পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কাফন

  • 16 November, 2025
  • 1 Comment(s)
  • 327 view(s)
  • লিখেছেন : বানু মুস্তাক
কোন কোন দিন সকালের নামাজ পড়তে ওঠা সাজিয়ার পক্ষে অসম্ভব হত। এইজন্য ও উচ্চ রক্তচাপের অজুহাত দিত। বারবার বলত যে হতচ্ছাড়া ট্যাবলেটগুলোর জন্য ওর মনে কোন শান্তি নেই।

সাজিয়ার মা বলতেন, "এই সব হল শয়তানের খেলা। খুব সকালে এসে পা টিপে দেয়, গায়ে জড়িয়ে দেয় কম্বল। তারপর পিঠে চাপড় দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় যাতে তুই নামাজ পড়তে না পারিস। লাথি মেরে তাড়াতে হবে ওকে আর প্রার্থনার জন্য ঠিক সময়ে উঠে পড়ার অভ্যাস করতে হবে।" ব্যক্তিগত ভৃত্যের মত শয়তানের এই পা টিপে দেওয়ার গল্প সাজিয়ার কাছে বেশ রোমান্টিক লাগত। এই জন্য সে বারবার পা ছুঁড়ে লাথি মারার ভান করে বেশ মজা পেত। তবে বদলাল না সাজিয়ার দেরি করে ওঠার অভ্যাস আর এই উপলক্ষে শয়তানকে দোষারোপ।

সেদিন সাজিয়া ভোর হয়ে যাওয়ার বেশ পরেও গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। হঠাৎ করে জেগে উঠে নিজের দিকে দেখল। মিঞার দিকে হাতটা ছড়িয়ে দিয়ে তাকে ছুঁয়েও ঠিক বুঝতে পারল না ঠিক কোথায় সে আছে। চেনা বালিশে মাথা আর গায়ে জড়ানো বিদেশি কম্বল দেখে বুঝতে পারল যে নিজের বাড়িতে নিজের ঘরেই ও এখন আছে। পরিচিত পরিবেশে জেগে উঠে ও যুগপৎ সুখ এবং তৃপ্তি বোধ করল।

কিন্তু এই তৃপ্তি বেশিক্ষণ থাকল না। শুনতে পেল কে যেন বাইরে ডাকাডাকি করছে। ধীরেসুস্থে উঠে দরজার কাছে গিয়ে ছেলে ফারমানের গলা শুনতে পেল। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখল যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আলতাফ দাঁড়িয়ে আছে। আর ফারমান ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে,"যা ঘটার তা ঘটেছে। এই সব কারও হাতে নেই। দুশ্চিন্তা কোরো না, বাড়ি যাও। আম্মি উঠলে আমি সব তোমার বাড়িতে দিয়ে আসব। আম্মি এখন ঘুমোচ্ছে, জাগাব না, শরীরটা ভালো নেই মোটে। ডাক্তার যত বেশি সম্ভব বিশ্রাম নিতে বলেছেন।"

"কিন্তু ভাই, জামাত বলেছে যে রাত পাঁচটায় কবর দিতে হবে। আমরা আর কারওর জন্য অপেক্ষা করছি না। তাই গোসল ও অন্যান্য আচার তাড়াতাড়ি সেরে নিতে হবে।"

ফারমান মেজাজ হারিয়ে বলল," দেখ, তুমি আমার হেফাজতে কোনও কাফন রাখনি। আম্মি হজ থেকে ফিরেছে ছ'সাত বছর হল। ইয়াসিন বুয়া ওর কাফন কেন মার কাছ থেকে নিয়ে আগে রেখে দেয়নি? আবার এও হতে পারে নিয়ে হয়তো কোথাও রেখে দিয়েছে। ঘরে আর একবার খুঁজে দেখে বলো।"

সাজিয়া ফারমানের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে মনে মনে বেশ ধাক্কা খেল। বলল," হচ্ছেটা কী এখানে? কার সঙ্গে কথা বলছ বেটা।" ফারমান ঘুরে তাকাল, মুখে প্রবল অসহিষ্ণুতার চিহ্ন। মনে মনে ভাবল," এই সব মহিলারা কিছুতেই নিজের খাওয়াদাওয়া, পোষাক-আষাক বা ব্যক্তিগত কাজকর্ম নিয়ে শান্ত থাকতে পারে না। একাধিক বিষয়ে নাক না গলাতে পারলে খাওয়া যেন হজম হয় না।" কিন্তু মুখে সেই অপছন্দের ভাব প্রকাশ না করে ফারমান বলল," মা, যাও ঘুমিয়ে পড়। কেন উঠে এসেছ এখানে? আলতাফ এসেছে। বলছে, ইয়াসিন বুয়ার ছেলে। কাফন চাইছে।"

 

সাজিয়ার মনে হল মাথায় যেন হাজারো বজ্রাঘাত হচ্ছে। সে দৌড়ে এসে আলতাফের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। রাগতভাবে বলল,"সাতসকালে কী সব হট্টগোল লাগিয়েছ? কাফনটা গেল কোথায়? কার বাড়ি কখন যাওয়া যায় সেবিষয়ে কোন বোধ হয়নি এখনও।" সাজিয়া বেশ বুঝতে পারছিল যে ফারমানের এসব মোটেই পছন্দ হয়নি। আলতাফ সাজিয়ার দিকে দুখী দুখী মুখে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,"চিকাম্মা, আম্মি আজ সকালের নামাজের সময় মারা গেছে। তাই আমি একটা কাফনের খোঁজে এসেছি।" খবরটা শুনে সাজিয়া ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ল। নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ধপ করে কাছের একটা চেয়ারে বসে পড়ল। এযে এক অকল্পনীয়, অসম্ভব ঘটনা। কী করে মুখোমুখি হবে? কী করে সামাল দেবে? কোন চিন্তাই আর সাজিয়ার নিয়ন্ত্রণে রইল না। ভিতরে ভিতরে ছারখার হয়ে পরিতাপ করতে লাগল," ভগবান, শেষমেশ এই কী ঘটার ছিল!"

সাজিয়া না চাইলেও ওর মন অতীতচারী হল। সেদিন বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান ছিল। এই উপলক্ষে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধব অনেকে জড়ো হয়েছিল। সাজিয়াবিবি আর মিঞা সুভান হজ করতে যাবে। এর মধ্যে ওরা অনেক নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে ফেলেছে। প্রত্যেককে আলিঙ্গন করে বলেছে যে ভুল কিছু বলে থাকলে, কাউকে আঘাত দিয়ে থাকলে, কোন প্রিয়জনের অভিযোগ  থাকলে বা ওদের বিষয়ে অসত্য কথা কিছু বলে থাকলে ওরা দু'জনেই ক্ষমাপ্রার্থী। আত্মীয়েরা ওদের জন্য ভোজ দিয়েছে, যথাসাধ্য পোষাক বা অন্যান্য উপহার দিয়েছে, আর ওদের দু'জনকে অনুরোধ করেছে দোষত্রুটি কিছু করে থাকলে ক্ষমা করে দিতে। পারস্পরিক ভুল-ত্রুটি মার্জনা করা হয়েছে এবং আচরণবিধি যথাযথভাবে মানা হয়েছে এই সন্তুষ্টি নিয়ে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুরা হালকা মনে ওদের বিদায় জানায়।

