পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তুবড়ির আলো ও খনি

  • 03 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1819 view(s)
  • লিখেছেন : কারিগর শমিক সাহা
তুবড়ি দিয়ে কি ঘর আলোকিত করা যায়? এরকম কোনও বোকা চেষ্টায় আমি আপনি সময়পাত করছি না তো! দেউচা পচামি সংক্রান্ত একটি আলোচনা করলেন কারিগর শমিক সাহা
আজকের বৃহৎপুঁজির উৎপাদন ব্যবস্থার সূচনা - শিল্পবিপ্লব। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব গোটা দুনিয়াকে প্লাবিত করেছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি রাজনীতি সামাজিক ভারসাম্য শিল্পবিপ্লবের পণ্যপ্লাবনে জারিত হয়ে আগেকার সব ব্যবস্থার বিপ্রতিপ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিপুল পণ্য উৎপাদন কী ভাবে সম্ভব হল তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দার্শনিক অর্থনীতিবিদ প্রযুক্তিবিদ সহ আরও বহু মানুষ। আমরা তাদের বক্তব্যের কাঁটাছেড়া না করে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে নজর দিতে চাই।
যে কোনও শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল মূলত তিন রকমের - উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ, খনিজ ( হাওয়া ও জলকে খনিজর সাথে যুক্ত রাখছি ) শিল্পবিপ্লবের আগে শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হত - উদ্ভিজ্জ ও প্রানীজ বস্তু, খনিজের ব্যবহার ছিল সীমিত। শিল্পবিপ্লবে কাঁচামাল হিসেবে খনিজের ব্যবহার সব থেকে বেশি শুরু হল। এর আগে যন্ত্রের চালিকা শক্তি ছিল মানুষ বা পশুর কায়িক বল এবং কিছু ক্ষেত্রে বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ ( হাওয়াকল, জলযান )। শিল্পবিপ্লবে যান্ত্রিক শক্তির উৎস হল প্রথমে খনিজ কয়লা তারপর খনিজ তেল, যাকে এককথায় বলা হয় - জীবাশ্ম জ্বালানি।
জীবাশ্ম জালানীতে প্রকাণ্ড পরিমান শক্তি পাওয়া গেল যা যন্ত্রকে দিল দূর্বার গতি। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানীতে এই শক্তি এল কোথা থেকে? কয়লা তৈরি হয়েছে উদ্ভিদের অবশেষ থেকে, পেট্রোলিয়াম প্রাণীর অবশেষ থেকে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই উদ্ভিদ ও প্রাণীরা প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে পরিপুষ্ট হয়েছিল; বিপূল পরিমাণ প্রকৃতিক শক্তি লক্ষ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হয়েছিল এদের দেহে। তারপর তারা মাটির নিচে চাপা পড়ে ভূগর্ভের বিপূল পরিমান তাপ ও চাপকেও সঞ্চিত করেছে লক্ষ বছর ধরে। এই লক্ষ লক্ষ বছরের সঞ্চিত শক্তিকে আমরা ব্যয় করেছি মাত্র আড়াইশো বছরে।
এতে মুশকিল হল দুটো -
১। জীবাস্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার পরিবেশ দূষণের মাত্রা ছাড়ালো, খনি তৈরি করতে গিয়েও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হল।
২। উৎপাদন এমন বস্তুর উপর নির্ভরশীল হল, যা পূরণযোগ্য নয়। কোনও খনিজ একবার খরচ হয়ে গেলে আবার তৈরি করা যায় না।
শিল্পবিপ্লবের পরের উৎপাদন ব্যবস্থা যে ঝলমলে জীবন যাপনের হাতছানি দেয় তার পিছনের অন্ধকার নোঙরা বাস্তবকে অত্যন্ত সযত্নে আড়াল করে।
