সুধী পাঠক নিশ্চয় জানেন ও মানেন যে, আজকাল উৎসবকালে, তা সে ধর্মীয় উৎসব হোক কিংবা জন্মদিন, বিয়ের অনুষ্ঠান, নিদেনপক্ষে ক্রিকেট-ফুটবল যাই হোক, শহর-গ্রাম সব জায়গা তীব্র আওয়াজে ভরে গেছে? উৎসব মানেই যেন ডি.জে.বক্স, সারাদিনরাত কানফাটানো মাইক, দিনরাতভর শব্দবাজি, মোটরবাইকের পিলেচমকানো গর্জন। এই সমস্ত কিছুই নির্বিবাদে হয়ে চলেছে উৎসব আর বছরে ‘একটা দিন’ আনন্দের নামেই। কিন্তু এই "উৎসব" এই “আনন্দ” আমাদের কানে শুধু নয়, হৃদয়েও ব্যথা জাগায়।
অথচ কোন কুসংস্কার, ক্ষতিকারক অভ্যাস, বা ধর্মের নামে–উৎসবের নামে দেশজোড়া এক লাগামছাড়া মাতামাতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করলেই মানুষ খুব দ্রুত ব্যক্তি-আক্রমণে নেমে পড়েন। দেশজুড়ে সুচিন্তিতভাবে সংস্কৃতিটাই সেই রকম সুরে বেঁধে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিককালে।
এইভাবে বছর জুড়ে একের পর এক পূজা-পার্বণ, উৎসবে-হুল্লোড়ে আমরাও মেতে উঠব –দড়াম চমাক শব্দে দেদার বাজি ফাটবে, মাইক, কোথাও বা ডিজে বাজবে তারস্বরে। বয়স্কদের হার্টের ধুঁকপুকানি বাড়বে, বাড়বে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, লাগামছাড়া হবে বায়ুদূষণ। বাড়িতে নবজাতক সহ আদরের পোষ্য কুকুর বেড়াল শব্দের তাণ্ডবে ছটফট করবে। শব্দদূষণ শুধু কানে যন্ত্রণা দেয় তাই নয়। এটি রক্তচাপ, নিদ্রাহীনতা, মানসিক চাপ, এমনকি শিশু ও বয়স্কদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আমাদের স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা পড়তে পারে না, অসুস্থ মানুষ বিশ্রাম পায় না, কর্ণকুহরে তালা পড়ে,
বাড়ির পোষ্যরা ভয়ে অভিমানে কুঁকড়ে থাকে, পাখিরা ভয় পেয়ে হারিয়ে যায়। এ কেমন উৎসব, যেখানে প্রকৃতির সুর হারিয়ে যায় শব্দের তাণ্ডবে, শিশুদের কল-কাকলি ঢাকা পড়ে শব্দাসুরের দাপটে?
আসলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব শুধু ধর্মীয় অনুসঙ্গেই টিকে থাকে না, বরং তা সর্বব্যপ্ত নানা সামাজিক- সাংস্কৃতিক চর্চায়, যাপনে। আর তাই যুক্তিবাদীদেরও বহু আচরণই এই ধরণের ধর্মীয় সংস্কৃতির অবশেষ বহন করে। কখনও জনসংযোগের, কখনও বা সৌজন্য রক্ষার বাস্তব প্রয়োজন থেকে। বিপদটা হয় তখনই যখন এইসব নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজনীয়তা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, বহু মানুষ ধর্মবিশ্বাসী এই যুক্তিতে। নতুন সংস্কৃতির আবাহন আর হয়ে ওঠে না। নতুন ভাবনা, নতুন সংস্কৃতির কিছু উদাহরণ কিন্তু দেশজুড়েই দেখা যাচ্ছে। দেশকাল আর সময়ের নিরিখে তার নবতম নির্মাণও জরুরি। রবীন্দ্রনাথ থাকবেন সামনে।
রবীন্দ্রনাথ আতশবাজির ঝলককে দেখেছিলেন মানুষের অস্থায়ী উল্লাস ও ভোগবিলাসী সভ্যতার প্রতীক হিসেবে। এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন –
“মানুষের আনন্দ যেন হাউইয়ের মতো—একবার আকাশে উঠে চমক দিয়ে নিভে যায়।” এখানে “হাউই” মানে হলো আলোকের আকস্মিক বিস্ফোরণ, যা মুহূর্তের মধ্যে ফুরিয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের ভোগবিলাস বা বাহ্যিক সাফল্যও তেমনই ক্ষণস্থায়ী। আসলে বাংলা সাহিত্য শুধু ভাবের নয়, ভাষারও শিল্প। তাই কবি ও সাহিত্যিকেরা শব্দকে খেলায় রূপ দিয়েছেন। আলোর প্রতীকে তাঁরা দেখেছেন জ্ঞান, প্রেম ও মুক্তির দীপ্তি।
এইভাবে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে “শব্দবাজি” ও “আলোর বাজি”র এক অপূর্ব মেলবন্ধন। হায়রে রবীন্দ্রনাথ, হায়রে বাংলা সাহিত্য শিল্প। শব্দের ও আলোর বাঙ্ময় কালের স্রোতে পাল্টে গেছে গগনভদী শব্দবাজি ও বোমার দাপাদাপিতে। আলো যেন হারিয়ে গেছে বিষাক্ত এক অন্ধকারের গর্ভে।
কেন শব্দবাজি ও আতশবাজি প্রাণ প্রজাতির পক্ষে বিষময়?
সকল বাজির ধোঁয়াই বাতাসে ভাসমান বিষের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। বিষাক্ত ধোঁয়া ফুসফুসের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। এর ফলে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট সহ ফুসফুসের বারোটা বাজানোর জন্য নিত্যনতুন রোগ অসুখের পাশাপাশি মস্তিষ্কে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। শব্দের দৌরাত্মে কানের পর্দা ফেটে চিরতরে বধির হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। তীব্র আলোর ঝলকানিতে এলার্জি এমনকি চোখের রেটিনার ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও হঠাৎ করে মাত্রাতিরিক্ত শব্দে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে, ভ্রূণ যে জলীয় আবরণে নিরাপদে থাকে, তা ফেটে গিয়ে গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে। হৃদরোগে আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তিদের এই কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও দেখা দিতে পারে মানসিক বৈকল্য। এটা বাস্তব সত্য যে, দীপাবলির পর ডাক্তারদের চেম্বারে চেম্বারে এইসব সমস্যায় আক্রান্ত শিশু বয়স্কদের ভিড় বেড়ে যায়। পশুপাখিরাও বিপন্ন হয়। বিশেষ করে কালীপূজা-দীপাবলির পর পর বহু পাখির মৃত্যু সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আমরা ভীত আতঙ্কিত হই। ‘আসছে বছর আবার হবে’ স্লোগানে মানুষ অপেক্ষা করেন পরবর্তী উৎসবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও, আমাদের যেন কিছুতেই হুঁশ ফেরে না।
বাজি তৈরির ক্ষেত্রে বিপদটা কেমন :
বাজি পোড়ানো বা ফাটানোর সাথে সাথে বাজি তৈরিও পরিবেশ আর মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ডেকে আনে। বাজি তৈরিতে প্রচুর শিশুশ্রমিকদের বেআইনি ভাবে কাজে লাগানো হয়। বাজির বারুদ তাদের উপহার দেয়