হজে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেও অনেকের সঙ্গে দেখা করা বাকি। মিঞা-বিবি দু'জনে মিলে দূরের আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে ডেকে নেয়। ওদের তরফে ভুলত্রুটি কিছু হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিতে বলে। সুভানের বড়সড় ব্যবসা, সাজিয়া বিরাট বাংলোর মালকিন। যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করার ফুরসত ছিল না বলে ওঁরা সবাইকে একসঙ্গে কাছে পাওয়ার জন্য ভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন। পারস্পরিক ক্ষমা প্রার্থনার আচারবিধি সেখানেও বলবৎ ছিল।

অনাহুত অথচ বিনম্র, অনসূয়া যে মানুষটি সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি ইয়াসিন বুয়া। তিন বছরের ব্যবধানে বুয়াকে দুই সন্তানের মা করে মিঞা কোন পিছুটান না রেখে প্রয়াত হন। কৃষি পণ্য বিপণন সমিতির প্রাঙ্গণে তিনি মাল বোঝাইয়ের কাজ করতেন। একদিন মাল বোঝাই করার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মিঞার মৃত্যুর পর তিনি ইদ্দত বা অপেক্ষাপর্ব পালন করেননি। তখন বুয়ার ভরা যৌবন। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে  মাথায় রুমাল বেঁদে প্রকাশ‍্যে বাড়ির সামনের উঠোনে বসে বাসনমাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া ও মেঝে মোছার কাজে লেগে পড়েন। বিয়ে বাড়ি, উৎসব, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, জন্মদিন সব আনন্দ থেকে মানসিকভাবে দূরে। অথচ শিশু সন্তানদের খোরাক যোগাতে এই সব অনুষ্ঠানের কর্মকান্ডের ভার বহনে অক্লান্ত। ইদ্দত পর্বে তিনি মাথা ঢাকা দিয়ে ঘরে বসে থাকেননি, প্রয়াত স্বামীর জন্য প্রার্থনা বা বাধ্যতামূলক শোকপর্ব পালন করেননি। অনেক জিভ নড়েচড়ে উঠেছে, অনেকে কাদা ছুঁড়েছে। কিন্তু সন্তানদের মঙ্গল কামনা ও ক্ষুধা নিরসন ইয়াসিন বুয়ার কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বুয়ার কঠিন পরিশ্রমে ছেলেমেয়ের জীবন গড়ে উঠেছে। একটু লেখাপড়া শিখে মেয়েটা অন্য মেয়েদের কোরান শিখিয়ে সামান্য অর্থ উপার্জন করছে। এই অর্থের সঙ্গে বুয়া নিজের উপার্জিত টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। এখন বুয়া অটোচালক ছেলের সঙ্গে থাকেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে হাড়গুলো যখন ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে, হাতের শিরাগুলো ফুলে ওঠে, বুয়া অন্যত্র কাজ বন্ধ রাখেন।

বুয়ার বড় ইচ্ছে ছেলের বিয়ে দেবেন। কিন্তু তার থেকেও বড় ইচ্ছে বুয়ার দেহমনকে এখন পেয়ে বসেছে। সারাদিন ধরে তিনি সেই ইচ্ছের শিখার পাশে ঘুড়ির মত উড়ছেন। বুয়া সঞ্চয়ী, কৃপণ বলে নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্বেগে। ছেলের বিয়ের জন্য রাখা সঞ্চয় থেকে কাফন কেনার টাকা নিতে গিয়ে বুয়ার মনে হয় তিনি যেন অন্য কারওর টাকা চুরি করছেন। এই বিরাট অপরাধের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে না পেরে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন, তিনদিন ধরে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখেন এই টাকা। কিন্তু এই জননীসুলভ প্রবৃত্তিও একসময় ব্যক্তিগত স্বপ্নের কাছে হার মানে। এক অদ্ভুত জেদ বুয়ার উৎসাহকে বাড়িয়ে দেয়। খুঁটে কষে টাকা বেঁধে দ্রুত সাজিয়ার বাড়ির দিকে পা চালান তিনি। সেখানে কত লোক, কত উদযাপন, কত রকম আনন্দ...

না, কেউ বুয়াকে আসতে বলেনি। স্বাগত জানিয়ে "ও তুমি এসেছ" তেমন বলার মত কেউ সেখানে ছিল না। আতিথেয়তা দেখিয়ে "এসো, খেতে এসো" কেউ বলতে আসেনি। সম্মান কী, সমাদর কী জীবনে সেই অভিজ্ঞতা বুয়ার হয়নি। অশ্রদ্ধা কী তাও তো অজানা। তিনি সামর্থ‍্য অনুযায়ী কাজে লেগে পড়লেন। পোর্সেলিনের থালা ধুতে ধুতে হাত ভারি হয়ে এল বুয়ার। বিরিয়ানির তেলতেলে ভাব হাত থেকে সহজে যাওয়ার নয়, গেলও না। সবার খাওয়া শেষ হলে তিনি সামনের সিমেন্ট বাঁধানো উঠোনে বসে কিছু মুখে দিলেন। বুয়ার সমস্ত মনোযোগ এখন সাজিয়ার দিকে। মনে মনে বললেন,"ভাগ্যবতী, পয়মন্তী।" ভাবলেন সাজিয়াকে কখন ফাঁকা পাওয়া যাবে, বলা যাবে মনের কথা। একমনে তিনি সাজিয়া কী করছে তা দেখতে থাকলেন।

সাজিয়া কখন একটু অবসর পাবে? অসংখ্য আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে শুভ কামনা ও উপহার পেতে পেতে সে ক্লান্ত। জড়িয়ে ধরে শুভ কামনা জানানোর সময় কেউ কেউ ব্যক্তিগত সমস্যার কথা দিয়ে শেষ করছে আর হজে গিয়ে ওদের জন্য প্রার্থনা করার কথা বলছে। একজন বলল,"সাজিয়া আপা, আমার ছোট মেয়ের জন্য ভালো বর পাচ্ছি না। ওর জন্য একটু প্রার্থনা কোরো।" আরেকজন বলল,"আমার শালীর ক্যান্সার। প্রার্থনা কোরো সে যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে।" কেউ বলল,"আমার ছেলেটা চাকরি পাচ্ছে না। বেশ কষ্টে আছে। প্রার্থনা কোরো যেন ওর একটা চাকরি হয়। চাহিদার তালিকা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সাজিয়া হেসে উত্তর দেয়,"ইনশাল্লাহ, আমি সবার জন্য প্রার্থনা করব।" ক্লান্তি সত্ত্বেও ও তা প্রকাশ না করে সবাইকে হাসিমুখে বিদায় দিল। যদিও এই ভোজ ছিল দুপুরে, সন্ধেবেলাও অনেকে আসতে থাকল। ইয়াসিন বুয়া সমানে বাসন মাজা, খাওয়ার থালা পরিষ্কার, ঝাঁট দেওয়া চালিয়ে গেলেন এই আশায় কখন তাঁর পালা আসবে।

রাত তখন প্রায় এগারটা। ক্লান্ত সাজিয়া সোফায় বসে নরম কার্পেটে পা দু'টো ছড়িয়ে দেয়। চোখে পড়ে শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে ইয়াসিন বুয়ার ছায়া। ধৈর্যচ্যুত বুয়া বলে ওঠেন,"ওরে আর পারি না। বড় ক্লান্ত।" সাজিয়ার জন্যও বুয়ার মন খারাপ হল। আঁচলে হাতদুটো মুছে তিনি গুটিগুটি পায়ে সাজিয়ার দিকে এগিয়ে এলেন। ভাবখানা এমন যে ওঁর নোংরা ফুটিফাটা হাতের দাগ যেন দামি কার্পেটে না লাগে। সাজিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশ্ন করে, "কখন এলে, বুয়া?

সাজিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পেরে বুয়া খুব খুশি। বলল,"অনেকক্ষণ।" সাজিয়া বলে," তাই নাকি? আমি কিন্তু সারা সন্ধে তোমায় খুব একটা দেখিনি।" তারপর আরও একটু সুর নরম করে বলে,"খেয়েছ তো বুয়া?" কৃতজ্ঞচিত্তে ইয়াসিন বুয়া বলে,"হ্যাঁ, তাঈ। তোমার বাড়ির অন্নে আমার জীবনটা এখনও টিকে আছে। তোমার ছোঁয়ায় সবকিছু সোনা হোক। তোমার গৃহ সমৃদ্ধ হোক।" সাজিয়া বলে,"খুব দেরি করে ফেলেছ বুয়া। কী করে বাড়ি ফিরবে তুমি?"ঘোরতর মেয়েলি এই উদ্বেগে বুয়া উত্তর দিল,"আলতাফ এসে ওর অটোয় করে আমাকে নিয়ে যাবে। ও এলেই আমি বেরিয়ে যাব।" সাজিয়া নজর করেছে যে বুয়া সারাদিন এই বাড়িতে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত ছিল। সাজিয়া ক্লান্ত শরীরটাকে টানতে টানতে ঘরে গিয়ে কিছু টাকাপয়সা নিয়ে এল। বলল," এই নাও বুয়া, সামান্য হাতখরচ। তিন দিন বাদে আমরা হজে যাচ্ছি। ৪৫ দিন পর ফিরব। আল্লাহ যেন আমাদের হজ কবুল করেন। আমাদের জন্য প্রার্থনা কোরো।"

বুয়ার  মুঠোয় টাকা ভরে সাজিয়া দুই হাতে চেপে ধরে। অভিভূত বুয়ার দু'চোখ জলে ভরে ওঠে। তাঁর মত একজন হেঁজিপেঁজি মানুষের জন্যও এত দয়া, এত সখ্য। কিন্ত সাজিয়ার থেকে বুয়া কোন টাকাপয়সা নিলেন না। বদলে আঁচলের খুঁটের গিঁট খুলে তিনি কিছু ভাঁজ করা টাকা বার করে বললেন," মা রে, এখানে ৬০০০ টাকা আছে। তুমি তো হজে যাচ্ছ। আমার জন্য পবিত্র জমজমের জলে ধোয়া একটা কাফন এন। এই পবিত্র কাফনে করে আমি অন্তত স্বর্গে যেতে পারব।

 

মুহূর্তের জন্য সাজিয়া কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। একাজটা তেমন দুরূহ বলে তখন তাঁর মনে হল না। "হে ভগবান, সামান্য একটা কাফন মাত্র। একটু বেশি টাকা লাগলেও আমি নিয়ে আসতে পারব," সাজিয়া ভাবল। স্বতঃস্ফূর্ত সেই পরিস্থিতির নিরিখে আর কোন কথা না বাড়িয়ে সে রাজি হয়ে গেল।

বুয়ার হাত থেকে টাকা নেওয়ার সময় সাজিয়া বুঝতে পারল গরীব মানুষ আর ওদের পকেটের টাকা অনেকটা একই রকম—ছেঁড়া, ফাটা, কোঁচকানো, ভাঁজ-পড়া, অন্তরে ও বহিরঙ্গে খাটো। এক এক সময়ে সাজিয়ার মনে হয়েছে যে গরীব মানুষকে যতই মুচমুচে নোট দাও না কেন, একসময়ে তা অদ্ভুত ও কুৎসিত রূপ নেবে। এখন সে এবিষয়ে নিশ্চিত হল। বুয়াকে বলল,"ঠিক আছে, এখন যাও, ফিরলে ফের এস।" বুয়াকে বাড়ি পাঠিয়ে সাজিয়া লাগোয়া গোসলঘরে ঢুকে বেসিনের ওপর টাকাগুলো রাখল। তারপর জীবাণুরোধী সাবানে ভাল করে হাত ধুয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

সাজিয়ার মনে পড়ল না ইয়াসিন বুয়ার দেওয়া টাকা ও বেসিন থেকে তুলেছে কিনা। হজ কমিটির ব্যবস্থাপনায় ওরা সকালের উড়ানে রওনা দিয়ে মদিনা পৌঁছল। নতুন পরিবেশ, ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণ, এবং আট দিনের অবস্থানে আবশ্যিক চল্লিশ বার নামাজ এসবের মধ্যে দিয়ে কী করে যেন সময় ফুরিয়ে এল। সুভান ওকে কেনাকাটা করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু সাজিয়া কি আর বিধিনিষেধ মেনে চলার লোক? ওর মতে আইন তৈরি হয়েছে ভাঙার জন্য। তাই ও দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে নিজের মতে চলল। পরিস্থিতির কোন বদল হল না।

সুভান নিয়তের প্রসঙ্গ তুলল। হজে যাওয়ার আগে ওরা তীর্থযাত্রা ও প্রার্থনার অভিপ্রায় স্থির করে রেখেছিল। সুভান সাজিয়াকে বলেছিল যে হজের পর ও কেনাকাটা করতে পারে। ওকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে আগে থাকতে কিছু কেনাকাটা করলে নিয়তের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হবে। মদিনা ছেড়ে মক্কা যাওয়ার সময় ওর আরেক নতুন অভিজ্ঞতা হল। এই সব কাজকর্মের মাঝে ও গ্রাম আর বাড়ির কথা ভুলতে বসেছিল। মক্কায় কয়েকদিন ভোলার মত নয়। ভারতের হজ কমিটি বেশ কয়েকটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। কিস্তিতে কে কত ভাড়া দিয়েছে তার ভিত্তিতে তীর্থযাত্রীদের ঘর বরাদ্দ করা হল। দু'টো ঘরের জন্য একটা গোসলঘর, একটা ছোট রান্নাঘর, স্টোভসহ একটা গ্যাস সিলিন্ডার, একটা ফ্রিজ, একটা কাপড়কাচার মেশিন এবং আবাসিকদের জন্য আনুষঙ্গিক অন্যান্য কিছু সুবিধা। সাজিয়ার মাতৃকুলের চারজন একসঙ্গে গেছিল বলে তাদের জন্য একটা বড় ঘর বরাদ্দ করা হয়েছিল। যথারীতি রান্নার দায়িত্ব ছিল মেয়েদের হাতে। ওদের বেশিরভাগ সময় কেটে গেল নামাজ পড়ে, কাবা প্রদক্ষিণ করে, প্রার্থনা আর অন্যান্য ধর্মীয় কাজেকর্মে। হীরা গুহা (যেখানে নবী প্রথম দৈববাণী শুনতে পেয়েছিলেন) ছাড়া অন্যান্য মসজিদ ভ্রমণ এবং নির্ধারিত সময়ে নামাজ পড়ার কাজে সবাই ব্যস্ত থাকলেন।  সৌদি সরকার, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও অন্যান্য দাতারা বড় বড় ট্রাকে করে খাবারের প্যাকেট, জুস ও জলের বোতল এনে নামাজের পর তীর্থযাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করলেন। হজযাত্রীরা আল্লাহর অতিথি বলে ওদের আপ্যায়ন করলে আল্লাহ খুশি হবেন এই ছিল সকলের বিশ্বাস। তাই আতিথ্যই জীবনের মূল লক্ষ্য এই আচরণ সকলের মধ্যে দেখা গেল।

সাজিয়া আর ওর লোকজন হজের বাকি আচার-অনুষ্ঠান শেষ করার কাজে ব্যস্ত ছিল। একদিন সকালে নামাজের পর কাবা প্রদক্ষিণ করে ও ফিরে এল। ইচ্ছে না থাকলেও সম্ভবত চড়া রোদে বাড়ি ফেরা আর দুপুরের খাওয়া পেটে পড়ার পর ক্লান্তিতে ওর চোখ বুজে এল। ছোট্ট ঘুম দিয়ে জেগে ওঠার পর সাজিয়া তরতাজা বোধ করল। এইবার অসর নামাজের জন্য আল-হারাম মসজিদে যাওয়ার পালা। ওজু করতে গিয়ে কিছু একটা দেখে ও থমকে গেল। পাশের ঘরের জয়নাব ওদের খাবার জলের জার থেকে ১০ লিটারের একটা বালতিতে জল ঢালছে। বিস্ময়ে সাজিয়া জিজ্ঞাসা করল," করছটা কী, জয়নাব?"

