পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একটি আত্মহত্যার প্রেক্ষাপট

  • 26 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 982 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস মজুমদার
নিকুঞ্জ স্যার আত্মহত্যা করেছেন। এই খবরটা এলাকার প্রায় কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না। নিকুঞ্জ স্যারের মত প্রাণোচ্ছল একটা মানুষ কিভাবে এই কাজটা করতে পারেন। ছাত্রছাত্রী, পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাইকে যে মানুষটা সবসময় লড়াই করার কথা বলত, জীবনকে নিংড়ে নিয়ে জীবনের যুদ্ধে ফিরে আসার কথা বলত সেই মানুষটা এভাবে জীবন থেকে পালিয়ে গেল কেন? প্রশ্ন অনেকেরই মনে, আলোচনা, পর্যালোচনা, জল্পনা এই নিয়ে প্রতিনিয়তই চলছে। কিন্তু সঠিক কারণ কেউই বুঝে উঠতে পারছে না।

অমিতেশ সেইসময় কলকাতায় ছিল না। অফিসের একটা কাজে সে দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে জানতে পারে এই ঘটনা। মুহুর্তে যেন তার পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল। যে মানুষটা একটা সময় তাকে সাহস জুগিয়ে ছিলেন, জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার শক্তি যুগিয়েছিলেন সেই মানুষটা কেন এভাবে নিজেকে শেষ করে দিলেন। অমিতেশ নিজের ছাত্রজীবনে যতজন শিক্ষককে দেখেছে তার মধ্যে নিকুঞ্জ স্যারের চেয়ে প্রাণোচ্ছল পজিটিভ মানুষ আর কাউকে দেখেনি। সেই মানুষের এই পরিণতি ভাবা যায় না।

অমিতেশ আর দেরি করল না, নিকুঞ্জ স্যারের বাড়ি যাওয়া দরকার। স্যারের পরিবারের কারওর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। অমিতেশ তাই সোজা এসে হাজির হল নিকুঞ্জ স্যারের বাড়ি।

অনাড়ম্বর একতলা বাড়ির বারান্দার গ্রিলের পাশে লাগানো কলিং বেল টিপতেই সামান্য সময় পরেই মলিন চেহারায় বেরিয়ে এল স্যারের একমাত্র ছেলে নিখিল। অমিতেশকে দেখেই সে তাড়াতাড়ি গ্রিলের তালা খুলে তাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, ‘অমিতেশদা, কবে ফিরলে?’

অমিতেশ বলল, ‘এই তো আজ ভোরেই ফিরেছি। কিন্তু ফিরেই যে খবরটা পেলাম সেটা তো এখনও নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না ভাই’।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিখিল, তারপর অমিতেশকে বলল, ‘এসো, অমিতেশদা ভেতরে এসো’।

অমিতেশকে সঙ্গে নিয়ে নিখিল ভেতরে ঢুকে সাম্নের বসার ঘরের একটা সোফায় তাকে বসিয়ে বলল, ‘একটু চা বলি অমিতেশদা?’

অমিতেশ তাকে হাত ধরে নিজের পাশে সোফায় বসিয়ে বলল, ‘তোমাকে আর এসব ফর্মালিটি করতে হবে না, আগে বল কাকীমা কেমন আছেন?’

নিখিল সেইভাবে মলিন মুখেই বলল, ‘মা, খুব ভেঙে পড়েছেন, বাবা যে এভাবে...অসুখে ভুগে কিছু একটা হলে তাও না হয় একটা স্বান্ত্বনা থাকত। কিন্তু এভাবে বাবার চলে যাওয়াটা...জানি না কি হবে? আজ দুদিন হল মা একেবারে বিছানায় শয্যাশায়ী’।

অমিতেশ বলল, ‘ভালো ডাক্তার দেখাও, কোনও দরকার হলে আমাকে জানিও, কিন্তু একটা কথা আমাকে বল তো, স্যার এই কাজ কেন করলেন? মানে স্যার এরকম করবেন এটা আমরা কেউ ভাবতেও পারি না। কত মুষড়ে পড়া ছাত্রছাত্রীকে, সাধারণ মানুষকে নিকুঞ্জ স্যার জীবনের লড়াইয়ে ফিরিয়ে এনেছেন, জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া অন্যায়, সেই ছাত্রজীবন থেকে স্যার আমাদের শিখিয়েছিলেন, সেই মানুষ নিজেই কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? কারণটা কি? স্যারের রিটায়ারের পর ভালো পেনশন ছিল, তুমিও এখন ভালোই রোজগারপাতি করছ, তোমাদের সংসারে কোনওরকম সমস্যা নেই, তাহলে কেন? কেন এই সিদ্ধান্ত? নিজেকে কেন এভাবে শেষ করে দিলেন?’

