নয়তো পনেরো মিনিট পর আবার বাজতে থাকবে। হঠাৎই আবার সেই তীক্ষ্ণ শব্দ। এইবার তার বোধগম্য হলো যে, শব্দটা মাইকের। এই সাতসকালে মাইক কোথায় বাজছে আর কেনই বা বাজছে? একরাশ বিরক্তিতে ছেয়ে গেল তার মন। তখনই তীক্ষ্ণ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল আর গান বেজে উঠলো," হরেকৃষ্ণ নাম দিল প্রিয় বলরাম রাখাল রাজা নাম রাখে ভক্ত শ্রীদাম"। গান শুনেই তার মনে পড়ল আজ জন্মাষ্টমী। পাড়ার মন্দিরে আজ সারাদিনব্যাপী উৎসব। উৎসবের মূল দায়িত্বে পাড়ার ক্লাবের।এক দিকে মন্দিরে পূজা অর্চনা প্রসাদ বিতরণ চলবে অন্য দিকে ক্লাবের উদ্যোগে আজ সকাল থেকে সারাদিনব্যাপী ফুটবল টুর্নামেন্ট। রাতে পুরস্কার বিতরণী এবং বিচিত্রা অনুষ্ঠান।
সামনের সপ্তাহে ভোট। এর মধ্যেই আবার জন্মাষ্টমী তিথি পড়ল। অনুপমের একটা প্রবাদ মনে পড়ল, 'একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর।' সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাইকের তীব্র শব্দ তার দুর্বল হৃদযন্ত্রে কম্পন ধরায়। তার উপরে আজ আবার উৎসব আর খেলা। সমস্তটা দিন যে কীভাবে কাটবে এই ভেবে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু কিছুই করার নেই। কাউকে কিছু বলা যায় না, বয়স বাড়তে বাড়তে বাহাত্তর ছুঁয়ে ফেলল। এক সময় দিন বদল, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বেদনা আজও বহন করে চলেছেন।
বিছানা ছাড়লেন অনুপম। ইলেকট্রিক কেটলিতে চায়ের জল বসিয়ে দিয়ে ব্রাশ পেস্ট নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরোলেন। দশ বছর আগে মা চলে গিয়েছেন। তারপর থেকে একাই থাকেন। সংসারের প্রাত্যহিক কাজকর্ম তিনি নিজেই করতে পারেন। যৌবনে রাজনীতি করতে গিয়ে ঘর ছাড়তে হয়েছে বহুবার। কখনও দলের কাজে জেলার বাইরে, কখনও পুলিশের চোখ এড়ানোর জন্য বিভিন্ন আশ্রয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। যদিও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, জেলেও ছিলেন বেশ কিছুদিন। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন বহু সাথী নিরুদ্দেশ। অনেকে খুন হয়ে গিয়েছে, আর যারা একটু অন্যরকম তারা চুপচাপ সুখী গৃহকোণে ঢুকে পড়েছে। অনুপমের আর বিয়ে করা হয়নি। একমাত্র অবলম্বন মাকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে জেল থেকে বেরোনোর পর কাজকর্ম তেমন কিছু জুটিয়ে উঠতে পারেননি। কখনও খবরের কাগজের হকারি, কখনও লন্ড্রিতে ইস্ত্রি করার কাজ, এই ভাবেই চলছিল। বছর পাঁচেক এইভাবে কাটার পর ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু শ্যামলের বদান্যতায় একটি বেসরকারি নার্সারি স্কুলের দপ্তরির চাকরি পেলেন। বদান্যতা না বলে বন্ধুকৃত্য বলাই ভালো। শ্যামল যে খুব বড়সড় চাকরি করত তেমনটা নয়। আসলে শ্যামল অত্যন্ত মেধাবী ছিল এবং শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনুপমের থেকে অনেকটাই এগিয়ে কিন্তু গায়ে রাজনৈতিক দাগ লেগে থাকার জন্য সরকারি চাকরি হচ্ছিল না। শ্যামলের এক কাকা রেলের বড় আধিকারিক ছিলেন।তার চেষ্টায় একটা নামী বেসরকারি কোম্পানিতে শ্যামল ভালো মাইনের চাকরি পেয়ে যায়। সেই চাকরি করতে গিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে শ্যামলের পরিচয় হয়। তাদের একজনের সুপারিশের জোরে অনুপমের স্কুলের চাকরিটা হয়েছে। রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল।পরকে আপন করে নেবার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা তার আছে। ফলে যেখানে গিয়েছেন সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে। স্কুলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। খুব সহজেই ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবক অভিভাবিকার সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। স্কুলের বাচ্চাদের কাছে তিনি অনুআঙ্কেল এবং সারা শহর তাকে অনুদা,অনুকাকা বলেই জানে।