একটা বাড়িতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠলে আমরা সগর্বে বলে উঠি - এ সভ্যতার আলো। কিন্তু আমরা কখনোই বলি না এই বিদ্যুৎ কোথা থেকে এলো। এখনও সব থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, কয়লা পুড়িয়ে। জল বিদ্যুতের প্রকল্পগুলি একেবারেই সফল হয়নি। ভারতের অন্যতম বড় নদী নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ DVC এখন জল বিদ্যুৎ নয়, মূলত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
এই খনিজ নির্ভর উৎপাদন ব্যাপারটা তুবড়ির মত, বহুক্ষণ ধরে বানিয়ে মুহুর্তে জ্বলে উঠে শেষ, তাই উজ্জ্বলতা বেশি, জৌলুস বেশি।
তুবড়ি সভ্যতা -
এই তুবড়ির বিষয়টা বিস্তারিত বোঝা দরকার৷ শুনতে মজার হলেও ব্যাপারটা আদৌ মজার তো নয়ই বরং ভয়ঙ্কর পর্যায়ের বিপজ্জনক৷
খনিজের ব্যবহারের কয়েকটা দিক আগে দেখা যাক৷ খনিজের ব্যবহার মূলত দু রকম -
১। গড়নের কাজে, যেমন - লোহা, বক্সাইট(এলুমিনিয়াম), তামা, পেতল, পাথর, নুড়ি, বালি ইত্যাদি৷
২। জ্বালানির কাজে, যেমন - কয়লা, পেট্রোলিয়াম, লিথিয়াম ইত্যাদি৷
এর বাইরেও অজস্র খনিজ আছে, তাদের বহু বিচিত্র ব্যবহার আছে, অতটা বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও এই দুই মূল ধারা নিয়ে আলোচনা করলেও আমরা পথভ্রষ্ট হবো না৷ তাই আমরা আমাদের আলোচনা মূলত এই দুই ধারায় সীমাবদ্ধ রাখবো৷
গৃহস্থ জ্বালানির প্রয়োজনে কয়লার ব্যবহার এখন খুবই সীমিত, কয়লার মূল ব্যবহার এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে৷ গোটা দুনিয়ার ৮০% বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, যার মূল জ্বালানি কয়লা৷ তাই আজকের বিদ্যুৎ নির্ভর জনজীবন আসলে মূলত কয়লা নির্ভর৷ এই বিদ্যুৎ নির্ভরতার কয়েকটা দিক আলোচনা করা যাক৷ প্রথমে বোঝার সুবিধার জন্য গৃহস্থ ব্যবহারের উদাহরণ নেবো।
একটা প্রমাণ মাপের ঘরের মাপ ধরলাম লম্বায় ও চওড়ায় ১২ ফুট, আর উচ্চতা ১০ ফুট । এরকম একটা ঘরে ১টা ৪ ফুটের টিউবলাইটেই যথেষ্ট আলো হয়। এরকম একটা আলোকিত ঘরের যেকোন জায়গায় বই ভাল ভাবে পড়া যায়। আমরা এই আলোর যোগানকে নূন্যতম মান ধরে নিয়েছি। এই আলোর কিন্তু মাপ আছে। এবার একটু মেপে দেখা যাক এই আলো মানে কতটা আলো। তার জন্য আমাদের কয়েকটা পরিভাষা বুঝে নিতে হবে - লাক্স, লুমেন। যতটা সম্ভব সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করছি। বলা হয় বই পড়ার জন্য প্রতি বর্গ মিটারে ২৫ থেকে ৫০ লুমেন আলো দরকার(৩ ফিট ৩ ইঞ্চিতে এক মিটার প্রায়, মানে এক বর্গ মিটার হল তিন ফুট তিন ইঞ্চি চওড়া ও একই মাপের লম্বা জায়গা)। আমরা হিসেবের সুবিধার জন্য ২৫ আর ৫০এর মাঝামাঝি ৩৭ লুমেন ধরলাম। এই লুমেন ব্যাপারটা কী? বলা হচ্ছে এক বর্গমিটারে যদি এক লুমেন আলো পড়ে তবে তাকে বলা হবে ১ লাক্স। তাহলে এক লাক্স মানে কী? এক বর্গমিটার যায়গায়, এক মিটার দূর থেকে যদি ১টা মোমবাতির আলো পড়ে তাহলে তা হবে ১ লাক্স। তাহলে দেখা যাচ্ছে ১ বর্গ মিটার যায়গায় যদি বই পড়ার উপযোগী আলো পেতে হয় তবে তার থেকে ১ মিটার দূরে অন্তত ৩৭টা (নূন্যতম ২৫টা) মোমবাতি জ্বালাতে হবে। এবার শুরুতে আমরা যে ঘরটাকে ধরে হিসেব করছিলাম তার শুধু ৪টে দেয়ালের মাপই ৪৪.