পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতি প্রসঙ্গে (চতুর্থ ও শেষ ভাগ)

  • 28 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 662 view(s)
  • লিখেছেন : শংকর
খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আচার্য শংকরের সময়ের (৭০০-৭৩২) পরবর্তীকালে ব্রহ্মবাদ ছাড়া বৈদিক চিন্তার আর কোনো ঘরানাই টিঁকে থাকেনি, অবলুপ্ত হয়েছে। বৌদ্ধ আন্দোলনও প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েছে। তাও ক্রমশ অবলুপ্ত হয়েছে। ফলত জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা যা কিছুর হাত ধরে ভারতে বিকশিত হয়ে হয়েছিল তার সকল গতিপথ রুদ্ধ করে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিজয়ী হয়েছে। আজকের বিজেপি তথা আরএসএস এই ধারারই ধারক বাহক। তারাই আবার প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-পদ্ধতির নামে বৈদিক জ্ঞান ভাঙিয়ে বাজার গরম করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং আজকের ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তার টুঁটি টিপে মারতে চাইছে।

আমরা ভারতীয় জ্ঞান-চর্চায় জ্ঞান ও কর্মের সংঘাত নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমরা একথাও বলেছিলাম যে, জ্ঞান উৎপাদন নির্ভর করে কর্মের ওপর। বৈদিক সভ্যতা ছিল তার পূর্ববর্তী হরপ্পা সভ্যতার তুলনায় অনেক পশ্চাৎপদ সভ্যতা। কিন্তু আদি বৈদিক মানুষ ছিল প্রধানত কেজো মানুষ। সুতরাং, কর্ম নিজেই তার নিজস্ব গুণে আবার জ্ঞানের অগ্রগতি ঘটাল। এই সূত্রে আমরা বৈদিক যাগযজ্ঞাদির কথা উল্লেখ করেছিলাম এবং সেখান থেকে গণিতের বিকাশের কথা বলেছিলাম।

 

মার্ক্সবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যজুর্বেদের অন্তর্গত শুল্বসূত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (১)। বৈদিক আচারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল যজ্ঞ। যজ্ঞের জন্যে সঠিক যজ্ঞবেদী নির্মাণ করতে হত। এই কাজটি উত্তরোত্তর জটিল চেহারা নিচ্ছিল। এখানে প্রথমে একটা ব্যাপার বুঝে নেওয়া দরকার। যজুর্বেদ মূলত পরবর্তী বৈদিকযুগের রচনা। আদিবৈদিক যুগে যজ্ঞ যা ছিল পরবর্তী বৈদিকযুগে তা সম্পূর্ণ আলাদা স্তরে চলে গেছিল। হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসস্তুপের ওপর যে বৈদিক সভ্যতা গড়ে উঠল তা তার পূর্ববর্তী সভ্যতার মতো শ্রেণিবিভক্ত ছিল না, ছিল শ্রেণীহীন। এর কারণ ছিল বৈদিক আর্যরা চাষবাস জানত না। প্রথমাবস্থায় তারা ছিল পশুচারণকারী অর্ধ-যাযাবর গোষ্ঠী। এই সময়ে এবং তার অব্যবহিত পরবর্তীকালে যখন তারা চাষবাস শিখেছে বটে কিন্তু তা খুব একটা উন্নত ধরণের নয়, ফলত ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা যখন নিত্যসঙ্গী তখন যে সমস্ত যজ্ঞগুলি তারা করত সেগুলি ছিল খুবই সাদামাঠা ধরনের। এই যজ্ঞগুলি ছিল একপ্রকার ম্যাজিক বা ইন্দ্রজাল। যে উদ্দেশ্যে যজ্ঞগুলি করা হত, যেমন বৃষ্টির জন্যে, বা ভালো ফলনের জন্যে, সেই উদ্দেশ্যগুলি যে যজ্ঞের মধ্যে দিয়ে সর্বদা অর্জিত হত এমন নয় (সেটাই তো স্বাভাবিক কারণ যজ্ঞ আর কাঙখিত ফললাভের মধ্যে তো কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই), কিন্তু যজ্ঞকারীরা মনে করত তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে। এতে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হত। আর এই আত্মবিশ্বাস তাদের সেই কাজগুলিই আরও দৃঢ়তার সাথে, বিশ্বাসের সাথে করার প্রেরণা জোগাত, যে কাজগুলির ফলে সত্যিই কাঙখিত ফল পাওয়া যায়। দেবীপ্রসাদ খুব চমৎকার বলেছেন (২), যজ্ঞগুলি ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষের হাতিয়ার। কিন্তু এমন হাতিয়ার যা সরাসরি প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে পারত না, পারার কথাও নয়। কিন্তু তা প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত মানুষের মনে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করত তা তাদের সেই দৈনন্দিন কাজগুলিকে আরও দৃঢ়তার সাথে, দক্ষতার সাথে করার প্রেরণা যোগাত, যা কিনা সত্যিই প্রকৃতিকে পরিবর্তিত করতে সক্ষম। অর্থাৎ, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে যজ্ঞগুলির ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। যজ্ঞগুলি পরোক্ষে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করত। সুতরাং, এই সমস্ত কিছু ছিল কর্মকে কেন্দ্র করে আধারিত। কর্মই তার কেন্দ্রীয় বিষয়। আর আমরা আগেই বলেছি, কর্মই হল জ্ঞানের জননী। কিন্তু প্রকৃতিকে পরিবর্তন করা, নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা, অথবা প্রকৃতির নিয়মগুলিকে অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী কর্মকে বিকাশ করা এবং কাঙখিত ফললাভ করা তো খুব একটা সহজ বিষয় নয়। এর জন্যে প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রচেষ্টা লাগে, এক দীর্ঘ সংগ্রাম লাগে। এই সংগ্রাম চলছিল। এর ফলে একদিকে যেমন কার্যকরী জ্ঞানের বিকাশ হচ্ছিল, তেমনই অন্যদিকে যজ্ঞগুলিও অতীতের তুলনায় ক্রমশ জটিল চেহারা নিচ্ছিল। তা আগের মত আর সাদামাঠা থাকছিল না। পাশাপাশি, জ্ঞানের বিকাশ উৎপাদিকা শক্তিরও বিকাশ ঘটাচ্ছিল। অতীতের অপ্রতুল উৎপাদনের জায়গা নিচ্ছিল অতিরিক্ত উৎপাদন। এই অতিরিক্ত উৎপাদনের মালিকানা কার হাতে যাবে এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে সমাজটা শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভক্ত হচ্ছিল। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম দেখা দিচ্ছিল। সুতরাং, একসময়ে যে যজ্ঞগুলি ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষের হাতিয়ার তা ক্রমশ এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে অন্য শ্রেণির মানুষের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছিল। ফলত, যজ্ঞগুলি আরও আরও দীর্ঘমেয়াদী, ব্যয়বহুল, জটিল হয়ে পড়ছিল। ফলত আবার তা দাবি করছিল জ্ঞানের অধিকতর বিকাশ। জ্ঞানের বিকাশ (ফলত, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ) অতীতের শ্রেণিহীন সমাজকে শ্রেণিতে বিভক্ত করল, শ্রেণিবিভক্ত সমাজ আবার জ্ঞানের বিকাশ ঘটাল। এভাবেই সমাজের জটিল বুনোট যজ্ঞগুলিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা দান করল। যজুর্বেদ এই নয়া সময়ের প্রতিনিধি।

 

অতীতের যজ্ঞরীতির জায়গায় দেখা দিল অনেক জটিল আচার-কেন্দ্রিকতা। যজ্ঞবেদী তৈরি হতে লাগল আগের থেকে সম্পূর্ণ নতুন রকম। এর জন্যে দরকার পড়ল জ্যামিতির প্রাথমিক জ্ঞানকে আরও উন্নত করা। নিখুঁতভাবে বৃত্ত অঙ্কন করতে বৈদিক আর্যরা আগেই শিখেছিল। নইলে সে চাকা তৈরি করতে পারত না। তাদের মধ্যে ঘোড়ায় টানা রথের বহুল ব্যবহার এটা প্রমাণ করে যে বৃত্ত অঙ্কনের জ্ঞান তাদের ছিল। আদিবৈদিক যুগের রচনা ঋগ্বেদে কাব্য সৃষ্টি করার দক্ষতাকে রথের চাকা তৈরি করার দক্ষতার সমপর্যায়ভুক্ত বলা হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায় তারা কী পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করত চাকা তৈরি করার কৃৎকৌশলে। কিন্তু যজ্ঞবেদী নির্মাণ করার জন্যে প্রয়োজন পড়ল নিখুঁত বর্গক্ষেত্র অঙ্কন যার একটি বাহুর পরিমাপ দেওয়া আছে। শুল্বসূত্র উদ্ধৃত করে দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে কীভাবে কতকগুলি পরষ্পর ছেদনকারী বৃত্রের সাহায্যে নিখুঁত বর্গক্ষেত্র অঙ্কন করা গেল যার একটি বাহুর পরিমাপ নির্দিষ্টকৃত। এইভাবে শুল্বসূত্র জুড়ে বিভিন্ন পরিমাপ পদ্ধতির গাণিতিক ও জ্যামিতিক সূত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে। যজ্ঞবেদীর প্রয়োজনে দরকার পড়ল ২-এর বর্গমূল নির্ণয় করার। এক্ষেত্রে বৌধায়ন যে ফর্মুলা দিয়েছেন তা হল,

√২ = ১ ১/৩ ১/৩.৪-১/১.৩.৩৪=১.৪১৪২১৫৬…, (৩) বলা বাহুল্য যে, দশমিকের পর পাঁচটি সংখ্যাই তিনি সঠিক বলেছিলেন। বর্তমানে আমরা জানি যে, সঠিক সংখ্যাটি হল ১.৪১৪২১৩৫৬। এভাবেই পাই (π) এর আবিষ্কার এবং প্রায় নিখুঁতভাবে তার মান নির্ণয়ও শুল্বসূত্রে দেখা যায় যা ভারতীয় প্রাচীন গণিতবিদ্যাকে উচ্চতা ও বিশিষ্টতা দান করেছে। মনে রাখতে হবে, যজুর্বেদীয় শুল্বসূত্রের রচনাকাল ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। তখনও পিথাগোরাসের জন্ম হয় নি। পিথাগোরাসের সমস্যা তার আগেই অন্য পদ্ধতিতে সমাধিত হয়েছে যজুর্বেদে। হয়ত, হরপ্পা সভ্যতার অবদান তাতে থেকেছে, হয়তো মেসোপটেমিয়ার গাণিতিক অগ্রগতির অবদান তাতে থেকেছে। কিন্তু তাতে করে জ্ঞানের জননী হিসাবে বৈদিক কর্মের গুরুত্ব এতটুকুও হ্রাস পায় না। শুল্বসূত্র নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় আমরা ঢুকব না। তা অনেকেই করেছেন। আগ্রহীজনে পড়ে দেখবেন। দেবীপ্রসাদের বইটিও পড়তে পারেন। আমরা সীমিত থাকত ভারতীয় জ্ঞানচর্চায় জ্ঞান ও কর্মের দ্বন্দ্বের বিষয়টিতে।

 

উপরের আলোচনা থেকে বর্তমানের চিন্তাশীল মানুষের মনে সঙ্গত কারণেই একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। যাগযজ্ঞ তো কুসংস্কার। তাহলে কি এটাই বলা হচ্ছে যে, কুসংস্কার থেকেও বিজ্ঞানের জন্ম হতে পারে? এই প্রশ্ন দেবীপ্রসাদেরও মনে হয়েছিল। তাই বৌধায়নের শুল্বসূত্রের গভীরে ডুব দিয়ে তিনি সহসাই এই ধাঁধার সামনে পড়ে যান। তাঁর কথায়,

 

"Practically all the modern scholars are inclined to accept the view that since in this text geometry is found to meet the requirements of constructing the fire-altars, the makers of it must have been the priests or their corporations. This, if true, would lead to the paradox of superstition or anti-science giving birth to science." (৪)

 

অর্থাৎ, সমস্ত আধুনিক পন্ডিতরাই এই মতকে গ্রহণ করেন যে, যেহেতু এই জ্যামিতিক ভাষ্যগুলি রচিত হয়েছিল যজ্ঞবেদী নির্মাণের জন্যে সেহেতু পুরোহিতশ্রেণিই ছিল এই সূত্রগুলির জনক। যদি তাই হয় তাহলে তা অবশ্যই আমাদের এই ধাঁধার সামনে ফেলে দেয় যে, কুসংস্কার বা (অপ)বিজ্ঞান জন্ম দিল বিজ্ঞানের।

 

এই ধাঁধা দেবীপ্রসাদ কীভাবে সমাধান করলেন? তিনি নিশ্চিন্ত হলেন এটা দেখিয়ে যে, যজ্ঞবেদীর গোটা কর্মটিই দাঁড়িয়ে রয়েছে ইঁটের ইমারতের ওপর। এবং এই ব্যাপারে পূর্ববর্তী সিন্ধুসভ্যতার মানুষেরাই পথিকৃৎ। সুতরাং, জ্যামিতির এই অগ্রগতি সিন্ধুসভ্যতাতেই হয়েছিল। বৈদিক পুরোহিতদের হাতে নয়।

 

আমরা বলতে বাধ্য যে, এখানে দেবীপ্রসাদের যুক্তি বড় দুর্বল। প্রথমত, যজ্ঞবেদী ইস্টকনির্মিত বা ইঁটের তৈরি হলেও গাণিতিক গণনার অগ্রগতির সঙ্গে ইঁটের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। বরং, যজ্ঞবেদী নির্মাণের সঙ্গেই তা সম্পর্কিত। দ্বিতীয়ত, সিন্ধুসভ্যতার খননকার্য থেকে এমন কিছু অঙ্কন পাওয়া গেছে যাতে পরষ্পরছেদনকারী বৃত্তের সন্ধান পাওয়া যায়। আরও কিছু যুক্তি থেকে এটা বোঝা যায় যে, হরপ্পা সভ্যতায় গণিতের একটা মাত্রায় বিকাশ হয়েছিল। কিন্তু শুল্বসূত্রের সূত্রগুলি হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার তার নিশ্চিত প্রমাণ এখনও নেই। এখনও পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে তাতে যজুর্বেদই প্রথম এই জ্ঞানকে সূত্রবদ্ধ করে তার নিজস্ব প্রয়োজনে, এবং তা হল যজ্ঞবেদী নির্মাণ। তৃতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতার মানুষ অবৈদিক বলে তার মধ্যে কুসংস্কার ছিল না, ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল না, তা তো নয়। তেমন ভাবা হলে সেটা হবে হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে একটা রোমান্টিক ভাবনা। বাস্তব তো তা নয়। সকল সভ্যতার মতো হরপ্পা সভ্যতায়ও ধর্মীয় আচার ছিল, ধর্মভাবনা ছিল। সুতরাং, অত নিশ্চিন্তে কীভাবে বলা যেতে পারে যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি সর্বদাই খুব সচেতন বিজ্ঞানসাধনার মধ্যে দিয়েই হয়েছে বা হয়?