---- কাকা, সকালের চা খাওয়া হয়ে গেছে? সামনের বাড়ি থেকে মৌমিতা তাকে জিজ্ঞাসা করল। মৌমিতা সহদেবের বউ। অনুপমের ছোটবেলার বন্ধু শ্যামলের একমাত্র ছেলের নাম সহদেব।
---- না এইসবে হাতমুখ ধুলাম। জল চাপিয়ে এসেছি। ঘরে ঢুকেই খাব।
---- বলছি আজ দুপুরে আর রান্না করতে হবে না। বাড়িতে গোপালকে ভোগ দেব। দুপুরে আমাদের বাড়িতে পাপান আর পপির সঙ্গে প্রসাদ খাবেন।
---- এ আর নতুন কথা কি মা? মাসের মধ্যে হয়তো কুড়ি দিনই তোমাদের বাড়িতে দুপুরে না হয় রাত্রের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
---- এ আবার কী ধরনের কথা কাকা? আপনি আপনার ভাইপোর বাড়িতে নাতি-নাতনির সাথে বসে কিছুটা সময় কাটান। আর আপনার খাওয়া! সে তো পাখির আহার। এসব বলে আমাদের লজ্জা দেবেন না। দুপুরে আসবেন কিন্তু পপি ডাকছে বোধ হয়, ঘরে যাই।
মৌমিতার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ঘরে ঢুকে চায়ের কাপ নিয়ে বসলেন অনুপম। এই পরিবারটির সাথে দীর্ঘ ষাট বছরের বন্ধন। তার যখন বারো বছর বয়স তখন তারা এই পাড়াতে নতুন বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন। তাদের বাড়ির উল্টোদিকে শ্যামলরা থাকত। সমবয়সী হওয়ার জন্য শ্যামলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হতে সময় বেশি লাগেনি এবং সেই বন্ধুত্ব শ্যামলের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বজায় ছিল। অনুপম ও শ্যামলের বাবা-মা মধ্যে এক নিবিড় আত্মীয়তা তৈরি হয়েছিল। সেই বন্ধনসূত্র তিনি আর শ্যামল রক্ষা করেছেন। শ্যামলের অবর্তমানে তার ছেলে বৌমাও অনুপমকে নিজেদের পরিবারের একজন বলে মনে করে।
---- ছোটদাদা কী ভাবছ বসে বসে? অন্যমনস্কতা ভেঙে চায়ের কাপ রেখে পিছন দিকে তাকালেন অনুপম। দরজায় পাপান দাঁড়িয়ে। সহদেবের ছেলে। তাকে ছোটদাদা বলে ডাকে, শ্যামলকে বড়দাদা বলত।
---- কিরে এত সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল কেন?
---- আমি বুঝি সকালে ঘুম থেকে উঠি না?
---- উঠবি না কেন! আজ তো স্কুল ছুটি। ছুটির দিন তো তুই লম্বা ঘুম দিস। তা আজ ব্যাপারখানা কি?
---- ওমা তুমি জানো না! আজ তো জন্মাষ্টমী। বাড়িতে পুজো হবে, মাঠে খেলা হবে। শুনছো না মাইকে খেলর গান বাজছে? আজ সারাদিন খুব আনন্দ, বেশ খুশি খুশি মুখে বলল পাপান। পাপানের কথা শুনে তার মনটাও কেন কে জানে খুশি হয়ে উঠল। যদিও সকালে মাইকের চিল চিৎকারে মেজাজ বিগড়ে ছিল, কিন্তু ছোটদের আনন্দ করতে দেখলে মন ভালো হয়ে যায়।
---- দাদান আজ তোমার কী প্রোগ্রাম?
---- আজ তো স্কুল নেই আর সকালে পড়াও নেই। তাই বাড়িতে মাকে কাজে সাহায্য করছিলাম। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলো বলে একটুখানিকের জন্য চলে এলাম।এখন খুব ব্যস্ত।
---- ও বাবা তাই নাকি! তা মাকে কী সাহায্য করছিল তুমি? ---- আরে বাড়িতে পুজো জানো না? অনেক কাজ। এই ধরো গাছ থেকে আমের পল্লব পেড়ে দিলাম। মা কী আর গাছে উঠতে পারত বলো? আজ আমাদের বাড়িতে তালের বড়া হবে। বাবা কাল অনেক তাল কিনেছে। বিশুকাকা দু'দুটো বস্তা বড় করে দিয়ে গিয়েছে।আমাদের পুজোতে লাগবে তারপর পাড়ার সবার বাড়িতে আজকে দিতে হবে।
---- তাই নাকি? তাহলে আমিও পাব। তালের বড়া আমার কিন্তু খুব প্রিয়।
---- সে তো আমিও জানি। তোমার জন্য মা প্রত্যেকবার বড় কৌটো করে আমার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। তাই না?
---- হ্যাঁরে, সত্যিই তাই। তোর মা জানে আমি গরম গরম তালের বড়া কত ভালোবাসি। জানিস আগের জন্মে তোর মা বোধ হয় আমারও মা ছিল।
পাপন বলে,---- সে তো হতেই পারে। সেজন্যই তো তুমি আমার ছোটদাদা হও তাই না?
আট বছরের পাপানের সরলতা দেখে মুগ্ধ হন অনুপম।
পাপান কথা বলতেই থাকে, ---- জানো তো আজ আবার মাঠে খেলা হবে। বাবা বলেছে কলকাতা থেকে সব প্লেয়াররা আসবে। তুমি যাবে তো দেখতে?
---- দেখি, আমি বুড়ো মানুষ খেলা দেখে কী আর হবে?
---- তুমি বুড়ো কেন হবে? তুমি তো আমার সঙ্গে সুন্দর ফুটবল ক্রিকেট দুটোই খেলতে পারো। বুড়ো হলে কি আর পারতে?