৬ বর্গমিটার। আমরা গোড়াতেই বলেছি ১টা ৪ফুটের টিউব লাইটে ঘরের সব দেয়ালেই বই পড়ার মত যথেষ্ট আলো পড়ে (পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন)। তাহলে শুধু দেয়ালেই আলো পড়ছে ৩৭ গুণ ৪৪.৬ মানে ১৬৫০.২ লুমেন আলো। অর্থাৎ ঘরে এই পরিমান আলো পেতে গেলে জ্বালাতে হবে অন্তত ১৬৫০টা মোমবাতি। এত আলোর বিলাসিতা সম্রাট সাজাহানেরও ছিল না। আর একটা কথা মনে করিয়ে দিই, মোমবাতির মূল উপাদান প্যারাফিন, যা পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া যায়। প্রদীপের আলো মোমবাতির থেকে অনেক কম হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ প্রদীপ মূলত উদ্ভিজ্জ তেল থেকে জ্বলে, যার শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা জীবাশ্ম জ্বালানির থেকে অনেক কম।
এত গেল শুধু একটা ঘরে একটা টিউবলাইটের হিসেব, এর বাদে ফ্যান আছে, একাধিক লাইট আছে, বহু ঘরে আছে ফ্রিজ, এসি, গিজার, টেলিভিশন, সাউন্ড সিস্টেম, মিক্সার গ্রাইন্ডার, মাইক্রোওভেন আরও বহু কিছু। এখনকার ৪ ফুটের এলইডি টিউব ১৮ ওয়াটের, আগের মোটা কাঁচের টিউবলাইট ছিল ৪০ ওয়াটের। এই প্রত্যেকটা যন্ত্রের গায়ে ওয়াটের হিসেব দেওয়া থাকে, একটু মিলিয়ে দেখে নেবেন। শুধু একটা বলি, ভাল মাইক্রোওভেন শুধু মাত্র গরম করার জন্য ৯০০ ওয়াট চায়। একটু আগে আমরা যে ১৬৫০টা মোমবাতির হিসেব দিয়েছিলাম তার মানে ছিল ১টা ১৮ ওয়াটের টিউবলাইট। এবার নিজেরাই একটু হিসেব করেনিন ৯০০ ওয়াট মানে কী!
এত গেল একটা ঘরের হিসেব, এবার শহর জোড়া আলোর ঝলকানি, মেট্রো রেল, লোকাল ট্রেন, এসি শপিং মল যোগ দিতে থাকুন, কূল কিনারা পাবেন না।
এর পরে আসে বৃহৎশিল্প। এক একটা যন্ত্র খায় হাজার হাজার ওয়াট বিদ্যুৎ। আইটি শিল্পের কাঁচে মোরা পেল্লায় বাড়িগুলোর অন্দর ঠান্ডা রাখতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে, সে সব তথ্য নেট ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন।
এই কারণেই আমাদের এই বিদ্যুৎ নির্ভর সভ্যতাকে যদি তুবড়ি সভ্যতা বলি, বোধহয় খুব ভুল হবে না। কারণ একটা তুবড়ি জ্বললে দারুণ আলো হয় ঠিকই, কিন্তু তার আয়ু কয়েক সেকেন্ড। এবার আমরা যদি চাই চাই তুবড়ি জ্বালিয়ে ঘর আলো করবো তাহলে ক্রমাগত তুবড়ি জ্বালিয়েই যেতে হবে। তাতে ঘরের দশা যা হবে, সেটা আর বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না। সত্যিই এই তুবড়ি সভ্যতার চোটে দুনিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা অনেকেই সেটা টের পাচ্ছি না।
আগেই বলেছি এই বিদ্যুৎ মূলত তাপবিদ্যুত এবং তা কয়লা নির্ভর। কয়লা নির্ভর বিদ্যুতের বিকল্পে অনেকে পারমানবিক বিদ্যুতের হয়ে সওয়াল করেন। এই লেখায় পারমানবিক বিদ্যুতের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করবো না, কলেবর প্রকাণ্ড বেড়ে যাবে। এই বিষয়ে বহু ভাল লেখা আছে, একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। শুধু একটা কথা স্পষ্ট করে দিই - আমরা পারমানবিক বিদ্যুতের বিরোধী। আমরা মনে করি পারমানবিক বিদ্যুৎ কোনও কল্যাণকর বিকল্প হতে পারে না।
কয়লা কোথা থেকে আসে?
