পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

করোনা ভাইরাস এবং বিশ্বনেতৃত্বের অবক্ষয়

  • 11 September, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1709 view(s)
  • লিখেছেন : রুদ্র সান্যাল
করোনা হয়তো প্রাকৃতিক নিয়মে একদিন লুপ্ত হবে। তা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যে যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল। কিন্তু করোনা পরবর্তী পৃথিবীকে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে কাজে লাগাতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

করোনা মহামারীর সময় অতি সম্প্রতি, নিউইয়র্কে প্রখ্যাত বুকার প্রাইজ জয়ী বিতর্কিত ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি, সাংবাদিক ক্রিস্টোফার বোলেনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন, "করোনা মহামারি এমন ধূমকেতু নয় যার লেজে সমাজতন্ত্র বাঁধা আছে। পৃথিবীর শক্তিকাঠামোগুলোর নির্মাতা এবং সুবিধাভোগীরা এত সহজে তাদের লাভজনক প্রকল্প বদলাবে না, বর্জনও করবে না। তবে হ্যাঁ, আমরা সুন্দর পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম করতে পারি।"

দেখা যাচ্ছে একটি নির্মম সত্য তিনি তুলে ধরেছেন। করোনা পরবর্তী পৃথিবী কি হতে পারে তাই নিয়ে আমরা বিভিন্ন রকম আলোচনা করেছি। এই করোনাকালীন সময়ে বহুবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। কিন্তু সত্যিই কি কিছু পরিবর্তন হবে অর্থনীতি বা সমাজনীতির ক্ষেত্রে? এই প্রশ্নটা পরিষ্কার তুলে ধরেছেন রুশদি। বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তিগুলি কখনই নিজেদের পরিবর্তন করবে না। করোনার মাধ্যমে সমাজে অনেক ভালো ভালো পরিবর্তন হবে বলে আশা করছি। কিন্তু বাস্তবে কখনই তা হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদেরই সংগ্রাম করতে হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্যে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের দায়িত্বে এগিয়ে আসতে হবে।

নেতৃত্ব যখন হীনমন্যতায় ভোগে এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে শুধুই মুনাফা এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে ছলে বলে কৌশলে নিজেদের পরাক্রম দেখাতে থাকে, তখন তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা হয়তো একটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই মহামারী মানুষের সামনে ভাল খারাপের ধারণা পরিষ্কার করে দিয়েছে, যেমন ভালো জিনিসটা হলো করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে যারা সামনে থেকে নিঃস্বার্থভাবে লড়াই করছেন, তাঁদের নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা সম্পর্কে শিক্ষিত জনমানসে একটা অংশের মধ্যে গভীর প্রভাব। আবার একই সাঙ্গে এই মারাত্মক ভাইরাস প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকদের অদম্য প্রচেষ্টা। কিন্তু একই সঙ্গে খারাপ দিকটা হলো এই মহামারীর সময় সমাজের একটা অংশের মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা এবং গোঁড়ামির বাড়বাড়ন্ত। রোগের বিরুদ্ধে লড়াইটা তারা খুব সহজেই রুগীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামিয়ে এনেছে— অপরিসীম কদর্যতা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে রুশদি বলেছেন, "এই মহামারী মহত্ব ও কদর্যতা উভয় দিকেই আলোকপাত করেছে। আবার একই সঙ্গে বিদ্বেষকে জয় করার বাসনাও প্রবল হয়ে উঠেছে। 'লর্ড অব দা ফ্লাইস' উপন্যাসের সভ্যতার সঙ্গে বর্বরতার দ্বন্দ্বের মতো অনেকটা।" শুভ অশুভের লড়াই। এই লড়াইয়ে প্রকৃত মানুষকেই আজ জিততে হবে। তবেই মানবসভ্যতার জয়লাভ হবে।

