পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ক্রিসালিস

  • 24 November, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 318 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস সরকার
--জনক আর শুকদেবের গল্পটা জানিস? --জনক মানে ওই জনক চাচার কথা বলছিস কি?জনক চৌবে ? ওই যে ভুজিয়ার দোকান ? --ধুস শালা গান্ডু ! আমি পুরাণের জনক আর শুকদেবের কথা বলছি ।

--পুরাণ ? হুঁ:! পুরাণ এখন পিছন দিয়ে বেরোচ্ছে ! ছেলের ভবিষ্যতের চিন্তায় আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ টিভি অব্দি দেখছি না ! তো পুরাণ ! মাইরি ! তুই না ! দিন্দার টিউটোরিয়ালে তোর ছেলেও পড়ছে আগে থেকে। সেইজন্যেই পরামর্শ চাইলাম, এখন পুরাণ মারাচ্ছিস ?
--শোন ! খিস্তি করিস না । সে কথাই তো বলছি, একটু রসিয়ে বলছি । অনিল বলল, "রসে ফসে আমি নেই বাপু ! সত্যি যদি কিছু পরামর্শ দিবি তো দে। কিছু গেঁড়ে পাকা পাবলিক আছে যারা ভাবে, আমার ছেলে আই আই টি বা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, পরিচিত অন্য কারুর ছেলেমেয়ে যেন না পায় ! তাদের কাছে পরামর্শ চাইলে কথার প্যাঁচে পিছলে বেরিয়ে যায়। তুইও যে সেই মাল, জানতাম না মাইরি !"
 বিনি খরচে এডভাইস ?", চোখ সরু করে অচিন বলে।
--মানে ?
--সিগারেট ফিগারেট অন্তত ছাড় !
–ওঃ ! শালা তুই না ! নে- বল !
ধোঁয়া ছেড়ে অচিন বলে, "তো, শুকদেব জনকের ইস্কুলে ভর্তি হতে গেছে । তখন তো ছাত্রদের ডে স্কুল ছিল না, শিক্ষাগুরুদের হস্টেলেই থাকতো হতো। তবে বয়েজ ওনলি ! গার্লস হোস্টেলের কনসেপ্টটা তখনো চালু হয় নি–
--ওঃ শালা তুই না ! কি বলতে চাস খোলাখুলি বলতো ! ধান ভানতে শিবের গীত গাইছিস কেন ? দিন্দা কেমিস্ট্রি পড়ায়, নাম করা প্রাইভেট টিউটর, তোর কাছেই তো ঠিকানা, ফোন নম্বর নিলাম ! একমাসের টিউশন ফি বাবদ দু হাজার টাকা এডভান্স জমা করতে হোল। ওটা জমাই থাকবে, সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসাবে। মাস পয়লা আবার দুহাজার করে জমা করতে হবে । এ কি ! তোর ছেলেকে ওখানে পাঠাচ্চিস আমার দুমাস আগের থেকে, তোকেও কি ওই সিকিউরিটি  ডিপোজিট রাখতে হয়েছে ? এই সিম্পল কোশ্চেনটির উত্তরে তুই পুরাণ মারাতে বসলি !
--ব্যাটা শোন না ! গল্পটা  শোন ! আমি পুরাণের আলোকে বর্তমান শিক্ষন পদ্ধতির একটা ছবি আঁকতে চাইছি !
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিল মনে মনে বলে, 'জ্ঞান দেবার সুযোগ পেলেই কোনো শালা ছাড়ে না! বলে যা আজকে ! পরে যখন কোন বিষয়ে পরামর্শ চাইতে আসবি  আজকের শোধটা সেদিন তুলবো ।' মুখে বলে , “ বল কি বলছিলি তোর পুরাণ কথা !”
– তো শুকদেব জনকের কাছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্যে গেসল । জনক বলল,"বেশ ! দেব । আগে গুরুদক্ষিণা দাও !"
শুকদেব বলল,"আগে ব্রহ্মজ্ঞানটি দিন ! জ্ঞান না পেলে কেমন করে গুরুদক্ষিণা হয় !" জনক তখন হাসতে হাসতে বলেছিল," ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে যাবার পর  আর কে গুরু কে শিষ্য সে বোধ কি থাকে ! তাই আগে  গুরুদক্ষিণার কথা বললাম । ”                               

এই হলো গল্প। জনকের রেফারেন্স তোর মতন মাথামোটাকে দিচ্ছি এটা বোঝানোর জন্যে যে দিন্দা নতুন কিছু নিয়ম চালু করে নি । ওর বদনাম করতে চাইলে করতে পারিস। একমাস পরে দিন্দার কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যদি পড়তে না যায়, দিন্দা কি টাকা আদায় করতে তার বাড়িতে ছুটবে ? বুঝলি ?
তোম্বা মুখে অনিল বলে," আরে এটা না বোঝার কি আছে ? তোর এই দিন্দা জনক তো আর একমাসের মধ্যে রসায়ন জ্ঞানদান শেষ করতে পারবে না। এতে করে কি হচ্ছে যে শিক্ষাশুরুর আগেই গুরুর বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকট হয়ে পড়ছে, এই আর কি !


— ঠিকই ! তবে তুই আমি খুঁত ধরলে কিস্যু যায় আসে কি ! দিন্দা তোর হাতের নাগালে তাই চেঁচাচ্ছিস তো ! তিন মাস আগে কি হোল ! তিন মাসের টিউশন ফি আর আরো কি সব হাবিজাবি ফিজ বাবদ একুশ হাজার টাকা জমা দিয়ে তোর ছেলেকে এগারো ক্লাসে ভর্তি করিস নি কি ? তখন কি এ কথাগুলি বলেছিলি ?
--এটা তো স্কুল ! সব স্কুলেই এ নিয়ম চালু আছে । সবাই মানে, মানতে বাধ্য বলে । চ ! সামনের চা দোকানটার একটা বেঞ্চ খালি হোল । একটু গলা ভেজাই ।

 রাস্তার ওপর গাছের তলায় একটা চা দোকানের সামনে বসলো দুজনে । আত্মীয়তা না থাকলে কি হবে, ওরা দুজন পরস্পরকে ছাড়া ভাবতেই পারে না !  অচিন বয়সে  বছর দুয়েকের বড়ই হবে, তাই হয়তো কর্তৃত্ব করে খানিকটা । বিশেষ করে পড়াশোনার ব্যাপারে । অচিনের পরামর্শ অনুসারে পুত্রের কোচিংয়ের প্রথম কিস্তি জমা করার সময়েই অনিল জেনে নিয়েছিল ছেলের রোল নম্বর কত হোল । এটা জানা দরকার , দিনদার রোল কলের সময় সাড়া দিতে হবে  তো ! ছাত্র ছাত্রীদের নাম ধরে ডাকার সময় পান না দিনদা । এক একটা ব্যাচে উনি মাত্র আশিজনকে পড়ান ! শহরের চারটে কোণায় উনি চারখানা রুম ভাড়া নিয়েছেন, সপ্তাহে একদিন করে সে রুমগুলিতে পড়ানো হয় ।সুতরাং তুমি যদি যথাসময়ে টাকা জমা দিয়ে সিট বুক না করে রেখেছো তাহলে ছুটতে হবে দশ পনেরো কিমি দূরের অন্য পাঠকক্ষে !এক একটি রুমে তো মাত্র আশিজনই সুযোগ পাবে !বেশ ! এবার যেখানেই হোক, তুমি সুযোগ পেলে ।এবার তোমার যদি আগ্রহ জাগে পাঠকক্ষটি দেখার, উঁকি মেরে দেখে নাও !  ষোল বাই বারো বা আঠারো আয়তনের একটি ঘর । পুরো ঘরটি জুড়ে শতরঞ্চি পাতা । বসার পরে সামনে বইখাতা রেখে লিখতে হয় ।ফলে ছাত্র ছাত্রীদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই বসতে হয় ! একদিকের দেওয়ালে একটি সাদা ব্ল্যাকবোর্ড । প্রায় সকলেই তাদের ছেলে মেয়েকে পৌঁছতে, নিতে আসেন ।গোটা চল্লিশেক চার চাকা, দু চাকাতে গোটা পাড়াটা ভর্তি ! একদিন কৌতূহলী হয়ে ক্লাসের ভেতরটা উঁকি মেরে দেখেছিল অনিল। ফিসফিস করে অচিনকে বলেছিল, "বহু মেয়েও তো ছেলেদের  গা ঘেঁষে বসে আছে রে ! এর কাঁধ  ওর বুকে  তো ঠেকাঠেকি হচ্ছেই ! এই এডোলেসেন্ট স্টেজে এভাবে গা ঘেঁষে আড়াই ঘণ্টা....! এহ হেঃ! এরা তো কি মেন্টালি কি ফিজিক্যালি ওয়েল ডেভেলপড সব ! এদের তো সুড়সুড়িই হচ্ছে শুধু ! উঁহু ! এ মেনে নেওয়া যায় না ! পড়াশোনা ঘোড়ার ডিম হচ্ছে ! তাই না ?" অচিন ওর কাঁধে চাপড় মেরে বলে," ওরে ! সামান্য স্পর্শসুখে গায়ে পুলক লাগা বা চোখে  ঘনায়  ঘোর – এসব আমাদের আমলে ছিল, এসবে এদের কিস্যু হয় না ! আর তোর মতন গান্ডু বাদ দিয়ে সবাই জানে যে পুত্র এবং মূত্র আর কন্যা এবং বন্যা এদেরকে নিয়ে ওরকম আতুপাতু করা অর্থহীনও বটে । মূত্র আর বন্যা ওদিকে পুত্র আর কন্যা কোনোটাই তোমার কন্ট্রোলের নয় ! ওরা ম্যাচিওরড হলে বেরিয়ে যাবেই --"
ওকে থামিয়ে অনিল বলে, " হ্যাঁরে ! বারান্দায় দুটো খোলা জানালার পাশে মোড়ায় বসে ওই যে  সাত–আটজন , কোলের ওপর বইখাতা , ওরাও কি পড়তে এসেছে নাকি !"
--হ্যাঁ !
--তা ওরা বাইরে কেন ?
--ভেতরে কষ্টে সৃষ্টে বাহাত্তরজন বসতে পারে , এরা ক্লাস শুরুর আধঘন্টা আগে আসতে পারে নি , তাই ভেতরে ঢোকার চান্স পায় নি ।
-- ওঃ ! দিন্দার হিসাব থেকে জানালার পাশের জায়গাটাও ছাড় পায়নি ! ধন্য ব্যবসাবুদ্ধি ! আচ্ছা, ভেতরে দিন্দা চেঁচাচ্ছে, ব্ল্যাকবোর্ডে  লিখছে, সেসব এরা দেখতে শুনতে পাচ্ছে ? মাইরি ! এরা আর ভেতরে মেয়েদের গা ঘেঁষে বসা ছেলেগুলো কিচ্ছু শিখছে না এটা জোর দিয়ে বলতে পারি ! বেকার আসা এদের ।
--শোন ! বিদ্যাসাগর গ্যাসবাতির আলোয় পড়াশোনা করতেন !
--এখনকার ছেলেমেয়েরা বিদ্যাসাগরের চাইতে অনেক বেশি কষ্ট করে ।
--কিরকম ?
--রাত চারটে সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে হাগাহাগি, চান, টিফিন করে স্কুলে দৌড়োনো, আড়াইটায় বাড়ি ফিরে নাকে মুখে দুটি গুঁজে তিনটের বাস ধরে চারটেয় টিউশন, সেটা শেষ করে রাত আটটার টিউশন, রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে নাকে মুখে দুটি গুঁজে ঘুম, কিংবা খেতে খেতেই ঘুমে ঢুলে পড়া- এতক্ষণ   পাঠক্রিয়ার মধ্যে বিদ্যাসাগর থাকতেন ? হুঁ ! তাহলে আর বর্ণপরিচয় লিখতে হতো না !এরা অনেক বেশি কষ্ট করে ।
--অভ্যেস করানো হচ্ছে । মিলিটারির ট্রেনিংয়ের মতন । পড়া শেষে তো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর  স্কিলড  লেবার হিসেবে চাকরিতে ঢুকবে   সব । বারো ঘন্টার ডিউটি !
-- হুঁ:! কি দিন এসে গেল মাইরি !
--হ্যাঁ ! বাইক রেডি কর ! ছুটি হচ্ছে । দিন্দা রোল কল করছে ! তাড়াতাড়ি বেরোতে না পারলে মেইন রাস্তায় ওঠার আগে জ্যামে পড়ে যাবি ।