খোলামুখ খনি আর সুড়ঙ্গ খনি নিয়ে অনেকে কৌতুহল দেখাচ্ছেন। প্রাথমিক কিছু বিষয় বলা যাক। এবার কিছু ছবির সাহায্য নিতে হবে। সঙ্গের ছবিগুলোতে নম্বর দেওয়া আছে। প্রতিটি প্রসঙ্গের সাথে নম্বর মিলিয়ে দেখে নেবেন।
গোড়ায় আবার টার্মোলজির ধাঁধা - ক্রস সেকশন। শিখে নিই, ১ নম্বর ছবি দেখুন। একটা ডিমকে A,A1 বরাবর কাটলে A ছবির মত দেখতে পাবো। B,B1 বরাবর কাটলে B ছবির মত দেখতে পাবো। কাটলে সাইড থেকে যা দেখা যায় তাই ক্রস সেকশান।
সুরঙ্গ খনি -
২ নম্বর ছবি দেখুন, এটা একটা কয়লা খনি অঞ্চলের ক্রস সেকশান। ওপরে মাটি টিলা জঙ্গল, নিচে বহু পাথরের স্তর। বেশ কয়েকটা স্তরের নিচে থাকে কয়লার স্তর(কালো রঙ দিয়ে দেখানো হয়েছে। কয়লার স্তরও সাধারণত কয়েকটা থাকে। এই কয়লার স্তরগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্রমাগত ঢালু হয়ে মাটির আরও গভীরে চলে যেতে থাকে। সাদা রঙ দিয়ে সুরঙ্গ বোঝানো হয়েছে। তীর চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে সুরঙ্গ ক্রমাগত কোন দিকে বাড়বে। ছবিতে একটা লাল দাগ দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে স্তরগুলো হঠাৎ বেঁকে গেছে। এই লাল দাগ দিয়ে চ্যুতি বা ফল্ট বোঝানো হয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচের স্তর হঠাৎ নেমে যায় বা উঠে যায়। সুরঙ্গও ওভাবেই কাটতে হয়। এই ধরণের কয়লা খনিতে প্রাণের ঝুঁকি খুবই বেশি। আমি যতবারই নেমেছি, বণ্ডে সই করে নামতে হয়েছে। এরকম খনির একটা নকল আছে কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে। বেশ ভাল অনুকরণ, আগ্রহ থাকলে দেখে আসতে পারেন। ওই মডেলে পনেরো ফুটের মত নিচে নামতেই বহু দর্শকের ভয় লাগে, ক্লস্টোফোবিয়া হয়। আসল কয়লা খনি ৫০০ ফুটেরও বেশি গভীর হয়।
এই সুরঙ্গ খনিতে প্রাণের ঝুঁকি তো বেশি অবশ্যই এছাড়াও বহু সমস্যা আছে। মূল সমস্যা হল অপচয়। ৩ নম্বর ছবি দেখুন। কয়লার স্তরের ওপরের স্তরগুলো যদি সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে খনির কয়লার স্তর হবে কিছুটা এরকম দেখতে। যে কালো থামগুলো দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলোও কয়লা। যে কয়লা ব্যবহারের জন্য তোলা হচ্ছে, সেই কয়লাই। এই থামের আকৃতির কয়লাগুলো ছেড়ে রাখতে হয়, নাহলে ওপরের স্তর ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ এই থামগুলো পুরোটাই অপচয়। আসলে ব্যাপারটা আরও বহুগুণ জটিল, বোঝার সুবিধার জন্য সরল করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবত অপচয় আরও অনেক বেশি।
সুরঙ্গ খনিও একটা সময়ের পরে পরিত্যক্ত হয়। নিয়ম হচ্ছে, সুরঙ্গ বালি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া। বাস্তবত তা হয় না। সেটার কারণ কখনও সদিচ্ছার অভাব, আবার বাস্তবতও বালি দিয়ে ওই সুরঙ্গ পুরোপুরি ভরাট করা সম্ভব নয়। আর এই ভরাটের জন্য যে পরিমাণ বালি লাগবে সেটাও সেই বালির খনি অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটায়। ফলে খনি অঞ্চলে হঠাৎ করে মাটি ধসে যাওয়া, নিচের কয়লার স্তরে আগুন লেগে মাটির উপরে উত্তাপ বা ধোঁয়া বার হওয়া ইত্যাদি আরও হাজার বিপদ থাকে।
