সেই অন্ধকার থেকেই একেবারে ক্ষীণ একটা ‘ভটভট-ভটভট’ করা আওয়াজ জেগে উঠছে যেন। বললাম, নৌকা? সায় দিয়ে আলাউদ্দীন বলল, তবে আপনারটা নয়।
এটা নাকি খেয়া, এপার ওপারের। অন্ধকারে শুধু আওয়াজটুকুই যা বোঝার। আমারটা অন্য এক নদী হয়ে এই নদীতে এসে উঠবে। না, নদীর সেই মুখ আপনি দেখতে পাচ্ছেন না এখন। ওর কথায়, দেখতে পাচ্ছি না অন্ধকার আর ছোট্ট একটা বাঁক আর ভাটার জন্যই।
আলাউদ্দীন বলল, পূর্ণিমা আজ, ঘন্টাখানেক পরেই চাঁদ উঠবে।
চাঁদের কথায় রুবির কথা মনে পড়ল ফের। চাঁদের আলোয় ওকে পাশে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকব ভেবেই আলাউদ্দিনকে ফোন করা। কতবার স্বপ্নে দেখা। যেন সরু নদী বা খালের দুপাশে ঝুঁকে আছে নানান গাছ, ঝোপ-জঙ্গল। ছোট নৌকাই। রুবি আর আমি, আকাশে চাঁদ। না ঠিক যে রুবি আর আমি তা নয় কিন্তু। স্বপ্নে শুধু সেই সরু খাল বা নদীর দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়া গাছ বা ঝোপ-জঙ্গলই। আর আকাশে চাঁদ। তাহলে রুবি? ও কি ছিল সেই স্বপ্নে? রুবিকে অবশ্য সেদিন ওর থাকার কথাই বললাম। যেন ও আর আমি— ।
আলাউদ্দীনকে বললাম, তোদের এই দ্বীপ কি ঠিক এই রকমই?
‘এই রকমই মানে?’
বললাম, কী জানি, তোদের দ্বীপ বলতে কেন জানি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সরু সরু অনেক নদী বা খাল আর নদী বা খালের গায়ে ঝুঁকে থাকা গাছ-গাছালির কথাই মনে পড়ে। মনে হয় যেন আগের বার এমনি একটা খাল বেয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তোদের গ্রাম—, একটা রাস্তার কথাও মনে পরে, শেষ হয়েছিল একেবারে তোদের বাড়ি গিয়ে, তোর বাবা— ।
একটা বেঞ্চে বসতে বলে আলা মানে আলাউদ্দীন চায়ের কথা বলল। এই দোকানের পেছন দিককার জঙ্গলের ওপর দিয়েই চাঁদ উঠবে ঠিক। চোখের সামনে নদীর ওপারের অন্ধকারের মাথায় এর মধ্যেই লেগে থাকা অল্প হলুদ।
‘সন্ধে সাতটা নাগাদই নৌকায় উঠেছিলাম না সেবার?’
‘নৌকার জন্য এমনি নদীর পাড়ে বসে থাকা কিন্তু খারাপ লাগে না, অবশ্য যতই সময় নিক আগেকার সেই হাতে টানা নৌকাই ছিল ভাল।’
‘এখন হাতে টানা নৌকার কথা বলছিস, সেবার নৌকা আসছে না দেখে পারলে ঝাঁপ দিয়ে— ।’
আমাকে বা আলাকে নয়। টের পাইনি এতক্ষণ, আমাদের বাদ দিয়ে আরও দুজন নদীর দিকে মুখ করে চায়ের গ্লাস নিয়ে বসে।
নদীর একেবারে গায়ে লাগা বাঁধের ওপরই দোকান। আলা বলছিল, আর যারা এসেছিল আগেরবার আপনার সঙ্গে— মেয়ে ছিল না একজন?
বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছে ও। কাল সন্ধেবেলা আসা থেকেই বেশ ক’বার এই একই কথা জিজ্ঞেস করেছে। বুঝতে পারি আমার সঙ্গে আসা অন্য কারোর জন্য নয়, ওর কৌতুহল সেই মেয়ে মানে রুবির জন্যই। আমাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বুঝেছিল কিনা কে জানে? বললাম, তুই বললি ক্যান্সার তোর বাবার, তাও ফুসফুসে, বিড়ি খেতে দিচ্ছিস কেন তাহলে?
