ভারতের মাথায় 'নতুন' শব্দটি জুড়েছে। শ্রমিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। 'নতুন ভারত' কী শ্রমিকের বাসভূমি নয়, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় শ্রমিকের ফুরিয়েছে। রাষ্ট্র এখন ইজরায়েলে শ্রমিক পাচারের সাথে যুক্ত। ভারতের শ্রমিকেরা বিদেশ গড়তে ইজরায়েলের শরণাপন্ন। কেরালার কোল্লামের বাসিন্দা পাটনিবিন ম্যাক্সওয়েলের কথা মনে আছে? ২০২৪ সালের ৪ঠা মার্চ লেবানন থেকে ছোড়া অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন ইজরায়েল ভূখণ্ডে। তিনি নির্মাণ শিল্পের দক্ষ-শ্রমিক ছিলেন। তাঁর সাথে আরও দু'জন ভারতীয়সহ মোট ৭জন আহত হয়েছিলেন।
সেই সময় ইজরায়েল রাষ্ট্র 'অখণ্ড ইজরায়েল' বানানোর বা ইজরায়েলের দখলদারির মানচিত্র বাড়ানোর লক্ষ্যে আশপাশের ভূখণ্ডের জনগণের উপরে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে এগিয়ে ছিল। এখন গাজা ও ফিলিস্তিনের সাথে শ্মশানভূমির পার্থক্য করা দুঃসাধ্য কাজ। এই যুদ্ধে ইরান সরাসরি যুক্ত হয়েছে। ইজরায়েল অনেকটাই পিছিয়েছে। তাই তাদের হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামতে বাধ্য হয়ে পড়েছে ইরানের বিরুদ্ধে। এমন সময় ভারতীয় শ্রমিকেরা ইজরায়েলে কী করছেন? ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ১০ই মার্চ ভারতের ৬,৬৯৪ জন শ্রমিক ও কর্মী কাজের জন্য ইজরায়েলে গেছেন। অনুমান, ইজরায়েলে ভারতের শ্রমিক ও কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৩০০০০-এর বেশিই হবে। যাঁরা ইজরায়েলের ১৯৫টি সংস্থায় নানা কাজে নিযুক্ত। তবে বেশিরভাগই কাজ করেন নির্মাণ শিল্পে। এমনটাই জানানো হয়েছে, 'ইন্ডিয়ান ইকনোমিক ট্রেড অর্গানাইজেশনে'র পক্ষ থেকে।
ইতিহাসে শ্রমিকশ্রেণি 'আন্তর্জাতিক' রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। দুনিয়া জুড়ে স্লোগান উঠেছে 'দুনিয়ার মজদুর এক হও'। শ্রমিকশ্রেণির ইতিহাস যেমন মানব সভ্যতার বিকাশকে সুদূরপ্রসারী করেছে তেমনই সম্পদ, উদ্বৃত্ত-লুট করা আধুনিক সমাজের পরনির্ভরশীল ক্ষমতাভোগীদের রাতের ঘুম কেড়েছে। বিশ্ব ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে এক দেশ থেকে আরেক দেশে শ্রমিক গেছে সেই দেশের শিল্পের বিকাশ ঘটানোর স্বার্থে। সেই শ্রমিক স্বেচ্ছায় গেছেন, তাঁকেও রাষ্ট্র'ই পাঠিয়েছে, যে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে খোদ শ্রমিকশ্রেণি ছিল।
আজ এমনই ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটে চলছে। তবে তা কোন দেশ বা শিল্পের বিকাশের স্বার্থে নয়। অথবা শ্রমিকের নিজ ইচ্ছায় নয়। দেশের ভেতরে ভালো মজুরি ও সামাজিক সুযোগ সুধিধা যুক্ত কাজ যথাযথ ভাবে না থাকবার কারণে শ্রমিকেরা বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, এই অভিযোগই করছেন ইজরায়েলে কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া সিংহ ভাগ শ্রমিকেরা। বিদেশি বুদ্ধিতে পরিচালিত ভারত রাষ্ট্র শ্রমিকের অসহায়তার সুযোগে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইজরায়েলে অবাধে শ্রমিক পাচার করছে। এই ধারা বিশ্বায়ন-পরবর্তী পৃথিবী বয়ে এনেছে, যাঁর মূখ্য ভূমিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও কিছু সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা রয়েছে। ফলে এদেশে দেশীয়-পুঁজি, প্রাকৃতিক কৃষি, শিল্পের বিকাশ রোধ হয়েছে। কৃষিতে আয় চূড়ান্ত পরিমাণে কমে যাওয়ার ফলে গ্রামীণ ক্ষেতমজুর, ভূমিহীন কৃষক, ছোট কৃষকেরা বছরের অর্ধেক সময়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে ঝুঁকতে বাধ্য হয়ে পড়ছেন। স্বল্প মজুরির বিনিময় ১২ ঘণ্টার কাজ করছেন। দেশের বিপুল সম্পদ, জল-জমি-জঙ্গল লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে সঁপে দেওয়ার ফলে এদেশের উৎপাদন সম্পর্কে এক ধরনের 'বিকৃত পুঁজিবাদী সম্পর্কে'র দেখা দিয়েছে। যা জনগণ ও বাজারের মধ্যে পুঁজির সম্পর্ক তৈরিতে অক্ষম, সংগঠিত শিল্প তৈরির সম্পূর্ণ বিপরীতে হাঁটছে এবং ছোট-মাঝারি ব্যবসা ও কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার দিকেই ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। যার ফল ভুগছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষ, কম মজুরির বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে, অতিরিক্ত খেটে, কিছু টাকা বেশি রোজগারের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে কাজে গিয়ে। ফলত, নষ্ট হচ্ছে দেশের বিপুল পরিমাণে শ্রমশক্তি, ক্ষয় হচ্ছে উৎপাদিকা শক্তি।
বর্তমানে দিনের শুরুতে 'বিশ্বগুরু', 'উন্নতমানের অর্থনীতি', 'বিকশিত ভারত' - এসব অতিরঞ্জিত কথার শেষে, তিনটি বাস্তবিক বিষয় রয়ে যায়;
এক, বেকারত্বের হার সর্বাধিক
দুই, অপরিসীম মূল্যবৃদ্ধি
তিন, কাজ পেলেও তা অস্থায়ী ও কম-মজুরির।
তাই একটু বেশি রোজগারের কাজ, বেশি সুযোগ-সুবিধার টোপে শ্রমিকেরা অন্যত্র ছুটতে রাজি হন। শ্রমিকের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ এতদিন আঞ্চলিক শাসকদলের নেতা-ঠিকাদাররা (সামন্তশ্রেণির অংশ) নিতেন। দু-পয়সা বেশি রোজগারের প্রলোভন দেখিয়ে অন্যান্য জায়গায় শ্রমিক-পাচার করতেন। এখন এমন পদ্ধতির পাচার খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি শুরু করে ফেলেছে।
এর আগে বহু অ-নথিভুক্ত শ্রমিকেরা ঠিকাদারের ফাঁদে পড়ে রাশিয়া গিয়েছেন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু তাঁদেরকে যুদ্ধের কাজে লাগানো হয়েছে। বহির্বিশ্বের সাথে তাঁদের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, আদপে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জোর করে যুদ্ধের কাজে লাগানোর জন্য তাঁদের জীবন সংশয়ও রয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র তখনো এ-বিষয়ে কোনো যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং, রাষ্ট্রের দ্বারাই চুক্তি হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইজরায়েলে শ্রমিক পাচারের। ইজরায়েলের সাথে ভারত রাষ্ট্রের এই চুক্তি আজকের নয়। এই চুক্তির মূলে রয়েছে, 'উদারীকরণ-বেসরকারীকরণ-বিশ্বায়ন' ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলির নানা চুক্তি। নব্বইয়ের গোড়াতে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হওয়ার পরে, একমেরু বিশ্বে ভারতের সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্র-পুতুল রাষ্ট্রগুলির সখ্যতা বাড়তে থাকে। সেই সময় থেকেই মূলত শুরু হয়, ইজরায়েলের সাথে ভারতের সম্পর্ক, যার গভীরতা পায় আরএসএস ও মোদি-বিজেপি জমানার সময়কালে। ২০২১ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও ভারত একটি অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক জোট গঠন করে জেরুজালেমে, যা প্রথম পূর্ণতা পায় ২০২২ সালে, 'আই.টু.ইউ.টু' পোশাকি নামে। ২০২৩ সালে ভারত ইজরায়েল রাষ্ট্রের চাহিদা মত শ্রমিক পাচারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের শ্রমিকেরা ইজরায়েলে পাচার হচ্ছেন।