বিভিন্ন চর্মরোগ সহ পেটের গন্ডগোল। নিরপরাধ শিশুগুলোর চোখও আক্রান্ত হয়। শ্বাসের সঙ্গে বারুদের বিষ ফুসফুসে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয় ফুসফুসের। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে প্রচুর মহিলা কর্মীদেরও স্বল্প মজুরিতে নিয়োগ করা হয়। বাস্তবত বাজি কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের কোনরকম সামাজিক নিরাপত্তা থাকে না। বাজি কারখানায় নানাবিধ দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর বছরভর দেশজুড়েই সংবাদ মাধ্যমের খবর হয়ে ওঠে। বাজি ব্যবহারের ফলে যে বিভিন্ন রাসায়নিক ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয় তা জল, বাতাস ও মাটিকে ভয়ঙ্কর ভাবে দূষিত করে। শেষ পর্যন্ত যা উদ্ভিদ ও সমগ্র প্রাণীজগতের জন্য ভয়ানক বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসে।
যখন আমরা বাজি পুড়িয়ে, ফাটিয়ে আনন্দে মাতি, তখন বাজির ধোঁয়ায় আমাদের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যায় বাজি কারখানায় শিশু শ্রমিকদের নিষ্পাপ মুখগুলো। হুল্লোড়ে চাপা পড়ে যায় এমনকি নিজেদের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সংকটের কথাও। প্রকৃতি পরিবেশের দূষণ নিয়ে ভাবনা? সে তো অযুত যোজন দূরে! তাই নিজেরা সচেতন হয়ে বাজির ব্যবহার বন্ধ না করলে, আইনি, বেআইনি, সবরকম ভাবেই বাজি তৈরি চলতেই থাকবে। চালু থাকবে সব দিক থেকে প্রাণঘাতী এই ‘শিল্প’। চলতেই থাকবে মানুষ সহ সমগ্র প্রাণের বিপর্যয়। সরকার ও নীতি নির্ধারকরা যখন উদাসীন থাকে, তখন নিজেদের ভালোমন্দ নাগরিককেই বুঝে নিতে হয়। তাই আমাদের আনন্দের সঙ্গে মিশে থাক একটু দায়িত্ব। আমাদের প্রত্যেকের সজাগ সচেতন চোখ আর মন আমাদের চারপাশের পরিবেশকে এখনও অন্যরকম করে তুলতে পারে। আসুন, আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে বাজি-বর্জিত উৎসবে বেঁচে থাকার শপথ নিই।
সামাজিক স্তরে ও প্রাণ প্রকৃতির জগতে ব্যারাম :
বাজির দাপাদাপি, আলোর তীব্র ঝলকানি, শব্দের তীব্র চমকানি, প্লাস্টিক বর্জ্যের ছড়াছড়ি, বিষাক্ত রঙিন খাবারে স্বাস্থ্যহানি – প্রবল দূষিত এই স্রোতের বিপরীতে উজান বেয়ে জনগণের বিকল্প উৎসব ও সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের অতি প্রিয় নাতি নাতনিদের জন্য একটা নির্মল আকাশ, একটা সুস্থ পরিবেশ, একটা সুন্দর ভালোলাগার সংস্কৃতি উপহার হিসেবে রেখে যাওয়ার জন্য এ ছাড়া আর অন্য পথ কোথায়? প্রকৃতির সন্তান প্রতিটি মানুষকে প্রকৃতিমুখিন চিন্তাভাবনায় জারিত হতে হবে, ভারতীয় সমাজে প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের নিজস্ব আপন আচার, পরব, সংস্কৃতিকে সামনে আনতে হবে জোরের সাথে। তাহলেই হয়ত এই গ্রহে মানব প্রজাতি টিকেও গেলেও যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, বাসযোগ্য একটাই পৃথিবী আছে, যে পৃথিবী দিনদিন কলুষিত, বিষাক্ত ও দূষিত হয়ে উঠছে।
উৎসব আজ আর আপন খাতে বয়ে যায় না। নদী নিয়ে বিধ্বংসী পরিকল্পনা নদীকে একদল মুনাফালোভী মানুষের ইচ্ছাখাতে গড়িয়ে যেতে বাধ্য করে। পরিবেশ ও প্রাণের বিনষ্টি ঘটে। সমস্ত উৎসবকে অর্থনীতির ইচ্ছায় পরিচালিত করে তেমনই বিনষ্ট করা হয় উৎসবের প্রাণময়তা। অর্থনীতির নিয়ম চেপে বসে উৎসবের স্বকীয়তায় মাথার উপর। অর্থ বিনিয়োগ ও প্রদর্শনই প্রাকশর্ত হয়ে ওঠে সাফল্যের। তাই শিশুর মুখেভাতের অনুষ্ঠান আর শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আয়োজনের ব্যবস্থাপনা, আপ্যায়ন ও আহার্যে বিশেষ পার্থক্য করা যায় না।
