পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কেন আমরা ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা সমর্থন করব?

  • 18 January, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 719 view(s)
  • লিখেছেন : মানস ঘোষ
ফ্যাসিবাদী শক্তির মেরুকরণের ক্ষমতা অনেক বেশি। একটাই উপায় ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মতাদর্শকে সোচ্চারে সাহসের সঙ্গে জনগণের মধ্যে নেমে প্রচার করা। আপাতদৃষ্টিতে প্রাথমিকভাবে এই কাজটাকে পন্ডশ্রম মনে হতে পারে কিন্তু এটাই একমাত্র উপায়। মনে রাখতে হবে জার্মানীতে হিটলারের সামনে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার প্রধান কারণ তারা মতাদর্শের সঙ্গে আপোষ করে কেবল কৌশল দিয়ে বাজি মাত করতে চেয়েছিল। ইটালীতে কিন্তু সেরকম হয়নি, ইটালীর কমিউনিস্ট পার্টি মার খেয়েও মতাদর্শগত আপোষ করেনি। সেই কারণেই রাহুল গান্ধীর এই লড়াই সমর্থনযোগ্য।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন না অযোধ্যায় যেভাবে কোর্ট মন্দিরের পক্ষে রায় দিল এবং  মসজিদকে নস্যাৎ করে দিল তা ইনজাস্টিস?

উত্তরঃ আপনি কেন সরকারের কাছে জাস্টিস চাইছেন? 

প্রশ্নঃ একজন তো সরকারের কাছেই জাস্টিস চাইতে যাবে, তাই না?

উত্তরঃ এই সরকারের কাছে আপনার তা প্রত্যাশা করা উচিত নয়। যারা সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষককে  সংস্কারি আখ্যা দিয়ে  মুক্তি দেয় তাদের  মনোভাব বুঝতে  আমাদের আর বাকি থাকে না। এদের কাছে জাস্টিস চাইবো কেন?  যদি আমাদের কোর্ট এবং সরকার সংবিধানকে সঠিকভাবে এবং সৎভাবে ব্যবহার করে তাহলে এদেশে অপরাধের সংখ্যা শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু যদি কেউ সংবিধানকে ইমপ্লিমেন্ট করব না মনে করে তাহলে আর কি করার আছে?  মানুষ এক টেবল থেকে আর এক টেবলে দৌড়োবে, আর তো কিছু হবার নয়! গত দশ বছরে কেউ জাস্টিস পেয়েছেন এদেশে? পাঁচ ছটা গুরুত্বপূর্ণ কোর্ট কেসের উদাহরণ দেখুন। কোথায় জাস্টিস পাচ্ছেন আপনি?

কে বলছেন এইসব কথা? – কোনো আর্বান নকশাল? ইন্ডিয়া জোটের ভোটপ্রার্থী? মানবাধিকার কর্মী? না, কথাগুলি বলছেন যিনি তাঁর নাম রাজেন্দ্র প্রসাদ তিওয়ারি। তিনি কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রাক্তন মহন্ত। তিনি বলছেন, ধর্ম বলতে আমি যা বুঝি তার মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা’র স্থান নেই। […] চাঁদের উপাসনা হিন্দুও করে মুসলমানও করে। একই নদীর জল সকল জাতির মানুষ ব্যবহার করে। আমি যাকে ‘প্রত্যক্ষ ঈশ্বর’ বলে মানি সেখানে সকলেই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। […] কিন্তু আজকাল দেখছি ধর্ম বলতে ব্যক্তির আধিপত্যকে বোঝানো হচ্ছে। মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে একটা অতি-সক্রিয় প্রোপাগান্ডা মেশিনারির মাধ্যমে ধর্মের নামে সমাজে বিষ ছড়ানো হচ্ছে। সমাজে বিকৃতি ছড়ানো হচ্ছে।

কথাগুলি রাজেন্দ্র প্রসাদ তিওয়ারি বলেছেন নিউজ ক্লিক’এর সাংবাদিক প্রয়াগ সিংকে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে ৬ ডিসেম্বর ২০২৩। কে জানে এই অপ্রিয় সত্যগুলো বলার জন্য তাঁকে কি মূল্য দিতে হবে! যদিও তিনি একা নন, চার শঙ্করাচার্য-সহ বেশ কয়েকজন মঠ-প্রধান আরএসএস ও বিজেপি’র ২২শে জানুয়ারির রামমন্দির কর্মসূচির বিরোধিতা করেছেন। পুরীর শঙ্করাচার্য তো সরাসরি বলেছেন, একজন প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ সংবিধান মেনে কাজ করা, ধর্মগুরু সাজা তার কাজ হতে পারে না। সেটা গণতন্ত্রে মানায় না। কিন্তু কে কার কথা শোনে!