---- তা ঠিক। আচ্ছা আছে দেখা যাক কী করি। বিকেল হোক আগে।
---- ছোটদাদা দুপুরে কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে যাবে। খাওয়ার পরে তোমার কাছে গল্প শুনব। অবশ্য আজ আবার খেলা দেখতে যাওয়া আছে। আচ্ছা আমি এখন যাই মার কাজে সাহায্য করতে হবে তো।
---- দরজার বাইরে বেরিয়ে আবার ফিরে এলো পাপান। ছোটদাদা তুমি আজকে আরো একটু তাড়াতাড়ি যেও।
---- কেন রে? দুপুরে তো খবার সময় যাবোই। আরও তাড়াতাড়ি কেন?
---- জানো তো আমার বলটা হারিয়ে গেছে। বাবা বলেছে আজ আমাকে নতুন বল দেবে। খাওয়ার আগে আমি আর তুমি ছাদে একটু প্র্যাকটিস করে নেব।
---- ঠিক আছে তাহলে বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি তারপর যাবখন।
বাজারে অবশ্য তেমন কিছু নেওয়ার ছিল না। একটা দুধের প্যাকেট নিলেন। পাপান পপির জন্য মিষ্টি কিনলেন। তারপর অভ্যাস মত শ্রীকৃষ্ণ প্রেসে ঢুকলেন। প্রেসে আসার অবশ্য অন্য কারণ আছে। এখানে সকালের দিকে তার সমবয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব আসে। সকলেরই বয়স হয়েছে। টুকটাক জিনিসের প্রয়োজনে বাজারে আসতে হলে খানিকটা সময় এই প্রেসে কাটিয়ে যায়। একটু গল্প গুজব ও চা খাওয়া হয়। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস, প্রায় পঞ্চাশ বছরের। তাদের পত্রিকা প্রকাশ হত এখান থেকে। তখন থেকেই এখানে সকাল সন্ধ্যায় আড্ডার রেওয়াজ চলে আসছে। প্রেসে ঢুকে দেখলেন তাপস, বিকাশ, রবি তিনজন বসে আছে। তাপস আর রবি গল্প করছে। বিকাশ এক মনে খবরে কাগজ পড়ছে। তাকে ঢুকতে দেখে প্রেসের মালিক নবেন্দু একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বলল, ---- বসেন অনুদা।
তিনি বসতেই রবি বলে উঠলেন---- আজ তো অনুদের পাড়ায় মহোৎসব চলছে। পুরো শহর মাইকে ছয়লাপ হয়ে গেছে।
---- আর বলিস না মাইরি। সকাল থেকেই মেজাজটা খিচড়ে আছে। কোন দেশে বাস করছি কে জানে! অনুপম উত্তর দিলেন।
---- কেন, আমাদের মহান দেশে। কাগজ পড়তে পড়তেই টিপ্পনি কাটলেন বিকাশ।
---- হ্যাঁরে আমরা কি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেলাম! নয়তো চারদিকে যা দেখছি শুনছি কোন কিছুই মানিয়ে নিতে পারছি না কেন? রবি প্রশ্ন করলেন।
---- বুড়ো তো অবশ্যই হয়েছি। তাই বলে সবকিছু কেমন করে মানবো বলতো? এই ধর আজকেই জন্মাষ্টমীর জন্য বাজারে তালের দাম কত জানিস? একটা তাল তিনশ টাকা বলছে। তাপস বললেন।
---- বলিস কি তিনশ টাকা! অবাক হয়ে গেলেন অনুপম। ---- তাতে তোরই বা কি আর আমারই বা কি? আমরা কি আর তাল কিনতে যাচ্ছি? ওসব এখন পয়সাওয়ালাদের ব্যাপার। বিকাশের কথার উত্তরে রবি বললেন,---- ঠিকই বলেছিস। গতকালই দেখলাম আমাদের শ্যামলের ছেলে সহদেব, পাইকারি বাজারে বস্তা ভরে তাল কিনছে। আমাকে বলল যে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সে নাকি পাড়ায় বাড়ি বাড়ি তাল বিলি করবে। তুই ভাবতে পারছিস কত টাকার ব্যাপার!
---- হ্যাঁ শুনছিলাম বটে, আমাকে সকালে পাপান বলছিল।অনুপম বলেন।
---- তাহলেই বোঝ। রবি আবার বললেন, ---- শ্যামলের ছেলে এভাবে কাঁচা টাকা কামাবে আর ওড়াবে আমরা কখনও ভেবেছি? আজ শ্যামল বেঁচে থাকলে এটা মানতে পারতো? অথচ এখনকার ছেলে ছোকরাদের কাছে এটা সহজ ব্যাপার। আমরা বুড়ো হচ্ছি না তো কি বল?
