পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ছোটু, জেঠু ও রাম কে নাম

  • 22 January, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 758 view(s)
  • লিখেছেন : শুভ্রদীপ ঘোষ
২২ তারিখ কলকাতার বুকে বিশাল ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে। অনেক অনেক ব্যক্তি মানুষ কিন্তু তাতে সামিল হবেন। তাঁরা ঝান্ডা রাজনীতি নাই করতে পারেন। হয়ত সেটাই তাঁদের ইতিবাচক দিক। যারা রাজনীতির লোক তাদের কাজ এই মানুষগুলোকে এক ছাতার তলায় আনা, ধরে রাখা। অন্যদিকের লোকগুলো কিন্তু একদম সেটাই করে এসেছে। হ্যাঁ, রাষ্ট্রের পূর্ণ মদত তারা পেয়েছে কিন্তু সেটাই সব নয়।

কীরে ছোটু , আজকের দিনে মুখ গোমড়া কেন? ভাল ঠাণ্ডা পড়েছে, পিঠের গন্ধ পাচ্ছি। তায় ছুটির দিন। আমি ত তোর কান এঁটো করা হাসিমুখ দেখব ভাবছিলাম।

- নাহ জেঠু, কিছু না।

কিছু তো হয়েছে। ঝগড়া করেছিস?

ঝগড়া করব কেন? আমি ঝগড়ুটে নাকি?

না না তা না। তবে ইদানীং তোকে খানিক অ্যাগ্রেসিভ লাগে।

তাই? কীরকম?

হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাস, চেঁচামেচি করিস।

জানি। আসলে মনের মধ্যে অস্থিরতা। চারপাশ দেখে একটা দুঃখ, ডিপ্রেশন ভিতরে ভিতরে দানা বেঁধেছে। বোধহয় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে কখনও কখনও।

বুঝেছি।

কিছুই বোঝনি। যে সময়ে মানুষের, এমনকি আমার সামাজিক অবস্থানের মানুষেরও ফেটে পড়ার কথা, বুক বাজিয়ে অবস্থান ঘোষণা করার, প্রতিটি কাজে সেই অবস্থানের ছাপ ফেলার কথা সেই সময়েও মানুষ কী নিরুত্তাপ! বৈঠকখানার বাইরে গেলেই তাদের হম্বিতম্বি শেষ। এই দোগলাপনা সব ক্ষেত্রে দেখি। মাঝে মাঝে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তখনই ভয়ঙ্কর রাগ হয়, নিয়ন্ত্রণ হারানোর অবস্থা হয়।

তুই তোর আমার মত সামাজিক অবস্থানের, আর্থিক সামর্থ্যের মানুষের কাছে বড় বেশি আশা করে ফেলেছিস।

খুব বেশি আশা করেছি? কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি এরা বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে। কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক অবস্থান চায়ের দোকান আর বৈঠকখানা ছাড়িয়ে বেরোবে না ? এই ভয়ঙ্কর সময়েও?

আচ্ছা আচ্ছা, আজ কী হয়েছে বল দেখি।

তেমন কিছু না। কলেজের বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। সেখানে এক বন্ধু রাম মন্দিরের একটা ভিডিও পোস্ট করে লিখেছে “ এঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেল।” কেন? না এমন ভিত বানিয়েছে যে কাঠামো নাকি ১০০০ বছর দিব্য থাকবে! তারপর সেই নিয়ে আলোচনা শুরু। আর এক বন্ধু দেখি “এতে কী ঘণ্টা হবে” তার জবাবে লিখেছে ঐ অঞ্চলের প্রচুর আর্থিক উন্নতি হবে, লোকের রোজগার হবে, অনামা গঞ্জ চকচকে শহর হবে। শুধু তাই নয়। শেষে জুড়ে দিয়েছে ২৫ কিলোমিটার দূরে মসজিদ তো হবে। সেখানে পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ কোরান থাকবে!

এসব দেখে ভীষণ কষ্ট হল জান। এই দুই বন্ধু কিন্তু মানুষ ভাল। এরা কিন্তু বিভেদ, অশান্তি চায় না। কিন্তু কী অনায়াসে একটা অন্যায় কাজের সমর্থনে বা বলা ভাল অন্যায় কাজটাকে গৌরবের মোড়কে পেশ করারযে রাজনৈতিক ভাষ্য হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে সমর্থন দিয়ে ফেলল। ৩২ বছরের যে অন্যায়, অবিচার তাকে স্বীকৃতি যোগানের লিস্টে এরা নাম লিখিয়ে ফেলল। অজান্তেই, কিন্তু কাজটা তো হল। তাই ব্যঙ্গ করে দু চার কথা লিখলাম। কিন্তু কেউ বুঝল না কেন এইটুকু সমর্থনও কেন ভয়ঙ্কর। উল্টে আমাকেই শুনতে হল সমাজমাধ্যমের বিপ্লবী ইত্যাদি প্রভৃতি।

এতেই এত রিয়াক্ট করলি?

শুধু এটা নয়। অনেককিছু জমে জমেই কোথাও না কোথাও ফুটে বেরয় তো। বাড়ীতে বাড়ীতে রামমন্দিরের জন্য চাঁদা তুলছিল না? সেইসময় আমাদের আবাসনের অনেকে মুখের উপর না বলে দিয়েছে। আমাদের বাড়ীতে তো আসেইনি। এদিকে এক বন্ধু, সেও ভাল মানুষ, উপকারী মানুষ, উঠতে বসতে এদের গাল পাড়ে - সে চাঁদা দিয়ে বসল।

সে কী?

কেন জান? যে দলটা চাঁদা তুলছিল তার পালের গোদাটার সঙ্গে এক অফিসে কাজ করে। একসঙ্গে দুর্গাপুজোতে মাথাও গলিয়েছিল। তাই কোনভাবেই সম্পর্কে চিড় আনতে চায় নি বোধহয়। এদিকে সেই পালের গোদাটা খোলাখুলিই বলে যে মুসলমানের দোকান থেকে জিনিস কিনবে না।

আরও শুনবে? বাড়ী বাড়ী রামলালার গৃহ প্রবেশের চিঠি দিতে এসেছিল না? সঙ্গে চাল ফাল কীসব যেন। আর এক বন্ধু, সেও এদের খুব গাল দেয়, জানি এদেরকে ভোট ফোট দেয় না, দেবেও না -সে একটা জিনিস নিল আর একটা নিল না। তবু মুখের উপর বলে দিতে পারল না “আমার নামে নয়, আমি নেব না।”

দ্যাখ, এসব হওয়াই স্বাভাবিক। তোর বন্ধুরা সবাই উচ্চবিত্ত, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের, নিশ্চয় উচ্চবর্ণেরও?

হ্যাঁ।

রামমন্দির হলে এঁদের জীবনযাত্রায় ত কোন প্রভাব পড়বে না। পড়লেও সেটা সুবিধাজনকই হবে। এঁদের নাম, সম্প্রদায়গত পরিচয়ের জন্য কোনদিন ভয়ে থাকতে হবে না। রাস্তাঘাটে কোনদিন মনে হবে না কেউ দলবেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। কোনদিন মনে হবে না সম্প্রদায়গত পরিচয়ের কারণে তার বাচ্চাকে স্কুল, কলেজে কেউ টিটকিরি দেবে। কোনদিন মনে হবে না তার বাড়ীর মেয়েদের স্লোগান দিতে দিতে ঘিরে ধরে কেউ যৌন হেনস্থা করবে, স্রেফ একটি সম্প্রদায়ের মানুষ বলে।

তাহলে তুমি বলছ এটাই স্বাভাবিক, এটাই মেনে নেব?

