পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব- ইন্ডিয়ান ডক্যুমেন্টারি-র প্রতিবাদ

  • 18 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 773 view(s)
  • লিখেছেন : উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
এইবারে ২৯ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যা প্রদর্শিত হতে চলেছে ৫ থেকে ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যাতে সবথেকে আমাদের ভারতবর্ষের সমাজে প্রতিবাদ ও আঙ্গিকের উপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম আছে একগুচ্ছ।

প্রতিবারের মতো ২০২২ এ ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (KIFF) এসেছিল বিশ্ব সিনেমার সেরা কিছু ছবি। সিনেমা ইন্টারন্যাশানাল বিভাগে নির্বাচিত ছবিগুলি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কৃত হয়ে থাকে। কান, বার্লিন, ভেনিস, সানড্যান্স, লন্ডন, শিকাগো প্রভৃতি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সম্মানিত হয়ে থাকে এই ছবি। সেইজন্য সিরিয়াস দর্শক মুখিয়ে থাকে প্রতিবছর এইসব ছবি দেখবার জন্য। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবি রুবেন অস্তলান্দের 'ট্রায়াঙ্গেলস অফ স্যাডনেস'। সমস্ত ক্লাস স্ট্রাকচারকে প্রশ্ন করেছে এই ছবি, পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে যা একটি ব্যাঙ্গাত্মক ব্ল্যাক কমেডি বলা যেতে পারে। গতবছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে এটি পাম দি 'অর (সেরা ছবি) পুরষ্কার পেয়েছে।

খুব সংবেদনশীল, শক্তিশালী আরেকটি ছবি লুকাস ঢোঁত পরিচালিত 'ক্লোজ' । দুটি বাচ্চা ছেলে ও তাদের সম্পর্ক নিয়ে এই ছবি। ইরানী পরিচালক জাফর পানাহীর 'নো বেয়ার্স' অসাধারণ ভাবে মন কেড়ে নেয়। প্রতিবাদও যখন করা আর যায় না, নজরবন্দী এমনই, তখনও প্রকৃত শিল্পী জানেন কীভাবে সাবভার্সন তৈরি করা যায় যার আরেক নাম প্রতিবাদ। বলতেই হয় পাকিস্তানের ছবি সায়িম সাদিকের 'জয়ল্যান্ড'-এর কথা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি। পাকিস্তানে এই ধরণের সাহসী ছবি কী করে তৈরি হয়েছে, সেটা ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। একটি আপাতভাবে সুখী দম্পতি। স্বামী এক ট্রান্সজেন্ডারের প্রেমে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রগাঢ় ভালবাসার সম্পর্ক। ছবিটি কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরেই প্রথম শো ২৮ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। আরেকটি খুব ভাল ছবি এসেছিল- 'প্রিজন ৭৭', স্পেনের আলবার্তো রুদ্রিগেজ পরিচালিত। আইন ব্যবস্থা কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে এই ছবি যা সমাজব্যবস্থা কে প্রশ্ন করে। ফ্রান্সের ছবি 'ক্রাইমস অফ দ্য ফিউচার' হ'ল একটি ২০২২ সালের সায়েন্স ফিকশন বডি হরর ড্রামা ফিল্ম যা ডেভিড ক্রোনেনবার্গ রচিত ও পরিচালনা করেছেন। ছবিতে অভিনয় করেছেন ভিগো মরটেনসেন, লিয়া সেডক্স এবং ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট। খুব মুন্সিয়ানা দিয়ে তৈরি ছবিটি। ভীষণ well crafted । মোটেও সহজবোধ্য বলে গণ্য হবে না এবং এই ছবিটি বেশ ক্রিটিক্যাল।

 

