আমি হিন্দু রীতি খুব ভালোভাবে জানি না, তবে ওই পুকুর পাড়েই রেবার নামে একটি মঠ নির্মাণ করেন তার পিতা দীনেশ সেন। মঠের গায়ে বাংলায় লেখা ছিল “রেবা”। একটা বাংলা সাল তারিখও লেখা ছিল, আমার আজ আর তা মনে নেই।
ফাইভ-সিক্স-এ পড়বার সময় ঐ মঠটির দিকে তাকিয়ে আমি প্রায়ই রেবা মেয়েটির মুখ ভাবতে চাইতাম। মৃত-নারী-আত্মাকে ভাবনায় সবসময় রূপসী-ই কি মনে হয়? আমার প্রায়ই মনে হতো, সুন্দরী একটি কিশোরী মেয়ে মন খারাপ করে পুকুর পাড়ে বসে আছে।
তার সকল আপনজনেরা তাকে তার চির-চেনা জন্মভিটেতে একা ফেলে চলে গেছে নিরুদ্দেশে।
কিছু অপরিচিত মানুষকে তার নিজের ভিটেতে দেখে কেন যেন মনে হতো রেবা রাগ হয়ে আছে। আর তাই আমার ছোট মামার অসুখ করাতে মসজিদের হুজুর যখন বলেছিল ওকে নাকি জিনে ধরেছে, আমরা তখন ওকে খুব খেপাতাম, বলতাম এটা ঠিক রেবার ভূত।
মৃণাল সেন এবং তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় প্রতি বছরই আসতেন। আসতেন মূলত রেবার মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করেই। অন্য সময়ও কখনো কখনো এসেছেন। যখন আমি বড় হয়েছি, তার পরিচয় জেনেছি, তখন আর জোর করে আমাকে খেলার মাঠ থেকে আনতে হত না। অমন গুণি একজন মানুষের জন্য নিজেই অপেক্ষা করতাম।
মৃণাল সেন আসতেন কখনও সস্ত্রীক, কখনও ভাই বা পুরো পরিবারের সঙ্গে। বাংলাদেশে এসে সাধারণত তিনি ঢাকা হয়ে ফরিদপুরে আসতেন।
ঢাকা থেকে তার সঙ্গে যোগ দিতেন এ দেশের অনেক গুণিজনেরা, কখনও তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদ কখনো আবুল খায়ের– এমন অনেকে।
প্রতি বার পুরো বড়িটা ঘুরে দেখতেন। দেয়ালে হাত দিতেন। আমি পুরোটা সময় তার সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকতাম। বাড়ির সামনেই একটা বড় চারচালা টিনের ঘর ছিল, সে ঘরটা তার সব চেয়ে প্রিয়।
বাচ্চাদের মতো আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে আমাকে বলতেন, ‘ঠিক অইখানে আমার পড়ার টেবিল ছিল। আমরা দু-ভাই এই ঘরে পড়তাম। উঠোনে নেমেই কান্না হাসি মেশানো গলায় কত বার বলেছেন, এই উঠোনে আমার বোনটা খেলত।
বাড়ির সমস্ত কোণা তার চেনা। কোথায় তার মা আচার রোদে দিতেন, কোথায় এক দিন তিনি খেলার সময় লুকিয়ে ছিলেন, কোথায় বসে খাবার খেতেন বলতেন। আর চলে যাবার সময় প্রতি বার বলতেন, এই পথ দিয়েই চলে গিয়েছিলাম!’
হায়রে ৪৭!
সাতচল্লিশেই বড় আব্বা বাড়িটা কিনেছিলেন। বড় আব্বা মানে আমার মায়ের দাদা। তাকে আমি দেখিনি। তিনি দারোগা ছিলেন। খুব নাকি রাগী মানুষ। সে সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি আমি জানি না। আমার ছোটবেলায় দেখেছি, ফরিদপুর ঝিলটুলীতে প্রতি দশ ঘরে অন্তত একটি হিন্দু বাড়ি ছিল। তা ছাড়া এই এলাকায় যতগুলো পুরোনো বাড়ি তার বেশির ভাগই দেশ ভাগের সময় হিন্দুদের কাছ থেকে মুসলিমদের কিনে নেওয়া। সেসব বাড়ির দেওয়ালে খোপ করে বাতি বা প্রদীপ, দেবী মূর্তি ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বাড়িটিও তেমন। মূর্তি রাখার জায়গায় আমরা পিতলের শো-পিস, বই ইত্যাদি রেখেছিলাম।
জীবন-যাপনে কোনো সমস্যা আমাদের হয়নি। তুলসি-মঞ্চগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সমস্যা হলো রেবার মঠটি নিয়ে। যেসময়ের কথা বলছি, উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়িটির মালিক সে সময় আমার নানা, খোরশেদ আলম চৌধুরী।
আমার নানার বাবা ধর্মভীরু এবং ধনী বাক্তি ছিলেন। বাড়ি কেনার পর পরই সামনের বাগানের রাস্তার ধারের জমিতে তিনি মসজিদ নির্মাণ করেন। বিষয়টি নিয়ে তখন থেকে শুরু করে ৫ বছর আগে পর্যন্ত এলাকায় যথেষ্ট মত বিরোধ ছিল। কারণ একই বাড়িতে মঠ এবং মসজিদ এলাকাবাসী মেনে নিতে পারেনি।
আমার স্পষ্ট মনেও আছে, বছর পঁচিশ আগে একবার সেই মঠটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য স্থানীয়রা আমার নানাকে বেশ চাপ দিয়েছিল। নানা যত দিন জীবিত ছিলেন নিজে বাড়ির মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেছেন।
নানা বা তার পিতা কেউ ওই মঠটি ভেঙ্গে ফেলার পক্ষে ছিলেন না। যত বার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন তত বার নানা বলেছেন ‘মঠের জায়গায় কবর হলেও কি ভেঙ্গে ফেলতে বলতেন?’
মৃণাল সেন কলকাতা ফিরে নানাকে নিয়ে কোনো এক ম্যাগাজিনে একটি গল্প লিখেছিলেন। মঠটি বছর দশেক আগে পর্যন্ত টিকে ছিল। বছর দশেক আগে পুকুরের পাড় ভাঙতে ভাঙতে মঠটি পুকুরে তলিয়ে যায়। মঠটি আমরা ভাঙ্গিনি বটে, কিন্তু আলাদা করে রক্ষণাবেক্ষণ করাও হয়নি। করা হয় না হয়তো।
আমি প্রায়ই পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলে তাকিয়ে অভিমানী এক কন্যার মুখ ভাবার চেষ্টা করতাম। এক শীতের রাতে মাকে বলেছিলাম, ‘মা, রেবার সারাক্ষণ ওই পানির নিচে ঠান্ডা লাগে না?’ মা বিড়বিড় করে কী যেন সূরা পড়ে আমার গায়ে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘বিকেলের পর কক্ষনো পুকুর পাড়ে যাবে না।‘
বড় হয়ে খুব দরাজ গলায় বলতাম, ৪৭ এর দেশভাগ রেবাকে অন্তত ভিটে ছাড়া করতে পারেনি। বেচারি মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে।
১৯৪৭-২০০৮। মৃণাল সেন প্রায় প্রতি বছর এ বাড়িতে এসেছেন। শেষবার এলেন কয়েক বছর আগে তার জন্মদিনের আগের দিন, শৈশব-তারুণ্যের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিতে জন্মদিন পালন করতে। আমরাও খুব খুশি ছিলাম। বাড়ির সামনে সামিয়ানা টানিয়ে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করার প্রস্তুতি চলছিল। এলাকা থেকে আবারও বাধা আসে। যে বাড়িতে মসজিদ, সে বাড়িতে একজন হিন্দুর জন্মদিন পালন করা যাবে না। তত দিনে নানা মারা গিয়েছেন। বড় মামা এগিয়ে এসেছিলেন সেবার সামনে, বলেছিলেন, অতিথির অপমান এ বাড়িতে কিছুতেই হবে না। তিনি এসেছেন যে স্বপ্ন নিয়ে তা পূরণ করা হবে। তাঁর জন্মদিন সসম্মানে পালন করা হয়েছিল।
সেই রেশ ধরে আবারও কিছু দিন এলাকার মুসুল্লিরা আমাদের মসজিদে নামাজ আদায় করল না। আমাদের খুব শাসিয়ে দিল। এসব দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। গায়ে লাগালাম না তাই। কিন্তু মৃণাল সেন এবার একটু মন খারাপ করেছিলেন বোধ করি।
গত বেশ কিছু বছরে তিনি আর আসেননি । শুনেছি কিছুটা অসুস্থ। আসবার খুব বেশি কারণ তো নেই সেভাবে। কী আর আছে এখানে? ওই মায়া স্মৃতি জন্মভিটা রেবা, এই তো।
আমি প্রায়ই পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি টলটলে পানিতে। বর্ষায় পানি বাড়ে। আমার কেন যেন মনে হয় আপনজনের অপেক্ষায় থেকে থেকে অভিমানী বালিকার চোখের জলে পুকুরটার দু কুল উপচে পড়ছে।
বাড়িটি পাঁচ বছর আগে ডেভেলপার-এর হাতে আমরা দিয়ে দিয়েছি। কী জানি কী মনে করে আমার বড় মামা মৃণাল সেনকে ফোন করে জানালেন এ কথা। বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে, তিনি চাইলে আসতে পারেন এক বার।
তিনি আসেননি আর।
১৫০ বছর এর পুরনো কড়ি-বর্গার বাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে বড় বড় দানবের মতো যন্ত্র। ভেঙ্গে যায় শৈশব, ভেঙ্গে যায় ইতিহাস, ভেঙ্গে যায় জীবন্ত ইতিহাসের বাস্তু ভিটা।
পুকুরটা এখনো আছে। পুকুরের ভেতর নিশ্চই পাথরের মঠের ভেতর আছে রেবাও। কেউ কেউ তো থেকেই যায়। কোনও ৪৭, কোনও দেশ ভাগ তাঁদের জন্মভিটা বদলাতে পারে না।
..................................................................
(মৃনাল সেন অথবা রেবার জন্য' স্মৃতি গল্পটি প্রথম প্রকাশ হয় পশ্চিমবঙ্গের 'খোয়াবনামা' ম্যাগাজিনের পূজা সংখ্যায়। ওরা আমার কাছে দেশ ভাগ নিয়ে গল্প চেয়েছিল। দেশ ভাগের কষ্ট নিয়ে যে পরিবারকে আমি সবথেকে কাছ থেকে বাঁচতে দেখেছি সেটা 'সেন পরিবার'!
সকলের কাছে তিনি গুণী পরিচালক, বাংলা চলচ্চিত্রের ট্রিলোজিতে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশেই রয়েছেন মৃণাল সেন। কিন্তু আমার কাছে তিনি আমাদের মৃণাল নানা বা আমাদের জন্মভিটার পুরোনো মালিক।
খোয়াবনামায় প্রকাশ হবার পর আমার গল্পগ্রন্থ 'সে রাতে আমিও মেঘ হয়েছিলাম' তে এই স্মৃতিগল্পটি স্থান পায়। যারা ম্যাগাজিন বা গল্পগ্রন্থটি সংগ্রহ করতে পারেনি তারা গত ৩০ ডিসেম্বর মৃণাল সেনের মৃত্যুর পর গল্পটি সামাজিক গণমাধ্যমে মুক্ত করার অনুরোধ করে।
মৃণাল সেন ও আগ্রহী পাঠকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে গল্পটি পত্রিকা বিডিতে প্রকাশ করা হলো। অন্য কোন পত্রিকা এই লেখাটি আমার অনুমতি ব্যতিত প্রকাশ করবেন না বলে আশা করি৷)