নিখিল একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল, ‘তোমার অর্জুনকে মনে আছে অমিতেশদা?’

অমিতেশ একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘অর্জুন রায়, তাইতো, তাকে ভুলব কি করে? তোমাদের ব্যাচেই ত পড়ত। স্যার আমাদের ক্লাসেও এসে মাঝে মাঝে অর্জুনের প্রশংসা করতেন। বলতেন খুব ব্রাইট ছেলে, আমাদেরও বলতেন, ‘দেখিস, তোদের জুনিয়র কিন্তু অর্জুনই একদিন আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। অর্জুনকে ভালোই মনে আছে, এই তো কাছাকাছির মধ্যেই তো থাকে। হালফিলে শুনলাম সে খুব বড় একটা সরকারি চাকরি পেয়েছে। স্যারের তো নিশ্চয়ই খুব গর্ব হয়েছিল সেটা শুনে। ছেলেটা দেরিতে হলেও বড় চাকরি পেয়েছে। আমাদের সবার চেয়ে বড় পদে আসীন হয়েছে সে। কিন্তু তুমি এখন অর্জুনের কথা বলছে কেন?’

নিখিল আবারও একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘অর্জুন এসেছিল এ বাড়িতে। চাকরি পেয়ে বাবাকে প্রণাম করতে। খুব খুশী হয়েছিলেন বাবা, আনন্দে শিশুর মত লাফাচ্ছিলেন। জানো তো বাবাকে সবাই সম্মান করে দ্রোণাচার্য বলে ডাকতেন। বাবা নিজেও সেটা জানতেন। সেইজন্য বাবা আমাকে বলতেন তুই চিরকাল অশ্বত্থামাই রয়ে গেলি নিখিল, অর্জুন রায়ই হল আমার সত্যিকারের অর্জুন। ওর জন্যই আমি দ্রোণাচার্য। সেই অর্জুন ওই বড় চাকরি পাওয়ায় বাবা দারুণ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই সব গোলমাল হয়ে গেল’।

অমিতেশ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, এতে গোলমাল হওয়ার কি হল?’