খোলা মুখ বা ওপেন কাস্ট খনি -
এখন সমস্ত কয়লা খনি ওপেনকাস্ট। অর্থাৎ একটা প্রকাণ্ড বড় গর্ত, সেই গর্ত কত বড়, আর কত গভীর তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। সেই গর্তের পরিমাপ বর্গ কিলোমিটার দিয়ে মাপতে হয়, গভীরতা ৩০০ মিটারেরও বেশি।
আবার ছবির সাহায্য নিই। এই ছবিগুলো আমার তৈরি করা মডেলের। আসল খনি আরও প্রকাণ্ড হয়, ছবিতে ধরাই মুশকিল। তাই বোঝানোর সুবিধার জন্য মডেলের ছবি ব্যবহার করছি।
৪ নম্বর ছবি দেখুন, একটা গর্তের মত যায়গা, লেখা আছে খাদান, আর একটা ঢিপির মত উঁচু, লেখা আছে ডাম্প। আগেই বলেছি ওপেন কাস্ট খনির গর্ত হয় প্রকাণ্ড বড়।
সেই গর্ত থেকে উঠে আসা বিপুল পরিমান মাটি-পাথর কী হয়? মূলত তিনটে ভাগ হয়। ১। টপ সয়েল ডাম্প, ২। মেইন ডাম্প, ৩। ব্যাকফিল।
মাটির নিচের কিছু দূর পর্যন্ত যা উপাদান থাকে তাতে গাছপালা জন্মাতে পারে, তাই এই মাটিটা আলাদা রাখা হয় টপ সয়েল ডাম্পে। বাকি পাথুরে মাটি জমা করা হয় মেইন ডাম্পে। খনির মূল গর্ত প্রথমে যেখানে হবে, পরে তার থেকে অন্য দিকে ক্রমাগত সরতে থাকে যেদিকে খনি এগোয় তার উলটো দিকের গর্তের পাড় ক্রমাগত ভরাট হতে থাকে, একে বলে ব্যাকফিল, এই ব্যাকফিলের উপরে টপ সয়েল বিছিয়ে দেওয়া হয়। কৃত্রিম বন সৃজন করা হয়। ৫ নম্বর ছবি দেখুন, বাঁদিকে ক্রমাগত মাটি কাটতে কাটতে এগোবে, ডান দিকের ব্যাক ফিল ক্রমাগত ভরাট হতে হতে এগিয়ে আসবে। এই খনিটা ক্রমাগত বাঁদিকে সরে যাবে (হলুদ তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে)।
একটা বড় খনিতে আড়াই তিন হাজার লোক কাজ করে। কিন্তু বুঝতে হবে অতি সামান্য অংশ খনির মূল টেকনিকাল কাজ করে। মাটি খোঁড়া ভরাট সবই যন্ত্রের সাহায্যে হয়, কয়েক শ লোক এই কাজগুলো করে ফেলে। বেশির ভাগ লোক রাস্তা বাগান ঝাঁট দেয়, অন্যান্য ফাই ফরমাশ খাটে। খনিতে নামা ওঠার ঢালু রাস্তার পাশে নিরাপত্তার জন্য মাটি বা পাথরের বাঁধ দেওয়া হয়, একে বলে বার্ম। বহু লোক বার্মের দেখাশুনা করে, চুন দিয়ে মার্কিং করে। অর্থাৎ এই আড়াই হাজার লোকের মধ্যে খুব কম অংশই নিতান্ত অপরিহার্য, বাকিদের রোজ কাজ থাকে না।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এর থেকে সুন্দর ব্যবস্থাপনা আর কিই বা হতে পারে! কিন্তু এর পাশাপাশি আরও বহু ঘটনা ঘটে। ডাম্প আর ব্যাকফিলের মাটি একেবারেই প্রাকৃতিক থাকে না। ব্যাকফিল, ডাম্পে জড়ো হয় বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যাওয়া পাথরের টুকরো, যা নিতান্ত ঝুরঝুরে। স্বাভাবিক মাটির নিচে পাথর জল বালি খনিজের অনেক রকমের স্তর থাকে। লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া বিক্রিয়ায় এই ভূপ্রকৃতি তৈরি হয়। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বনভূমি শুধুমাত্র মাটির উপরিতলের চরিত্রের উপর নির্ভরশীল নয়, সেই মাটির বহু নিচে পাথরের স্তর, জলস্তর, জলপ্রবাহ, মাটির ঢাল আরও বহু কিছুর উপর নির্ভরশীল। ব্যাকফিল বা ডাম্পে এই ভূপ্রকৃতিই বিলীন হয়ে যায়। ভূপ্রকৃতির উপর নির্ভরশীল গাছপালা, বনজ সম্পদ, তার ওপর নির্ভরশীল প্রাণী জগৎ; খনিগুলো এই সমস্ত কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।