সাজিয়ার দিকে তাকিয়ে জয়নাব বলল, "কাফনটা ধোব।"

"কী বললে?" সাজিয়া রাগে ফেটে পড়ল। "পানীয় জল চুরি করছ তুমি। ঠিক এটা? হজ করতে এসেও এরকম খেলো আচরণ!" সাজিয়ার চিৎকার শুনে জয়নাব বালতি নিয়ে ঘরে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল। হজের সময় পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব সৌদি সরকারের। জল সরবরাহ করার সব কোম্পানি, প্লাস্টিকের ডাব্বায় করে এই জল আনে না। ওরা কাবা চত্বরের ভিতরে পাতকুয়ো থেকে জমজমের জল ট্যাঙ্কে ভরে নিয়ে আসে। তারপর দুটো ঘরের ব্যবহারের জন্য রাখা জলের পাত্রে ভরে দেয়। তা প্রায় ১০-১৫ লিটার জল। বিকেল তিনটে নাগাদ ওরা আসে। সাজিয়া কদাচিৎ এই পানীয় জল সংগ্রহ করার সুযোগ পায়। বেশিরভাগ দিন সুভান নামাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় ৫ লিটারের জার নিয়ে আসে।

খুব রেগে গেল সাজিয়া। জয়নাবের মিনমিনে জবাব ওর শরীরে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। এই অবধি চুরি করা জলে জয়নাব কতগুলো কাফন ধুয়েছে? পরিবারের সবাইকে কী ও জমজমের জলে ধোয়া কাফনে শোয়াতে চায়? সাজিয়া যখন এইসব ভাবছিল ওর গলার আওয়াজে সুভান দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এসে দেখল সাজিয়া হাসিতে ফেটে পড়েছে। একটু আগেই সাজিয়া চিৎকার করছিল কিনা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল," হয়েছেটা কী, সাজিয়া? এত হাসছ কেন?" হাসতে হাসতে ও বলল," দেখ দেখি, এই সব লোক মোটেই হজের গুরুত্ব বোঝে না। এখানে এসে এত সামান্য কারণেও লোক ঠকায়।" সামান্য হেসে ও বলল," আজ জানলে বুঝি? আমি যেদিন এখানে এসেছি বুঝে গেছি। কিন্তু আমি না রাগ করেছি, না তোমার মত ঝগড়া। এই কারণেই রোজ আমাদের জন্য জল কিনে নিয়ে এসেছি। ছেড়ে দাও। এতো কোন ঝগড়াঝাটির বিষয় নয়।"

সাজিয়ার হঠাৎ মনে পড়ল ইয়াসিন বুয়ার কাফনের কথা। "হ্যাঁ গো, বুয়ার জন্য আমাদের একটা কাফন কিনতে হবে। সন্ধেবেলা নামাজ পড়ে ফেরার সময় কিনব," সাজিয়া বলল। প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ায় সাজিয়া আর একদম দেরি করতে চাইল না। সুভান মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল আর চটপট তৈরি হয়ে নিল, দেরি হয়ে গেছে বেশ। ওরা যেরকম ভেবেছিল সেরকম ব্যস্ততা এখন আল-হারাম মসজিদে। নিয়মমত নারী- পুরুষের আলাদা-আলাদা জমায়েত। মসজিদের স্তম্ভগুলোর মাঝখানে ওরা করজোড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। সাজিয়া আর সুভানের যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই মসজিদের বিস্তৃত আঙিনায় ওরা পাশাপাশি দাঁড়াল। কিছুক্ষণ বাদেই দেরিতে আসা লোকজনে আঙিনা ভরে গেল। রোদ্দুর ছিল বেশ। বড় বড় ছাতা আপনাআপনি খুলে গিয়ে ছায়া দিল। আবার পড়ন্ত সূর্যে সব ছাতা বন্ধ হয়ে যেতে স্তম্ভের মত লাগল। সাজিয়ার চোখে সে এক বড় আকর্ষণীয় দৃশ্য।

ঈশার নামাজের পর এইবার ওদের কাবা চত্বর থেকে ফেরার পালা। মূল সড়ক ও অলিগলি দিয়ে লাখে লাখে লোক ফিরছে। সুভান বুঝতে পারল না যে এই ভিড়ে কোন দোকানে ও কাফনের খোঁজ করবে। সাজিয়াকে তো কিনে দিতে হবে একটা ইয়াসিন বুয়ার জন্য। সুভান বিবির হাত শক্ত করে চেপে ধরে চলতে লাগল। এই ভিড়ে যদি সাজিয়া হারিয়ে যায় কী করে ও খুঁজে পাবে! অভ্যাসমত সাজিয়ার হাত ধরে বা কোমর জড়িয়ে ওরা এগিয়ে চলল। কোন সঙ্কোচ বা দ্বিধার বালাই ছিল না। সাজিয়ার অলস গতির সঙ্গে তাল মেলাতে সুভানকে আস্তে চলতে হল। চলতে চলতে সুভান প্রত্যেক দোকানে দাঁড়িয়ে খোঁজ নিল সেখানে কাফন পাওয়া যায় কিনা। সেই খোঁজ করতে করতে একটা গালিচার দোকান সাজিয়ার সব মনোযোগ কেড়ে নিল। সেই সব গালিচা দেখে সাজিয়ার এমন অবস্থা যে মনে হল ও দোকানেই থেকে যাবে। কী সুন্দর, নক্সাদার, বর্ণময় বুনন এই সব গালিচার! সুভানের সম্মতি না নিয়ে ও একটা গালিচার দরদাম শুরু করে দিল। ফালতু কেনাকাটা থেকে সাজিয়াকে বিরত করার জন্য সুভানের পরিকল্পনা খানখান হয়ে গেল। নিয়তের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হবে বা সন্দেহের আতসকাচে দেখা হবে সাজিয়ার অভিপ্রায় এইসব আবেগের কথা বাতাসে কোথায় যেন ভেসে গেল। হজের আচারবিধি সম্পন্ন হওয়ার পর খুশিমত কেনাকাটা করার কথাও সাজিয়ার মনে কোন আলোড়ন তুলল না। সুভান যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ওকে দোকানের বাইরে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হল।

সব কিছু ভুলে, সবাইকে ভুলে সাজিয়া ওর পছন্দের তুর্কি গালিচায় নিজেকে হারিয়ে ফেলল। ব্যর্থ সুভান ফিসফিস করে দোকানের বিক্রয় সহকারীকে জিজ্ঞাসা করল,"এখানে কি কাফন পাওয়া যায়?"সহকারী তৎক্ষণাৎ একটি কাফন বার করে দেখাল, প্লাস্টিকে জড়ানো, মৃতদেহের মত ভারি। সুভান সাজিয়ার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করল। গালিচায় চেপে বসে ও বাঁহাতে কাফনটাকে তোলার চেষ্টা করল। বলল, "আয়াপ্পা! কী ভারি এই কাফন! কীভাবে এটা নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরব!" মুহূর্তে বাতিল হয়ে গেল ওর কফিন কেনার ভাবনা। গালিচার দিকে চলে গেল সমস্ত মনোযোগ।

শেষপর্যন্ত কেনাকাটা শেষ হল। সুভান পকেট থেকে টাকা বার করে দিল। তারপর দোকানদারের বেঁধে দেওয়া গালিচা কাঁধে ফেলে হাঁটা লাগাল। রাস্তায় তখন অটো বা কুলি পাওয়ার কথা নয়। তাই সুভানকেই ঘাড়ে করে টেনে নিয়ে যেতে হল। ওকে কারওর চোখে পড়বে না ভাবলেও পথে চেনা কয়েক জনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাঝপথে সাজিয়ার খারাপ লাগল। ও সুভানকে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল," হ্যাঁ গো, খুব ভারি?" কোন উত্তর এল না। খুব রাগ হয়েছিল সুভানের। ইচ্ছে করছিল সাজিয়াকে মেরে বেহুঁশ করে দেয়। কিন্তু খুব শান্তভাবে ও গালিচা ঘরের এক কোণে নামিয়ে রাখল। তারপর একটা গভীর শ্বাস ছাড়ল। অন্য কোন পরিস্থিতিতে সে সাজিয়ার দিকে রুষ্ট হয়ে তাকাত বা ওকে বকাবকি করত। কিন্তু এখন হজ, ঘরে অনেক আত্মীয়স্বজন, তাই নিজেকে শান্ত রাখল।

হজের মেয়াদ শেষ হল। এখানে ওখানে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলেও ওরা উভয়েই সন্তুষ্ট হয়েছিল। মিনা থেকে ফেরার পর একটু উদ্বেগ বাড়িয়ে সাজিয়া বিছানা নিল। রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে দিন দুয়েকের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। ছেড়ে দেওয়ার পর আরও একদিন বিশ্রাম নিয়ে রক্তচাপ আয়ত্তে এল। কেনাকাটার সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে সাজিয়ার বেশ রাগ হল। সাজিয়া জোর দিয়ে বলল যে ও ভাল আছে, অন্তত সুভানের সামনে। আর খুব তাড়াতাড়ি ও সুস্থ বোধ করতে লাগল। কেনাকাটা স্থগিত রাখার জন্য সুভান নানারকম ফন্দি আঁটতে লাগল। টাকার চিন্তা ওর ছিল না। চিন্তা ছিল বেশি মালপত্র থাকলে উড়ানে ফেরার অসুবিধে হবে। সে ওই ফাঁদে পা দিল না। কিন্ত সাজিয়াকে হতাশ করতেও সুভানের মন চাইল না। এতে ওর রক্তচাপ আবার যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই কেনাকাটায় কাঁটছাঁট করার চিন্তায় তেমন আমল দিল না। সাজিয়াকে আর এখন থামানোর কেউ নেই।

কেনাকাটার নেশায় ছুটতে ছুটতে সাজিয়ার মনে ইয়াসিন বুয়া আর তাঁর কাফনের কথা ঝলকের মত আসত, যেত। শেষে তা অন্য কিছুর আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। তারপর সম্পূর্ণ বিস্মৃতি। এই জাদু শহরে কাফনের মত মন খারাপ করা, ভারি একটা বিষয়ের চিন্তা মনের কতটা জায়গা জুড়ে নেয়। হে ভগবান! ভারতে কি কাফন পাওয়া যায় না? পাওয়া যায় না কি, আমাদের গ্রামে? গিয়ে বলে দেব মক্কায় এসব পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, তবে হজ থেকে ফিরে এরকম মিথ্যাচার করা যায় কি? গালে আলতো টোকা দিয়ে সাজিয়া বলল,"তওবা, তওবা"। না, আর মিথ্যা কথা নয়। ও ভাবতে পারেনি যে ইয়াসিন বুয়ার ইচ্ছা ওকে এরকমভাবে বিব্রত করবে।

এখন বুয়ার মৃত্যুর কথা শুনে সাজিয়ার মন সামান্য বিক্ষিপ্ত হল। অপূর্ণ আশার পরিণাম নিয়ে ও ভাবতে শুরু করল। ‌উফ, কী মানসিক যন্ত্রণা! ও যদি আগে জানত, কথা রাখত, তা সে যত অসুবিধেই হোক না কেন।

ওরা যখন কেনাকাটা সেরে ফিরল সঙ্গে প্রচুর মালপত্র। অতিরিক্ত সামগ্রী দলের অন্যান্যদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হল। এই কাজ যখন শেষ হল সুভান একেবারে বিধ্বস্ত। এরপর পাঁচ লিটারের পাত্রে জমজমের জল, কয়েক কিলো খেজুর সবাইকে ভাগ করে দেওয়া হল। এই সব জিনিসও কম ভারি ছিল নাকি? সাজিয়া বোরখা পরে হাতব্যাগ মুঠোয় ধরে যে কোন ছোটখাট বিষয়ে সুভানের পেছনে ঘুরে বেড়াল। এতে ওর বিরক্তি বাড়ল বই কমল না। শেষে অনেক ঝামেলা সামলে ওরা মালপত্র সহ নিজেদের জায়গা করে নিল উড়ানে।

হজ থেকে ফিরে আসার একমাস পরেও সাজিয়া সবকিছু সবাইকে দিয়ে উঠতে পারল না। জেট ল্যাগ ও অসুস্থতার কারণে প্রথম তিনদিন ও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। তারপর বাক্স-প্যাঁটরা খোলার পালা। তারপর সে ঘনিষ্ঠ ও প্রিয়জনদের জন্য আনা সোনাদানা ও অন্যান্য দামি উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা করল। মূল্যবান গালিচা পেতে দিয়ে সে সুখী বোধ করল। সুভান কোন বিষয়ে কিছু না বললেও সাজিয়ার তা চোখে পড়ল না। বিরক্ত হয়ে সুভান অন্যত্র চলে গেল।এরপর খেলনা, পোষাক ইত্যাদি জনে জনে দিয়ে দেওয়া হল। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও স্বজনেরা সাজিয়াকে বলে দিয়েছিল বোরখার নকশা, রং, কাটাই, সূচীশিল্প কেমন হবে। কেউ আগে টাকা দিয়ে দিয়েছিল। কাউকে ও দায়বদ্ধতা থেকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। অন্যদের প্রত্যেককে ও একটা করে জা-নামাজ(নামাজ পড়ার মাদুর), জপমালা, অল্প খেজুর ও বোতলে করে জমজমের জল উপহার দিয়েছিল। সবকিছু নিজের হাতে না করলেও শুধু দেখভাল করতে গিয়ে সাজিয়া বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এই সব শেষ করতে প্রায় একমাস কেটে গেল।

একটা বিশ্বাস আছে যে হজফেরত সবাই এক ‌ইতিবাচক ও আধ্যাত্মিক শক্তির মূর্ত প্রতীক। এই শক্তির যাতে কোন অপচয় না হয়, শুধু আল্লাহর প্রার্থনায় কাজে লাগে তার জন্য প্রায় চল্লিশ দিন ঘরে থাকতে হয়। কঠোর শপথের মত এই নৈমিত্তিক প্রার্থনার অভ্যাস চালিয়ে যেতে হয়। সাজিয়াও তাই করল। অভ্যাসমত ইয়াসিন বুয়া বেশ কয়েকবার ওর বাড়িতে এল। নিজের উপস্থিতি না জানিয়ে ফিরেও গেল। সাজিয়া তখন হয় ঘুমিয়ে ছিল বা বিশ্রাম নিচ্ছিল। নয়তো নামাজ পড়া বা অন্য কোন জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিল। এই সব বার্তা পেয়ে ইয়াসিন বুয়ার চোখে জল আসত। একদিকে তো কাফনটা দেখার জন্য বুয়ার প্রাণ ছটফট করছিল। অন্যদিকে হজফেরত সাজিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের রুক্ষ হাতে ওর হাতদুটো ধরার ইচ্ছে। দিনের পর দিন বুয়া অপেক্ষা করতে লাগল। আশা যে সাজিয়া কিছু উপহার বুয়ার জন্যও এনেছে।

শেষে, বুয়ার যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষা পর্বের সাক্ষ্য বহন করে সাজিয়া দেখা দিল। সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে, চুল তখনও আধভেজা। গায়ে দারুণ একটা আকাশী নীল চুড়িদার। মাথায় কাসুতির কাজ করা মানানসই দোপাট্টা। ইয়াসিন বুয়া খুশিতে ফেটে পড়লেন। ওর আনন্দ বাঁধ মানল না। উনি দৌড়ে গিয়ে সাজিয়ার হাত নিজের চোখে চেপে ধরলেন।

হাজ্জিনের হাত ছুঁয়ে বুয়ার মনে হল তিনিও আধ্যাত্মিকভাবে পবিত্র হয়ে গেছেন। ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সাজিয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বুয়াকে মামুলি প্রশ্ন করল,"কেমন আছ বুয়া?" তারপর দ্রুত ঘরে গিয়ে বুয়ার জন্য জা-নামাজ আর জপমালা নিয়ে এল। বলল, "এটা নাও, তোমার জন্য এনেছি।" ইয়াসিন বুয়া যা চেয়েছিল তা সেখানে ছিল না। জমজমের জলে ধোয়া যে কাফনে শুয়ে আল্লাহর কাছে যাওয়ার কথা তা বুয়া পেল কই? উপহারের জন্য হাত বাড়াতে গিয়েও বুয়া থমকে গেল। অবিশ্বাসের চোখে তাকাল সাজিয়ার দিকে। মুহূর্তের জন্য অন্ধ হয়ে গেল হতাশায়। তারপর সাহসে ভর করে দৃঢ় কন্ঠে সাজিয়াকে স্পষ্ট  বলল, "এসব আমার প্রয়োজন নেই। আমার কাফনটা দাও।" সাজিয়া এরকম আচরণ আশা করেনি। তাই খুব রেগে গেল। রাগ লুকোনোর চেষ্টা না করে চিৎকার করে ধমকে উঠল। "দেখ দিকি! প্রার্থনার মাদুর কেউ ফিরিয়ে দেয়?"

কিন্তু বুয়া নিজের বক্তব্য থেকে এক ইঞ্চিও নড়ল না। নিজের জেদে অটল থাকল। "তোমার শ্বাশুড়ি-মা হজ থেকে ফিরে যে জা-নামাজ আমায় দিয়েছিলেন তা এখনও আমার কাছে আছে। সময় পেলে সেটায় বসে আমি নামাজ পড়ি। এরকম সুন্দর ও নতুন একটা জা-নামাজ আমি রাখব কোথায়?আর কতদিন আমায় বেঁচে থাকতে হবে? আর ক'বার আমি নামাজ পড়তে পারব? সমাজ আমাকে সংসার থেকে চলে যেতে বলছে। অরণ্য বলছে অবসর নিয়ে চলে এস এখানে। তাই কাফনটা আমার চাই-ই চাই।

 

ইয়াসিন বুয়ার এরকম মনোভাব আগে কখনও সাজিয়ার চোখে পড়েনি। চলতে-ফিরতে শ্রদ্ধায় কোমর ঝুঁকিয়ে বুয়া প্রতি মুহূর্তে সাজিয়ার আকাশছোঁয়া প্রশংসা করেছে। ওর যাতে খারাপ নজর না লাগে সেজন্য আঙুলের গাঁট ফাটিয়েছে। সবসময় ভাল চেয়েছে বুয়া। বলেছে, "আল্লাহ তোমায় দীর্ঘ জীবন আর ঐশ্বর্য দিক! তোমার সংসারে সুখ হোক, দাম্পত্য মধুর হোক। আল্লাহর কৃপায় স্বর্গে প্রবাল-প্রাসাদ হোক।" কোথায় গেল সেই বুয়া যে সবসময় আশীর্বাদ করত, মঙ্গল কামনা করত? যে বুয়া এখানে শক্ত হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে সে কি তাহলে অন্য কেউ?

 

সাজিয়ার রাগ বুদবুদের মত উপচে পড়ল। ও ভুলে গেল যে সদ্য হজ থেকে ফিরেছে।

চিৎকার করে বলল,"কী কাফন? কোন কাফন? মরে গেলে কেউ না কেউ ঠিক তোমায় একটা কাফনের ব্যবস্থা করে দেবে। তাহলে এত গোলমাল করছ কেন? কী হয়েছে বুয়া? মতিভ্রম! আমায় কত টাকা দিয়েছিলে তুমি? আমি দশ গুণ টাকা তোমার মুখে ছুঁড়ে মারব। নিয়ে আসছি, দাঁড়াও। তবে এখানে আর কখনও এস না।" সাজিয়া দৌড়ে ঘরে চলে গেল। যখন ফিরল হাতে দু'টো ৫০০ টাকার নোট। ইয়াসিন বুয়াকে কোথাও দেখা গেল না। মেজাজের কারণে, ‌‌‌‌সাজিয়া এত সহজে বুয়াকে ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছিল না। ও দৌড়ে রান্নাঘরে গেল, বাড়ির পেছনদিকে গেল। কাছের গলি পথে উঁকি মারল। কিন্তু এদিক-সেদিক দেখেও বুয়াকে খুঁজে পেল না। মনে মনে জাহান্নামে যাক বুয়া একথা বলে সে নোটদু'টো চায়ের ট্রেতে রেখে  সোফায় শুয়ে পড়ল। সাজিয়া যেমন চেয়েছিল ইয়াসিন বুয়া আর ফিরে এল না। পরিত্রাণ পাওয়া গেছে ভেবে সাজিয়ার মনে সুখ-শান্তি ফিরে এল। কিন্তু কী করে বুয়া এমন করতে পারে? সাজিয়ার মনে এই প্রশ্ন অহরহ জেগে উঠতে লাগল। আর লুকোনো রাগটা আবার বেড়ে গেল। বুয়া মুখ না দেখালে ওর কী করার আছে আর? যেতে দেবে ওকে? হতে পারে বকরি ঈদ বা রমজানে বুয়া আবার আসবে, ভিক্ষার খোঁজে। কোমর বেঁকিয়ে এত ছোট হয়ে যাবে যে বুয়াকে তখন হাতের মুঠোয় ধরা যাবে। কিন্তু না বুয়ার আত্মমর্যাদা খুব বেশি। সে একবার কাফনটা ছুঁয়ে দেখার জন্য খুব আগ্রহী। কনেবউ যেমন করে বিয়ের উপহার দেখতে চায়। সালংকারা সাজিয়া সাজপোশাকের গুমরে বুয়ার সঙ্গে অন্ত্যজ নিঃস্বের মত ব্যবহার করেছে। বুয়ার মনে এখন এক চিরস্থায়ী ক্ষত।