শ্যামল অথবা তার পরিবারের নামে কেউ কিছু বললে এখনও ভালোভাবে নিতে পারেন না অনুপম। এরা যা বলছে কথাটা হয়তো সঠিক, কিন্তু কেন জানিনা অনুপমের মনটা খচখচ করে। তাই বলে ওঠেন, ---- দেখ রবি তোর কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু সহদেবেরই বা কী করার আছে বল? শ্যামল তো অনেক কষ্টে ছেলেটাকে মাস্টার ডিগ্রী পর্যন্ত করালো। কিন্তু চাকরি হল কই? সুযোগই বা কোথায়! চারদিকের অবস্থা দেখতেই তো পাচ্ছিস শেষমেশ কন্ট্রাক্টরির কাজে লেগে পড়ল সহদেবটা।তারা তো ভালই জানিস কন্ট্রাক্টরির কাজকর্ম পেতে গেলে এখন কীভাবে কী করতে হয়, কাকে ধরতে হয়, কোথায় যেতে হয় তোদের সবার কাছেই বিষয়টা পরিষ্কার। কোন রাখঢাক নেই রে।
বিকাশ বলল,---- কথাটা তুই ভুল বলিস নি। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানিস? সহদেবের মত একটা উজ্জ্বল ছেলে যেভাবে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেটা দেখলে কষ্ট হয়। আসলে আমরা তো শ্যামলের বন্ধু।শ্যামল নিজের আদর্শ বজায় রাখতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সংসার টিকিয়ে রেখেছিল। তবু তার শিরদাঁড়া সোজা ছিল।সেই শ্যামলের ছেলে যখন নেতাদের পিছন পিছন বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন খারাপ লাগে।
সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল ফলে এসব কথাবার্তা আর ভালো লাগছিল না তার।
---- আজ আসিরে টুকটাক কেনাকাটা আছে। কাল দেখা হবে। অনুপম উঠে পড়লেন।
বাড়ি ঢোকার সময় পাপানকে আর দেখতে পেলেন না।বাড়ির ভিতরে পুজো নিয়ে হয়তো ব্যস্ত আছে। স্নান করে বেরিয়ে ছাদে উঠলেন। ছাদ থেকে খেলার মাঠটা বেশ ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে। একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। কিছু ছেলে এখনো মাঠে কাজ করছে, বেশ একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। সহদেব বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাইক বের করার সময় তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হেসে বলল,
---- কাকা দুপুরে এসো কিন্তু। আমি একটু বেরোচ্ছি।আজ অনেক ঝামেলায় আছি, আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না খেয়ে নিও।
সহদেব বেরোতেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরও দুটো বাইকে বসে থাকা চারজন ছেলে ওকে কিছু একটা বলল তারপর তিনটে বাইক একসঙ্গে বেরিয়ে গেল। প্রেসে সহদেবকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছিল সেগুলো আবার তার মনে পড়ল। সত্যি সত্যিই ইদানিং সহদেবের আচার-আচরণ কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। চিরকালের বাধ্য নম্র ছেলেটি হঠাৎ কেমন পাল্টে গেছে। চাকরিবাকরি যোগাড় করতে না পেরে এমনিতেই বেশ চাপে ছিল। শ্যামল বেঁচে থাকতে থাকতে কন্ট্রাকটারির ব্যবসা শুরু করে।
প্রথম দিকে সহদেব খুব একটা ভালোভাবে ব্যবসাটা চালাতে পারত না। আসলে ব্যবসার অলিগলিগুলো বুঝতে সময় লেগেছিল সহদেবের। ছোটখাটো দু-একটা রাস্তা তৈরির কাজ তাও একা নয় তিন-চার জন মিলে একসঙ্গে হয়তো পেত। তাতে পুঁজি কম লাগত ঠিকই তবে লাভও আসত কম। সেই সময় শ্যামল খুব সাপোর্ট দিয়েছিল। ক্রমে সহদেব ব্যবসা বুঝল। আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে গেল। এসবের মধ্যেই হঠাৎ বৌদি মারা গেলেন। সংসারটা ছন্নছাড়ার মত হয়ে গেল। সেই সময় অনুপম শ্যামলকে পরামর্শ দিলেন,---- সহদেবেকে এবার বিয়ে দে। অনুপম জানতেন সহদেবের সঙ্গে একটি মেয়ের সম্পর্ক আছে। দুজনকে একসঙ্গে দেখেও ফেলেছেন কয়েকবার। শ্যামলকে সে কথা বললেন। তারপর দুজনে গিয়ে মৌমিতাদের বাড়িতে কথা বলে এবং সহদেবের বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফিরে এলেন।
মৌমিতা খুবই ঘরোয়া আর সংসারী মেয়ে তাই সহদেবের বিয়ের পর সংসারটা আবার তার শ্রী ফিরে পেল। সহদেবের কাজকর্ম ক্রমে বাড়তে লাগল। ব্যবসা বাড়ার পিছেনে যে কারণ সেগুলো শ্যামলের পছন্দ করতে পারত না। যে কোনোও কাজের জন্য টেন্ডার জমা দেওয়া থেকে ওয়ার্ক অর্ডার হাতে পাওয়া পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে।যা সাদা চোখে দেখা যায় না। যারা এই ধাপগুলো দেখতে পায় এবং পেরোনোর পথগুলো রপ্ত করে ফেলে তাদের পক্ষে কাজ পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। সহদেব কয়েক বছর ঘোরাঘুরির পর এই ধাপগুলো আবিষ্কার করে ফেলল। তারপর থেকে তার উপরে ওঠার পালা। অফিসের পিয়ন, সাধারণ কর্মচারী, বড়বাবু এমনকি ইঞ্জিনিয়ারদের কীভাবে তুষ্ট রাখতে হয় সেই পদ্ধতিগুলো সহদেব খুব সুন্দর ভাবে আয়ত্ত করে ফেলল।
আর এইসব নিয়েই শ্যামলের সঙ্গে তার মতবিরোধ শুরু হল। মাঝে মাঝে রাতে বাবা ছেলের তর্কাতর্কি কানে আসত। কোনদিন হয়তো শ্যামলের উত্তেজিত গলা শোনা গেল,---- তাই বলে ঘুষ, ঘুষ দিয়ে কাজ পেতে হবে?