ট্রাজেডির অবিস্মরণীয় রূপকার মাইকেল কাকোয়ানিস (জন্ম ১৯২১) ছিলেন গ্রিক চলচ্চিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তাঁর হাত ধরেই গ্রিক চলচ্চিত্রের জায়গা করে নেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের আঙিনায়।নাটক ও অভিনয় বিষয়ে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন ইংল্যান্ডে। দেশে ফিরে তৈরি করেন 'উইন্ডফল ইন এথেন্স' (১৯৫৪), 'স্টেলা' (১৯৫৫), 'এ গার্ল ইন ব্ল্যাক' (১৯৫৬) এবং 'এ ম্যাটার অফ ডিগনিটি' (১৯৫৭)। বলা যেতে পারে, এই অনুসরণে নির্মিত একটি ট্রিলজি হ'ল 'ইলেকট্রা' (১৯৬০) , 'দ্য ট্রোজান উইমেন(১৯৭১), এবং 'এফিগেনিয়া'(১৯৭৭)। প্রাচীন যুগের গ্রীক নাট্যকার ইউরিপিডিসের লেখা এই তিনখানি ট্রাজেডির রূপ দেন তিনি। ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে সফল চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ তার এই কাজগুলি। ট্রাজেডি তার চলচ্চিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল কারণ তিনি মনে করতেন আধুনিক জীবনকে বোঝা ট্রাজেডির মাধ্যমেই সম্ভব। অবশ্যই একথা মাথায় রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি তাঁর চৈতন্যে গভীর ছাপ ফেলেছিল। ফলে ট্রাজেডির প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ স্বাভাবিক। সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে তিনি ১৫ টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করেন। থিয়েটারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। পরিবারিক অনুপ্রেরণায় তিনি লন্ডনে আইন পড়তে যান।আইনের পাঠ শেষ করলেও আইন ব্যবসায় তাঁর উৎসাহ তেমন ছিল না। তিনি ১৯৪০ ও তারপরে লন্ডনের থিয়েটারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নাটকে অংশগ্রহণ করেন।তারমধ্যে অন্যতম জর্জ বার্নার্ড শ'র 'কনভারশন' আর আ্যালবেয়ার কাম্যুর 'ক্যালিগুলা'। ওনার বিশেষ উৎসাহী ছিল সংগীতে। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক শহরে বিখ্যাত অপেরা হাউসে তাঁর নির্দেশিত অপেরা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাইকেল কাকোয়ানিস এর সবচেয়ে সফল ছবি : 'জরবা দ্য গ্রীক' (১৯৬৪) ছবিটি যা তাঁকে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করে তোলে। কাকোয়ানিস শেষ ছবি নির্মাণ করেন ১৯৯৮ সনে, আন্তন চেকভের 'দ্য চেরি অরচার্ড'। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই প্রবাদপ্রতিম গ্রীক চলচ্চিত্রকারের মৃত্যু হয় ২০১১ সালে ৯০ বছর বয়সে। তারই শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ কিছু ভাল ছবি দেখানো হয়।


কিন্তু এইবারে ২৯ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যা প্রদর্শিত হতে চলেছে ৫ থেকে ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যাতে সবথেকে আমাদের ভারতবর্ষের সমাজে প্রতিবাদ ও আঙ্গিকের উপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম আছে একগুচ্ছ। 'কম্পিটিশন অন ইন্ডিয়ান ডক্যুমেন্টারি ফিল্মস' সেকশনে এই ছবিগুলি যথাক্রমে - সৌরভ ষড়ঙ্গীর 'বাঘ বাহিনী' (Tiger Army), বিন্দু নায়ারের 'ফোর্জড ইন ফায়ার' , বিশাল পি ছালিয়ার  'সাম ডে' (Someday), শুভ দাস মৌলিকের 'নবজাগরণের গান'চ, হায়দার খানের 'ল্যাঙ্গুর' (Langur - The Man Monkey) , রমেশ বোরা ও শিবানী বোরার 'চ্যালেঞ্জ' , অভিজিৎ চক্রবর্তীর 'শবর - অরণ্যের অন্ন কথা', সুষমা মিলিন্দ কুভালেকারের ' দ্য ডিভাইন হার্ট '।
'বাঘ বাহিনী' তে যে বিশ্বের মানুষ পছন্দ করে 'সুন্দরবন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারদের' রক্তমাখা আখ্যান যেখানে বাঘেরা সর্বদাই দুষ্টু খলনায়ক। অতএব,  তাদের হত্যা করা ছিল বীরত্বপূর্ণ কাজ।  যদিও আমাদের জ্ঞানী পূর্বপুরুষরা এও জানত যে বাঘরা বনের রক্ষক, কিন্তু মানুষ তো বন্দুক এবং মস্তিষ্কে সজ্জিত, তাই তাদের বেশিরভাগকে নির্মূল করেছে।  আমরা তার উজ্জ্বল জ্বলন্ত জঙ্গল হারিয়ে শেষ করে দিলাম পরিবেশ ও প্রতিবেশ। জঙ্গল হারানো মানে গরীব মানুষেরা নিশ্চিহ্ন হবে। অভিজিৎ চক্রবর্তীর 'শবর - অরণ্যের অন্ন কথা' ছবিতে দেখানো হয়েছে, পুরুলিয়া জেলার আটটি ব্লকে, ১৬৮টি গ্রামে ৩১২১ পরিবারের অল্প সংখ্যক ১২৩৬০ জন বনবাসী বাস করে।  এই ব্যক্তিদের সরকারীভাবে 'শবর' বলা হয়।  আগে তারা শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিল, কিন্তু এখন তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে।  কিন্তু তাদের সরলতা আগের মতোই রয়ে গেছে।  এই চলচ্চিত্রটি তাদের জীবনের গল্পের দিন-আজকের বিবরণ তুলে ধরেছে। ছবিটি দেখলে মনে হয় এই আমাদের দেশ, এই আমাদের প্রাণ - আমাদের প্রতিবাদ থাকুক এই মানুষগুলোর সততার দর্পনে।

0 Comments

Post Comment