গাজায় ইজরায়েলের আগ্ৰাসন ও গণহত্যা শুরু হওয়ার পর ফিলিস্তিনি শ্রমিকেরা ইজরায়েলে কাজে আসতে দ্বিধাবোধ করেন এবং ইজরায়েল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনি শ্রমিকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে, ইজরায়েলকে শ্রমিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। সেই ঘাটতি মেটানোয় 'বলদ' হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভারতীয় শ্রমিকদের। ভারত ও ইজরায়েল রাষ্ট্রের ২০২৩ সালের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী বিগত বছরে(২০২৪) এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৬০০০ শ্রমিককে ইজরায়েলে পাচারের কথা দেওয়া হয়েছিল। ইজরায়েল কর্তৃপক্ষের তখনকার তথ্যানুসারে বলা হয়েছিল যে, তারা আগামী মাসগুলিতে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার ভারতীয় শ্রমিক নেওয়ার আশা করছে। ইজরায়েলের 'সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন'-এর তখনকার তথ্য বলছে, এটি ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ইজরায়েলে প্রবেশকারী বিদেশি শ্রমিকদের মোট সংখ্যার সমান হবে। 'আগামী বছরগুলিতে ভারত ইজরায়েলে নির্মাণ শ্রমিকদের বৃহত্তম সরবরাহকারী দেশ না হলেও অন্যতম দেশ হয়ে উঠবে', এই কথা 'ইজরায়েল বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন'-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল শেই পজনার তখনি বলেছিলেন।
ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মারণাস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্র এই ইজরায়েল রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন উৎপাদন ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্রটি গঠিত হয়(১৯৪৮), ছড়িয়ে-ছিটিয়ে(বিশেষত ইঙ্গো-মার্কিন) থাকা কিছু ইহুদি বণিকশ্রেণির অনুদান, জার্মানদের ক্ষতিপূরণ তথা ইউরোপ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্যে এবং স্বার্থে। ফলে তাদের এতদিন ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের নিয়ে কাজ চালাতে হত, যা আজ ভারতীয় শ্রমিকদের কাঁধে। ভারত রাষ্ট্রের সাথে ইজরায়েল রাষ্ট্রের চুক্তির গভীরে আসার প্রধানত দু'টি কারণ রয়েছে। এক, দুই দেশের শাসকশ্রেণির নীতিগত মিলের জায়গাগুলি; দুই, অফুরন্ত মুসলমান বিদ্বেষ। এই চুক্তিতে ইজরায়েলে গেছেন মূলত আরএসএস ও বিজেপি শাসনাধীন রাজ্যের শ্রমিকেরা(হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি)। এছাড়াও কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্যগুলি রয়েছে। প্রত্যেককে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে ইজরায়েল ভূখণ্ডে। তাছাড়াও ইজরায়েল রাষ্ট্রকে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে চারিদিক থেকে ইরান রাষ্ট্র(রেভলিউশানারী গার্ড) ও হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ সহ আরো বিভিন্ন বিদ্রোহী সশস্ত্রবাহিনীগুলি ঘিরে ধরেছে(ফিলিস্তিনিদের মুক্তির স্বার্থে)। ফলে, ইজরায়েল রাষ্ট্রকে গাজা থেকে বিভিন্ন প্রান্তে সৈন্য স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। সেই জন্য ইজরায়েল রাষ্ট্রের বহু পরিমাণে ভাড়াটে সৈন্যের প্রয়োজনও রয়েছে। ফলে নিরুপায়, অসহায় অনেক শ্রমিকের ভেতরকার মুসলমান বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে ইজরায়েল রাষ্ট্র ইরান, ফিলিস্তিনি-মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে, এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এই আতঙ্কময় পরিবেশের কথা ভাবলে রাশিয়ায় যুদ্ধে ব্যবহৃত ভারতীয় শ্রমিকদের কথা ও ইজরায়েলে মৃত শ্রমিক কেরালার পাটনিবিন ম্যাক্সওয়েলের কথা কার না মনে পড়ে? যুদ্ধবিধ্বস্ত ইজরায়েলে ভারতের শ্রমিকেরা কেমন আছেন তা এখনও পর্যন্ত অজানা রয়েছে। এই ভাবে 'নতুন ভারত' শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ জারি করেছে।