সহদেবের গলাও শোনা যেত,---- বাবা তুমি কোন যুগে বাস করছ? ঘুষ কি আগে ছিল না? তোমাদের সময়েও তো এই ভাবেই কাজ হত।
---- হ্যাঁ হত। এই ব্যবস্থাটাই তো আমরা বদলাতে চেয়েছিলাম। এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, শোষণ, দুর্নীতি এগুলোর বিরুদ্ধেই তো আমাদের লড়াই ছিল।
---- কিন্তু কী লাভ হল? পারলে কি কিছু পাল্টাতে?
---- না পারিনি। সেটা আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন আপোষ ছিল না, সততা ছিল। আর এখন স্বার্থের জন্য,তাও আবার দলীয় স্বার্থ নয় ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ন্যায়-নীতি সব জলাঞ্জলি দিয়ে এক একজন দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছে। আর তুই কিনা তাদের পিছনে ঘুরছিস?
---- তোমাদের মধ্যে আপোষ ছিল না সততা ছিল এই কথাটা কি সর্বাংশে সঠিক বাবা? তুমি আর অনু কাকা এই দুজন ছাড়া তোমার অনেক বন্ধুবান্ধবকেই তো দেখি। ভেবে তারা দেখো কী ধরণের জীবন যাপন করছে! তাদের যাপন তাদের বিলাসিতা দেখে তোমার মনে হয় যে এদের মধ্যে আপোষ ছিল না সততা ছিল? তোমার বন্ধুদের কথা ছাড়ো, এই যে যাদের আজকে দুর্নীতিবাজ বলছো তোমাদের সময়কার বেশ কিছু বড় মাপের নেতা-নেত্রী আজ এই দুর্নীতিবাজ দলের প্রথম সারির নেতা নেত্রী পদে রয়েছে।কেউ তো আবার মন্ত্রীর পদ আলো করেবসে আছেন।তাহলে তাহলে আমি যদি দুটো পয়সার জন্য সংসার চালানোর জন্য এদের পেছনে ঘুরি তাহলে অপরাধ কোথায়? বরং এদের পেছনে না ঘুরলে আমার কাজ জুটবে না। সেই প্রথম দিকের মত অবস্থা হবে। এখন আমি আর এই রিক্স নিতে পারি না বাবা।
বাবা ছেলের তর্কাতর্কির মাঝখানে মৌমিতা ঢুকে পড়ে। সহদেবকে উদ্দেশ্য করে বলে, ---- তুমি কী গো? জানো না বাবার প্রেসার? কেন বাবার মুখে মুখে অযথা তর্ক করছ?রাত হয়েছে ঘুমোতে যাও। আর বাবা আপনাকেও বলি নিজের শরীরের দিকে একটু তাকান। এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকাটা কি ঠিক? আর ওর সঙ্গে তর্ক করে কি কোন লাভ হয়? ও কি কারো কোনও কথা শোনে? বাবা চলুন, শুতে চলুন। মৌমিতা শ্যামলকে হাত ধরে তার ঘরে নিয়ে যায়।
নিজের ঘরে জানলার সামনে বসে এই দৃশ্য দেখে অনুপম সেদিন অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন যাক বৌদি চলে যাওয়ার পরে শ্যামল-সহদেবকে আগলে রাখার মানুষ তিনি ওদের সংসারে এনে দিতে পেরেছেন।
এই স্বস্তিটা অল্প কিছুদিনের জন্যই ছিল। দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সহদেব তার কাছে এসে বলেছিল,----- কাকা তুমি একটু বাবাকে বোঝাও। তুমি ছাড়া বাবা কারও কথা শোনে না। আচ্ছা তুমিই বলো এই লাইনে কিছু খরচাপাতি না করলে কাজ পাওয়া যাবে? আমি টিঁকতে পারব। বাবা কিছুতেই যে কেন বুঝতে চায় না! তুমি একটু বলো।
অনুপম তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর তিনি শ্যামলকে বোঝাতেও সক্ষম হয়েছিলেন সহদেব যে প্রশ্নগুলো তুলেছে তার উত্তর সত্যিই তাদের কাছে নেই। এবং এই ব্যবসা করতে গেলে চূড়ান্ত আদর্শবাদিতার স্থান এখানে নেই। সহদেবের সংসার হয়েছে। তাকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। অনুপমের সাথে কথা বলার পর শ্যামল নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিল। চুপচাপই থাকতো সারাক্ষণ। শুধু বিকেলে দুজনে যখন একসঙ্গে হাঁটতে বেরোতেন তখন মাঝেমাঝে আক্ষেপের স্বরে বলত, ---- এই দেখবো বলেই কি আমাদের যৌবনকালটা এভাবে শেষ করলাম অনু? আমরা কি ভুল করেছিলাম? কিছুই তো করা গেল না রে! কোথাও তো ভুল ছিল নিশ্চয়ই সেটা কোথায় কখন?
অনুপম চুপচাপ শুনতেন। মাঝেমাঝে উত্তরে বলতেন,---- তারপর কি হল? সর্বহারা বঞ্চিত মানুষের কথা যারা বলল তারাই বা কয়েক দশক ধরে কি করল?