বাড়ি পৌঁছে ছেলে প্রথমেই একগুচ্ছ জেরক্স করা কাগজ বের করল । গোছাটা অচিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,"বাবা দেখ !",ইংরেজি প্রিন্ট আউট আর তার মাঝে ডায়াগ্রাম  এক ঝলক দেখে নিয়ে অচিন বলল, "কি এগুলো ?কেমিস্ট্রির কিছু সলভড প্রবলেম মনে হচ্ছে ! কোনো রেফারেন্স বই থেকে জেরক্স করলি ?"
জিত মুচকি হাসে, বলে, "নেট থেকে ডাউনলোড করা পেপার । দুটো করে সেট  দিন্দা স্যার আমাদের প্রত্যেককেই দিয়েছেন। এই সেটটা আই আই টি আর হুঁ! এই সেটটা জেইই'র প্রিপারেশনের জন্যে ।" এই দুটি নাম শুনে অচিন এবার একটু উৎসুক হয়, বলে,"বুঝলাম না ! নেট থেকে ডাউনলোড করতে হবে কেন ? টেক্সট বইয়ে থাকবে না ?"
-- ওঃ বাবা ! তুমি না ! ইটস নট সো সিম্পল ! ধরো, কার্বন ।     হ্যাঁ ? এই কার্বনের কতগুলো কম্পাউন্ড আছে জানো তো ? আউট অব দোজ মিলিয়নস- আট দশটা কম্পাউন্ন্ডের স্ট্রাকচার নিয়ে ভেরিয়াস এঙ্গেল থেকে পিকিউলিয়ার প্রবলেম সলভ করতে দেয় এইসব এন্ট্রান্স এগজামগুলোয় । সব টেক্সট বইতে কি আর ইন ডিটেইলস থাকে ! নেট এন্ড এইসব স্যারেরা ছাড়া এইসব এন্ট্রান্স এগজাম ! উফ !   Nহরিবল ! ভাবাই যায় না !
সুচেতা এতক্ষণ ছেলের কথা শুনছিল মুগ্ধ চোখে । গদগদ স্বরে তিরস্কারের ভঙ্গি করে বলল,"নে, আর পাকামি করতে হবে না । জামাপ্যান্ট ছেড়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বোস !" তারপর অকারণে অচিনকে খোঁটা দিল,"তুমি কী বোঝ বল তো এখনকার পড়াশুনার ?গাঁয়ের স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলে । তোমাদের সময়ে কম্পিটিশন কি জিনিস ছিল না,তাই চাকরিটা পেয়ে গেসলে । এখন হাত পা ধুয়ে খেতে বোসো ।"
অচিন হাসে। জিতের ওঠার লক্ষণ নেই দেখে সুচেতা তাগাদা দেয়, "কি রে ! ওঠ এবার ! হোমওয়ার্ক গুলো তো শেষ করতে হবে । রাত এগারোটার মধ্যে না শুলে ভোর চারটেয় উঠবি কি করে !" ছেলে বলে,"দাঁড়াও না!" বাবার আই কিউ টা একটু টেস্ট করি !     বাবা ! বলতো দেখি, ' ক্রিসালিস' কি ?"অচিন ভিরমি খায় ! বলে," বাব্বা ! প্রথম শুনলাম ! কেমিস্ট্রির কিছু প্রবলেম নাকি?" ছেলে মিটিমিটি হাসে ! বলে, "নাঃ ! পিওরলি জেনারেল নলেজের কোশ্চেন । হ্যাঁ ! জুলজিরও বলতে পারো। নাও বলো !  উঁহু ! তোমার চোখ মুখ দেখে  মনে  হচ্ছে  জানো না। যাকগে ! মা ! তুমি তো বায়ো সায়েন্স । উত্তরটা দিয়ে বাবাকে হারিয়ে দাও তো !" সুচেতা হাল ছেড়ে দেয়,বলে, "এইসব জটিল ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করার চাইতে তুইই তাড়াতাড়ি বলে দে !
খাবার গরম করতে হবে ।" বাবা-মা দুজনকেই জব্দ করা গেছে দেখে ছেলে খুশি হয় । অচিনও। পত্নীর কাছে তর্কে হেরে যে স্বামী  কাজে জিতে যান তিনি বুদ্ধিমান । সন্তানের কাছে জ্ঞানগম্মি তে পিছিয়ে থাকলে সব  পিতা খুশিই হন। জিত বলে, "কিভাবে প্রজাপতি জন্ম নেয় জানো তো ? "
--হ্যাঁ ! শুয়োপোকা থেকে ।
--প্রজাপতিতে কনভার্টেড হবার আগে শুয়োপোকা যে গুটিটা তৈরি করে তাকে 'ক্রিসালিস' বলে । বুঝলে ?
--ও ! তাই নাকি ! জানতাম না তো !
অচিন ভাবে সত্যিই সে  ভাগ্যবান। কিই বা সিলেবাস ছিল তাদের !  এখনকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে কি না শেখাচ্ছে ! এইসব টিউটর বা স্কুলগুলো যেমন নেয় তেমনি উসুল ও দিয়ে দেয় ।
তার ভাবনায় ছেদ পড়ে বাইরের ঘরে  অচিনের ফোনটি বেজে ওঠায় । ফোন তুলে সুচেতা একটা দুটো কথা বলতে  থাকে । অচিন জানে তার স্ত্রীর  মেয়েলি কৌতূহলের কথা ,তাই সব ফোনই ঝাঁপিয়ে পড়ে  আগেই ধরে সে । এখনও যেহেতু সুচেতা ওকে ডাকল না  তাই মনে হয় ফোনটা অচিনের নিকটাত্মীয়দের কারুর নয়,তাই টিভি চালু করে । লো ভলিউমে । সে শুনতে পায়, সুচেতা বলছে,"না । এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না মামা ।ধরুন ! ওকে দিচ্ছি ।" অচিন টিভি মিউট করেই দিয়েছিল, সুচেতা দৌড়োতে দৌড়োতে এ ঘরে আসে,ফিসফিস করে বলে,"ফোনটা ডাইনিং টেবলেই আছে, তোমার বড় মামা, নাতি মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। এবার শহরে রেখে পড়াতে চাইছেন যাতে নাতি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে।খবরদার ! আবেগের ঘোরে আবার এখানে থাকার কথা বলে ফেলো না ! আমি তাহলে জিতকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে যাবো । হ্যাঁ-!