প্রতিবার মহামারীর পরে মানুষ ভেবে এসেছে এরপর আশা করি আর এই বিপর্যয় আসবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিপর্যয় আসতেই থাকে। আসলে মানুষ প্রতিবার অতিমারীর পড়ে আধুনিক হয়েছে। আচার আচরণ প্রযুক্তি সবেতেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রকৃত শিক্ষিত হয়নি। নইলে পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার যুদ্ধ হয় কেন। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। মানব সভ্যতার অচিন্তনীয় ক্ষতি হয়েছে, তাও কি আমরা শুধরেছি। নইলে একবিংশ শতাব্দীতে এই করোনা মহামারী আমাদের দেখিয়ে দিলো, আমরা এই আধুনিক সমাজকে যেভাবে দেখি, আসলে সমাজটা মোটেও তা নয়। একেবারে হালকা কাঁচের মতন ভঙ্গুর। এই ভাইরাস উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সমাজ ব্যবস্থাকে কি ভাবে ভেঙে চৌচির করে দিল! আধুনিক সমাজের প্রকৃত চিত্রটা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

ব্যবসায়ীদের কাছে করোনা লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন ভ্যাকসিন তৈরির। তারমধ্যেও অনেকে মুনাফার জন্যে প্রস্তুত। মাস্ক এবং স্যানিটাইজার এখন বিশাল লাভদায়ক ব্যবস। আমার নিজেরাই নিজেদের শেষ করবো? এই মরণপণ প্রতিজ্ঞা করেই মাঠে নেমেছি। পরিবেশকে এক প্রকার নিশ্চিহ্ন করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুরোপুরি দখল করে নেওয়ার কথা এই ভয়াবহ সময়ে একশ্রেণীর মানুষ ভাবতে পারছে। সরকার তাতে মৌন সম্মতি জানাচ্ছে। এক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজিপতিদের আগ্রাসন চীনা আগ্রাসনের থেকে কোন অংশে কম নয়। এটাই সবচেয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছে এই মহামারীর সময়। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা দরাজ এই সব বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি, ঠিক ততটাই অবজ্ঞার জায়গায় থাকে সাধারণ নিম্ন বিত্ত বা প্রান্তিক মানুষ। ভারতের মতো দেশেও স্বাস্থ্য পরিসেবা ধীরে ধীরে বেসরকারী হাতে চলে যাচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে সাধারণ মানুষ আর কতদিন রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে পারবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ এক ঝরা সময়!

তবে করোনার আগেও প্রকৃতি নানা ভাবে হুঁশিয়ার করেছিল। আমরা তা মানিনি। গতবছর চেন্নাইতে ভয়াবহ জলসঙ্কট আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে অনৈতিকভাবে জলসংগ্রহ কতটা ক্ষতি করতে পারে। একদিকে নগরায়ণ অন্যদিকে প্লাস্টিকের জঞ্জাল— সর্বনাসা যুগলবন্দী। ভাইরাস আমাদের দেশের তথা বিশ্বের অর্থনীতিকে আঘাত করেছে প্রবল। কিন্তু একই সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছে পরিবেশের অদ্ভুত পরিবর্তন। লকডাউন দেশের বিভিন্ন শহর কেন্দ্রিক অঞ্চলে নিত্য নতুন পাখি এবং প্রাণীদের অনেকের স্বচ্ছন্দে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাতাসে দূষণের মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে অবিশ্বাস্য ভাবে অনেকটাই। এটাও তো একটা প্রাপ্তি প্রকৃতির জন্যে অবশ্যই।

তাই একটাই বিষয় এখন ভাবতে হবে, এই করোনা হয়তো প্রাকৃতিক নিয়মে একদিন লুপ্ত হবে। তা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যে যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল। কিন্তু করোনা পরবর্তী পৃথিবীকে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হবে। ছাত্রছাত্রীরাই আমাদের ভবিষ্যৎ, তাই তাদের নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে আমাদের। যেভাবে গ্রেট থার্নবার্গ সারা বিশ্ব নেতৃত্বকে ভাবতে বাধ্য করেছে প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য। ঠিক সেই ভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বর অনেক দায়িত্ব থেকে যায়। তাদের মাঠে নেমে পরিষ্কার একটা পথ দেখাতে হবে ভবিষৎ প্রজন্মকে। তবেই করোনা পরবর্তী পৃথিবী আবার আগের থেকে বেশি সুস্থ হয়ে উঠবে। এই আশা আমরা রাখতেই পারি।

কিন্তু সব কিছু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘাড়ে দায়িত্ব সম্পাদন করলেই হবে না। আমাদেরও যথেষ্ট দায় রয়ে গেছে।

0 Comments

Post Comment