পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লড়াই নগরে নয়, লড়াই হবে মাটিতে…

  • 24 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 514 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমিতা আলম
টাকা আছে হেলথ ইন্সুরেন্স কিনছি, শিক্ষা কেনার মতন। কিন্তু তারপর যদি হাসপাতাল আর না থাকে চিকিৎসা করার মতন, যেটা আমরা দেখেছি উন্নত দেশগুলোতে প্যান্ডামিক এর সময়। টাকা দিয়ে পড়িয়ে ছেলে মেয়ের কর্মসংস্থান হবে কোথায়? আতুপুতু করে বড় করা বাচ্চাগুলোকে যখন ২৪ ঘন্টার গাধা খাটুনিতে বেসরকারি কর্পোরেট পুঁজি সিস্টেম পিষে মেরে ফেলে দেবে কার বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড ধরবেন? আরজিকর নিয়ে আন্দোলন যে শিক্ষা দিয়ে গেল, তা বোঝার সময় কি এখনও হয়নি?

টোটোতে করে এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পাড়ি দিয়ে যখন বাড়ি পৌছালাম, অবাঙালি বন্ধুটির অবস্থা দেখে নিজের মধ্যে পাপবোধ হলো। মনে হলো একটু কষ্ট করে একটা গাড়ি ভাড়া করলে তাঁর কষ্ট লাঘব হতো। প্রায় পাঁচ কিমি রাস্তা চলাচলের অযোগ্য। অন্য একটা শর্ট রাস্তা আছে কিন্তু সেটাতে নদী পার হতে হয়। প্রায় ৫০০০ বা তারও বেশি লোকের বাস। কিন্তু যাতায়াত সেই একই। বন্ধুটির ইচ্ছে আমার বেড়ে ওঠা ছুঁয়ে দেখবে। তাই আমার সবুজে ঘেরা বাড়িতে তার আসা। বারবার সে জানতে চাইছিল লোকজনের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তাঁরা কী করে! আসলে মানুষ এমনই টিকে যায় বা ঝরে যায়। সংখ্যার পতনে কিছুই যায় আসে না।

উত্তরবঙ্গের তাপমাত্রা গত ৩৭ বছরের রেকর্ড কে ভেঙে দিয়েছে, রবি ঠাকুরের এসেছে শরৎ, হিমের পরশ কাব্যকে নস্যাৎ করে। উত্তরবঙ্গ পুড়ছে। উৎপাদন কমেছে চা পাতার, যে চা পাতা দেখতে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বাবুদের উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের আদিখ্যেতা তা ভবিষ্যতে থাকবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। ভীষণ গরম ও টোটোর ঝাঁকুনি খেতে খেতেও সাংবাদিক বন্ধু স্বাতী শিখা বলে গেলেন যে ঝাড়খণ্ডেও একসময় প্রচুর চা বাগান ছিল, যা আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন হারিয়ে গেছে। সবুজের মাঝে বসেই তাঁর এই উপলব্ধি যেন আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। কিন্ত সাবধান বাণী শোনার আর নেওয়ার জন্যও চোখ চাই, কান চাই। সেই চোখ , কান তো সব যারা নীতি নির্ধারণ করেন তাদের কাছে। তাদের শোনার ফুরসত তো নেই। তারা কলকাতায় বসে শুনবেন কেন কলোনির কথা! আর তাদের শোনানোর মতন স্বর নেই উত্তরের গ্রাম বাংলার মানুষের। মালদার বন্যা তাই মালদার লোক জানে শুধু।

কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে এক ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। পৈশাচিক এই খুনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ। যারা মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের শ্রেণী আবর্তে আবর্তিত। এটা অত্যন্ত আশার কথা। যে শ্রেণী ফ্ল্যাট, ই এম আই, গাড়ি, ফেসবুকীয় কূট কাচালি, দু একবার বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া কিছু ভাবেন না, তারা একজন নারীর জন্য বিচার চাইছেন খুব আশাপ্রদ এই ঘটনা। আমি অবশ্য এই শ্রেণীর মধ্যে সারাবছর ধরে জে এন ইউ এর ছাত্র নাজিব কোথায় কিংবা ওমর খালিদের মুক্তির দাবিতে যে ছাত্র এবং ক্ষুদ্র এক নাগরিক সমাজ পথে নামেন সারাবছর ধরে দু চারজন লোক নিয়ে তাদের কথা বলছি না।