‘সন্ধে সাতটা মানে কিন্তু অনেক রাত তখন। এখন তো দেখি ন’টা-দশটা অব্ধিই খোলা থাকছে সব।’
‘সেই সেদিনও কিন্তু চা খেয়েছিলাম এই দোকানে, মনে পড়ছে?’
অন্য লোকটি এবার হাসতে শুরু করল। বলল, সেবার গ্লাসের পর গ্লাস চা খাচ্ছিলাম ভয় কাটাতে। যদি বেরোতে না পারি রাত থাকতে। লোকটা দোকান বন্ধের কথা বলছিল। আর কিছুক্ষণ দেখেই নাকি বন্ধ করবে।
লোকদুটির বয়স মনে হচ্ছে বাবার মতোই। ওই ষাট-পঁয়ষট্টি, মানে বুড়োই।
দোকানের সামনে আমাদের বসার এই বেঞ্চ বলতে গেলে বাঁধের ওপরকার সরু ঢালাই রাস্তার গায়েই। বাঁদিকে দু’পা গেলেই নীচে নদীর দিকে নেমে যেতে থাকা সিঁড়ি। পাড় থেকে জল কিন্তু বেশ নীচুতেই এখন। ওপারের সেই ‘ভট্ভট্’ শব্দ তুলে আসতে থাকা আলার কথার সেই ফেরি নৌকা এখন প্রায় পাড়ের কাছে। শব্দ খেয়াল করে তাকালে অস্পষ্ট এক আলোও চোখে পড়ছে। কোনও লোক আছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না যদিও। আলা বলল, আপনার নৌকা তো দূরপাল্লার, বড় অনেক।
আমাদের পাশে বসে থাকা লোকদুটির একজন সিগারেট ধরাচ্ছে একটা। আরেকজনের সেই অভ্যাস নেই নিশ্চিত। পেছনের জঙ্গলে একটা কোনও পাখি ‘ট্টি-ট্টি-ট্টি’ শব্দ তুলে আমাদের থেকে আর একটু দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।
দোকানে বসে থাকা সেই লোক আলাকে জিজ্ঞেস করল কিছু। আলা বলল, আছে ভালই।
‘ওই সব বিপ্লবের স্বপ্ন না দেখলে এই দ্বীপে কোনও দিনই আসা হত না কিন্তু।’
‘স্বপ্ন-টপ্নের কথা বলিস না আর, আমার ছেলে তো— । হ্যাঁ, লাভের মধ্যে লাভ এই দ্বীপটাই। পালানোর জন্য না এলে এটার খোঁজ কে দিত?’
নদীবাঁধের গা দিয়ে আমাদের এই ঘাট প্রায় মিনিট পনেরোর পথ। বাঁধের গায়ে সেদিন তুমুল শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ঢেউ। রুবি বলেছিল, ফের যদি আসিস কোনও দিন এখানে আর বাঁধ বরাবর হাঁটতে গিয়ে জলের ঝাপটায় ভিজতে থাকিস ঠিক মনে পড়বে আমার কথা।
কী মনে হল, বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াই একটু। রাস্তার ডানদিকে আলো যায়নি তেমন। আলাকে বললাম, পেচ্ছাব করে আসি একটু। এবার অন্ধকারে একটু ঝোপ-জঙ্গল দেখে ফোন বের করি। ওর নম্বরে আঙুল ছুঁইয়েই বলতে থাকি, হ্যালো, হ্যালো রুবি একেবারে সেই স্বপ্নের মতোই, দুপাশে ঝুঁকে থাকা গাছ, ঝোপ-জঙ্গল, আকাশে চাঁদ আর ছোট্ট এক নৌকোয় শুধু তুই আর— । নাহ্, ফোন ঢোকেইনি তো! বিজি। ফের আঙুল ছোঁয়াই। আড়চোখে আলাকে লক্ষ্য করি। নাহ্ ,বিজি- বিজি- বিজি। কার সঙ্গে এত কথা বলছে ও?
নীচে সিঁড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে সেই ফেরি নৌকা লেগেছে এতক্ষণে। আলাকে জিজ্ঞেস করলাম, বেঞ্চে বসে থাকা লোকগুলিকে চিনিস তুই?
ও দেখি আমার পাশ থেকে কখন উঠে গিয়ে ঘাটের সিঁড়ি ধরে নামছে। জিজ্ঞেস করি, কি রে আসব?