উদ্ভটতম স্বপ্নেও সাজিয়া ভাবেনি যে মরার পরেও বুয়া তাকে দেখা দেবে। আকস্মিক যন্ত্রণার ভারে ও কেমন অবসন্ন হয়ে পড়ল। ও কী করবে? কী করবে না? একটা কাফনের দাম এক লাখ টাকাও যদি হয় সাজিয়া দিতে প্রস্তুত। কিন্তু মক্কা থেকে জমজমের জলে ধোয়া কাফন! হায় আল্লাহ! কী করবে সাজিয়া। ভুল সংশোধনের কথা ভাবতে গিয়ে ওর যন্ত্রণা যেন আরও বেড়ে গেল। উৎকন্ঠার মত মোবাইল ফোনটাকে মুঠো বন্দি করে "কী করব, কী করব"এই সব সাত পাঁচ ভেবেই চলল। তারপর কূলকিনারা না পেয়ে উপরে একটা খালি ঘরের এক কোণে গিয়ে আশ্রয় নিল। শরীরের তাপমাত্রা কি বাড়ছে, কাঁপুনি ধরছে কি, কেন যে ঘাম হচ্ছে সাজিয়া বুঝতে পারল না। আমি আমার সব সৎকর্ম উজাড় করে দিলেও এই গরীব মহিলা যদি ওর আঁচল মেলে ধরে বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে একটু সুবিচার প্রার্থনা করত! তবুও দোষী হয়ে থাকতাম আমি, সাজিয়া ভয়ে ভয়ে ভাবল। সাজিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল ও বুয়ার থেকেও গরীব, আরও অভাগা।

মক্কা থেকে আনা একটা কাফন ছিল প্রয়াত বুয়ার শেষ ইচ্ছা। নাহলে কেনই বা ওর ছেলে ছুটে আসবে? পরলোকগত মায়ের হয়ে ভিক্ষা চাইবে? আলতাফ খুব নরম সুরে আর্জি জানালেও একথা স্পষ্ট ছিল যে যে ও মায়ের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে দৃঢ়সঙ্কল্প। সাজিয়া কী করে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসবে! ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল নিচে। যদি আলতাফ অন্য কোন কাফন ব্যবহার করতে অস্বীকার করে, বুয়াকে আর সেদিন দাফন করা হবে না। জামাত সুভান মিঞা আর ছেলেকে মসজিদে ডেকে পাঠাবে, নানান প্রশ্ন করবে। করজোড়ে মাথা নিচু করে ওদের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভেবে সাজিয়া শঙ্কিত হল। ফারমান অবশ্যই সাজিয়াকে ছেড়ে কথা বলবে না। ছেলে সাজিয়াকে যেমন ভালবাসে তেমন নিষ্ঠুরভাবে খাটো করতেও পারে। ওর ভাবনা-চিন্তা আকাশে এলোমেলো ঘুড়ির মত উড়তে লাগল। সাজিয়া বসে বসে কাঁদতে লাগল যতক্ষণ পর্যন্ত না ওর হৃদয় দুঃখে ফেটে পড়ে। হাঁফ ধরে না যাওয়া পর্যন্ত ও কেঁদে চলল। অবিরাম কেঁদে কি একটু হালকা হল সাজিয়া? না। ওর গলার কাছে দলা হয়ে আছে প্রবল দুঃখ। হে আল্লাহ! চরম শত্রুও যেন এরকম কষ্ট না পায়। অতি কষ্টে ও দম নিতে লাগল।

দু-এক ঘন্টা একা একা বসে কাঁদার পর আশার একটা ঝলক দেখা গেল। নিচে থেকে সুভানের গলা ভেসে আসছে। জোরে জোরে ও বলছে,"সাজিয়া আমার জামাকাপড় কই? কলম কই? জলখাবার কই?"শুনলেও সাজিয়ার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। ছেলের বৌ সাবা উত্তর দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,"আব্বা, আম্মি বোধহয় বাড়ি নেই। সকালে কেউ একজন মারা গেছে খবর এসেছে। মা বোধহয সেখানেই গেছে।"

সুভান জানতে চাইল, "কী! কে মারা গেছে? কে তোমায় খবর দিয়েছে?"

"ফারমান বলেছে, ওতো সকালে চা-জলখাবারও খায়নি। আম্মি বোধহয় ওর সঙ্গেই গেছে। সাজিয়া একটা স্বস্তির দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। সাবা সাংঘাতিক প্রকৃতির মেয়ে হলেও বৌমার ভূমিকায় ধূর্ততায় কোন খামতি নেই। বৌমার প্রতি সাজিয়া একটু নরম হল। খাওয়ার টেবিলে পোর্সেলিনের পাত্রে চাপাটি আর সব্জি গুছিয়ে রেখে সাবা রাঁধুনির তৈরি খাবার সুভানকে পরিবেশন করছিল। একটু পরে সুভানের গাড়ি গেট ও সীমানা প্রাচীর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কান্নাকাটি করে আর কোন লাভ নেই। সাজিয়া অনুভব করল যে নিজের চেষ্টায় একটা রাস্তা ওকে খুঁজে বার করতে হবে।

 

সাজিয়ার পরিচিত অনেক লোক আগেও তো মারা গেছে। কই তখন তো সাজিয়া এত চোখের জল ফেলেনি। তখন কত লোক আশেপাশে, কেউ জল খাওয়াচ্ছে, কেউ গোলাপজলে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে। সবাই সাজিয়াকে শান্ত করতে চায়, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে চায়। বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন একে অপরকে ঠেলে এগিয়ে আসে। এসবের ঘেরাটোপে দুঃখটা কোনমতে সহ্য করা যেত। এখন গৃহকোণে একাকী এক অনাথ শিশুর মত লুকিয়ে সাজিয়ার মনে হচ্ছে ও নিজেই এর জন্য দায়ী। আর এই দায় থেকে ওকে বেরোতে হবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ও দ্রুত আত্মীয়স্বজনকে ফোন করা শুরু করল।

"জমজমের জলে ধোয়া একটা কাফন লাগবে আমার..."—সাজিয়ার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই উত্তর এল," কী... সাজিয়া বলছ? বাড়িতে তো এখন কোন কাফন নেই। আম্মি হজে গিয়ে একটা এনেছিল বটে, কিন্তু কেউ একজন চেয়েছিল, দিয়ে দেওয়া হয়েছে, গল্প সেখানেই শেষ।" আরেকজন হেসে বলল,"কী চাইছ, কাফন? সে আবার কেউ বাড়িতে এনে রাখে নাকি? না, না, কাফন নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি আমরা কাউকে দিইনা। বড় বাজে কাজ।" আরেকজন বলল," মক্কা থেকে কাফন নিয়ে আসার কী দরকার! এখানকার কাবন হলে কী অসুবিধে! মরণোত্তর জীবনে কী ফল পাব তা ইহজীবনের কাজে ঠিক হয়ে যায়, তাই না?

