পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

'জওয়ান' রাজনৈতিক ছবির নতুন প্রস্তাব

  • 20 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 842 view(s)
  • লিখেছেন : সম্রাট মুখোপাধ্যায়
জওয়ান ছবিতে ফিরে এসেছে হিন্দি ছবির সেই বনেদি ফর্মুলা দেশের শত্রু আর নায়কের পরিবারের শত্রু এক।এই ফর্মুলাকে দারুণ মজা ক'রে উদযাপন করা হয়েছে এই ছবির চিত্রনাট্যে।কত 'ভুল' ফর্মুলাও কত সময় কত কাজে আসে!



----

নাহ্,দুঃখিত,আমি কোনদিনই শাহরুখ খানের ভক্ত ছিলাম না। নানা কারণে হ'তে পারি নি।
খান সাহেবের প্রথম 'কাল্ট' ছবি 'রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান'এর একখানা সমালোচনা লিখেই ঘটনাচক্রে তিরিশ বছর আগে এই প্রতিবেদকের 'রিভিউয়ার' জীবনের শুরুয়াৎ হয়েছিল। ক্রীড়া সাংবাদিক হ'তে এসে 'বন গয়া রিভিউয়ার' এতদ্বারা ঘটেছিল। সেই ছবিটি ছিল রাজ কাপুরের প্রবাদপ্রতীম 'শ্রী ৪২০'এর এক সময়োচিত রকমফের তখন শাহরুখের অভিনয়কে ধরে নেওয়া হচ্ছিল রাজ কাপুর আর দিলীপকুমারের এক বিলম্বিত আর অমীমাংসিত মিশ্রণ।তা সে সদ্য মঞ্চ থেকে আসা একজন নিতান্ত নবাগত থিয়েটার অভিনেতার পক্ষে সেটাই ছিল খুবই গৌরবের এক তুলনা।
না,এসব দেখে-লিখেও শাহরুখের 'ফ্যানবেসের মধ্যে ঢুকি নি কখনও। একজন পেশাদার চলচ্চিত্র সমালোচকের চোখে শুধু 'ফলো' করে গেছি তাকে।
অমিতাভ বচ্চন অনুসৃত রাগী আগুনে-পথে যেসব ছবি এসেছিল সাতের আর আটের দশকের মেইনস্ট্রিমে,মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি হয়েও তার ভেতর ধরা থাকত যেসব প্রতিষ্ঠান-বিরোধী উন্মাদ,সেগুলির প্রতিই ছিল আমার প্রজন্মের অনেকের পক্ষপাত। মিঠুন কিংবা অনিল কাপুর সেই পথেই কার্যত হেঁটেছেন। সঞ্জয় দত্ত ঐ ধারার আরও একটু অতিরেক। কিন্তু এই ধারার মৃত্যু ঘন্টা বাজাল শাহরুখের 'ডিডিএলজে'ধর্মী ধারাবাহিক চিত্রমালা। হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়কস্বত্ব গেল এনআরআই এবং কোটিপতি প্রেমিক যুবকদের হাতে। যাদের আপাদমস্তক ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়-জুতো-টুপিতে মোড়া। আর এই দলটিরই অধিনায়ক হলেন শাহরুখ। হয়ত এই সামগ্রিক চরিত্র-চ্যুতিই রাগের কারণ হ'ল আমাদের, আমার।
শাহরুখের অনুরাগী তাই হতে পারি নি কখনও।
আর এবারও পরপর 'পাঠান' এবং এই 'জওয়ান'এর বেলায় তাঁর ছবির হল-আগ্রাসন,অন্য সব ছবিকে হটিয়ে-সরিয়ে পর্দার দখল নেওয়া মেনে নিতে পারি নি একেবারে। মনে হয়েছে এও তো এক আগ্রাসন। 'ফ্যাসিবাদ'। বাংলায় ব'সে বাংলা সিনেমাকে উচ্ছেদ করার স্পর্ধা!
সেই রাগ নিয়েই হলে ঢুকেছি...।
কিন্তু ছবি দশ মিনিট এগোতেই বুঝেছি এবার এখানে তিনি অন্য খেলার, না,বলা ভালো অন্য যুদ্ধের সৈনিক।
ছবি এগিয়েছে আর আমার রাগের লৌহশলাকারা তাত হারিয়েছে! তাঁর সাহস,তাঁর ঝুঁকিপূর্ণ 'স্টান্স' অবাক করেছে।মুগ্ধ হয়েছি। মেইনস্ট্রিমে এতখানি রাজনৈতিক স্পষ্টভাষি ছবি শেষ কবে দেখেছি?
ইদানিংকালে দেখেছি কি?
ছবি দেখে বেরিয়ে মনে হ'য়েছে ফের ব'দলে যাবেন না তো শাহরুখ? জনতা আপনার পিছু নিয়েছে।
আপনার দায়িত্ব বাড়ল।
আপনার সাহস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক...।


