পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জলবায়ু সংকট ও পুঁজির দৌরাত্ম্য

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 202 view(s)
  • লিখেছেন : অনিরুদ্ধ দত্ত
একটি ছোট পরিবর্তন (যেমন বননিধন)➤ বড় পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে ➤যার ফলে নতুন পরিবর্তন আরও তীব্রভাবে সেই ধ্বংসকে বাড়িয়ে তোলে ➤ অবশেষে সিস্টেমটি “tipping point” অতিক্রম করে পড়ে যায় এক অপ্রত্যাবর্তনীয় সংকটে। তাই বলা যায় –এটি এমন একটি দশাবিন্দু, যেখানে কোন প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় ছোট একটি পরিবর্তন ঘটলেও সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় রূপ নেয়। যেমন হিমালয় গ্লেসিয়ার➤ বরফ গলন➤ নদীপ্রবাহ অস্থির➤ ভূমিধস➤উদ্ভিদ ধ্বংস➤ আরও উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বরফের গলন।

বিপজ্জনক সীমা অতিক্রমের পথে পৃথিবীর পরিবেশ। “Global Tipping Points Report” (University of Exeter ও Global Systems Institute-এর যৌথ প্রকাশনা) আসলেই এক চূড়ান্ত ঘণ্টাধ্বনি। এটি পৃথিবীর জলবায়বীয় ভারসাম্যের এক বিপজ্জনক সীমানা অতিক্রমের ইঙ্গিত দেয়।

২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে কোপেনহেগেন থেকে প্রকাশিত “Global Tipping Points Report”-এ ১৬০ জন বিজ্ঞানী এক অভূতপূর্ব সতর্কবার্তা দিয়েছেন –বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে একের পর এক “tipping point” বা অপ্রত্যাবর্তনীয় সীমা অতিক্রম করছে পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থা। রিপোর্টে বলা হয়েছে –সমুদ্রের প্রবাল প্রাচীর (coral reefs) প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবে ধ্বংস হতে শুরু করেছে, অ্যামাজন রেইনফরেস্ট ধ্বংসের সীমায় পৌঁছে গেছে; গড় উষ্ণতা মাত্র ১.৫°C বৃদ্ধিতেই তার ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। Atlantic Meridional Overturning Circulation (AMOC) নামক বিশাল সমুদ্রস্রোত ব্যবস্থাও অস্থির হচ্ছে। যার কারণে ইউরোপে শীতকালীন আবহাওয়া হঠাৎ পরিবর্তিত হতে পারে।

এই সতর্কবার্তা কেবল পরিবেশগত নয় বরং সভ্যতার ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে এক অশনি সংকেত। কারণ একবার এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। পৃথিবী এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে ‘tipping points’ বা পরিবেশগত উলটফেরার সীমা একে একে অতিক্রম করা শুরু হয়েছে। এর অর্থ, একবার যদি কোনো ইকোসিস্টেম সেই সীমা পেরিয়ে যায়, তাহলে স্বয়ং-প্রবাহিত ধ্বংসের চক্র (self-reinforcing degradation loop) শুরু হয়, যা থামানো প্রায় অসম্ভব।

'টিপিং পয়েন্ট'-এর অর্থ কী?

“Tipping Point” বলতে বোঝায় এমন এক সংকট মুহূর্ত, যখন কোন প্রাকৃতিক ব্যবস্থা (ecosystem) তার নিজস্ব ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুতহারে অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের দিকে এগোয়। তখন ছোট একটি পরিবর্তনও বিশাল বিপর্যয় ডেকে আনে। অর্থাৎ একটি ছোট পরিবর্তন (যেমন বননিধন)➤ বড় পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে ➤যার ফলে নতুন পরিবর্তন আরও তীব্রভাবে সেই ধ্বংসকে বাড়িয়ে তোলে ➤ অবশেষে সিস্টেমটি “tipping point” অতিক্রম করে পড়ে যায় এক অপ্রত্যাবর্তনীয় সংকটে। তাই বলা যায় –এটি এমন একটি দশাবিন্দু, যেখানে কোন প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় ছোট একটি পরিবর্তন ঘটলেও সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় রূপ নেয়। যেমন হিমালয় গ্লেসিয়ার➤ বরফ গলন➤ নদীপ্রবাহ অস্থির➤ ভূমিধস➤উদ্ভিদ ধ্বংস➤ আরও উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বরফের গলন। আর একটি উদাহরণ, অ্যামাজন জঙ্গল > গাছ কাটা > বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া > মাটি শুকিয়ে যাওয়া > আরও গাছের মৃত্যু > বৃষ্টিপাত আরও কমে যাওয়া > বনের মরুভূমিতে পরিণত হওয়া। অর্থাৎ এটি কেবল আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়। বরং পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য, কৃষি উৎপাদন, জলসম্পদ ও মানবজীবনের মূলভিত্তি ধ্বংসের সূচনা।

 

COP30 :এক নতুন দিগন্ত না পুরোনো প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি?

 

২০২৫ সালের COP-30 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ব্রাজিলের অ্যামাজন অরণ্যের প্রান্তে বেলেমে। এ বছরের ১০ থেকে ২১ নভেম্বরে তা চলবে। জাতিসংঘ জলবায়ু সংস্থা (ইউএনএফসিসিসি) আয়োজিত এই  ৩০তম বার্ষিক সম্মেলন বা কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস তথা কপ-৩০, যেখানে জড়ো হবেন বিশ্বনেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে এই সম্মেলনে। 

সম্মেলনের জন্য ব্রাজিল অ্যামাজন এক প্রতীকী স্থান, কারণ এখানেই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। তবে গত তিন দশকের COP ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে –এই সম্মেলনগুলো বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতির মঞ্চ হলেও বাস্তবে জলবায়ু নীতিতে তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। COP-21 (Paris Agreement, 2015)-এ প্রতিশ্রুতি ছিল উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ১.৫°C-এ সীমাবদ্ধ রাখা কিন্তু বর্তমানে উষ্ণতা ইতিমধ্যেই ১.৪৫°C ছুঁয়ে গেছে। তবুও অধিকাংশ উন্নত দেশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগ করেনি; বরং “net zero by 2050”–এর মতো সময় কেনার রাজনীতি শুরু করেছে। আমেরিকা মাথাপিছু বিচারে সবচেয়ে বড় দূষক দেশ হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোন দায় নিতে অস্বীকার করে এই আন্তর্জাতিক মঞ্চ  থেকে পালিয়েছে। উল্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গকে ‘হোকস' বলে বিদ্রূপ করেন।

 

অর্থাৎ, জলবায়ু সংকটের মুখেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাস্তব পদক্ষেপের বদলে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির আড়ালে নিজেদের দায় এড়াচ্ছে অথবা অস্বীকার  করছে।

 

কর্পোরেট পুঁজির ছায়ায় জলবায়ু রাজনীতি

 

আজকের জলবায়ু রাজনীতির নেপথ্যে রয়েছে এক গভীর কর্পোরেট প্রভাব ও শ্রেণি-রাজনীতি। উদাহরণ :

(ক) ফসিল ফুয়েল কর্পোরেশনগুলির দায় –ExxonMobil, Shell, BP, Chevron –এর মতো কোম্পানিগুলি প্রতি বছর কোটি কোটি ডলারের ভর্তুকি পায়। তারা জলবায়ু সংকটের মূল কারণ, কিন্তু নিজেদের দায় ঢাকতে “carbon capture” বা “green energy investment”–এর নামে greenwashing চালায়।

(খ)কার্বন বাজার: নতুন ধরণের মুনাফা –

“Carbon credit” ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী দেশগুলো নিজেদের নিঃসরণ “বজায় রাখছে” দরিদ্র দেশের বনভূমি কিনে নিয়ে।

ফলে স্থানীয় আদিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, বনভূমি বেসরকারি মালিকানায় চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ “সবুজ” নামে নতুন উপনিবেশবাদ তৈরি হচ্ছে।

 

অ্যামাজনের সংকট: উন্নয়ন না ধ্বংসের প্রকল্প?

 

অ্যামাজন বনাঞ্চল পৃথিবীর ফুসফুস, কিন্তু এখন সেটিই “carbon sink” থেকে “carbon source” হয়ে উঠছে। এর প্রধান কারণ –কৃষিজমি তৈরির জন্য বন উজাড়, পশুপালন ও সয়াবিন রপ্তানিতে কর্পোরেট দখলদারি এবং ব্রাজিল সরকারের “সবুজ উন্নয়ন”-এর নামে কর্পোরেট বিনিয়োগ। Cargill, JBS, Bunge–এর মতো কর্পোরেশনগুলো অ্যামাজনের জমি দখল করে কৃষি উৎপাদন করছে। “Global Tipping Points Report”-এ গবেষকেরা সতর্ক করেছেন যে অ্যামাজনের প্রায় ২৫% বনাঞ্চল ইতিমধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বা নষ্ট হয়ে গেছে। এবং যদি এটি ৩০–৩৫% সীমা অতিক্রম করে, তবে সমগ্র বন আর পুনরুদ্ধারযোগ্য থাকবে না। এটি এখন কেবল পরিবেশ ধ্বংসের মতো নৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং ভূমি ও শ্রমের রাজনীতির অংশ।

 

জলবায়ু সংকটের শ্রেণীচরিত্র

 

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো –যারা পৃথিবীর সবচেয়ে কম নিঃসরণ ঘটায়, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন আফ্রিকার কৃষক, দক্ষিণ এশিয়ার মজুর, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপবাসী, লাতিন আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে “সবুজ প্রযুক্তি”র নামে নতুন মুনাফার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ইলেকট্রিক গাড়ি, লিথিয়াম ব্যাটারি, হাইড্রোজেন ফুয়েল যা সবই আবার খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য নতুন উপনিবেশবাদকে উৎসাহ দিচ্ছে।