সবার থেকে না শোনার পর, সাজিয়া সাবার আম্মিকে ফোন করল। মন বা হৃদয় কিছুরই সায় ছিল না, তবু। পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর সাজিয়া আবরু ও আত্মমর্যাদা সরিয়ে রেখে আসল কথায় এল। "দিদি, তোমার বাড়িতে হয়তো মক্কা থেকে আনা একটা কাফন আছে।" সাবার আম্মি সাজিয়াকে খুব একটা পছন্দ করত না। সাবার নিয়মিত বার্তা থেকে ওর আম্মির মনে হয়েছিল সাজিয়া একটা মিটমিটে শয়তান। সাবার ওপর ও শুধু কড়া নজর রাখে না ওর শান্তিকে পাইথনের মত পেঁচিয়ে রাখে। সবকিছু সত্ত্বেও সাবার আম্মি যেকোনভাবে একটা কাফনের বন্দোবস্ত করে দেবে বলে ভেবেছিল। তবে যদি তা সাজিয়ার ব্যবহারের জন্য হয়। সাজিয়াকে জিজ্ঞাসা করল,"কাফন কি তোমার লাগবে?" তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করল,"তোমার কেন কাফন লাগবে?" কথায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ। কোন কথা না বলে সাজিয়া লাইন কেটে দিল। এখন ওর মাতুলালয় থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন সবার কাছে পৌঁছে গেছে একটা কাফনের জন্য আর্তি। নিজেকে এরকম অসহায় মনে হবে তা সাজিয়া কখনও কল্পনা করেনি। ও আবার কেঁদে ভাসাল।

কেঁদে কোন লাভ হবে না বুঝে সাজিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল। খাবার ও ওষুধ খেল। কিন্তু এসব করে বিশেষ কিছু লাভ হল না। নিজেকে পরাস্ত মেনে নিয়ে ও ভাবতে বসল স্থানীয়ভাবে একটা কাফন সংগ্রহ করে, জমজমের জলে ধুয়ে, বুয়ার জন্য পাঠিয়ে  দেবে। কিন্তু সেই কাফন তো মক্কা থেকে আনা কাফন হবে না। কোন অতলে ও তলিয়ে যাচ্ছে সেকথা ভাবতে ভাবতে সাজিয়া অসহায়ভাবে নিজেকে গালমন্দ শুরু করল,"থুঃ, থুঃ, গোল্লায় যাক তোর জীবন। বেদনা, মনোকষ্ট, মর্যাদাহানি, অসহায়তা আর মুহূর্তের যন্ত্রণাভোগ মোটেই কহতব্য ছিল না।

বিকেল তিনটে নাগাদ ফারমান বাড়ি ফিরল। খাওয়ার টেবিলে গিয়ে সাবাকে জিজ্ঞাসা করল," আম্মি কোথায়?" শ্বাশুড়ি মায়ের মেজাজ ভালো নেই ভেবে সাবা কোন উত্তর দিল না। শুধু চোখের ইশারায় ঘরের দিকে দেখিয়ে দিল। ফারমান দৌড়ে গেল। শব্দহীন আম্মির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেল সব। পাশে বসে হাতদুটো ধরে ডাকতেই সাজিয়া ছেলের কাঁধে মাথা রাখল। ছেলে যতই সান্ত্বনা দিক না কেন হাঁফ ধরার আগে পর্যন্ত সাজিয়া কেঁদে চলল। সাবা দরজায় দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবল ওর শ্বাশুড়ি-মা কি এতই সংবেদনশীল যে সামান্য এক দাসীর মৃত্যুতে এত কাঁদছে। ফারমান ইশারায় ওকে চলে যেতে বলল।

সকালে ফারমান আম্মির ওপর খুব বিরক্ত হয়েছিল। "আম্মির উচিত হয়নি কাফন আনার কথা দেওয়া... কিন্তু কথা যখন একবার দিয়ে ফেলেছে তা রাখার দরকার ছিল বইকি। একটা কাফন বয়ে আনা এমন কি বড় ব্যাপার। তাও একজন গরীব মানুষের জন্য।" খুব খারাপ লেগেছে ফারমানের। "আমি আর সাবা যখন উমরাহ পালন করতে গতবছর মক্কা গেলাম, আম্মি আমাদের কাফন নিয়ে আসার কথা বলতে পারত, নিয়ে আসতাম।" একটা কাফন নিয়ে আসা যে কী সমস্যা সেকথা ভেবে সে মাকে দোষারোপ করতে গিয়েও শান্ত হয়ে গেল। মায়ের দুর্দশার জন্য কষ্ট অনুভব করে ও বলল,"ছেড়ে দাও মা, কখনও কখনও এরকম হয়। ভুলে বা স্রেফ দুর্ভাগ্যের জন্য এই সব ঘটে। একথা মনে পুষে রেখ না। তাছাড়া আম্মি আমি আলতাফের সঙ্গে সকালে বুয়ার ওখানে গেছিলাম, দাফন করার আচারবিধি পালন করে এই ফিরেছি। আমি কাফন, আগরবাতি, আতর যা যা লাগে সব কিনে দিয়ে এসেছি। তারপরে কবরখানায় পছন্দের জায়গা খুঁড়ে রেখে এসেছি। মৃতদেহের গোসল সেরে এসেছি। আমি ভেবেছিলাম যে দুপুরের খাওয়া সেরে তোমায় সঙ্গে নিয়ে যাব। নাহলে শান্তি হবে না তোমার। এস,খাওয়া সারি দু'জনে। তারপর একসঙ্গে গিয়ে বুয়াকে শেষবারের মত দেখব।

সাজিয়ার দুঃখ আবার বেড়ে গেল। ফারমান মাকে খাবারের থালা বাড়িয়ে দিল। একটু ভাত মায়ের পেটে যেতে না যেতেই ফারমান সাবাকে বলল,"তোমার আর গিয়ে কাজ নেই, আম্মি গেলেই যথেষ্ট।" তারপর মাকে নিয়ে ইয়াসিন বুয়ার বাড়ি গেল। সেখানে কী কী ঘটতে পারে, মনে মনে তার ছবি এঁকে নিল। বুয়াকে দেখে সাজিয়ার চোখ আবার জলে ভরে গেল। বুয়ার ছেলেমেয়েরাও বোধহয় এত কাঁদেনি। কিন্তু তবুও সাজিয়া নিজেকে ক্ষমা করতে পারল না। উপলব্ধি করল যে নিরন্তর শোকপালন করে যেতে হবে।

যখন সাজিয়া ছেলের সঙ্গে বুয়ার বাড়ি পৌঁছল, সবকিছু এমনভাবে ঘটল যেন তাই হওয়ার ছিল। সাজিয়ার দুঃখ ছিল অন্তহীন, চোখে অবিচ্ছিন্ন জলের ধারা। ওর মুখ, রক্তবর্ণ চোখ আর ফোলা ঠৌঁট দেখে সবাই বিস্মিত হল। মানুষের সহানুভূতি উপচে পড়ল। কী বিশিষ্ট পরিবার! কী ধনী! তবু সামান্য একজন দাসীর মৃত্যুতে এত শোক! না, এমনটা কেউ আগে কখনও দেখেনি। কে জানে ওদের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল! তারপর সব ভাবনার বোঝা আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিল। শুধু আল্লাহ জানে। সাজিয়া শুধু সত্যটা জানত। এই শেষকৃত্য ইয়াসিন বুয়ার ছিল না, ছিল সাজিয়ার নিজের।

 

কন্নড় থেকে ইংরেজি: দীপা ভাস্তি

ইংরেজি থেকে বাংলা: গৌতম চক্রবর্তী

1 Comments

Basudeb Gupta

16 November, 2025

Khub bhalo lagoo anuvad. Lekhak ke abhinandan.

Post Comment