----

শাহরুখ খান কি তবে ইদানিং ব্রেখটের অনুগামী হ'য়ে পড়ছেন?
'জওয়ান' কিন্তু হেঁটেছে বিলকুল জার্মানির সেই বিখ্যাত 'প্রোপাগান্ডিস্ট' নাট্যকারের পথে। সেই যেখানে নাচ-গান,জমজমাট প্রেম কিংবা প্রতিশোধের গল্প,আদ্যোপান্ত আমজনতার বিনোদন...আবার তারই মাঝে দেশ যে ঠিকঠাক চলছে না, সে কথাটাও মাঝেমাঝে বলে যাওয়া। সাম্প্রতিককালে মোদি-জমানায় আয়ুস্মান খুরানাকে ছেড়ে দিলে আর কোনও মূলধারার তারকা কিন্তু নিরাপদ ক্রিজ ছেড়ে এসে এতখানি ব্যাট হাঁকান নি।
এ'ছবি শুরুই হচ্ছে এক মন্ত্রীকে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে এই প্রশ্নে যে দেশে এখন বিলাসবহুল গাড়ি আর চাষের প্রয়োজনীয় ট্রাক্টর কোনটা কেনার জন্য ব্যাঙ্ক ঋণ নিতে গেলে বেশি সুদ দিতে হয়? নায়ক আজাদ ওরফে শাহরুখ তারপর ধরিয়ে দিচ্ছেন,বেশি সুদের বোঝা বইতে হয় ট্রাক্টর কেনা কৃষককেই! ইন্টারকাটে পর্দায় আসে কৃষক বিক্ষোভের ছবি। ফ্ল্যাশব্যাকে আসে নির্মম এক উপকাহিনী। ব্যাঙ্কের ঋণ খেলাপি এক দরিদ্র চাষিকে নগ্ন ক'রে দেওয়া ও তার আত্মহত্যা।আসে গ্রামীন হাসপাতালগুলির অব্যবস্থা ও দুর্নীতির চিত্র।বিভিন্ন কারখানায় চলা শ্রমিক শোষণ এবং অবাধ পরিবেশ দূষণ। নির্লজ্জ মুনাফাবাজদের শায়েস্তা ক'রতে আজাদ তালা ঝোলানোর ব্যবস্থা করে ঐসব কারখানায় শ্রমিকদেরই হাত দিয়ে। এতখানি বৈপ্লবিক দৃশ্য শেষ কবে এ'দেশের মূল ধারার ছবি দেখেছে,তা মনে করতে কষ্ট করতে হবে।  চিত্রনাট্যই। তবে এসব কথা শুকনো বক্তৃতার ঢংয়ে আসে নি। এসেছে অনেকটা মজাদার নৌটঙ্কি বা রঙিন রামলীলার ঢংয়ে। আবার ছবির শেষ সব রূপক সরিয়ে নায়ক শাহরুখ সরাসরি এক বক্তৃতাও দিয়েছেন।এই দৃশ্যে তার পেছনে সার বাঁধা অপহরণ ক'রে আনা সব ভোটিং মেশিন।আর নায়ক আজাদ টিভি মারফত প্রশ্ন করেন জনগণকে," যেখানে একটা পাঁচ মিনিট জ্বলা মশার ধূপ কিনতে গিয়ে আপনারা অনেকরকম প্রশ্ন করেন দোকানিকে,সেখানে কেন পাঁচ বছর সরকার চালাবে যে তাকে নির্বিবাদে বিশ্বাস ক'রে ভোট দিয়ে দেন? ধর্ম বা জাতপাতের নামে ভোট আসে এ'দেশে! অথচ পেছনে প'ড়ে থাকে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো জনগণের প্রয়োজনীয় ইস্যুগুলো!"দেশজুড়ে আসন্ন ভোটের বাদ্যি যেন বাজিয়েই দিলেন বাদশা খান।  
