পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সন্দীপদাকে নিয়ে একটি ব্যক্তিগত গদ্য

  • 20 March, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1052 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
তখন ইন্টারনেটের সময় নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কঠিন একটা কাজ করে চলেছিলেন, সন্দীপ দত্ত। মফস্বলবাসীদের লিটিল ম্যাগাজিনও যে সংরক্ষণ করা জরুরী, তা সন্দীপ দত্তই দেখিয়েছিলেন। অনেক বই হয়তো দ্বিতীয় বা তৃতীয় সংস্করণ করা যায়, কিন্তু সন্দীপ দত্তদের কোনও দ্বিতীয় সংস্করণ হয় না। তাঁকে নিয়ে একটি ব্যক্তিগত গদ্য লিখলেন নীহারুল ইসলাম।

আমরা মফস্বলবাসী। আমরা সাহিত্য করি। আমরা লিট্‌ল ম্যাগাজিন ছাপি। নিজেদের লেখা নিজেরাই প্রকাশ করি, পড়ি। মাঝে মাঝে সাহিত্য-বাসরের আয়োজন করি। সবকিছু এই মফস্বলে বসেই। তখন কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্য-জগৎ ছাড়া অন্য সাহিত্য-জগৎ সেই অর্থে আমাদের কাছে অজানা। অপরিচিত। সেখানে এমন কোনও ঠিকানার কথা জানা ছিল না যেখানে গিয়ে আমরা আমাদের মতো বসব। আমাদের মতো কথা বলব। আমাদের প্রকাশিত পত্রিকার পসরা সাজিয়ে বসব। এ-নিয়ে আমাদের আক্ষেপ ছিল।  

সেই আক্ষেপ মিটে গেল অল্প কিছুদিনের মধ্যে। অচিরেই আমরা আমাদের জায়গা পেয়ে গেলাম। ১৯৯০ সাল। আমরা সুকুমার সাহা সম্পাদিত ‘আগ্রহী’ পত্রিকার ব্যানারে ‘সারা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন মেলা’র আয়োজন করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এর মূল হোতা ছিলেন বিধান মজুমদার। তিনি সোদপুরের বাসিন্দা হলেও আমৃত্যু জন্মভূমি লালগোলার সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় যোগ। তাঁর আমন্ত্রণেই আমাদের আয়োজিত ওই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় এসেছিলেন আরও অনেকের সঙ্গে কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্ত মহাশয়। দু-দিনের অনুষ্ঠানে ব্যস্ততার কারণে সেভাবে আলাদা করে কারও সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ সেভাবে ঘটেনি। তবু ফিরে গিয়ে সন্দীপদা আমাকে চিঠি লিখে তাঁর লাইব্রেরিতে আমাকে যেতে বলেন। তাঁর সেই আমন্ত্রণে সাড়া ওই ৯০ সালেই গিয়েছিলাম টেমার লেনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিতে। আমাকে পেয়ে তিনি যে কত খুশি হয়েছিলেন, বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে তাঁর লাইব্রেরি দেখানো দেখে। আমার মনে হয়েছিল তিনি যেন তাঁর নিজের তৈরি পৃথিবী দেখাচ্ছেন আমাকে। সেই পৃথিবী যেখানে সৃষ্টির কত যত্ন! কত আদর! কত ভালবাসা! কত দরদ! অনুভব করেছিলাম সন্দীপ দত্ত নামে একজন মহান হৃদয়ের মানুষকে।

সেই থেকেই সন্দীপ দত্তের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। ‘সন্দীপ দত্ত’ কখন ‘সন্দীপদা’, ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ হয়ে যান টের পাই না। বছরে একবার কি দু’বার দেখা হয়। বইমেলাতে অবশ্যই একবার। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা, ‘কেমন আছ নীহারুল?’

-ভাল আছি দাদা।

তারপর বাড়ির খবর নেওয়া। আব্বা-মা কেমন আছেন? ভাই-বোন! আর সবাই? সবশেষে লালগোলা কেমন আছে?

শুধু তাই না, ১৯৯৫ সালে বীরেণ শাসমল সম্পাদিত ‘তীব্র কুঠার’ পত্রিকার অক্টোবর সংখ্যায় ‘জেনা’ নামে আমার একটি গল্প প্রকাশিত হয়। সেই গল্প সুইডেন থেকে গজেন্দ্রকুমার ঘোষ সম্পাদিত ‘উত্তরাপথ’ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়। এই ঘটনা আমার অজানা ছিল। সন্দীপদা এই ঘটনা ফোন করে শুধু আমাকে জানান নি, ‘উত্তরাপথ’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি ফোটো কপি করে ডাকযোগে আমাকে পাঠিয়েছিলেন।

অবাক হয়ে যেতাম। একজন ব্যস্ত মানুষ কিভাবে এতসব মনে রাখেন!

---

১৯৯০ সালে সন্দীপদা যখন প্রথম লালগোলায় প্রথম আসেন, এখানে আবাসিক হোটেল ছিল না। সবার সঙ্গে গাদাগাদি করে তাঁকে এম. এন. একাডেমীতেও রাখতে পারিনি। আব্বাকে বলে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। তাঁর সঙ্গী ছিলেন কল্লোল ভট্টাচার্য। নৈহাটি ভাটপাড়ার সন্তান। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। কবিতা লিখতেন। কিন্তু সেই পরিচয় দিতেন না তিনি। বলতেন, আমি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। লিট্‌ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সক্রিয় সদস্য।

কল্লোলদা চাকরি করেছেন কলকাতার বিভিন্ন ব্রাঞ্চে। অথচ সন্দীপদার লাইব্রেরি ছিল তাঁর সাধনাক্ষেত্র। ব্যাঙ্কের ডিউটি শেষ করে লাইব্রেরি খোলা থাকলে সেখানে যাওয়াটা ছিল নেশার মতো। সেই কল্লোলদাও কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন।

---

২০১৩ সাল। একদিন হঠাৎ কল্লোলদার ফোন, কোনো খবর জানিস?

বললাম, না।

-অপেক্ষা কর সন্ধ্যায় জানতে পারবি।

সন্ধ্যায় নয়, বিকেলবেলা খুব ঘনিষ্ট একজনের ফোনে জানতে পারলাম, এবছর লিট্‌ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ছোটগল্পকার সম্মাননার প্রচলন করল। ‘শ্রীমতি লিপি সরকার স্মৃতি ছোটগল্পকার সম্মাননা’। সেই সম্মানের প্রথম প্রাপক আপনি। 

কল্লোলদার কথা মনে পড়ল। তাঁকে ফোন করলাম, এ কী ব্যাপার শুনি!

কল্লোলদা বলল, ঠিকই শুনেছিস। সন্দীপদা তোকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারেননি।

এত ভালোবাসা! খুব অবাক হয়েছিলাম। গর্বিতও। খাস্‌ কলকাতার মানুষ অন্তত একজন হলেও আছেন যে আমাকে শুধু চেনেন না, আমাকে জানেনও।

আমাদের ‘খোঁজ’ পত্রিকা বছরে একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেবার বইমেলায় সন্দীপদাকে পত্রিকা দিতে গিয়ে ভুল করে দু’টি সংখ্যা দিয়ে ফেলেছি। সন্দীপদা বললেন, আমাকে একটি দাও। আর একটি অন্য কাউকে দিয়ে দিও। যাঁরা পত্রিকা কিনতে পারেন না। বলে একটি কপি আমায় ফেরৎ দিলেন।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস। আমার একটি উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন হবে ‘বইচিত্র’ সভাঘরে। ‘সৃষ্টিসুখ’ আমার প্রকাশক। প্রিয় স্বপ্নময়দা (চক্রবর্তী) মোড়ক উন্মোচন করবেন। সোমনাথ বেহালা বাজাবে। দারুণ পরিবেশ। হঠাৎ দেখি সেখানে সন্দীপদা উপস্থিত।

আমি তো বলিনি। তাহলে সন্দীপদা এখানে কিভাবে?

নিজেকে অপরাধী মনে হল। সেই জড়তা নিয়ে সন্দীপদাকে বরণ করলাম। তিনি কিছু কথাও বললেন আমাকে নিয়ে। সবশেষে ‘ইচ্ছা পুতুল’-এর একটি কপি কিনতে চাইলেন। আমি বললাম, কিনতে হবে দাদা- এটা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির জন্য সৌজন্য কপি।

সন্দীপদা বললেন, এই সৌজন্যে প্রকাশকের ক্ষতি হবে। আমি চাই না এমন ক্ষতি হোক।

খোঁজ পত্রিকা প্রায় প্রতি বছর বার্ষিক অনুষ্ঠান করে থাকে। সেটা ২০১১ সাল থেকে নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। সেবছর আব্বা মারা গেলেন ২৩ জানুয়ারি। অনেকেই ফোন করে সহানভূতি জানান। নবারুণদাও (ভট্টাচার্য) ফোন করেন। বলেন, তুই বারবার বলিস লালগোলা যাওয়ার কথা। যাওয়া হয়ে ওঠে না। এবারে কিন্তু যাব। সামনেই দোল আসছে, সেই সময়।

নবারুণদা আসবেন আমাদের লালগোলায়! সেই আনন্দে আমরা সিদ্ধান্ত নিই সদ্য প্রয়াত আব্বার নামে একটি পুরস্কার চালু করব। রফিকুল ইসলাম স্মৃতি খোঁজ পুরস্কার। যার প্রথম প্রাপক হবেন নবারুণ ভট্টাচার্য।

নবারুণদা এসেছিলেন বৌদিকে নিয়ে। আর আমরা খোঁজ-এর তরফ থেকে আব্বার নামে সেই পুরস্কার প্রদান করে নিজেরাই সম্মানিত হয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রতি বছর সেটা হয়ে আসছে। ২০১৯ সালে আমরা বেছে নিয়েছিলাম চন্দনগর গল্পমেলা’র প্রাণপুরুষ গৌর বৈরাগী এবং কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তকে।

 

এ ব্যাপারে সন্দীপদার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি তো নিজের নামে কোনও পুরস্কার নিই না। দিতে হলে আমার লাইব্রেরিকে দাও।আমরা সেটাই করেছিলাম। সন্দীপদা নিজে এসেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের লাইব্রেরির হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। আমরা ধন্য হয়েছিলাম।

সেবার লালগোলায় এসে তিনি আমাদের মাইনুদ্দিনদাকে (সমাজসেবী মোঃ মাইনুদ্দিন সেখ) দেখে, মাইনুদ্দিনদার কাজকর্মের কথা জেনে গিয়েছিলেন। সে তো অনেকেই যায়। কিন্তু গত বছর যখন সন্দীপদা তাঁর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সেই মাইনুদ্দিনদা আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ ব্যক্তিত্ব সম্মানে সম্মানিত করেন, আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না কত বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি!   

0 Comments

Post Comment