‘কাশেম শেখের নাকি ক্যান্সার হয়েছে ফুসফুসে।’
‘কোন কাশেম শেখ?’
‘ওই সেবার লাটদারের লোককে কুড়ুল দিয়ে মারতে গেল যে লোকটা। ওর বাড়িতে দু’-তিনরাত খেলামও তো আমরা।’
‘দেখলি লোকটাকে? বললি না কেন আমাকে?’
‘বললেই তুই আবার ভ্যানর ভ্যানর— । পুলের বাজারের মুখে চায়ের দোকানেই বসে ছিল তো।’
‘চিনতে পারলি?’
‘তুইও চিনতে পারতিস। সেই হালকা-পাতলা আর লম্বাটে চেহারা। বিড়ি টানছে ফুকফুক করে।’
‘বললি, ক্যান্সার ফুসফুসে, আবার বিড়ি?’
ওদের পাশ থেকে উঠে গিয়ে আমি এবার নামতে থাকি সিঁড়ি দিয়ে। আর কী অবাকের ভাবো বাঁধের ওপর থেকে যে নদীটাকে দেখছিলাম এতক্ষণ একেবারে জলের কাছে গিয়ে যেন অন্য আর এক নদী। সিঁড়ির দু’পাশে জেগে ওঠা মাটি। বালির চরা। জল তখনও বেশ দূরেই। নদী যেন পাড়ের থেকে আরও দূরেই চলে যাচ্ছে কোথাও।
আলা আর সেই ফেরি নৌকার মাঝির সঙ্গে আমিও উঠতে থাকি উপরে। পাশে একটা বউ আর ওর স্বামীই সম্ভবত। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের ছেলে একটা, হাতে ব্যাগ। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে একবার পেছন ফিরে তাকাই, পড়ে থাকা নদীটাকে দেখি। শীতকাল নয়, তবু কেমন কুয়াশা। বা নদী যেন নেমে যাচ্ছে আরও নীচে। ভাটা কখন শেষ হবে কে জানে?
রুবিকে ফের ফোন করার ইচ্ছে হল খুব। আলা ততক্ষণে উঠে গিয়েছে উপরে। বের করি মোবাইলটা। ‘লাভ’ চিহ্ন দেওয়া ওর নম্বরে আমাদের দুজনের গালে গাল ছোঁয়ানো মুখ। কিন্তু আঙুল ছোঁয়াতে গিয়েই ভয় হল খুব। মোবাইলের কোম্পানি হয়তো ফের বলতে শুরু করবে, ‘বিজি, বিজি, বিজি, ট্রাই এগেন।’ নাহ্, রিং হল এবার। হয়েই যাচ্ছে। ও কি তাহলে ফোন রেখে বাইরে কোথাও।
পেছনে নদী যেন প্রায় অদৃশ্যই। আলার কথামতো পূর্ণিমার চাঁদ কোথায় গেল কে জানে? মনে হয় মেঘই। এপার থেকে ওপার হয়ে অন্ধকারের মধ্যে এই মুহূর্তে কোথাও আর ফাঁকফোকর নেই কোনও।
‘স্বপ্ন জিনিষটা কেমন ভাব, কে কোথায় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখল আর সবাই মিলে ছোট-ছোট— ।’
‘আমি কিন্তু দেখেছি।’
‘নিজের চোখে? বিপ্লব? তোর মনে আছে কিছু? ঠিক কী রকম বা কী দেখেছিলি তুই? যে কোনও স্বপ্নে কোনও ছবি তো থাকে। বা তোর ওই কাশেম শেখ? ব্যাটা দেখতে পারে বিপ্লব বলে কিছু?’
‘লোকটাকে একবার দেখে আসতে পারলে হত কিন্তু। সেবার আমাদের সেই ওয়ান-শটার দেখে কী বলেছিল মনে আছে?’
‘স্বপ্ন না দেখলেও লোকটার একটা চেতনা ছিল বল। মানে বিপ্লব বা ওই ধরণের কিছুরই।’
এমন হয় না কিন্তু। সেই নীচ থেকে ওপরে ওঠার পর থেকে অপেক্ষা করছি। ফোন করেছি দেখতে পেলে একবার অন্তত— ।
বেঞ্চে বসা লোকদুটিকে দেখিয়ে আলাকে বললাম, চিনিস এদের? মনে হয় আমার মতো দূরের সেই নৌকার জন্যই।
দোকানদার লোকটি এবার আলাকে দেখে বলল, তোর বাবার বিড়ি খাওয়াটা বন্ধ করতে পারলি না?
‘বাবা তো ক্যান্সারের জানে না কিছু।‘
‘না জানুক, ডাক্তার তো বলেছে।’
‘মা বলল, ডাক্তার যা খুশি বলুক, তোর বাবা না জানলেই হল।’
বেঞ্চে বসা লোকদুটির একজন এবার দোকানের লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, নৌকার খবর জানেন কিছু? সেবার আপনি— ।
লোকটি কারও একজনের পয়সা হিসেব করতে করতেই বলল, আমি কিন্তু আর মিনিট পনেরো আছি।
আলাকে বললাম, কিরে আসবে তো নৌকা? ও দেখলাম, বেঞ্চে বসা লোকদুটির দিকে তাকিয়ে। পেছনে ভট্ভট্ শব্দ হল ফের। ভট্ভট্-ভট্ভট্। ফেরি নৌকাটা ছাড়ল ওপারের জন্য। শব্দ শুনে পেছনে তাকাতেই দেখি নদী কোথায়, শুধু অন্ধকারই। একটু আগে শোনা নৌকার শব্দ অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে মিলিয়েই যাচ্ছে ক্রমে।
লোকদুটির দিকে তাকিয়ে আলা বলল, কোথায় দেখেছি যেন, মনে করতে পারছি না কিছুতেই।
বললাম, হয়তো অনেক দিন আগে বা স্বপ্নেও হতে পারে। কত কী যে দেখে মানুষ। আমিও।
‘আপনার ফোন পেয়ে আমি কিন্তু ওই দিদিও আসবে বলে ভেবেছি। কী নাম ছিল যেন? আসবে বলেছিল ফের।’
‘হঠাৎ করে ওই দিদির কথা কেন ভাবতে যাবি তুই’ বলতে গিয়ে মনে হল, ফোনে শব্দ হল না রিং-এর। কল করল মনে হয় কেউ।
নাহ্, মাঝে মাঝে ভুল হয় এমন।
চায়ের দোকানের লোকটি দোকান বন্ধ করে বলে গেল, অপেক্ষা করুন, আসবে ঠিকই।
আমাদের নয়, বলে গেল ওই লোক দুটিকেই।
আলা বলছিল ঘন্টাখানেকের মধ্যে চাঁদ উঠবে। আজ নাকি পূর্ণিমা।
আকাশে চাঁদের কিন্তু চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। চিহ্ন নেই তারাদেরও। ঠিক করে বললে আকাশেরই কোনও চিহ্ন নেই আলাদা করে। যেন আমার পায়ের কাছের অন্ধকার থেকেই শুরু হয়ে গেছে আকাশের। অন্ধকারেরও।
‘এতকাল পর এই দ্বীপেই কেন মরতে এলাম বল তো? কী এমন আছে এখানে?’
‘কেন, কাশেম শেখ। ব্যাটা বিড়ি ফুকছে ফুসফুসে ক্যান্সার নিয়ে। তুই না বললে মনেই পড়ত না আমার।’
‘কলেজ-জীবনে আমাদের দেখা সেই স্বপ্ন বা স্বপ্নের চিহ্নমাত্রও বলতে পারিস। যাই হোক, টিঁকে তো আছে।’
বাঁধের ওপরকার সেই চায়ের দোকানের লোকটা চলে গেছে অনেকক্ষণ। বন্ধ দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসে লোকদুটো অপেক্ষা করছে। একেবারে ফিস্ফিস্ করে বলছে কিছু। অন্ধকারে নদীর পাশে বসে কেউ যদি শব্দ করে কোনও, সেই শব্দ কিন্তু অন্ধকারে অন্ধকারে গড়ায় অনেক দূর। আর আমিও তাই লোকদুটির সব কথাই শুনতে পাচ্ছি। আলাকে কিছু বুঝতে দেব না বলে পেচ্ছাবের নাম করে আমি ফের সেই অন্ধকার ঝোপ-জঙ্গলের আড়াল খুঁজি। নৌকোয় ওঠার আগে আর একবার— । লোকদুটির কারও হয়তো কোনও হাসির কথা মনে পড়েছে। হেসেই যাচ্ছে। আমি শুনতে পাচ্ছি।