আশ্চর্যের বিষয় এইসব কথাগুলো রাজনীতিকদের বলার কথা ছিল। অথচ হচ্ছে উল্টোটা। পবন খেরা থেকে মমতা ব্যানার্জি যা বলে বেড়াচ্ছেন তা আসলে ধর্মের যুক্তি। রাজনীতির যুক্তিতে কথা বলার সাহস তাঁরা পাচ্ছেন না। আর সংবিধান, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের কথাগুলো বলতে হচ্ছে ধর্মগুরুদের। এদেশের লিবারাল রাজনীতিতে এই মুহূর্তে একজনমাত্র রাজনীতিবিদ সংবিধান, গণতন্ত্র ও ন্যায়কে সামনে রেখে বড় একটা কর্মসূচী শুরু করেছেন – তিনি রাহুল গান্ধী। কথাটা শুনতে ভালো লাগুক না লাগুক এটা সত্যি। রাজনীতিতে এথিক্স কাজ করে মূলত ন্যায়ের ধারণার মাধ্যমে। সংবিধান ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রতিজ্ঞা হল, সকলের জন্য ন্যায় বা জাস্টিস ফর অল। রাহুল গান্ধীর কৃতিত্ব হল তিনি সেই প্রতিজ্ঞাটিকে সামনে রেখে ৬,৫০০ কিমির যাত্রা শুরু করেছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ৪,৫০০ কিমি’র ভারত জোড়ো যাত্রা’র বড় সাফল্য তাকে প্রেরণা যুগিয়েছে সন্দেহ নেই।  

আজকের দিনে যখন সবাই ভোট লড়ছে কৌশলের উপর সেখানে রাহুল গান্ধী জোর দিচ্ছেন ন্যায় ও নীতির ওপর, এটা লক্ষ্য করার মতো বিষয়। মারি অরি পারি যে কৌশলে তিনি আস্থাবান নন। তিনি ন্যায় ও দেশের অখন্ডতাকে সামনে রেখে পথ হাঁটছেন। এইরকম রাজনৈতিক সদিচ্ছা অনেকদিন ভারতের রাজনীতিতে অনুপস্থিত ছিল। তাঁর রাজনীতিতে নীতিকে কৌশলের উর্ধে স্থান দেওয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করে অনেকে তাকে গান্ধীজী’র সঙ্গে তুলনা করছেন। ঘৃণা’র উপরে ভালোবাসার স্লোগানও তাঁর গান্ধীবাদি মনোভাবকে স্পষ্ট করেছে। এইসব প্রশংসা বাক্যের পরও অনেকেই তাঁর প্রয়াসের সাফল্যে সন্দিহান। কারণ তাঁর ক্ষেত্রে বড় বাধা বিজেপি-আরএসএস নয়, স্বয়ং তার নিজের দল। সেদলের অধিকাংশ নেতাই মন থেকে এইসব ন্যায়-নীতির কথায় বিশ্বাস করেননা। তারা ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছে্ন। ফ্যাসিবাদ কি, তার বিপদ কতটা সেসব তাঁদের মাথায় ঢোকে বলে মনে হয়না। আসলে কোনদিনই নৈতিকতার রাজনীতির সঙ্গে এইসব নেতাদের পরিচয় ছিল না। তাঁরা আদতে ভজনলাল-বংশীলালের মত নেতাদের উত্তরসূরী, সেটা কমলনাথ ও গেহলতেদের দেখলেই মালুম হয়। দেশের মানুষ এঁদের ওপর আস্থা হারিয়েছেন। সেই আস্থা ফিরিয়ে আনার দায় একা কাঁধে নিয়ে রাহুল গান্ধী পথে নেমেছেন।