শ্যামল ঘনঘন মাথা নেড়ে বলত,---- জানিনা রে জানিনা। উত্তর নেই। সেইসব বিচ্যুতির ফল এখন দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ আরও ভয়ংকর।
এর কিছুদিনের মধ্যেই করোনা চলে এল। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল। পাপান পপির সাথে খেলা নেই, শুধু শুধু বাড়ির বারান্দা অথবা ছাদ থেকে ওই বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা হয়। রাস্তায় লোকজন চলাচল কম। বাজারে বেরোনো বারণ।এর মধ্যেই কী ভাবে যেন শ্যামল করোনা আক্রান্ত হল। এক সন্ধ্যায় অ্যাম্বুলেন্স এসে শ্যামলকে নিয়ে গেল। হেঁটে হেঁটে অ্যাম্বুলেন্সে উঠল। অনুপম বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বললেন, ---- সুস্থ হয়ে ফিরে আয় তাড়াতাড়ি।
শ্যামলের মুখে হাসি ফুটে উঠল বলল ---- সব কী আর আমাদের হাতে থাকেরে? যাই। ওদের দিকে খেয়াল রাখিস। মৌমিতা কেঁদে ফেলল,----- যাই বলতে নেই বাবা, বলুন আসি। সহদেব শ্যামলের সঙ্গে গেল। পরদিন সকালে পৌরসভার লোক এসে বাড়ির সামনে পোস্টার লাগিয়ে দিয়ে গেল। মন্দের ভালো ও বাড়ির আর কারও কিছু হয়নি। কিন্তু দুদিন বাদেই খবর এল শ্যামল আর নেই।শুধু তাই নয় কোভিড নিয়মকানুন মেনে তার শেষকৃত্য নাকি হয়ে গিয়েছে। স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন অনুপম। উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। শোক এত ভারী হয় কে জানত! তবুও সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ওদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন মৌমিতা আর বাচ্চা দুটোকে সামলানোর জন্য।
---- ছোট দাদা তুমি এত দেরি করছ কেন? কখন আসবে? তাড়াতাড়ি এসো।
পাপানের ডাকে চমকে উঠলেন অনুপম। সহদেবকে দেখার পর থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছিল।
---- এইতো এক্ষুনি আসছি দাদান।
---- হুম তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে অনেক কিছু দেখাব।
গেটের মুখে পাঁচ বছরের ছোট্ট পপি এসে হাত ধরল।
---- ছোট দাদা একটা জিনিস দেখে যাও।
---- কী দেখাবে আমার সোনা দিদানটা!
---- আগে এসোই না তবে তো দেখবে। পপি তার হাত ধরে ওদের ঠাকুর ঘরের সামনে টেনে নিয়ে গেল। মৌমিতা আলপনা দিচ্ছে। পপি বলল,---- এই দেখো ছোটদাদা। আমিও এখানে এঁকেছি। অনুপম দেখলেন দরজার একপাশে একটা ফুল এঁকেছে পপি।
---- বাহ খুব সুন্দর হয়েছে তো।
---- সত্যি বলছ তো? আমি তো চক দিয়ে আঁকলাম। মা এরপরে এইটাকে খড়িগোলা দিয়ে ভর্তি করে দেবে। তখন দেখতে আরও ভালো লাগবে।
---- খুব সুন্দর হয়েছে।সেই জন্য এই পুরস্কার, এই বলে মিষ্টির প্যাকেটটা পপির হাতে দিলেন।
অনুপমের গলা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এল পাপান।
---- ছোটদাদা চলো চলো, একটা জিনিস দেখাব। বলে হাত ধরে টানতে থাকে।
---- ওরে আমি কি এখন তোর মত দৌড়াতে পারি? আস্তে আস্তে চল। তিনতলার ছাদে উঠতে একটু হাঁপ ধরল তার। প্রশস্ত ছাদ। ছাদে একটা ছোট ঘর। ঘরের শিকল তোলা। পাপান তাকে ঘরের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল,---- তালের গন্ধ পাচ্ছ? কি সুন্দর সত্যিই তাই না?
ঘরের সামনেটা পাকা তালের গন্ধে ম ম করছে। পাপান বলল,---- শিকলটা একটু খুলে দাও না ছোটদাদা। আমি অত উঁচুতে হাত পাই না।একবার দেখব ভেতরে কতগুলো বস্তা আছে।
অনুপম রাজি হলেন না। বললেন,---- না বন্ধই থাক। তোমার বাবা গুছিয়ে রেখেছে। বাবা আসুক বা মা আসুক তখন খুলে দেবে।
---- একটুখানি খুলে দেখাও না ছোটদাদা। আমি উঁকি মেরে একটু দেখব তারপর আবার বন্ধ করে দিও। আমি ভেতরেও ঢুকব না। কিছুতে হাতও দেব না। শুধু একটু দেখব। বাবা বলল আজ নতুন বল এনে দেবে। বলটা কী ভুল করে এই ঘরে রেখেছে?