।।  দুই ।।                                                                      

মানুষে  মানুষে প্রতিটি সম্পর্কই অর্থনৈতিক । তাই খুব জ্বাল দিয়ে ঘন করে  তৈরি করা সম্পর্কের মধ্যেও অর্থ বা স্বার্থর পাক কড়া হয়ে গেলেই সম্পর্কের লাড্ডু আর দানা বাঁধে না,ঝুরো ঝুরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে !
মাতুলালয়ের সঙ্গে অচিনের সম্পর্কের নাড়ু কোনদিনই দানা বাঁধে নি । প্রতীক্ষারত মোবাইলটি কানে তুলে নেবার আগে এমনই ভাবছিল সে । সুচেতার সতর্কীকরণের প্রয়োজন ছিল না ।
-- হ্যাঁ বড়মামা বল ! শুভ ফার্স্ট ডিভিশন পেল ! বাঃ !
-- হ্যাঁরে ! যাক– বল তোরা কেমন আছিস ?
"ভালো না গো ! তোমাকে জানাইনি খামোখা চিন্তা করবে বলে ।একটা মেয়েলি রোগে ভুগে ভুগে সুচেতার মেজাজ খিটখিটে । আমার আবার হার্টে গন্ডগোল ধরা পড়েছে । এসব কারণে দুজনেরই মন মেজাজ ঠিক থাকে না । প্রায়ই খিটিমিটি লেগে যাচ্ছে দুজনের ।এতে করে জিতেরও পড়ার ক্ষতি হচ্ছে বেশ। যাকগে ছাড়ো, তোমাদের কথা বলো । " একনাগাড়ে কথাগুলি বলে বেশ তৃপ্ত ভঙ্গিতে সুচেতার দিকে তাকিয়ে  চোখ নাচায় অচিন । ভূমিকা রচনা সদর্থক হোল তো ?  আবার শুরু করে ," যাকগে ছাড়ো, তোমাদের কথা বলো । শুভ, পিন্টু, বৌমা সব খুশি তো ? কত পেয়েছে যেন ?"
– সাতশো চব্বিশ । ধর, গাঁয়ের ইস্কুল, কোচিং টোচিং বলে ত কিছু পায় নাই। সেই লেগেই ইখেনের হেডমাস্টার থেকে আরম্ভ করে সব্বাই বলচে কি, 'কোলকাতা বা দুগ্গাপুরে কুনু ভালো ইস্কুলে উয়াকে ভত্তি করে দাও !' তোদের উখেনে ত বাঘা বাঘা মাস্টার রইছে ! লয় ? উয়াদের কাছে টিউশুনি পড়লে জয়েন্ট কি আই আই টি কি আরো কি কি সব বড় বড় পরীক্ষা আছে তাথে পাশ করার ভালো টেনিং পাওয়া যায় ।" সতর্ক শজারুর মতন অচিনের কান আর  গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে! মামা তো বুঝেও বুঝতে  চাইছে  না রে বাবা ! বিরক্তির  সঙ্গেই বলে ,"তাই যদি হতো মামা তাহলে তো দুর্গাপুরের হাজার হাজার ছেলেমেয়েই এইসব পরীক্ষাগুলোয় চান্স পেতো । তা নয় ! কলকাতা বাদ দিলে অন্য কোনো শহর থেকে এতো ছেলেমেয়ে তো  আর পরীক্ষা দেয় না ।এক দেড় লাখ পরীক্ষা দিলে পঞ্চাশটা ছেলে মেয়ে তো পাবেই ! অন্য কোন শহরের পঞ্চাশটা ছেলে মেয়ে পায় কি ? সেজন্যেই বাইরের লোকের ধারণা , এখানে পড়াশোনার চর্চা খুব বেশি, কি এখানে দারুণ কোচিং পাওয়া যায় । এইরকম !  এতরকম বাজে নেশা, কুসঙ্গ,আমরা দিনরাত দেখছি তো ! কত হাজার ছেলেমেয়ে যে নষ্ট হয়ে যায় সে খবর বাইরে  কি     ছড়ায় ? না । আমরা দুজন তো ভয়ে ভয়ে থাকি, ছেলে যেন ড্রাগের নেশা না ধরে ! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না ! ভিক্ষে  চাই না বাবা, কুকুর সামলাও !" তবু মামা দমবার পাত্র নয় ! বলে ওঠে, "তবু ধর, ফেমিলির হেড বলেই ইয়ারা এখনো মানে আমাকে, তাই ঠাকুদ্দা হিসাবে আমারও দায় আছে একটা, ইটাই আমি মানি। লয় ? আমি মনে মনে যা ভাবছিলাম  ঠিক সেটাই কাল রেতের বেলাতেই বউমা বললেক আমাকে । তুয়ার সঙ্গে পরামশশো করতে বললেক। তাই বলি, গার্জেন হিসাবে আমাদের কাজ উয়াকে একটা ভালো ইস্কুলে ভত্তি করা আর টিউশুনির পয়সা জুগিয়ে যাওয়া । লয় ? এখন শিব গড়তে যেয়ে যেদি বাঁদর তোয়ের হয়ে গেল  তাইলে আর কি করার আছে ! আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার ! লয় কি ?