আসলে তাঁর দলের মধ্যে তো বটেই, এদেশের কৌশল-প্রধান সামগ্রিক রাজনীতিতে তিনি সবচেয়ে নিঃসঙ্গ নেতা। আপশোষের বিষয় এটাই যে তাঁর দলের যেসব প্রথম সারির নেতা তাঁর সঙ্গে দায়ে পড়ে পথ হাঁটছেন তারা মোটেই তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী নন, কিন্তু তাঁকে অস্বীকার করার উপায় নেই কারণ ভারত জোড়ো যাত্রার পরে তিনি এই মুহূর্তে বিরোধী গোষ্ঠির সবচেয়ে বড় ‘মাস মবিলাইজার’। এটা আবার বিরোধী-গোষ্ঠির মধ্যে বড় সমস্যার কারণও বটে।  যতই আম-জনতার মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হচ্ছেন ততই নীতিশ কুমার, মমতা ব্যানার্জি’র মতো মেগালোম্যানিয়াক নেতাদের তাঁকে নিয়ে সমস্যা বাড়ছে। অবশ্যই এর প্রত্যক্ষ কারণ কমলনাথ, বাঘেল, গেহলতদের মতো নেতাদের সংকীর্ণ জোট-বিরোধী মনোভাব। কিন্তু ভিতরের কারণটা অন্য। নীতিশ-মমতাদের ধারণা ছিল রাহুল গান্ধী দূর্বল নেতা, যার ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙ্গা যাবে সহজে। কিন্তু তারা দেখছেন রাহুল গান্ধী সর্বভারতীয় জননেতা হয়ে উঠছেন ফলে তাদের অস্বস্তি বাড়ছে। তবে এদের আবার ঠিক পালাবার পথও নেই। কারণ এরা তো অনেকদিন ন্যায়পরায়ণ রাজনীতি থেকে দূরে, ফলে এদের কেউ বিশ্বাস করেনা। এরা সহযোগী শক্তি হিসেবে হয়ত ওপর ওপর থাকবে কিন্তু মনেপ্রাণে চাইবে রাহুল গান্ধী যাতে সর্বভারতীয় নেতা হয়ে উঠতে না পারেন।

যে সত্যটা আর সকলে বুঝতে চাইছেন না, বা বুঝলেও সংকীর্ণ স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন তা হল, কেবল কৌশল করে ফ্যসিবাদি শক্তিকে পরাস্ত করা যায় না। ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি টাইপের বোকা বানানো রাজনীতি দিয়ে একটু-আধটু সাফল্য পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে ফ্যাসিবাদি শক্তির ক্ষতি তেমন হয়না। কারণ হল, ফ্যাসিবাদ দাঁড়িয়ে থাকে শক্ত মতাদর্শের ভিত্তির ওপর। সে মতাদর্শ যতই ভ্রান্ত হোক তার একটা র‍্যাডিক্যাল আবেদন থাকে। তাই গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে এবারে মতো ভোটটা করিয়ে নিই বললে কোনো লাভ হয় না। ফ্যাসিবাদী শক্তির মেরুকরণের ক্ষমতা অনেক বেশি। একটাই উপায় ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মতাদর্শকে সোচ্চারে সাহসের সঙ্গে জনগণের মধ্যে নেমে প্রচার করা। আপাতদৃষ্টিতে প্রাথমিকভাবে এই কাজটাকে পন্ডশ্রম মনে হতে পারে কিন্তু এটাই একমাত্র উপায়। মনে রাখতে হবে জার্মানীতে হিটলারের সামনে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার প্রধান কারণ তারা মতাদর্শের সঙ্গে আপোষ করে কেবল কৌশল দিয়ে বাজি মাত করতে চেয়েছিল। ইটালীতে কিন্তু সেরকম হয়নি, ইটালীর কমিউনিস্ট পার্টি মার খেয়েও মতাদর্শগত আপোষ করেনি। তাই তারা শেষ পর্যন্ত তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল।

আর সেখানেই রাহুল গান্ধী অনেকটা বেশি নম্বরের দাবী রাখেন। তাঁর দলের অন্য নেতারা ও ইন্ডিয়া জোটের নেতৃবৃন্দ এসব বোঝেন বলে মনে হয় না। এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম বামপন্থী দলগুলি। তারা ফ্যসিবাদের বিপদ বোঝে। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি এই যাত্রা সংগঠনের অনেকখানি দ্বায়িত্ব অর্পণ করেছেন কানাইয়া কুমারের মত বামপন্থায় শিক্ষিত নেতার উপর। তিনি বুঝেছেন, মতাদর্শহীনতা ও জনবিচ্ছিন্নতা, এই দুটি চলতে থাকলে ফ্যাসিবাদের হাতে পরাজয় অনবার্য। তাই অখন্ডতা, সম্প্রীতি, ন্যায়, গণতন্ত্রের মতো মতাদর্শগত প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখে তিনি জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের উদ্দেশ্যে পথে নেমেছেন। মানুষের মাঝে থাকা ও মতাদর্শের পতাকা উর্ধে তুলে রাখার কাজটা এখন খুব জরুরি। সেই কাজটাই রাহুল গান্ধী করছেন ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার মাধ্যমে। ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা ও সংবিধান-গণতন্ত্র রক্ষার দিক থেকে দেখলে তাঁর এই প্রয়াস সমর্থন করা উচিৎ আমাদের।

0 Comments

Post Comment