নিখিল বলল, ‘দিনকয়েক আগে বাবার সাথে আমাদেরই ক্লাসের সঞ্জয় বলে একটা ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল। সঞ্জয় রকে বসে আড্ডা মারছিল, হয়ত পথ-চলতি লোকজনকে টোন-টিটকিরিও করছিল। বাবা তাকে গিয়ে বলেন যে এসব করে নিজেদের ক্ষতি না করে কোনও কাজের চেষ্টা তো তারা করতে পারে। বাবা উদাহরণ হিসাবে অর্জুনের কথা বলেন, বাবা নাকি বলেছিলেন যে অর্জুনের মত না হতে পারলেও অর্জুনকে দেখেও তো তারা শিখতে পারে। সেই কথার উত্তরে সঞ্জয় বাবাকে জানায় যে অর্জুন নাকি মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে ঐ চাকরি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, সঞ্জয়দের মুরুব্বি যে রাজনৈতিক নেতা তাকে ধরেই নাকি অর্জুন চাকরিটা পেয়েছে আর সেজন্য সে প্রথমে সঞ্জয়ের কাছেই এসেছিল। সঞ্জয়ের কথাটা বলার ধরণও নাকি ছিল বিশ্রী। বাবা কথাটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করেননি। বাড়ি ফিরে মাকে সবকথা জানিয়ে বাবা ছুটেছিলেন অর্জুনের বাড়িতে। মায়ের কাছে শুনেছি বাবা অর্জুনের বাড়ি থেকে ফিরেছিলেন চোখে জল নিয়ে। মাকে নাকি তিনি বলেছিলেন অর্জুন বাড়ির দরজা খুলতেই বাবা সরাসরি তাকে সেই প্রশ্ন করেন। অর্জুন প্রথমে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে বাবার চাপে সে নাকি সত্যি কথাটাই বলে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে অর্জুন মিথ্যে বলতে পারেনি, সে নাকি বাবাকে বলেছিল বেশ কয়েকবার চাকরির পরীক্ষায় বসে ভালো পরীক্ষা দিয়েও সে বারেবারে অন্যায়ের শিকার হয়েছে। তার বাবা-মায়ের স্বপ্ন, তাদের কষ্টস্বীকার সব ব্যর্থ হয়ে যেতে বসেছিল। নিজের স্বপ্নের সঙ্গে তাই সে আপোশ করেনি। বাড়ি বন্ধক রেখে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিটা বাগিয়েছে সে। সঞ্জয়ের সবকথা সত্যি। বাবা মেনে নিতে পারেননি এটা। যে স্বপ্নের শুরুই হল দুর্নীতি দিয়ে সেই স্বপ্ন ভবিষ্যতে আরও দুর্নীতির দুঃস্বপ্নকে বাস্তব করে তুলবে। আরও আরও ভ্রষ্টাচারে শেষ হয়ে যবে চারিদিক। আমি সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে দেখি বাবা উদাস নয়নে নিজের আরামকেদারায় বসে রয়েছেন। তার চোখ ছলছল করছে। আমাকে দেখে বললেন, ‘অর্জুন ছাড়া দ্রোণাচার্য হয় না রে নিখিল, আজ আমার অর্জুনই আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। আমাকে বধ করতে কোনও ধৃষ্টদ্যুম্নর প্রয়োজন হয়নি, পেছন থেকে আমার অর্জুনই আমার মাথা কেটে দিয়েছে। ও যদি ঘুষ দিয়ে ওই চাকরি যোগাড় না করে অন্যকোনও বিকল্প রোজগারের পথ বেছে নিত তাহলেও বরং আমি ওর জন্য গর্বিত হতে পারতাম, কিন্তু অন্যায়ের কাছে হেরে ও নিজেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার পথ বেছে নিল, আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল’, আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না, তারপর বাবা আবার বললেন, ‘আমরা মানুষ গড়ার চেষ্টা করি, আর এই লোকগুলো কারা যারা আমাদের সব চেষ্টায় জল ঢেলে দিয়ে আমাদের গড়া মানুষগুলোকেও অমানুষ করে তুলছে। কে করবে এদের বিচার? আজ আমার মনে হচ্ছে আমার শিক্ষকতার সব আদর্শই ব্যর্থ হয়ে গেল’। ব্যস ওই আমার সঙ্গে বাবার শেষ কথা। পরদিন সকালেই মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙে। ছুটে গিয়ে দেখি বাবার দেহটা ঘরের......’

কথা শেষ করতে পারল না নিখিল। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। অমিতেশ তাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে কিছু পরে বেরিয়ে এল নিকুঞ্জ স্যারের বাড়ি থেকে। কিন্তু নিকুঞ্জ স্যারের তোলা প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগল। অমিতেশের মনে হল নিকুঞ্জ স্যারের মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন আত্মহত্যা নয়, এটা সমাজের সার্বিক এক অবক্ষয়, এক চেতনার মৃত্যু। এর প্রতিরোধ না হলে, যুবসমাজ গর্জে না উঠলে এই ভ্রষ্টাচারকেই শিষ্টাচার বলে মেনে নিতে হবে, আর তা হবে সত্যের অপমৃত্যু, সমাজের অপমৃত্যু, যেমন নিজের অজান্তেই একরকম নিজের আত্মাকে, বিবেককে হত্যা করেছে অর্জুন। আর অর্জুন তৈরি হতে দেওয়া যাবে না। দ্রোণাচার্যদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে অমিতেশ, নিখিল এরাই। না হোক এরা নিকুঞ্জ স্যারের অর্জুন কিন্তু স্যারের ছাত্র তো, স্যারের পথেই লড়াইয়ের শপথ মনে মনে নিল অমিতেশ, নিখিলও সব শুনলে শোক কাটিয়ে নিশ্চয়ই যোগ দেবে এই লড়াইতেই। নিকুঞ্জ স্যারই তো বলতেন, ‘বেঁচে থাকার রসদ রয়েছে জীবনের লড়াইতে’, না, স্যার, এত সহজে আপনাকে আমরা হেরে যেতে দেব না, সংকল্প কঠিন মুখে এগোতে লাগল অমিতেশ।

0 Comments

Post Comment