পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মাতৃবন্দনা ২

  • 22 October, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1688 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
গ্রামে ছিল বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির। বিশালাক্ষী হলেন শিবের স্ত্রী সতীর এক রূপ। সেখানে পূজার সময় বালক গদাধরের ভাবসমাধি হয়। পরে শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রাপালা হয় গ্রামে। সেখানে তিনি অভিনয় করেন শিবের চরিত্রে। অভিনয় করতে করতে তাঁর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তার পর থেকে এমন আধ্যাত্মিক চেতনা তাঁর সারা জীবন জুড়ে ব্যাপ্ত হয়। এটি হল রসের চরম এক পর্যায়। আজ সপ্তমী দ্বিতীয় পর্ব।

১৮৬১ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ এক ভৈরবীর নির্দেশনায় তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। এই ভৈরবী ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্না এবং সিদ্ধা। পরমহংসদেব তন্ত্রের ৬৪ রকমের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেন। ভৈরবীর কাছ থেকে রামকৃষ্ণকে কুমারী পূজার শিক্ষা পান। ভৈরবীই প্রথম ব্যক্তি যিনি রামকৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার ভেবেছিলেন। এই তন্ত্রসাধনা করে রামকৃষ্ণের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক কষ্টের সুরাহা হল। তন্ত্র হল ত্রাণ বা মুক্তি। কেন তাঁর কষ্ট হচ্ছিল? কেন তিনি কষ্ট থেকে ত্রাণ চাইছিলেন? সে কি ইষ্টসাধনের কষ্ট? এটির উত্তর খুঁজতে গেলে চলে যেতে হবে গদাধরের বাল্যকালে।

রামকৃষ্ণের জীবনী থেকে জানা যায়, অল্প বয়স থেকে তাঁর ভিতর নান্দনিক ভাব দেখা যায়। তিনি তন্ময় হয়ে উঠতেন। একবার গ্রামের কাছাকাছি কোনও এক ধানক্ষেতের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বালক গদাধর ঘন কৃষ্ণবর্ণ আকাশে শুভ্র বলাকা প্রত্যক্ষ করেন। সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি ভাবতন্ময় হন। বয়স বাড়লে তিনি এই অভিজ্ঞতাকে এক অনির্বচনীয় আনন্দের অভিজ্ঞতারূপে বর্ণনা করেন। বালকবেলায় আরও কয়েকবার এমন অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। তাঁর মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য। দুটিই মাতৃবন্দনার সঙ্গে যুক্ত।

গ্রামে ছিল বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির। বিশালাক্ষী হলেন শিবের স্ত্রী সতীর এক রূপ। সেখানে পূজার সময় বালক গদাধরের ভাবসমাধি হয়। পরে শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রাপালা হয় গ্রামে। সেখানে তিনি অভিনয় করেন শিবের চরিত্রে। অভিনয় করতে করতে তাঁর এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তার পর থেকে এমন আধ্যাত্মিক চেতনা তাঁর সারা জীবন জুড়ে ব্যাপ্ত হয়। এটি হল রসের চরম এক পর্যায়। রস কাকে বলে?

যা আস্বাদন করা যায় তাই হল রস। শ্রুতিতে আনন্দরূপ ব্রহ্মের চেতনা হল সর্বশ্রেষ্ঠ রস। ভক্তিশাস্ত্রে ভগবানের প্রতি ভালবাসা নিবেদনে পাঁচটি ভাব বা রসের উল্লেখ আছে। সেগুলি হল-- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। পরমহংসদেব এই ভাবগুলির অভ্যাস করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে তাঁর সেই অনাদি অনন্ত মাতৃদর্শন হয়েছিল। তার কিছু কাল পরে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দুই ঘটনার মধ্যে বেশ কয়েক দিন তিনি দাস্যভাবের সাধনা করেছিলেন। দাস্যভাব হল ভক্তিমার্গের প্রথম সিঁড়ি। তুমি প্রভু আমি দাস—এই ভাব গ্রহণ করলে সমস্ত কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হয়। এই দাস্যভাবে সাধনাকালে রামপত্নী সীতাদেবীর দর্শন পান তিনি। সীতার মূর্তি তাঁর দেহে অন্তর্হিত হয়ে যায়। মাতৃবন্দনা করতে গিয়ে স্বয়ং মা তাঁর শরীরে লীন হয়ে যান।

১৮৬৪ সালে দক্ষিণেশ্বরে দেবীপ্রতিমায় মাতৃভাব আরোপ করে রামকৃষ্ণ বাৎসল্যভাবের সাধনা করেন। ওই সময় তিনি ‘রামলালা’ অর্থাৎ বালক রামচন্দ্রের একটি ধাতুমূর্তির আরাধনা করতেন। পরে তিনি বলেছিলেন, ওই সময় তাঁর হৃদয় মাতৃভাবে পূর্ণ হয়ে যেত। তাঁর শরীর ও মনে নারীর ভাব ফুটে উঠত, তাঁর কথাবার্তায় ও হাবভাবে মেয়েলি ভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। রামকৃষ্ণ ওই ধাতুমূর্তিতেই জীবন্ত বালক রামচন্দ্রকে প্রত্যক্ষ করতেন। আরও পরে তিনি নিজের উপর গোপিনী রাধার ভাব আরোপ করেছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকারূপে মধুর ভাব সাধনা করেছেন। এই প্রেমকে সম্যকভাব উপলব্ধি করার জন্য তিনি বহুকাল বিজেকে নারী ভেবেছিলেন। এই সাধনার শেষে তাঁর সমাধি হয়। তাঁর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক মিলন হয়। একবার রামকৃষ্ণ নবদ্বীপে যান। সেখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবর্তকদের জন্মস্থান চাক্ষুষ করেন। এই সময় তিনি ভাবনয়নে দুই নৃত্যরত বালক—চৈতন্য ও নিত্যানন্দকে তাঁর শরীরে লীন হতে দেখেছিলেন। মা কালীকে দর্শনের পর তিনি শান্ত ভাব অর্জন করেছিলেন। শোনা যায়, কালী পূজার সময়ও রামকৃষ্ণের ভাবসমাধি হত। কালীপূজা বা মাতৃবন্দনার সঙ্গে তন্ত্রের যোগ নিবিড়।

কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে হয় কালীপূজা। কোজাগরী পূর্ণিমার কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চদশীতে। এর ঠিক আগের রাত হল ভূতচতুর্দশী। বাঙালি ওই দিন চোদ্দো শাক খেয়ে চোদ্দো পুরুষকে স্মরণ করেন। বাংলায় এই উৎসবের অন্য মাত্রা রয়েছে। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ঋষি দীর্ঘতমা হলেন উতথ্য ও মমতার পুত্র। তিনি ছিলেন অন্ধ ও গোবিদ্যায় পারদর্শী। যত্রতত্র সঙ্গম করে বেড়াতেন বলে অন্য ঋষিগণ তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। স্ত্রী প্রদ্বেষীর আদেশে দীর্ঘতমা ঋষির পুত্ররা পিতাকে ভেলায় চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেন। বিখ্যাত রাজা চক্রবর্তী বলি তাঁকে দেখতে পেয়ে প্রাসাদে নিয়ে যান। ঋষি বলিপত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম নামের পাঁচ পুত্রের জন্ম দেন। বলি রাজার এই পাঁচ জন পুত্র পূর্ব ভারত শাসন করতেন, তাঁদের নাম অনুযায়ী রাজ্যগুলির এমন নামকরণ। বলি রাজা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের অধীশ্বর ছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। শিবভক্ত, দানশীল মহারাজ চক্রবর্তী বলি বিষ্ণুর আরাধনা করতেন না। দেবতারা শিবভক্ত বলির পরাক্রমে অস্থির হয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু বামন অবতার রূপে বলির কাছে তিন পাদ জমি চাইলেন। সব জেনেবুঝেও বলি তা দিতে সম্মত হলেন। বামন অবতার তখন তাঁর এক পা রাখলেন স্বর্গে, অন্য পা মর্ত্যে। উদর থেকে বেরিয়ে এল তৃতীয় পদ। বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র বলি সেই চরণ মস্তকে ধারণ করলেন। শিবভক্ত বলির স্থান হল রসাতলে, সে এক গূঢ় জগৎ। মহাবলি মৃত্যুহীন প্রাণ। তিনি সপ্ত চিরজীবীর অন্যতম। বাকি ছয় জন হলেন ব্যাসদেব, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, পরশুরাম, হনুমান ও বিভীষণ।

ভূতচতুর্দশীর রাতে শিবভক্ত বলি মর্ত্যে আসেন পূজা নিতে। সঙ্গে আসেন তাঁর অনুচর ভূতরা। এর ঠিক পরের দিন, চন্দ্রের তিথিনিয়ম মেনে, হয় কালীপূজা। সেও আলোর উৎসব, আতসবাজির জলসা। কালীপূজা ও দীপাবলি উৎসবের গূঢ় দিক হল কালী/কালিকার আরাধনা। কৃষিপ্রধান বাংলায় তিনি আদ্যাশক্তি, তিনিই দশমহাবিদ্যা। মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুযায়ী, আদ্যাশক্তি হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধুমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনী। কৃষিপ্রধান তন্ত্রে কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। তিনি শক্তি, তাঁর নাম প্রকৃতি। তিনিই মহৎ জ্ঞান বা বিদ্যা।

ছবি -- আনখ সমুদ্দুর।

মাতৃবন্দনা প্রথম পর্ব পড়তে পারবেন এই সুত্রে---https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-1

মাতৃবন্দনা তৃতীয় পর্ব পড়তে পারবেন এই সুত্রে---https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-3

মাতৃবন্দনা চতুর্থ পর্ব পড়তে পারবেন এই সুত্রে----https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-4

---------------------------------------------------------------------------

0 Comments

Post Comment