এ'ছবির ওপরের পালিশে শাহরুখ তথা তাঁর প্রযোজনা সংস্থা রেড চিলিজ চেয়েছে হালফিলের দক্ষিণি ছবির চোখ ধাঁধানো মেজাজটা আনতে।তাই হয়ত তরুণ দক্ষিণি পরিচালক অ্যাটলিকে আনা।সেটা সঠিক সিদ্ধান্ত এবং নিজের কাজে অ্যাটলি একশো এক শতাংশ সফল। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে ছবির 'নৌটঙ্কি' মেজাজের শর্ত মেনে তিনি শিহরণের চেয়েও বেশি এনেছেন মজা। তা চরমে গেছে বাবা আর ছেলে দুই অবতারে জোড়া শাহরুখ যখন ভিলেন দমনে নেমেছে। আর এ'ছবির চিত্রনাট্য যেন বহু হিন্দি সিনেমার মিলিত 'স্ফুফ' বা রগড়। 'কর্মা','দেশপ্রেমী','খতরো কে খিলাড়ি','ইন্ডিয়ান'...দর্শক 'জওয়ান' দেখতে ব'সে স্মৃতি হাতড়াবে। এই ধরণের ছবির মৃত্যুঘন্টা বাজিয়েছিলেন একসময় শাহরুখ তাঁর 'দিলওয়ালে...' ভাবমূর্তি নিয়ে এসে। মজার কথা সেই ফর্মূলার পুনরুদ্ধার ঘটল তাঁরই হাতে।
গল্পে বাবা শাহরুখ একজন সৈনিক। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আবিষ্কার করেন তাদের হাতের অস্ত্র বিকল। অস্ত্র চুক্তির দুর্নীতি নিয়ে সরব হন তিনি। ফল ভুগতে হয় এরপর। ছেলে আজাদ আবার জেলার। সে জেলের কয়েদিদের নিয়ে তৈরি করেছে লুকোনো বাহিনী। প্রতিপক্ষ ভিলেনের নাম কালী গাই (বিজয় সেতুপতি)। তার উদ্দেশ্যে বাবার হুঙ্কার,"ছেলেকে ছুঁয়ে দেখার আগে বাবার সঙ্গে ল'ড়ে দেখা।"
এখানে যেন ফিরে এসেছে হিন্দি ছবির সেই বনেদি ফর্মুলা দেশের শত্রু আর নায়কের পরিবারের শত্রু এক। এই ফর্মুলাকে দারুণ মজা ক'রে উদযাপন করা হয়েছে এই ছবির চিত্রনাট্যে। কত 'ভুল' ফর্মুলাও কত সময় কত কাজে আসে!
বাবা শাহরুখের নায়িকা দীপিকা পাড়ুকোন। পরিসর অল্প। তবু এটাই যেন এখন বলিউডের সেরা জুটি বোঝাপড়ায়।ছেলে শাহরুখের নায়িকা দক্ষিণের নয়নতারা। তবে ছবি জুড়ে চ্যাম্পিয়ন আর একজন। এ প্রযোজনার ক্যারেক্টার ডিজাইনার হেড প্রীতিশীল জি সিং। ছবি জুড়ে দুই শাহরুখের অন্তত ডজন দুয়েক আলাদা আলাদা রকমের 'লুক' আর 'স্টাইল স্টেটমেন্ট' তৈরি করেছেন তিনি। আর তাতেই 'জওয়ান' উড়ছে।

জনপ্রিয় ছবিকে কদাচ অস্বীকার করবেন না। জনপ্রিয় ছবির নায়কদের জনমানসে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাষ্ট্রনেতাদের চেয়ে কম নয়।

0 Comments

Post Comment