ওপেন কাস্ট খনিতে যতদিন খনিজ পাওয়া থাকে ততদিন খোদাই আর ভরাট চলতে থাকে। একদিকে খোঁড়া হচ্ছে অন্যদিকে ভরাট হচ্ছে। এই ভাবে চলতে চলতে একসময় খনিজ শেষ হয়ে যায়, অথবা যেটুকু থাকে তা তোলার খরচ এত বেশি যে তাতে খনি মালিকের পরতায় পোষাবে না। তখন খনি পরিত্যক্ত হয়। পড়ে থাকে একদিকে মেইন্ডাম্পের ঝুরঝুরে পাথরের টিলা অন্যদিকে সিড়ির মত ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া এক প্রকান্ড গর্ত। সিড়ি মানে বাড়ির সিড়ি ভাববেন না। এই সিড়ির একেকটা ধাপ ১০মিটার, মানে তিন তলা বাড়ি সমান একটা ধাপ। সেই গর্ত প্রায় একটা প্রমাণ আকারের হ্রদের মতো। তার গভীরতা কয়েক শ মিটার। কোনও বড় দীঘির গভীরতা ২০মিটারও হয়না, আর পরিত্যক্ত খনির গভীরতা ২৫০/৩০০ মিটার, অত গভীরে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী জন্মায় না। তাতে টলটলে জল জমে না, মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা বহু বিষাক্ত খনিজ সেই জলে মেশে। নিখুঁত প্রাকৃতিক ভারতসাম্যের এক বনভূমি, খনিজর চাহিদা মেটাতে হয়ে যায় প্রকাণ্ড এক মৃত্যুফাঁদ। কত প্রজাতির প্রাণী উদ্ভিদ যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই খনির সর্বগ্রাসী খুদায় তার কোনও খতিয়ান নেই।
যে জঙ্গল উজার হয়ে গেল ঝকঝকে আলো জ্বালানোর স্বার্থে, সেই জঙ্গল এত দিন কী করছিল? সে কি শুধু অক্সিজেন আর কাঠের যোগানদার ছিল? এই বনভূমির উপর নির্ভরশীল আমাদের দেশের আদিবাসী সমাজ। আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হয় - নদীর ধারে উর্বর পলি মাটি অঞ্চলে মানুষ প্রথমে বসতি স্থাপন করে, কারণ শেখানে কৃষি কাজ করা সহজ। কিন্তু আমরা কী ভেবে দেখি - আমাদের আদিবাসী সমাজ কেন দুর্গম বনাঞ্চলে, পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বসবাস করে? কেন এত কষ্ট সহ্য করে তারা ঐরকম ঝুঁকিপুর্ণ এলাকায় থাকে? অনেকে বলেন - তথাকথিত সভ্য মানুষদের অত্যাচারে আদিবাসীরা এরকম জায়গা বেছে নিয়েছে। হ্যাঁ তা হতেই পারে, কিন্তু তার পাশাপাশি আরও একটা সত্য আছে - আদিবাসীরা জঙ্গল থেকে জীবনযাপনের বহু উপাদান সংগ্রহ করতে সক্ষম। তথাকথিত সভ্য মানুষেরা বনাঞ্চলকে আদিবাসীদের মত করে চেনেই না। এখনও বহু আদিবাসী সমাজে কৃষিকাজ প্রচলিত নয়, তারা এখনো মূলত সংগ্রাহক, অত্যন্ত কম তাদের চাহিদা। স্বাধীন ভারতে খনি ড্যাম রাস্তা রেলপথ আর কারখানা বানানোর উন্নয়নের গুঁতোয় আমাদের দেশের প্রায় ১০ কোটি আদিবাসী উৎখাত হয়েছে তাদের নিজস্ব আবাস থেকে। তাদের ঠাঁই হয়েছে নোংরা বস্তিতে। স্বাধীন প্রকৃতি নির্ভর জীবন থেকে উৎখাত হয়ে তারা হয়েছে সস্তার মজুর। আদিবাসীদের শিল্প কলা গান নাচ কারিগরি সব কিছুই ধ্বংস হচ্ছে এই উৎখাতের পরিনামে। নগরায়নের বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনের এই অবনমনকে মানবো কোন নৈতিকতায়?
এতক্ষণ আলোচনা করলাম কয়লা খনি নিয়ে। লোহার খনি সুরঙ্গ হয়ই না। গোটা পাহাড় গুঁড়ো হয়ে যায় লোহার যোগান দিতে। বাড়িতে লোহা লাগানোর সময় মজবুতির আকঙ্খায় আমরা কি মনে রাখি - এই লোহা আসছে কোথা থেকে? কত আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ হচ্ছে, কত পশুপাখি মারা পড়ছে, কত গাছ কাটা পড়ছে, কত প্রজাতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে চিরকালের মত! এলুমিনিয়ামের স্লাইডিং জানলা লাগাবো বাড়িতে দিব্যি ঝকঝক করবে, আবার নিয়মগিরি পাহাড়ে আদিবাসীদের লড়াইকে সমর্থনও করবো, এত দ্বিচারীতা আদৌ সইবে? নিয়মগিরিতে বেদান্ত গোষ্ঠী বক্সাইটের খনি করতে চেয়েছিল, যা এলুমিনিয়ামের কাঁচা মাল।
রাস্তা পাকা করার দাবিতেও আন্দোলন করবো আবার সুস্থ পরিবেশেরও দাবী করবো! ভাল মজা! রাস্তার স্টোনচিপ্স, পিচ আসবে কোত্থেকে? রেল লাইন বাড়ানোর দাবি করবো কিন্তু জবাব দেবো না - ঐ বিপুল পরিমান পাথর, ইস্পাত আসবে কোত্থেকে? কোত্থেকে আসবে ট্রেন চালানোর বিদ্যুৎ অথবা ডিজেল?
উন্নত জীবন যাপনের যা মাপকাঠি আমরা ধরেছি, তার সব কিছুই ধ্বংসাত্মক। আমাদের জীবন যাপনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা প্রকৃতিকে এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছি, যা পুরণ হবার কোনও পথ নেই।
বিকল্প জ্বালানির যে সমস্ত উৎসগুলোকে খোঁজা হয়েছে - সৌর শক্তি, বায়ুশক্তি, জলশক্তি, হাইড্রোজেন জ্বালানি - কোনও কিছু দিয়ে আজকের তাপবিদ্যুতের সম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন সম্ভব নয়। আজ যে বিপুল পরিমাণ কয়লা দেউচা পচামিতে পাওয়া গেছে, তাও অফুরাণ নয়। সেও চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে ফুরিয়ে যাবে। পৃথিবীর সব জীবাশ্ম জ্বালানীই আগামী পঞ্চাশ ষাট বছরের বছরের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে এবং আর তৈরি হবে না। অর্থাৎ তুবড়ি নিভে যাবার সময় হয়েছে।
খনি বিরোধী আন্দোলন করা দরকার। নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে, আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার তাগিদেই করা দরকার। কিন্তু খনি বিরোধী আন্দোলন করার আগে আসুন একটা তালিকা বানাই - উন্নত জীবনের কী কী ত্যাগ করতে আমরা নিজেরা প্রস্তুত। আগে নিজেদের পোষা বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধি। তারপর প্ল্যাকার্ড লেখা যাবেখন। আর যদি আন্দোলন হয় শুধুমাত্র হিড়িক তুলে নেতা হবার রাস্তা সুগম করার পন্থা তাহলে তা নেহাতই ছুঁচোবাজি, হুস করে জ্বলে উঠে ফুস করে কোথায় সেঁধোবে তা আর বললাম না।
এবার এই জোড়া ফলার মাঝখানে আমাদের কি কিছুই করার আছে। আছে বৈকি কারিগরি উৎপাদন খনিজ নির্ভর উৎপাদনের অনেক খানি বিকল্প হতে পারে।
কর্মসূত্রে বেশ কিছু খনির অন্দরমহল দেখার সুযোগ হয়েছে৷ নিতান্ত পেটের দায়ে খনি বিষয়ক বহু বিষয় জানতে হয়েছে। এই লেখায় আমার জানা বহু তথ্য আলোচনা করা হয়েছে, আমার জ্ঞান মতে এই তথ্যগুলো ঠিকঠাক, কিন্তু পাঠকদের প্রতি অনুরোধ রইল, সন্দেহ হলে যাচাই করে নেবেন, ত্রুটি থাকলে জানাবেন, শুধরে নেবো।
0 Comments

Post Comment