আসলে এই চরম উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আন্দোলনটাও এক ধরনের বাজার দ্বারা সৃষ্ট করা মানুষের ভিড়। স্টারবাক এ কফি খেলাম, তারপর একটু প্রাইড এর মিছিলে হাঁটলাম আর তারপর জোমেটো থেকে বিরিয়ানি অর্ডার করে ঘরে বসে একাকী বা খুব বেশি হলে দুজনে খাবার খেলাম। পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ কি খেলো কি খেলো না, বাড়ির হেল্প এই চরম দ্রব্যমূল্য এর বাজারে কী করে দিন গুজরান করছে তা জানার প্রয়োজন বোধ করছি না। টাকা আছে হেলথ ইন্সুরেন্স কিনছি, শিক্ষা কেনার মতন। কিন্তু তারপর যদি হাসপাতাল আর না থাকে চিকিৎসা করার মতন, যেটা আমরা দেখেছি উন্নত দেশগুলোতে প্যান্ডামিক এর সময়। টাকা দিয়ে পড়িয়ে ছেলে মেয়ের কর্মসংস্থান হবে কোথায়? আতুপুতু করে বড় করা বাচ্চাগুলোকে যখন ২৪ ঘন্টার গাধা খাটুনিতে বেসরকারি কর্পোরেট পুঁজি সিস্টেম পিষে মেরে ফেলে দেবে কার বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড ধরবেন? না পড়ে থাকলে পড়ে নিন Anna Sebastian Perayil এর কথা। মাত্র ২৬ বছরের আন্না সেবাস্টিয়ান পেরেইল “হাড়ভাঙ্গা খাটুনি” সইতে না পেরে মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন তার মা। সেটা নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ আন্না সেবাস্টিয়ান পেরেইল কাজ করতেন আর্নস্ট এন্ড ইয়ং কোম্পানিতে যা চারটি প্রথম একাউন্টিং ফার্ম এর মধ্যে অন্যতম। তাই সুবিধাবাদী রোষ দিয়ে সিস্টেম বা সমাজ বদলানো যাবে না, পাল্টাতে হবে সবকিছুই।

 

আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষিত হওয়া মেয়েটি বিচার পাক। কিন্তু যে আন্দোলনকে আমরা গালভরা মুভমেন্ট বা আন্দোলন বলছি সেইটা কি আদৌ আন্দোলন নাকি এক শ্রেণীর রোষ, যে রোষ আছড়ে পড়ছে শুধুই নিজেদের গায়ে আঁচ লেগেছে বলে। প্রথমে ভালো পড়াশোনা তারপর সুখের চাকরি  - আর কে পায়  - এই মধ্যবিত্ত স্বপ্নে ধাক্কা লেগেছে বলে!  আচ্ছা জাস্টিস পেলে তারপর? রোজ যে ঘটে চলেছে সাবির আলি থেকে মিয়া মুসলিমদের উপর জুলুম, তার ন্যায়, তার জাস্টিস?

ভারত নামক এই বিশাল সমষ্টির দেশে যেখানে নানা শ্রেণী, নানা জাতির বাস, তাদের নানা রকম যাতনা, নানা রকম শোষণের ইতিহাস। সেখানে সরকার , রাষ্ট্র আর তার কর্পোরেট পরিচালিত গণতন্ত্র মাঝে মাঝে এই সব রোষ দেখলে বিচলিত হয়না। উল্টে তারা সেই রোষকে কিভাবে বাজারে বেচবে তার হিসাব খোঁজে। গণতন্ত্র এ বিশ্বাস করে যে সংসদীয় বাম দলগুলো তারা মাটির কাছে নিয়ে যেতে পারতেন এই আন্দোলনকে। কিন্তু নগর এখন সুখী আস্তানা। শহরের শিকড় হীন ঘরে বসে গ্রামের উপর ফরমান চাপিয়ে বামপন্থী আন্দোলন চলবে না। আমরা যারা নারীবাদী ও LGBTQ মুভমেন্টের সাথে জড়িত তাঁদেরও কৃষক, শ্রমিক, সংখ্যালগুদের প্রশ্নে এক হতেই হবে।

 

আমাদের দরকার আরও মাটির কাছে যাওয়ার। চেঁছে তুলে ফেলতে হবে নিপীড়িত মানুষদের আর্তনাদ আর তা গরম লোহার মতন শানিত চিৎকারে ভরে দিতে হবে শাসকের কানে। এটাই একমাত্র উপায়। এটার মূল। কোনো শর্টকাট নেই। একজনের ন্যায়ের দাবিতে তড়িঘড়ি আরেকজনের ফাঁসি শুধুই শাসকের বেঁচে যাওয়ার সুবিধে করে দেওয়া। ফিরে যেতে হবে উত্তাল আন্দোলনের দিনে। নেতা কে হবে? আমার গ্রামের চা শ্রমিক লালমন ওঁরাও কিংবা ফিলকি খাতুন, কিংবা বাসন্তী যাঁর কোনো টাইটেল নেই। যাঁরা সেলফি তুলবেন না, শুধুই আধাঁরে লাঠি শক্ত করে হিলিয়ে দেবেন কর্পোরেট ফান্ডেড গণতন্ত্রের পুঁজি। কবি ওয়ারা ওয়ারা রাও তো বলেই দিয়েছেন:

সেই জায়গাটি

যেখানে মানুষ ঘুরে বেরিয়েছে গতকালও

শহীদ হয়েছেন কতজন

যাঁদের স্মৃতিতে তৈরি হয়েছেল

স্মারক ফলক।
<!--[if !supportLineBreakNewLine]-->

ভয়ে শাসক গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেই জায়গা

পরিণত করেছে কবরস্থানে

আর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনীকে পাহাড়ায়

কিন্তু এখনও তো সেই জায়গায় মাটি আছে, তাই না?

সেই মাটি কি সাক্ষী দেবে না?

হ্যাঁ, এই মাটির কাছেই সব। মাটির কাছেই ফিরতে হবে। মাটি থেকেই লড়াই, মাটিই মুক্তি নারীর, মাটিই মুক্তি সব শোষণের , অত্যাচারের। নগর ভেসে থাকে অনেক অনেক উঁচুতে , মাটি ছাড়িয়ে। তার আন্দোলন শুধু নীচ থেকে ঘাড় তুলে দেখে গ্রাম। গ্রাম তাকে ছুঁতে পারেনা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment