ্গতে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিকের কথা কে ভাবছে?

  • 20 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 816 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন ভট্টাচার্য
কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে, আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে শেষ হলো ২০২৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট। সারা প্রতিযোগিতায় ভাল খেলেও ভারতের ১১ জন ক্রিকেটার পরাজিত হলেন, তবুও তাঁরা পেলেন বাহবা, কোটি কোটি টাকা। কিন্তু ভারতের ৪১ জন শ্রমিক যে উত্তর কাশীতে সিল্কায়ারা সুড়ঙ্গ কাটতে গিয়ে আটকে রয়েছেন, তাঁদের জন্য কি আমরা প্রার্থনা করেছি? দেশের জন্য টানেল কাটতে গিয়ে আটকে পড়া শ্রমিকরা, যাঁদের সুড়ঙ্গয় আটকে পড়ার পর বেরিয়ে এলে পরে নিজেদের পারিশ্রমিকের বাইরে এতটুকু বেশি পয়সা পাবেন কিনা তাও কেউ জানে ?

ওঁরা ৪১ জন। ওঁরাও ভারতীয়। এবং ওঁরাও প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ‘চারধাম রাস্তা প্রকল্প’-এর জন্য কাজ করতে গিয়েছিলেন। এবং দীপাবলির রাত থেকে আটকে রয়েছেন এক টানেলের ভিতরে। কিন্তু ওই ৪১ জনের জন্য কোনও প্রার্থনা নেই, টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে কোনও তারকাদের বিবৃতি নেই, এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও রবিবার যখন নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে ট্রফি দিতে পৌঁছেছিলেন, তখনও  ওই হতভাগ্য ৪১ জনের জন্য কোনও শব্দ উচ্চারণ করেননি| সোমবার সকাল পর্যন্ত উত্তর কাশীতে সিল্কায়ারা সুড়ঙ্গ কাটতে গিয়ে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিকের ভাগ্যে শুধুই অনিশ্চয়তা আর তাঁদের পরিবারের জন্য সরকারি তরফে প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই নেই।

বিশ্বাস করুন, ওঁদের জন্য কিছুই নেই। গ্যালারিতে তারকারা নেই, যদি টানেল দিয়ে ওঁরা বেরিয়ে আসতে পারেন তাহলে গলায় মালা পরানোর জন্য কোনও তারকা কন্যাও নেই। ট্রফি হেরে গিয়েও আমাদের ক্রিকেটাররা প্রত্যেকে হয়তো কয়েক কোটি করে টাকা পাবেন, কিন্তু দেশের জন্য টানেল কাটতে গিয়ে আটকে পড়া শ্রমিকরা, যাঁদের সুড়ঙ্গয় আটকে পড়ার পর ৮ দিন অতিক্রান্ত, তাঁরা বেরিয়ে এলে পরে নিজেদের পারিশ্রমিকের বাইরে এতটুকু বেশি পয়সা পাবেন কিনা তাও কেউ জানে না। যদি অবশ্য ওঁরা সবাই নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন!

চারদিকে যখন ছটপুজোর আমেজ, তখনও বিহারের পুষ্কর তাঁর ভাই বিক্রমকে, যে ভাই আটকে পড়া অন্য ভাইয়ের উদ্ধারের জন্য ওই টানেলের বাইরে পৌঁছে দিয়েছিল, সে শুধু একটা কথাই বলেছেন যে, দেশে থাকা মা যেন জানতে না পারেন সন্তান কোথায় আটকে রয়েছে। বিক্রম, বড় ভাই তাঁর পঁচিশ বছরের ছোট ভাইকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি। খবর ঠিকই দেশে এসে পৌঁছেছে। এবং এই উৎসবের আবহেও বিক্রম-পুষ্করদের ঘর নিষ্প্রদীপ। চারপাশের সমস্ত প্রচার, বিশ্বকাপ নিয়ে যাবতীয় উচ্ছ্বাসের মাঝে জানিয়ে রাখা ভালো, যে ৪১ জন উত্তর কাশীর ওই নির্মীয়মান সুড়ঙ্গের ভিতরে আটকে রয়েছেন, তাঁদের কোনও দিন মহম্মদ শামির মতো ‘দেশদ্রোহী’ তকমা পেতে হয়নি। তবু প্রচারের সার্চ লাইট থেকে অনেক দূরে ‘ঈশ্বরের ধাম’-এ পৌঁছে দেওয়ার জন্য যাঁরা সুড়ঙ্গ কাটছিলেন তাঁদের উদ্ধারের জন্য আপাতত ঈশ্বরই ভরসা।

আরও জানিয়ে রাখা ভালো ২০২১-এ হঠাৎ আসা হড়পা বানে তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার সুড়ঙ্গে যে ২০৪ জন চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশের নিকট আত্মীয়রা এখনও কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি। ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ সংক্রান্ত বিবাদে মীমাংসা না হওয়ার কারণেই ওই হতভাগ্য পরিবারগুলির এহেন ঝুলে থাকা! আর সোমবার পর্যন্ত যাঁরা উত্তর কাশীর সুড়ঙ্গের ভিতরে আটকে পড়েও বাঁচার জন্য আকুল লড়াই চালাচ্ছেন, যাঁদের আত্মীয়রা  উদ্ধার কার্যে দেরি হওয়ার জন্য বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখিয়েছেন, তাঁদের কী হবে? প্রথম ড্রিলিং মেশিনটি আটকে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ড্রিলিং মেশিনটি কখন প্রত্যাশিত উদ্ধারের কাজ করে দেখাবে সেই ভরসায় বসে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

ক্রিকেটারদের জন্য হাজারো প্রার্থনা, লক্ষ লক্ষ শুভেচ্ছাবার্তা, কোটি মানুষের চোখ গুজরাটের প্রধানমন্ত্রী নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামের দিকে ছিল। তখন কতজন আমরা খেয়াল রেখেছিলাম ৪১ জন ভারতীয় আটকে রয়েছেন এই ভারতেরই অন্য এক প্রান্তে? সাধারণত যে দীপাবলিতে গোটা দেশ উৎসবে এবং ছুটিতে মেতেছিল, সেই সময় ওই ৪১ জন নিজেদের কর্তব্যের খাতিরে সুড়ঙ্গ কাটতে ঢুকেছিল। মনে রাখা ভালো, যে ‘চারধাম রাস্তা প্রকল্প’-এর জন্য এই যে কাজ তাঁরা করছিলেন তারও প্রকল্প খরচ প্রায় ৯০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু কতটা সতর্কতা, নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য কতটা ভাবনা চিন্তা ছিল? বিশেষজ্ঞরা ইংরেজি সংবাদপত্রে বিরাট বিরাট লেখা লিখেছেন, কোনও বিকল্প পথ বা ‘এক্সিট রুট’ না রেখেই এই ধরনের সুড়ঙ্গ কাটতে যাওয়ার পরিকল্পনা ভাবাই যায় না। বিশেষজ্ঞদের এই হাহুতাশ কিংবা সুরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যর্থতা কি সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য কোনও সুরাহার পথ দেখিয়েছে? না। নরেন্দ্র মোদির ‘ড্রিম প্রজেক্ট’, হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এই ‘চার ধাম’-এ পৌঁছোনোর জন্য উত্তর কাশীতে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা, সেই প্রধানমন্ত্রীও কি গত ৮ দিনে একবারও উত্তর কাশীর সুড়ঙ্গের সামনে পৌঁছে উদ্ধার কাজ তদারকি করার কথা ভেবেছেন? উত্তর কাশী নিশ্চয়ই মণিপুর নয়, যে সেখানে যাওয়ার ঝুঁকি প্রধানমন্ত্রী নিতে পারেননি! তাহলে ৪১ জন ভারতীয় কর্তব্যপরায়ণ শ্রমিকের প্রাণের মূল্য, সুরক্ষার মূল্য কি আমাদের কাছে কানাকড়িও নেই?

প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার এবং বর্তমানে আপের তরফে রাজ্যসভার সাংসদ হরভজন সিং ছাড়া আর কেউ উত্তর কাশীতে আটকে পড়া শ্রমিকদের নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বলে এখনও পর্যন্ত কোনও খবর নেই। কোনও ক্রিকেটার কিছু বলেননি, সেলুলয়েডের তারকারা, এমনকি যাঁরা বিগত দিনের ব্যর্থ তারকা ডেভিড বেকহ্যামের পাশে দাঁড়িয়ে সহাস্যে ছবি তুলেছেন, তাঁরাও ৮ দিন ধরে আটকে থাকা ৪১ জন ভারতীয় শ্রমিকের বিষয়ে কিছু জানেন বলে মনে হয় না। ‘গোদি মিডিয়া’ যারা সর্বক্ষণ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের খাস তালুকে, জয় শাহের ব্যবস্থাপনায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত দেখিয়েছে, বলিউডের ৮০ পেরোনো সুপারস্টার থেকে টলিউডের রিল বানানো টেলিভিশন স্টার সকলেই যত শব্দ ব্যয় করেছেন ১১ জন ভারতীয় ক্রিকেটারের জন্য, তার এক ভগ্নাংশও বরাদ্দ নেই ওই হতভাগ্য ৪১ জন শ্রমিকের জন্য। এই না হলে নরেন্দ্র মোদিদের ‘অমৃতকাল’!

0 Comments

Post Comment