 

অর্থাৎ, জলবায়ু সংকট আজ এক শ্রেণী-সংকট, যেখানে পুঁজির মুনাফা বনাম জীবনের নিরাপত্তা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পুঁজিবাদী হামলা আসলে পুঁজির মরণোন্মুখ  আর্তস্বরের প্রকাশ, যাকে বাঙলা প্রবাদ  অনুসারে বলা যায় ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল'। অর্থনীতির ভাষায়, পুঁজিবাদী পথে ফুলে-ফেঁপে ওঠা ‘ফিকটিশাস ক্যাপিটাল’- কে নিয়ন্ত্রিত রাখার বাধ্যবাধকতায় পুঁজি মাটির রসের সন্ধানী আজ। অন্যথায় তার মৃত্যু। প্রাকৃতিক সম্পদের বেহিসাবী ব্যবহার পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ‘ফিকটিশাস ক্যাপিটাল’ কে রিয়েল ক্যাপিটালে পরিবর্তন করতেই হবে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। তাই প্রকৃতি ধ্বংসের চক্রবুহ্যে ঢোকা ছাড়া আর উপায়ই বা কী! তাতে মানুষ ও না-মানুষের আত্মাহুতি তো অবশ্যম্ভাবী।

 

বিকল্প পথের সন্ধান

 

উন্নয়নের বর্তমান মডেলই যে বিপর্যয়ের শিকড়, আলোচ্য রিপোর্টটি স্পষ্ট করে তা বলছে। এই ধ্বংস প্রাকৃতিক নয়, বরং পুঁজিবাদী উন্নয়ন মডেলের ফল। বর্তমান উন্নয়নচিন্তা মূলত অবিরাম মুনাফা, অদম্য ভোগবাদ এবং “growth fetishism”-এর উপর দাঁড়িয়ে। এর ফলে –প্রাকৃতিক সম্পদকে বাজারযোগ্য ‘পণ্য’ হিসেবে দেখা হয়; বন, জল,খনিজ, এমনকি কার্বনও ‘বাণিজ্যিক সম্পদ’-এ পরিণত হয়; আর রাষ্ট্র নিজেই কর্পোরেট স্বার্থের রক্ষক হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়া পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে দিয়েছে। “Tipping Points Report” বলছে –বর্তমান গতিপথে চললে পৃথিবী শীঘ্রই multi-tipping cascade-এর মুখে পড়বে, যেখানে এক বিপর্যয় আরেকটিকে ত্বরান্বিত করবে।

“Global Tipping Points Report” পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছে যে এই ধ্বংস রোধ করা সম্ভব। কিন্তু শর্ত একটাই –পুঁজিবাদী উন্নয়ন মডেল থেকে সরে এসে পরিবেশ- ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ –“To avoid irreversible collapse, societies must move beyond the capitalist model of growth and toward eco-justice and equitable sustainability.” এর জন্য প্রয়োজন –জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পে ভর্তুকি বন্ধ ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ন্যায্য রূপান্তর, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে পরিবেশ নীতি প্রণয়ন, অপচয় রোধ, অতিভোগী জীবনযাপন থেকে সংযমী, টেকসই জীবনের দিকে সমাজের পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বদলে আঞ্চলিক ও গণভিত্তিক পরিবেশ আন্দোলনের জোরদার সংহতি। প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা হতে হবে সমষ্টিগত, কর্পোরেট নির্ধারিত নয়। জলবায়ু রক্ষা মানে শুধু কার্বন হ্রাস নয়; বরং শ্রম, ভূমি, জল ও জীববৈচিত্র্যের উপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করা।

 

পৃথিবীর পক্ষে, পুঁজির বিরুদ্ধে

 

“জলবায়ুর সংকট মানে কেবল প্রকৃতির সংকট নয় —এটি ন্যায়ের সংকট।” COP-30 সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে মানবসভ্যতা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারে—

আমরা কি কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে, নাকি পৃথিবীর জীবনের পক্ষে দাঁড়াব? “Global Tipping Points Report” আসলে এক চূড়ান্ত ঘণ্টাধ্বনি –যদি এখনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের সভ্যতা প্রবেশ করবে অপ্রত্যাবর্তনীয় ধ্বংসযুগে।

পৃথিবী কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এক জীবন্ত পারস্পরিক সম্পর্কের জগৎ। যদি আমরা পুঁজিবাদী উন্নয়ন মডেলকে প্রশ্ন না করি, তবে প্রতিটি নদী, বন, বরফস্তর আমাদের আত্মবিনাশের পথে ঠেলে দেবে।

অন্যদিকে, যদি আমরা “পরিবেশ- ন্যায়ভিত্তিক সমাজ” নির্মাণে সাহসী পদক্ষেপ নিই –যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সমানভাবে মূল্যায়িত, তবে হয়তো এই ঘণ্টাধ্বনিই হবে নতুন এক মানবিক সভ্যতার সূচনা।

 

0 Comments

Post Comment