-- হ্যাঁ ! সেটা তুমি বলতে  পারো। মামা ! কিছু মনে কোরো না, প্রতি মাসে শুভর পেছনে কত টাকা খরচ করতে পারবে তোমরা ?
-- তোর সঙ্গে ত বছরে একবার কথা হয় , তাও আমি ফোন করলে তবেই ! ফোনই ত ঘরে ঢুকলেক বছর দুয়েক । তাই বলা হয় নাই আর ইসব কথা কি ফোনে বলা যায়, 'হ্যাঁরে ! আমি পঞ্চাশ লাখ  কি একশ লাখ জমাইছি ?' জিগালি যখন তখন বলি শুন ! আমার রিটারমেন্টের পুরা টাকাটাই ফিক্সড করা   আছে। চাষ আর পুখুর থেকে যা ইনকাম তাতেই হেসে খেলে সংসার চলে যায় ।গাঁয়েঘরে ত আর ফুটানি কিছু নাই ! রোগ বালাইয়ের খরচও কিছু নাই ! ধর ক্যানে, মাসে বিশ পুঁচিশ যা লাগে খরচা করবো । যা  টাকা লাগব্যাক আমি দুব। টাকা রেখে কি করবো ? লাতিনও নাই যে বিয়া দিতে হব্যাক । লয় ?এখন তুই হেল্প করলেই শুভটাও মানুষ হয়ে উঠলেক । ইটাই কামনা এখন !
-চমকে ওঠে  অচিন , "আমি ? আমি কি হেল্প করবো ? "
-- তোর কাছে শুভ থাকলেক । মানে তুইই গাইড করলি উয়াকে। তোর ত তিনটে শুবার ঘর ।বসার ঘরও বিরাট ! যিখেনে হোক শুভ থাকলেক । হঁ ! বৌমার খাটালি ত হবেকই ঘরে যেদি একজন মেম্বার বেড়ে যায় । তবে তোর রাঁধুনি ত আছেই !তাথেই সাহস পেলম আর কি !তবে তিনবেলা বেড়ে খেতে দিয়া , চা ইসবের ঝঞ্ঝাট ত থাকছেই । সেরকম বুঝলে তোর  ইখেনের মামী কি বৌমা তো  তোর ঘর সামাল দিবার লেগে যেতেই পারে ! তবে উখেনের বৌমা বললে, তবেই ! এখন ত আর বেড়াতে যাবার সময় লয় ! আগে ছেলে মানুষ ! বঠে কি না ?
মামা আরো কি সব ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যেতে থাকে, অচিনের কানে সেসব ঢোকে না, তার কোন মাথা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। মুখ তুলে হঠাৎ দেখে ঠিক তার উল্টোদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে খরচোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে সুচেতা । বুঝতে পারে সে এক অভিনব সংকটে পড়েছে যার থেকে পরিত্রানের উপায় তাকে এখনই বার করতে হবে !লাঠিকে অক্ষত রেখে সর্প নিধন কঠিন কাজ নয় যদি লাঠিটা পাকা বাঁশের হয় !  তবে আজ তার লাঠি অক্ষত থাকবে না !
বলে," মামা ! মাথা ঠান্ডা করে শোন ! শহরের পড়াশোনাটা পুরোপুরি কেনাবেচার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ! আমি বা আমার মতো লোকেরা সমস্ত শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে শুধু ছেলে বা মেয়ের পেছনে ঢালছি ! লোকে ঘোড়ার রেসে টাকা লাগায় শুনেছ তো ? আমাদের সন্তান হচ্ছে সেই রেসের ঘোড়া ! তুমি মাসে বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারবে বলছ !  বেশ ! বিষ্ণুপুরে শুভর বাবা মা একটা বাড়ি ভাড়া নিযে থাকুক । ওখানের হাইস্কুল আর টিউশনির সুনাম দীর্ঘদিনের । তবে শুভ একা  থাকলে হবে না, বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকুক । তুমি জানো না, এই বয়সের একটা ছেলেকে কোথাও একা রাখা মানে বখে যাওয়ার চান্স বেশি। বাবা-মায়ের সতর্ক নজর দরকার! " মামা হাসে। বলে," রেজাল্ট ভালো হতে পারে ইটা আন্দাজ করেই সব জায়গায় খোঁজ লিয়া হয়ে গেছে রে ! বিস্টুপুরে কুথাও আর ঘর ফাঁকা পড়ে নাই যে ভাড়া পাওয়া যাবেক । কুনু মেসও খালি নাই । সব ভত্তি ! ভেবেছিলম যেদি ভালো রেজাল্ট করতে পারে ত তোর কাছে উয়ার থাকার কথা পাড়বো ।
-- হুঁ ! তাহলে এক কাজ করো । ওকে একটা মপেড কিনে দাও ! স্কুল সেরে একটা দুটো টিউশনি পড়ে রাতের দিকে দিব্যি বাড়ি ফিরতে পারবে । রাস্তা তো মাত্র বাইশ কিলোমিটার । এখানেও অনেকেই আরো দূর দূর থেকে টিউশনি পড়ে বাড়ি ফেরে ।
মামা তো আর যাই হোক অচিনের মতন শহুরে হয়ে যায় নি । তাই আর কোন  যুক্তি সাজাতে পারে না । তাছাড়া গেঁয়ো মানুষ হলেও  হাঁদা তো   নয় !  বোঝে , অচিন ভাইপোকে রাখতে রাজি নয় । মামার ম্লান হাসি শোনা যায় । বলে," তুই অনেক বছর হল গাঁয়ে আসিস নাই । তবে খবরের কাগজ ত পড়িস । পদ্ম আর ঘাসফুলে গোটা গাঁ এখন দু ভাগ ! একদল বলে, গাঁয়ের মানুষের উবগার আমাদের চাইতে ভালো আর কেউ করতে লারব্যাক, ত অন্যদল বলে, " আমরা কি কিছু কম  বঠি না কি ? তুমরা হঠ দেখি ! আমরা দেখছি !' দিনের বেলায় লাঠালাঠি আর রাতের আঁধারে দল বেঁধে হামলা আর বোমা ছুঁড়াছুঁড়ি ! সন্ধের পরে মদ, জুয়া আর  সাট্টার ঢালাও জারবার ! তারপর রাত দশটার পর থেকে ভিডিও হলে ছেলে ছোকরার ভিড় ! নোংরা সিনামা ! বহু ছেলে মাধ্যমিকে ইরকম শুভর মতোই রেজাল্ট করে তারপর হায়ার সেকেন্ডারিতে পি ডিভিশন ! হায়ার সেকেন্ডারী ইস্কুলও ত সেই বহু দূরে ! তা বাদে একটা টিউশুনি মাস্টার নাই যে পড়াব্যাক ! ইখেনে কুনু ভবিষ্যত নাই ! রেজাল্ট ভালো করায় ভাবলম যে তোর কাছে রেখে যদি পড়ানো যেত ! তাহলে হয়তো--"
-মামা ! তোমাকে তো আগেই বললাম ওর ভালো যদি চাও ওকে কোনো হস্টেলে বা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে রেখো না। বাবা মায়ের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে রাখো ।তোমাদের যুগ তো বটেই আমাদের যুগও পাল্টে গেছে ! বখে যাওয়ার জন্যে অজস্র হাতছানি ।
-- হঁ ! তোকে ত আত্মীয় বলে ভাবি নাই এতকাল ! ঘরের ছেলা বলেই জানথম ! হ ! রোজগারের ঠেলায় কি সংসারের চাপে ইদিক পানে আর ঘন ঘন যাওয়া আসাটা তেমন নাই আর। লোকজনকে ত ইসবই বলি ! বলি," আমাদের অচিনের ঘর ত লয়, রাজপাসাদ ! বুলি আজ বেঁচে থাকলে কত খুশি হোতো ! তিনটে শুবার ঘর, একটা বসার ঘর ! বৌমাটি রূপে সরস্বতী, গুণে লক্ষী ! আমাদের নাতি সায়েব ত ডাক্তার কি ইঞ্জিনিয়ার হবেকই ! যাকগে ছাড় ! কথায় কথা বাড়ে ! তুই বুদ্ধিমান ছেলে , ঠিকেই বলেছিস । ইখেনে থাকলে ওই পি ডিভিশন আর প্লেন গেজুয়েট ছাড়া কিছু হবেক নাই ।ইয়ারা ত কম্পিউটার কি জিনিস টিভিতেই দেখেছে কেবল ! ইন্টারনেট কি জিনিস আমিও যা জানি ইয়ারাও তাই জানে ! এই আর কি ! তাই ভাবলম-- যাকগে ছাড় ! বৌমাকে ভালো ডাক্তার দেখাবি ! চোটপাট করিস, মামা বাড়ির স্বভাব যাবেক কুথায় ! তা সে সয়েছে এতকাল ! ইবার ত ফোঁস করব্যাকই ! আর নিজের শরীরের দিকে খেয়ালটা রাখবি নাই ? বুলি বেঁচে নাই , বৌমা নিজের শরীর লিয়েই কাহিল, তোর দিকে খেয়ালটা কে রাখব্যাক ? যাক গে- রাখলম ।   হুঁ ! দেখেচু ! নিজের ধান্দায় আসল কথাটাই বলতে ভুলেছি !  আসছে বছর দুগ্গাপুজোয় ইখেনে দুটো দিন কাটিয়ে যাবি কি ? যে বছরই বলি শুনতে হয়, বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটা আছে নাই ত দাদুভায়ের পরীক্ষা ! ইবার ত ধর ছ'মাস আগে থেকে মনে করাঁই দিচ্ছি ! ইবার আসবি কি ? তোদের একটু আদর যত্ন করতে পারলে স্বর্গ থেকে বুলি আর তোর বাবা দেখে একটু খুশি হতো ! গাঁইয়া  হলেও ওরা দুজন ত মানত আমাকে ! 'দাদা' বলে ডাকার আর ত কেউ ছিল নি ! ভেবে দেখবি কি ? তবে একা লয়, বৌমা আর দাদুভাইকেও লিয়ে আসবি ? গাঁয়ের সবাইকে দেখাথম ! আমরা একই ফেমিলির ! বঠে কি না ?   আসবি ?