একদিকে আতিশয্যই আভিজাত্য বলে সামাজিক মান্যতা পায়। অন্যদিকে একছাঁচে ঢালা উপস্থাপন পায় আধুনিকতার বরমাল্য। এই পরিস্থিতিতে আধিক্য আর অপচয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে উৎসব উচ্চকিত হয় সুতীব্র চিৎকারে, প্রাণের আর্তস্বর তা ঢাকা পড়ে যায়।
এই ভয়াবহ সামাজিক ও প্রকৃতি পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে তবুও কিছু সমাজ সচেতন মানুষ, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা বারবার করেই তাঁদের যথোচিত ভূমিকা নিয়ে হাজির হচ্ছেন মানুষের দরবারে। নানান লেখা, পুস্তিকা, বই প্রকাশিত হচ্ছে। সাথে থাকছে রাস্তায় নেমে প্রচার কর্মসূচি। তবুও জনচেতনা তলানিতে। মগজে স্থবিরতার দূষণ তাড়ানোর সময় এসেছে। এটা ঠিকই যে –নিয়মকানুন, বাধা নিষেধ, আইন আদালতের কড়া ও কার্যকরী অবস্থান জল মাটি বাতাসের দূষণ কিছুটা কমাতে পারে, খানিক রাশ টানতে পারে শব্দের উৎপাতে, একটা দূর অবধি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে আমার শহর, মফস্বল অঞ্চলকে। কিন্তু ব্যাপক জনসচেতনতা এবং জনজমায়েত ছাড়া এইসব ব্যাধির নিরাময় বা আমূল পরিবর্তন নেহাতই কষ্টকল্পনা। সামাজিকস্তরের উদ্যোগ বাড়াতে সচেতনতা প্রসারের ধারাবাহিক কাজ করে যেতেই হবে। উৎসব ঘিরে এই যে এত উন্মাদনা, মাতামাতি, যা বয়ে নিয়ে আসে হাজারো ক্ষতিকারক দিক, সেই হুল্লোড়ের শুধু সমালোচনা করলেই হবেনা। বরং এর বিপরীত সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হবে। যেমন নববর্ষ উৎসব, বৃক্ষরোপণ উৎসব, কৃষক ভাইদের সম্মান জানিয়ে নতুন শস্যকে আদরে বরণ করে নেওয়ার নবান্ন উৎসব, প্রকৃতির উপাদানকে পূজা তথা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের লোকায়ত পরব, গ্রামীণ মেলা, স্থানীয়ভাবে তৈরি কুটির শিল্পের সামগ্রী ও লোকসংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে মেলা, বইমেলা, জৈব খাদ্যের মেলা, পিঠেপুলির মেলা, ইত্যাদিকে উৎসাহিত করা, আয়োজন করা ও তাতে নিজেদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অনেক বাড়াতে হবে। এইসব উৎসবে প্রচুর মানুষের অন্ন সংস্থান যেমন হবে, পাশাপাশি প্রচুর মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারবেন অন্তরের ভালোলাগা ভালোবাসা সহ তাঁদের সামগ্রী ও লোকসংস্কৃতি বা গ্রামীণ সংস্কৃতি নিয়ে। শহরেও এই ধরনের উৎসব করা সম্ভব। যেখানে গান বাজনা, নাটক, কবিতা ও শিল্পসামগ্রী নিয়ে মনের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারবেন স্থানীয় নাগরিক। সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে নিয়ে এই ধরনের মেলা বা উৎসবের কিছু উদাহরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, সেখান থেকে রসদ নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
আইন ও আইন না মানার খেলা:
