সুদূরের পিয়াসী
শহরের ভিড়ভাট্টা ফেলে বিকেলের শেষ আলোয় সৌরভ হাঁটছিল পার্কের পথ ধরে। পাশে অনন্যা। অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু, কিন্তু আজ অনন্যার চোখে যেন অচেনা ঝিলিক। কথার ফাঁকেই অনন্যার চুল উড়ে এসে লেগে গেল সৌরভের গালে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল সৌরভের।
সৌরভ ভাবল, এ স্পর্শই তো আসল। মানুষ যা ছুঁতে পারে, সেটাই তার কাছে সবচেয়ে সত্য হয়ে ওঠে। বইয়ের পাতায় লেখা কবিতা, কিংবা দূর থেকে শোনা সুর—সবই সুন্দর, কিন্তু যতক্ষণ না তা হাতে ধরা যায়, ততক্ষণ তা অসম্পূর্ণ।
অনন্যা হেসে বলল,
—কি হলো? চুপ করে গেলে কেন?
সৌরভ শুধু মাথা নেড়ে হেসে উঠল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানল—এই এক মুহূর্তের চুলের ছোঁয়া, এই সামান্য স্পর্শ, তাকে চিরকালের জন্য অনন্যার সঙ্গে বেঁধে দিল।
তখনই তার মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই ভাবনা—
“মানুষের ক্ষুধা স্পর্শের ক্ষুধা। যা ছুঁতে পারে, তার তৃষ্ণা মেটে দ্রুত। যা ছুঁতে পারে না, সেই অদৃশ্যের আকাঙ্ক্ষা তাকে অস্থির করে রাখে।”
সৌরভ বুঝল—অনন্যার হাসি, তার কণ্ঠস্বর, এগুলো সে প্রতিদিন পায়। কিন্তু আজকের সেই হঠাৎ স্পর্শই তাকে অন্য এক ভুবনে নিয়ে গেল। হয়তো এই অদৃশ্য না পাওয়ায়ই জীবনের আসল উপভোগ। এই না-পাওয়াই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে অনেক দিন।
মোহরের চিঠি
এইচএমভি’র রিহার্সাল রুমে সেদিন দরজা ঠেলেই ঢুকলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। সলিল চৌধুরী তখন নতুন সুর বাঁধছেন।
চোখ তুলে হেসে বললেন—
“মোহরদি! আপনি এখানে?”
কণিকা হালকা লাজুক হাসি হেসে উত্তর দিলেন—
“তোমার গান শুনেছি… মনে হচ্ছে, না গাইলেই অন্যায় হবে। আমাকেও একটা গান দাও না, সলিল।”
দিন কয়েক পরেই রেকর্ড হয়ে গেল দুটি গান। কণিকার গলায় নতুন সুরের ঝরনা বয়ে গেল। স্টুডিওর সবাই মুগ্ধ।
কিন্তু বাইরে তখন ঝড় উঠছে। শান্তিনিকেতনের কড়া নির্দেশ—
“মোহরদি, রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি আধুনিক গান— আপনাকে বেছে নিতেই হবে। সলিলের গান গাইলে শান্তিনিকেতনে থাকা যাবে না।”
কণিকার বুক কেঁপে উঠল। একরাশ দ্বিধা আর কষ্ট নিয়ে লিখলেন একটি চিঠি—
সলিল, কর্তৃপক্ষ বলেছেন তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। আমি তো চিরকাল রবীন্দ্রনাথকে নিজের ভেতরে বয়ে চলেছি। অশান্তি চাই না। তাই আমাকে ক্ষমা করো ভাই।”
সলিল অনেকক্ষণ ধরে চিঠিখানা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বসে রইলেন।
অবশেষে নিঃশব্দে বললেন—
“তুমি চলে গেলে গান রইল… কিন্তু তোমার গলা ছাড়া সে তো অপূর্ণ।”
শেষমেশ উৎপলা সেন গাইলেন সেই গান। শহরের আলো-ঝলমলে পুজোয় বাজল— “প্রান্তরের গান আমার”।
কিন্তু কোথাও, অদৃশ্য সুরের ভিতরে, বেজে রইল মোহরের এক নিঃশব্দ আক্ষেপ।
মানুষ ভাসছে
কলকাতার পার্কস্ট্রিটে নতুন শো-রুম খোলা হয়েছে। উৎসবের আগে মেয়ে বউকে নিয়ে নিয়ে ঢুঁ মেরেছিলাম। বিশাল, ঝকঝকে আলোয় ভরা দোকান। আমার মেয়ে জামাকাপড় দেখছে, আমি একটু হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই গরমে দোকানের ভেতর বেশ ঠান্ডা, বাইরে উজ্জ্বল আলো।
ট্রায়াল রুমের সামনে দাঁড়ানো এক তরুণ মুখ বাঁকা করে বলল,
—“স্যার, টাইম হয়ে গেছে, ট্রায়াল রুম ক্লোজ।”
অনুরোধ করতেই দরজা খুলে দিল। ফিসফিস করে বলল,
—“শেষ বাসটা ধরতে হবে, নইলে হেঁটেই ফিরতে হয়।”
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় বাড়ি তোমার?”
—“জিরাট স্যার। 11টা 25এর মালদা টাউন এর ট্রেনে উঠতে পারলে বেঁচে যাই।”
আমি একটু হেসে বললাম, “স্যালারি তো ভালোই হবে এত বড় দোকানে?”
চোখ নামিয়ে উত্তর দিল,
—“মাইনে পাই ৯০০০ নতুন জয়েন করেছি তো-। তবে আমরা সবাই কন্ট্রাক্ট স্টাফ, অফ-ডে নেই, রাত করে ফিরি। ঘুম আর খাওয়া—এই তো।”
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ঝকঝকে আলোয় মোড়া দোকানের বাইরেই ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই ভেসে যাচ্ছে এক তরুণের ক্লান্ত স্বপ্ন, ছিঁড়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটার মতো।
ফুটপাথে বেরোতেই দেখি, রঙিন ফানুস উড়ছে আকাশে।
আমি মনে মনে বললাম,
—আমরা সবাই আসলে ওই ফানুসের ভেতর আটকে আছি, বাইরের হাওয়া যেদিকে টেনে নিয়ে যায়, সেইদিকেই ভাসছি।