সহসা অচিন ডুকরে কেঁদে ওঠে !ভাগ্যিস ! কেঁদে ওঠার মুহূর্তে মোবাইলটা কান থেকে দূরে সরাতে পেরেছিল ! তবু মামা বোধহয় কিছু একটা আঁচ পেয়েছিল । চেঁচিয়ে উঠল," কি হোল ? অ অচিন ! কিসের আওয়াজ ?" অচিন অবরুদ্ধ গলায় বলে,"কিছু না    মামা ! তোমার বৌমার ধাক্কা লেগে একটা চেয়ার মেঝেতে পড়ে গেল ! আঁতকে উঠলাম । সামান্য ব্যাপার ।
-- চেয়ারটা ঠিক আছে তো?
--হ্যাঁ গো ! রাখো !

গলা বুজে এসেছিল অচিনের। দান হাতের তর্জনী দিয়ে দু চোখের কোণের থেকে ক'ফোঁটা জল মেঝেতে ফেলল । সুচেতা ততক্ষনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । হাত বাড়িয়ে অচিনের কাঁধ স্পর্শ করল সে । বলল," কেঁদে নাও ! হালকা হবে । আমার মাকে যেদিন দু বছরের জন্যে আসতে বারণ করেছিলাম, আমিও কেঁদেছিলাম ! সেদিন তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াও নি ! আজ আমি তোমার পাশে !" সুচেতার আবেগ অচিনকে স্পর্শ করে না , সে বিড়বিড় করে বলে," নিখিল নক্ষত্র থেকে মানুষের/ এইভাবে সরে সরে থাকা/ নীলিমার প্রতিচ্ছবিহীন ঘোলা জলে/ এইভাবে মানুষের স্নান...!/
সুচেতা ওর অস্ফুট শব্দগুলোকে আঁকড়ে ধরতে চায়, বলে ," কি বলছ বিড়বিড় করে ?"
-- কিছু না । ছাড়ো!  কিভাবে একটা চরম স্বার্থপর কীটের মতন নিজের চারপাশে একটা গন্ডী তৈরি করে দিন কাটাচ্ছি!  বলো ?
সুচেতা তার কন্ঠস্বরে একঝুড়ি মায়া মিশিয়ে উত্তর দেয়,"হ্যাঁ ! তাই তো ! মাকে আসতে বারণ করে দিয়েছি ! বন্ধু বা প্রতিবেশীরা বাড়িতে আড্ডা দিতে এলে চিন্তা শুরু হয় , কতক্ষণে যাবে সব ! কোনো দরকার নেই , তবু রান্নাঘরে গিয়ে এটা ওটা নাড়তে শুরু করি ! তারা একটু বসে থেকে উঠে    পড়ে ! নিজেরা পারতপক্ষে কারুর সঙ্গে মেলামেশা করি না , আমরা না থাকলে ছেলে যদি ফাঁকি মারে ! আমরা কেমন পোকার মতন গুটি তৈরি করে দিন কাটাচ্ছি ! কেন বলো তো ?
-- কেন?
-- একটা প্রজাপতি জন্ম নেবে বলে ! একজন বড়ো ডাক্তার কি একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার বা আর একজন বড় আমলা  এই দেশকে উপহার দেব বলে ! আমাদের ছেলে, জিত ! ভবিষ্যতের প্রজাপতি ! আমরা একটু গুটির অন্ধকারে থাকবো না ?
        
     

 

 

0 Comments

Post Comment