একটু ইতস্তত করে দরজা খুললেন অনুপম সত্যিই ঘরের ভেতর অনেক বস্তা। বোঝা যাচ্ছে সবকটার ভেতরেই পাকা তাল। কয়েকটা তাল মাটিতেও গড়িয়ে পড়েছে। পাপান একটু উঁকিঝুঁকি মারল। তারপর বলল, ---- নাহ এই ঘরে বোধ হয় নেই। বাবা কখন আসবে? কখন দেবে? ভাবলাম তোমার সঙ্গে খেলব।
অনুপম বললেন, ---- ঠিক আছে এখন থাক। বাবা এসে যখনই বল দেবে তখনই আমরা খেলব। আমি তো একটু পরে আবার আসব। পাপান রাজি হল। দরজাটায় আবার শিকল তুলে দিলেন অনুপম।
পাপানকে বললেন চল, ---- এবার নিচে যাই। আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দোতলায় নামতেই দেখলেন মৌমিতা উঠে আসছে হাতের উপরে সাজানো প্লেটে লুচি, তরকারি, মিষ্টি।
মৌমিতা বলল,---- জলখাবার খেয়ে যান কাকা।
---- মিছিমিছি এইসব কর বৌমা। তোমার আজ কত কাজ। উপোস করে রয়েছো।
---- আপনি বসুন তো। টেবিলের উপরে মৌমিতা সবগুলো সাজিয়ে দিল। আপনার ছেলেখেয়ে বেরোল।তাছাড়া ছেলেমেয়ে দুটোর জন্যও করতে হল। আপনার জন্য আলাদা কিছু হয়নি খেয়ে নিন তো।তার স্বরে শাসনের সুর। অনুপম বাধ্য ছেলের মত বসে পড়লেন। এই মায়ার শাসন তিনি উপভোগ করেন।
টেবিলে বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলেন তিনি। বাড়ি জুড়ে প্রাচুর্যের ছাপ। শ্যামল মারা যাওয়ার মাত্র দু আড়াই বছরের মধ্যে একতলা বাড়ি দোতলা হল। ঘরে ঘরে দামি ফার্নিচার, এসি, তিনখানা টিভি এল। এই প্রাচুর্য কীভাবে হল? প্রশ্নটা অনুপমের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। আজ প্রেসে যে আলোচনা হচ্ছিল সবটাই কি মিথ্যা? নিশ্চয়ই নয়। শ্যামলের মৃত্যুর পর সহদেবের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সে সরাসরি রাজনীতি করে। দলের কোন একটা পদেও আছে শুনেছেন। শোনা যাচ্ছে সামনের পৌরসভা নির্বাচনে টিকিট পাওয়ার জন্য খুব ছোটাছুটি করছে। শুধু তাই নয় মাঝেমধ্যে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরে। অনুপম বুঝতে পারেন মৌমিতার সঙ্গে প্রায়ই অশান্তি হয়। নেশার ব্যাপারে মৌমিতা তার কাছে দু'একবার অনুযোগও করেছে। কিন্তু সহদেবের সঙ্গে এখন তার আর সেই সহজ সম্পর্ক নেই। তিনি কিছু বলে উঠতে পারেন না। কে জানে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। হয়তোবা সম্পর্কটাই নষ্ট হতে পারে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পান অনুপম। দুই একবার সহদেবকে বলার চেষ্টা করেননি তা নয়।কিন্তু, "দিনকাল ভালো নয়", "একটু বুঝেশুনে চলিস", সাবধানে চলাফেরা করিস", "শ্যামল নেই এখন পরিবারের সবার দায়িত্ব তোর উপরে",এই সব কথার বাইরে আর কিছু বলে উঠতে পারেননি। সহদেব অবশ্যই এসব কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বা কোন উত্তর দেয়নি। বেশ বোঝা গেছে বাবার বন্ধু বলে চুপচাপ শুনছে কিন্তু তার কথার কোন গুরুত্বই তেমন দেবে না।
---- ও ছোট দাদা চুপ করে বসে কি ভাবছ? তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
লজ্জিত হলেন অনুপম সকাল থেকেই আজ কী যে হয়েছে! বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তারপর প্রেসে সহদেবকে নিয়ে কথাবার্তা শুনে সব কেমন এলোমেলো হয়ে আছে।
---- কী ভাবছি? ভাবছি যে এখন এত খেলে দুপুরে খাবো কী করে? পেট তো ভর্তি হয়ে থাকবে।
পাপান বেশ বড়দের মত বলল,---- খাও তো এখন। আজ দুপুরে খেতে দেরি হবে। তার আগে আমার সাথে খেলতে হবে। পেট ভরে না খেলে গায়ে জোর হবে কী করে?
---- হুম কথাটা ঠিকই বলেছিস। তাহলে খেয়েই নিই কি বলিস?
খাওয়া শেষ করে নিচে নামলেন। বেরোনোর মুখে মৌমিতা বলল, ---- বেশি দেরি করবেন না কাকা। অবেলায় খেলে কিন্তু হজম হবে না।
---- তুমি বাড়ি গিয়ে ওষুধ খেয়েই চলে এসো। আমি ততক্ষণ বলটা খুঁজি। বাবা যে কোথায় রেখে গেল। ফোন করেও বাবাকে পাচ্ছিনা। পাপান আবার উপরে চলে গেল।
বাড়ি ফিরে সুগার আর প্রেসারের ওষুধ খেয়ে অভ্যাসমতো খবরের কাগজটা খুলে বসলেন। যদিও কাগজ আজকাল আর পড়তে ইচ্ছা করে না। কাগজ খুললেই খুন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক তরজা, চুরি, অজস্র অনিয়ম, বেনিয়মের খবর। প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখলেন। খাওয়াটা একটু বেশি হয়েছে মনে হয়। হালকা তন্দ্রা মত আসছে। অনুপম ভাবলেন কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিয়ে তারপর পাপানের সাথে খেলতে যাবেন। অসময়ে খানিকটা ঘুমিয়েও পড়েছিলেন তিনি। হঠাৎ পাপানের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো পাপান বাড়ির বারান্দা থেকে চেঁচাচ্ছে, ---- ছোটদাদা দেরি করছ কেন? তাড়াতাড়ি চলে এসো।
---- এইতো আসছি রে দাদান। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটু অপেক্ষা কর জামাপ্যান্ট পরেই আসছি। লুঙি পরে তো আর খেলা যাবে না কি বলিস?