না না মেনে নিতে বলিনি। বলেছি যে এরা কেন এমন করে তার কারণটা জানি।

সেটা আমিও জানি। কিন্তু তাই বলে এরা এটুকুও বুঝবে না এটা আর পাঁচটা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার ঘটনা বলে সরলীকরণ করা চলে না। এটা একটা সমাজকে আড়াআড়ি ভেঙ্গে দেবার রাজনৈতিক প্রকল্প। এটা সমাজে যেটুকু সম্প্রীতি, যেটুকু সহাবস্থান ছিল তাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেবার ষড়যন্ত্র। এটা দেশের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানাবার অভিসন্ধি। আমি কেন কোনভাবে সেই অপচেষ্টায় স্বীকৃতি দেব? কেন সাবধানে পা ফেলব না? কেন ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে জেনে বুঝেও মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেব না?

কথাটা ঠিকই বলেছিস রে। আসলে সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী এতশত ভাবে না, বোঝেও না। তাহলে যে আয়নার সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি হত। কারণ তাহলে সে দেখতে পেত তার গড়ে ওঠার পিছনে তার জন্মগত প্রিভিলেজের একটা বড় ভূমিকা আছে। কে চায় বল সযত্নে লালিত প্রতিমার ভেঙ্গে পড়া দেখতে?

বিরুদ্ধতা, বিপ্লবীয়ানাও ঐজন্যই বসার ঘর বা চায়ের দোকানের চৌকাঠ ডিঙ্গোতে পারে না। আসলে কী জান। চারদিকে সর্বক্ষন রাম মন্দির নিয়ে এত গদগদ ব্যাপার চলছে যে নিতে পারছি না। যেখানে দলবেঁধে সোচ্চার হবার কথা সেখানে যদি খারাপ হব না বলে, সম্পর্ক  খারাপ করব না বলে লোকে মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়, তখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি না। যখন আসামের বরাক উপত্যকায় ২২ তারিখ ঘরে ঘরে ভগোয়া ঝাণ্ডা তোলার ফরমানে, বেছে বেছে মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘরে গিয়ে নিদান দেবার ফরমানে আতঙ্কিত মেয়েটি লেখে “মরে যেতে ইচ্ছে করছে” , যখন আমাকে “বন্ধু” মানা, আমার ছেলের বয়সী কন্যাসন্তানের বাবা তার জন্মদিন পালনের আনন্দে সামিল হতে পারে না কারণ সেই দিনটিতেই সংসদে পাশ হয়েছিল বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন, যখন বেসরকারী তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিতে ম্যানেজারের পদে চাকরি করা ছেলেটির কথায় বারে বারে ফুটে বেরোয় ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয় তখন স্থির থাকতে পারি না। বারবার মনে হয় তাদের ছোট ছোট আনন্দ, শান্তি কেড়ে নেবার পিছনে আমারও হাত আছে। যদি কোনভাবে ওদের পাশে দাঁড়াতে পারি, ওদের আশঙ্কার সামনে ঢাল হতে পারি, সেই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় অহরহ। আমার ক্ষমতা সীমিত, আমার দ্বারা খেলা ঘুরনোর কোন কাজ সম্ভব নয়। কিন্তু অন্তত বাবরি ধ্বংস বিস্মৃত না হয়ে, কোনভাবে রাম মন্দির নামক রাজনৈতিক প্রকল্পের গৌরবগাথার প্রচারে নিজেকে সামিল না করে অথবা স্পষ্টভাবে তার বিরোধিতা করে ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন কি খুব কঠিন কাজ? সেটুকু যদি না করি তাহলে সব বাগাড়ম্বর অর্থহীন, অসৎ।

শোন, এত হতাশায় ভুগিস না। তাহলে ঐ পাশে দাঁড়ানোটুকুও করতে পারবি না। তোর পরিচিত বৃত্তে কি কোন উদাহরণ নেই রুখে দাঁড়ানোর?

আছে, আছে। সব শেষ হয়ে যায়নি। জানো জেঠু, যেখানে আশা করিনি সেখান থেকেই প্রতিরোধ এসেছে।

বল। শুনি।

কলেজ জীবনের এক বান্ধবী আছে। ভারি ভাল মেয়ে। ভিতর বাইরে একইরকম নরম। কোনদিন গলা তুলে কথা বলতে দেখিনি। সেই মেয়ে ওদের আবাসন থেকে যখন চাল, চিঠি দিতে এসেছিল, তাদেরকে পত্রপাঠ দরজা দেখিয়ে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে তর্কে মেতেছে। খবরটা জেনে এত আনন্দ হয়েছে, এমন রিয়াক্ট করেছি যে ও উল্টে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল “ এমন কী করলাম রে! “ কোনদিন রাজনীতি নিয়ে কোন আলোচনায় আগ্রহ দেখায়নি যে মেয়ে সে ঠিক সময়ে উঠে দাঁড়াল, স্পষ্ট অবস্থান নিল। এতে করে আবাসন নামক পল্লীসমাজে ওকে একঘরে হয়ে যেতে হতে পারে, কিন্তু তাও ও চোখে চোখ রেখে ওদের পিছু হটাল। আনন্দ হবে না, বন্য আনন্দ হবে না? বল? কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসে কাজ করা আর এক বন্ধু জানিয়েছে সে ২২ তারিখ সকালে অফিসে যাবেই যাবে। অন্য কিছু হলে সে ছুটি উপভোগ করত, খুশিই হত, কিন্তু এই কারণে দেওয়া সরকারী ছুটির বিরোধিতা করতেই সে অফিস যাবে।

বাঃ। ছোটু, তোর বন্ধুদের আমার তরফ থেকে অভিনন্দন জানাস। তাহলে দ্যাখ কোথাও কোন প্রতিরোধ নেই তা তো নয়।

কিন্তু সবই তো বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিগত। ফলে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অনেক কম।

শুরু তো এভাবেই হয়। ব্যক্তিগত মানে গুরুত্ব কম কে বলেছে? ব্যক্তি মিলেই সমষ্টি তৈরি হয়। জানিস বোধহয় ২২ তারিখ কলকাতার বুকে বিশাল ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে। অনেক অনেক ব্যক্তি মানুষ কিন্তু তাতে সামিল হবেন। তাঁরা ঝান্ডা রাজনীতি নাই করতে পারেন। হয়ত সেটাই তাঁদের ইতিবাচক দিক। যারা রাজনীতির লোক তাদের কাজ এই মানুষগুলোকে এক ছাতার তলায় আনা, ধরে রাখা। অন্যদিকের লোকগুলো কিন্তু একদম সেটাই করে এসেছে। হ্যাঁ, রাষ্ট্রের পূর্ণ মদত তারা পেয়েছে কিন্তু সেটাই সব নয়।

হুম।

শোন ছোটু। ভেঙ্গে পড়বি না। হতাশ হবি না। বরং এটাই প্রসারিত করার, প্রসারিত হবার সময়। খুঁজে বেড়া এমন মানুষদের যারা আরও বেঁধে বেঁধে রাখতে চায়। তাদের নিয়ে জোট বাঁধ। নিজের জন্য, তোর সন্তানের জন্য এটা জরুরী। তোর সন্তান যেন এই অন্ধকার বর্তমান নয়, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি বুকে ধারণ করে। আর সেটা সম্ভব হবে তোর জন্যই।

 জোয়ান বেজের গানের লাইনগুলো মনে আছে ?

We are still marching on the streets

With little victories and big defeats

But there is joy and there is hope

And there is a place for you

হাল ছাড়বি না। মাঠে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও হাঁটু সোজা রাখবি। আজ আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু তা বলে পিঠ দেখাব না। আমাদের পরে লড়াইয়ের ব্যাটন তুলে নেবে অন্য কেউ। 

মনে রাখবি ক্রমশ একা হয়ে গিয়েও মাঠ না ছাড়া একটা লোক এই কয়েকদিন আগেই বলেছে “Not all battles are fought for victory. Some are fought to tell the world that someone was there on the battlefield.”  

1 Comments

Bihan Banerjee

23 January, 2024

ধন্যবাদ স্যার। এই কথাগুলো দরকার ছিল।

Post Comment