আতসবাজির ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল কেবল মাত্র কালী পুজোয়, দেওয়ালিতে সন্ধ্যা ৮টা থেকে রাত্রি ১০টা পর্যন্ত, ছট্ পূজায় সকাল ৬টা থেকে ৮টা, আর বড়দিন ও বর্ষবরণের রাতে ১১:৫৫ থেকে ১২.৩০ মিনিট পর্যন্ত কেবলমাত্র সবুজ বাজি ব্যবহার করা যাবে। কোন রকম উচ্চ আওয়াজের বাজি ব্যবহার নৈব নৈব চ। ২০২২ সালে হাইকোর্টও রায় দেয় –কলকাতার বাজি বাজারেও কেবল মাত্র সবুজ বাজিই বিক্রি করা যাবে। যদিও সবুজ বাজির রসায়ন নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠে গেছে। যেখানে একটি শব্দবাজি ফাটলে প্রায় ১৬০ ডেসিবেল আওয়াজ হয়, সেখানে সবুজ বাজিতে আওয়াজ হয় মোটামুটি ১১০ ডেসিবেল। শরীর স্বাস্থ্য, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ বিষাক্ত দূষিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ফারাক রইলো কি? আর বাস্তবে কয়টি কারখানায় এই তথাকথিত সবুজ বাজি নিয়ম কানুন মেনে হয়, সেই নিয়েও রয়েছে প্রচুর ধোঁয়াশা। এই প্রহেলিকা ভেদ করলে দেখা যাবে গ্রীনবাজি একটি বৃহদাকার ভাঁওতাবাজি। বাজার ধরার আর এক কৌশল। আমরা জানি আইন আছে। আইন ভাঙ্গার প্রবণতাও বাড়ছে কী সামাজিক, কী রাজনৈতিক সর্বস্তরে। আইন না মেনে চলাটাই রাজনৈতিক দল, নেতা মন্ত্রী সান্ত্রী সহ জনগণের একটা অংশের জন্য দস্তুর।
শিল্পী নিরুপম ঘোষ (শিল্প বিতান, নৈহাটি)
অত:কিম ?
সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরের সাথে সাথে প্রাণ প্রকৃতির ভয়ঙ্কর দূষণ আর বিপর্যয়ের উল্টো পথে হেঁটে প্রতিরোধে সামিল হচ্ছেন বেশকিছু সমাজ সচেতন মানুষ ছোটবড় জমায়েতের মধ্যে দিয়ে। এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলো সংখ্যায় কম হলেও বাড়ছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই জমায়েতের সামনের দিকে থাকছেন মহিলা ও ছাত্র-যুবা বাহিনী। তাঁরা শুধু প্রতিবাদই করছেন না, বরং গড়ে তুলতে চাইছেন পচাগলা বিকৃত জীবনের কদর্যতার বিরুদ্ধ সংস্কৃতি। মানবিক সংস্কৃতি, মানবতার সংস্কৃতি যা মানুষ ছাড়িয়ে সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ থেকে জল-মাটি-বাতাস হয়ে আকাশের প্রতি ভালবাসায় প্রসারিত। গরলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই সংস্কৃতির সুধা আমাদের মাতাল করুক।
আসুন, আমরা একটু থামি। একটু ভাবি।
উৎসব করি, কিন্তু মানুষের শান্তি আর পরিবেশের বিঘ্ন ঘটিয়ে নয়। মাইক্রোফোন বাজুক, কিন্তু নীচু স্বরে। আমরা একটু ‘অমায়িক’ হয় না কেন! সকাল-রাতে নিয়ম মেনে তা বন্ধ রাখি। আইনবিরোধী ডি জে নয়, শব্দবাজি নয়। শব্দদূষণ বিরোধী আইন আমাদের শত্রু নয় –এটি আমাদের শান্তি, সহাবস্থান ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার রক্ষাকবচ। যে নাগরিক এই আইন মানে, সে শুধু নিয়ম মানে যে তাই নয় –সে সহানুভূতি ও সহযোগিতার বন্ধনে শহরকে সুন্দর রাখে। গা-জোয়ারী আইন-অবাধ্যতা মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয় হয়তো, কিন্তু মনে নেয় না।