পাপান বলল,---- ঠিক আছে তাই এসো।
অনুপম আড়ামোড়া ভেঙে উঠে জল খেলেন। কিছুটা সময় বসে থাকার পর ছাদে গেলেন গামছা, লুঙি তুলে আনার জন্য। ছাদে উঠতেই শুনতে পেলেন পাপান ডাকছে, ---- ছোটদাদা এই দেখ। তিনি ওদের বাড়ির দিকে তাকালেন। একতলা,দোতলার বারান্দায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
পাপান বলল,---- আমি ছাদে।
ঘাড় উঁচু করে তাকালেন অনুপম। পাপান তিনতলার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের কার্নিশটা বেশ উঁচু ফলে পাপানের মাথা থেকে বুকের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। পাশে পপি দাঁড়িয়ে তার মুখটুকুই দেখা যাচ্ছে।থুতনিটা কার্নিশে ঠেকিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে।পাপানের হাতে একটা তাল।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন,---- তাল নিয়ে ছাদে উঠেছিস কেন? পাপান চেঁচিয়ে বলল,---- নিয়ে উঠবো কেন ছাদের ঘর থেকে বের করলাম। তোমাকে ডাকলাম দেখাব বলে।
---- কিন্তু ছাদের ঘরে শিকল কে খুলল? মা? নাকি বাবা বাড়ি এসেছে?
---- আরে না, না। আমি নিজেই খুললাম।
---- তুই! তুই কীভাবে শিকলে হাত পেলি?
---- নিচের থেকে টুল নিয়ে এলাম। টুলের উপর দাঁড়িয়ে খুলে ফেললাম।
---- এটা কিন্তু ঠিক করনি পাপান, তিনি বললেন।
পাপান বলল,---- না খুলুলে হতোই না। বলটা তো কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবলাম এখানে আছে কিনা ভালো করে খুঁজে দেখি।
---- বোকা ছেলে! বল কি বাবা এখানে রাখবে? শোবার ঘরে কোথাও রেখেছে হয় তো।
---- না গো ছোটদাদা এখানেই রেখেছিল। বেশ রহস্যময় গলায় বলল পাপান। তবে এই বল কিন্তু প্লাস্টিকের তৈরি না। অন্যরকম বল।দড়ি দিয়ে তৈরি।তুমি কোনও দিন দড়ির বল দেখেছ?দেখাচ্ছি দাঁড়াও। উত্তরের অপেক্ষা না করে দৌড়ে চলে গেল। পপি অনুপমের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল। এক মিনিটের মধ্যেই পাপান ফিরে এল।
---- এই দেখ ছোটদাদা। বলে ডান হাত উঁচুতে তুলল। পাপানের হাতের দিকে তাকিয়ে স্থবির হয়ে গেলেন অনুপম। বোবার মত তাকিয়ে রইলেন কোন কথা বলতে পারলেন না। তারপর কোনক্রমে সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠলেন,---- পাপান এটা তুমি কোথায় পেলে?
পাপান বলল,---- ওই ঘরের মধ্যেই ছিল তালের বস্তার পেছনে। আরও অনেকগুলো আছে ব্যাগের মধ্যে আনব?
---- একদম না, অনুপম চিৎকার করলেন ---- তুমি যেভাবে আছো সেইভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। একটুও নাড়াচড়া করবে না। আমি এক দৌড়ে আসছি।
---- তুমি ওই রকম ভাবে কথা বলছ কেন ছোটদাদা?
অনুপম বললেন, ---- চুপ।একদম চুপ। তুমি পপি কেউ ওখান থেকে এক পাও নড়বে না। আমি আসছি। তারপর সব বলব।
---- একদম নড়বে না। অনুপম ওদের চোখে চোখ রেখে পিছোতে থাকলেন ছাদের সিঁড়ির দিকে।
পাপানের হাতে যেটা রয়েছে সেটা অনুপমের খুব চেনা। তার নাম হল পেটো। সহদেব এই সর্বনাশা জিনিস বাড়িতে রেখেছে! ভয়ঙ্কর আতঙ্কে সিঁড়িতে পা দিয়ে দ্রুত নামতে থাকলেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই বাড়ির তিনতলায় পৌঁছাতে হবে। তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে শেষ সিঁড়ির কাছে এসে অনুপমের পা পিছলে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সমস্ত পাড়া কাঁপিয়ে তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। জানলা দরজাগুলো কেঁপে উঠল। হাঁটুতে প্রচন্ড যন্ত্রণা, উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন। কোনক্রমে বাইরে রাস্তায় এলেন।
অসহায় তিনি দেখলেন শ্যামলের বাড়ির তিনতলা ছাদ থেকে কুন্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশে। প্রচুর মানুষ হইহই করে ছুটে যাছে ওই বাড়ির দিকে।
অনুপমের চারপাশে হঠাৎ অন্ধকার নেমে এল।চেতনার শেষ প্রান্তে পৌঁছেও তিনি যেন স্পষ্ট শুনতে পেলেন পাপান তাকে ডাকছে,---- ছোটদাদা তাড়াতাড়ি চলে এস এবার খেলা হবে।
★(প্রকাশিত