 

আমরা এই ধাঁধার সমাধান অন্য পথে করব। এবং তা করব দেবীপ্রসাদের হাত ধরেই। আর, এই সূত্রেই বুঝে নিতে চাইব ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে জ্ঞান ও কর্মের দ্বন্দ্ব ও তার পরিণতির বিষয়টা। আসলে যজ্ঞগুলি পরবর্তীতে যে চেহারাই নিক না কেন, তার উৎপত্তি কুসংস্কার হিসাবে হয় নি। দেবীপ্রসাদই দেখিয়েছেন যে, যজ্ঞগুলির উদ্দেশ্যই ছিল কর্ম এবং তা প্রবলভাবেই কর্মকেন্দ্রিক। যজ্ঞগুলি ছিল একপ্রকার ম্যাজিক, ইন্দ্রজাল, যা মানুষের মনে তার সাফল্য সম্পর্কে বিশ্বাস যোগাত। কীসের সাফল্য? বলা বাহুল্য, কর্মের সাফল্য। এইজন্যেই দেখা যাবে বৈদিক দর্শনে যাঁরা কর্মবাদী পূর্ব মীমাংসাপন্থী তাঁরা সকলেই যজ্ঞের মাহাত্ম্য স্বীকার করেছেন। তাঁরা এমনকি ঈশ্বর বা ব্রহ্ম অথবা কোনো ধরণেরই জগত-নির্মাতা ও জগত-নিয়ন্ত্রণকারী অতিশক্তির অস্তিত্বই স্বীকার করেন নি। দেবীপ্রসাদ নিজেই এঁদের বস্তুবাদী দার্শনিক বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এঁরা কারা? এরা তো পুরোহিতশ্রেণিরই একটি অংশ, যাজ্ঞিক। পুরোহিত বটে, কিন্তু কার পূজারী? ঈশ্বরের নয়, কর্মের। যজ্ঞের পৌরোহিত্য তাঁদের কাছে ছিল আসলে প্রবল কর্মবাদ। যজ্ঞের বিবর্তনের ফলে তাতে ধীরে ধীরে কুসংস্কার সঞ্চারিত হতে থাকল বটে, কিন্তু ভারতের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে একটা লম্বা সময় এমন চলেছে যখন এই নিরীশ্বরবাদী কর্মবাদী বৈদিক পুরোহিতের দল টিঁকে থেকেছে এবং কর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা জ্ঞানবাদীদের সাথে তাঁদের তীব্র সংঘাত চলেছে। দেবীপ্রসাদ তাঁর অন্য একটি সুবিখ্যাত গ্রন্থে সেই সংঘাতের কথা লিখেছেন (৫)। এঁরাই হলে পূর্ব-মীমাংসাপন্থী জৈমিনি এবং শিষ্যসমূহের ধারাবাহিকতা, ব্রহ্মবাদীদের আলোচনায় যাঁরা প্রায়শই 'জৈমেনেয়' বলে অভিহিত হয়েছেন। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের বিকাশে এঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।

 

বেদের শেষভাগ উপনিষদের সময় থেকেই বেদব্যাখ্যার একটি প্রবল ধারার জন্ম হয়। তা হল ব্রহ্মবাদী ধারা, যা ধীরে ধীরে প্রখর ব্রাহ্মণ্যবাদে বিকশিত হল। এই ধারার বৈশিষ্ট্য হল, তা কর্মকে সম্পূর্ণ নাকচ করে শুধুমাত্র জ্ঞানকেই স্বীকার করল। এতদিন পর্যন্ত জ্ঞান ও কর্মের পারষ্পরিক নির্ভরতা আমরা দেখছিলাম তাতে ছেদ পড়ল। যেহেতু কর্মই হল জ্ঞানের জননী তাই কর্মকে অস্বীকার করে জ্ঞানকে মাথায় তোলার ফলে আসলে জ্ঞানই অনাথ হল। ফলে জ্ঞান ধরা দিল বিকৃতরূপে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কথায়, প্রকৃত জ্ঞান আসলে হল ব্রহ্মজ্ঞান। বাকি সব মিথ্যা। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বাৎসায়ন ও জৈমিনির দার্শনিক সংঘাত আসলে জ্ঞানবাদ এবং কর্মবাদের মধ্যে সংঘাত।

 

যে সমস্ত গ্রন্থগুলিকে ব্রহ্মবিদ্যার  উৎস বলে ধরা হয় তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল বাৎসায়নের 'ব্রহ্মসূত্র'। ব্রহ্মসূত্রের প্রথম শ্লোকই হল, "অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা।" অর্থাৎ, "অতঃপর ব্রহ্মজিজ্ঞাসা।" এখানে এই "অতঃপর" কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে প্রচুর তর্কাতর্কি হয়েছে। কিন্তু এখানে সঠিক অর্থটি হল এই যে, বাৎসায়ন বলতে চাইছেন যখন সকল কর্ম করে এবং ফল না পেয়ে কর্মের অকার্যকারীতা বুঝে নেওয়া হয় তারপরই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা সম্ভব। অর্থাৎ, যতক্ষণ কর্মের প্রতি মোহ থাকে ততক্ষণ ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করা যায় না। সেই অর্থেই "অতঃপর" কথাটি ব্যবহৃত। "গীতা"তেও একই কথা বলা হয়েছে। "একথা আমাদের বলা হয়েছে যে, ইন্দ্রিয়গুলি পরম। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের থেকে মন পরম। মনের থেকে বুদ্ধি পরম। কিন্তু যিনি বুদ্ধির থেকে পরম, তিনিই সেই নিত্য-আত্মা, নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব।"

 

সুতরাং, ব্রহ্মবাদীদের এই কর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যার ফলে জ্ঞানচর্চাকারীকে কর্ম না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দেবীপ্রসাদও দেখিয়েছেন (৬) যে আচার্য শংকর কীভাবে বাস্তবিক যজ্ঞের পরিবর্তে 'মনোময় যজ্ঞ"-এর কথা বলেছেন। বাস্তবিক যজ্ঞবেদীর পরিবর্তে "মনোময় যজ্ঞবেদী" বা "মানসচিত" -এর কথা বলেছেন। শুধু তাই নয় তিনি প্রায় ৩৬ হাজার প্রকার মানসচিতের কল্পনা হাজির করে প্রকৃতপক্ষে কর্ম বিষয়টিকেই গায়েব করে দিয়েছেন।

 

খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আচার্য শংকরের সময়ের (৭০০-৭৩২) পরবর্তীকালে ব্রহ্মবাদ ছাড়া বৈদিক চিন্তার আর কোনো ঘরানাই টিঁকে থাকেনি, অবলুপ্ত হয়েছে। বৌদ্ধ আন্দোলনও প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েছে। তাও ক্রমশ অবলুপ্ত হয়েছে। ফলত জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা যা কিছুর হাত ধরে ভারতে বিকশিত হয়ে হয়েছিল তার সকল গতিপথ রুদ্ধ করে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিজয়ী হয়েছে। আজকের বিজেপি তথা আরএসএস এই ধারারই ধারক বাহক। তারাই আবার প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-পদ্ধতির নামে বৈদিক জ্ঞান ভাঙিয়ে বাজার গরম করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং আজকের ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তার টুঁটি টিপে মারতে চাইছে। সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নাগপুরের দালালে পর্যবসিত করে, জ্ঞানচর্চার সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে দখলে এনে তারা জ্ঞানের রাজত্বে এক অন্ধকার কায়েম করতে চাইছে। এই চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করা তাই আজ অত্যন্ত জরুরী কাজ।

(সমাপ্ত)

 

 

তথ্যসূত্র

 

১) Science and Philosophy in Ancient India/ Debiprasad Chattopadhyaya/ Aakar Books

২) প্রাগুক্ত

৩) "Sulba-Sutra" of Vedic India and Pythagorean Principle of Mathematics/ Bipin R Shah

৪) দেবীপ্রসাদ/ প্রাগুক্ত

৫) What is Living and What is Dead in Indian Philosophy/ Debiprasad Chattopadhyaya/ PPH

৬) Science and Philosophy in Ancient India/ Debiprasad Chattopadhyaya/ Aakar Books

 

অন্য লেখাগুলো পাবেন নীচের সূত্রে।

ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতি প্রসঙ্গে (প্রথম ভাগ)

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment