পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নির্বাচনী বন্ডের সত্যিটা যাঁরা প্রকাশ করছেন, তাঁদের কুর্ণিশ।

  • 16 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1514 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
যে কাজটা একজন সাংবাদিকের কাজ, তার বদলে তিনি যদি সরকারের গুণকীর্তন প্রচারে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সাংবাদিকতার মৃত্যু হয়। রোজ সন্ধ্যেবেলা, কোনও একটি চ্যানেলে বসে, চিৎকার করাটা আর যাই হোক সাংবাদিকতা নয়। পুণম আগরওয়াল, যে কাজটা দীর্ঘদিন ধরে করছেন, সেটাই আসল সাংবাদিকতা। ময়ূখ, অনির্বাণ বা সবার পরিচিত সুমন দে, যা করেন, তাকে দালালি বলে, সাংবাদিকতা নয়।

দেশের বৃহত্তম সরকারি ব্যাঙ্ক, এসবিআই, সুপ্রীম কোর্টের ধমক খেয়ে নির্বাচনী বন্ডের ত্রেতাদের নাম এবং গ্রহীতার নাম, দুটো আলাদা খামে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার পরে, সারা দেশে শোরগোল পড়ে গেছে। প্রথম ৩০টি সংস্থা, যারা ইলেকট্রোরাল বন্ডে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সর্বোচ্চ ঘুষ দিয়েছে দেখা যাচ্ছে তার ১৪টি-তে বন্ড কেনার আগে বা পরে কেন্দ্রীয় এজেন্সি, ইডি-আইটি-সিবিআই, নানা অজুহাতে হানাদার বাহিনী পাঠিয়েছিল।

 

রয়টার্স সংবাদ সংস্থা দাবি করেছে 'প্রুডেন্ট ইলেট্রোরাল ট্রাস্ট'-এর মাধ্যমে সিরাম ইনস্টিটিউট ৫২ কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে। উল্লেখ্য যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কন্ট্রাক্ট এই সংস্থার হাতে প্রধান দেওয়া হয়। তারপরে প্রতিষেধকের শংসা পত্রে, মোদীর ছবি ছাপিয়ে প্রচার করা হয়।

 

লটারির কিং সান্তিয়াগো মার্টিনের কোম্পানি ফিউচার গেমিং এ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস ২০২০-র ২৭শে অক্টোবর থেকে ২০২৩-র ৫ই অক্টোবর পর্যন্ত রাজনৈতিক তোলাবাজদের বন্ড কিনে মোট ১৩৬৮ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। এখানে ইডি হানা দেয়।

 

মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফাস্ট্রাকচার লিমিটেড ধাপে ধাপে ৯৬৬ কোটি টাকা বন্ড কিনে ঘুষ দিয়েছে আয়কর হানার পর।

 

হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড মোট ৩৭৭ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। ২০২০-তে সিবিআই হানা হয়।

 

বেদান্ত লিমিটেড বিভিন্ন সময়ে ৪০০ কোটি টাকা ডোনেট করে বন্ডের মাধ্যমে। ২০২২-এ এখানে ইডি হানা দেয়।

 

যশোদা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল ২০২১-এ ১৬২ কোটি টাকা দেয়। এখানে আয়কর হানা দেয়।

 

ডিএলএফ কমার্শিয়াল ডেভেলপার্স লিমিটেড ১৩০ কোটি টাকা দেয়। ২০১৯ ও ২০২৩ সালে এখানে ইডি হানা দেয়।

চেন্নাই গ্রিনউডস প্রাইভেট লিমিটেড ১০৫ কোটি টাকা দেয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে আয়কর হানা দেয়।

 

ডক্টর রেড্ডি'স ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড ২০২৩-সালের ১৭ই নভেম্বর ৮০ কোটি বন্ড কেনে। এর ঠিক চারদিন আগে ১৩ই নভেম্বর আইটি হানা দেয়।

 

আইএফবি অ্যাগ্রো লিমিটেড ৯২ কোটি টাকা দেয়। জিএসটি সংক্রান্ত কিছু গরমিল থাকায়, এখানে ডিজি জিএসটি হানা দেয়।

 

এনসিসি লিমিটেড ৬০ কোটি টাকা দেয় আইটি হানার পর।

 

ডিভিএস ল্যাবরেটরি লিমিটেড ৫৫কোটি টাকা দেয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইটি হানা দেয়।

 

ইউনাইটেড ফসফরাস ইন্ডিয়া লিমিটেড ৫০ কোটি টাকা দেয়। ২০২০-সালের জানুয়ারি মাসে আইটি হানা দেয়।

 

অরবিন্দ ফার্মা ১.৬ কোটি টাকা দেয়। ইডি হানা দেয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে।  

 

জিন্দাল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড ১২৩ কোটি টাকা দেয়। ২০২২ সালে ইডি হানা দেয়।

 

অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, এই তথ্যগুলো কীভাবে প্রকাশ হচ্ছে, কারা কাজ করছেন এই বিষয়ে? এখনও তো মিলিয়ে দেখা হয়নি, সরকারিভাবে, তাহলে কী করে পাওয়া যাচ্ছে এই তথ্য? এখনো তো ঐ নির্বাচনী বন্ডের যে একটি ‘অভিন্ন’ সংখ্যা থাকার কথা, তা তো ব্যাঙ্ক জানায়নি, তাহলে কারা এই দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন? আসলে যে কথাগুলো নিয়ে এখন সংবাদমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে আলোচনা হওয়ার কথা, তার বদলে অন্য অনেক কিছু নিয়ে কথা হচ্ছে। যে কাজটা একজন সাংবাদিকের কাজ, তার বদলে তিনি যদি সরকারের গুণকীর্তন প্রচারে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সাংবাদিকতার মৃত্যু হয়। রোজ সন্ধ্যেবেলা, কোনও একটি চ্যানেলে বসে, চিৎকার করাটা আর যাই হোক সাংবাদিকতা নয়।

কিন্তু, কিছু কিছু মানুষ এখনও আছেন, যাঁরা নিশ্চুপে কাজ করে চলেছেন। যাঁরা মনে করেন, সাংবাদিকতার অর্থ সত্যের খোঁজ করা। তেমনই একজন মানুষ পুণম আগরওয়াল। ২০১৮ সাল থেকে তিনি কিন্তু বলে আসছেন, এই নির্বাচনী বন্ড একটা বড়সড় দুর্নীতি। শুধু নির্বাচনী বন্ড নয়, তিনি কিন্তু প্রথম, যিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভিভিপ্যাট স্লিপ কেন নষ্ট করে দেওয়া হলো, সেই নিয়ে তথ্য জানার অধিকার আইনে, প্রশ্ন তুলেছিলেন, তিনি এই পুণম আগরওয়াল। তিনি তখন কুইন্ট বলে একটি সংবাদসংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নির্বাচনী বন্ডে যে একটি ইউনিক বা অভিন্ন সংখ্যা আছে, এবং সেটা যে ব্যাঙ্ক সরকারকে জানিয়েছে, তাও প্রথম বলেন এই পুণমই। আজকের সময়ে, এই সাহসী মানুষেরা, যাঁরা সরকারের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছেন। সত্যি, খুঁজে বের করার চেষ্টা করে চলেছেন, তাঁরাই আসল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন।

একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কী করে এই নির্বাচনী বন্ড, যার পুরো বিষয়টাকেই অস্বচ্ছ করে রাখা হয়েছে, তার সম্পর্কে এই স্বচ্ছ ধারণা তৈরী করলেন? উত্তরে তিনি বলেন, তিনিই প্রথম সাংবাদিক, যিনি একটি নির্বাচনী বন্ড কিনে, সেটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি প্রথমে দিল্লির এসবিআইয়ের সংসদ ব্রাঞ্চে গিয়ে আবেদন করেন, যে তিনি বন্ড কিনতে চান। ব্যাঙ্কের যিনি আধিকারিক, তিনি সন্দিহান হয়ে, পুণমকে প্রশ্ন করেন, কেন তিনি ঐ বন্ড কিনতে চান? তিনি বলেন, তিনি একটি রাজনৈতিক দলকে এই বন্ডের মাধ্যমে টাকা দিতে চান। ব্যাঙ্ক থেকে তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরা তাঁকে বারংবার প্রশ্ন করেন, কেন তিনি একজন ব্যক্তি হিসেবে এতো টাকা দিতে চান? তাঁর থেকে ১ হাজার টাকার একটি চেকও নেওয়া হয়, প্রাথমিকভাবে। তারপরে তাঁকে ঐ বন্ড দেওয়া হয়। তারপরে তিনি ঐ বন্ডটি নিয়ে একটি ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে যান, পরীক্ষা করানোর জন্য। তাঁর মনে হয়েছিল, ঐ বন্ডগুলোতে নিশ্চিত কোনও সংখ্যা আছে, যা দেখে সরকার বুঝতে পারছে, কোন শিল্পপতি তাঁদের টাকা দিয়েছেন এবং তা ব্যাঙ্কের যোগসাজশেই ঘটছে। স্টেট ব্যাঙ্ক নিজেই এই তথ্য, সরকারের কাছে দিচ্ছে, কোন শিল্পপতি তাঁদের সহায়তা করছেন আর কারা বিরোধীদের দিচ্ছে। সেই হিসেব করেই ইডি এবং সিবিআই পাঠানো হচ্ছে, যাতে আরো চাপ সৃষ্টি করে আরো টাকা তোলা যায়। পুণমের মনে হয়েছিল, প্রতিটি বন্ডে যে লুকোনো সংখ্যা আছে, তা অভিন্ন, অর্থাৎ একটি হাজার টাকার বন্ডের সঙ্গে অন্য হাজার টাকার বন্ডের সংখ্যার পার্থক্য আছে। তাই তিনি আরো একটি বন্ড কেনেন এবং সেটাকেও পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করান। তারপরে তিনি তথ্য জানতে চেয়ে এসবিআই এবং অর্থ মন্ত্রকে চিঠি লেখেন। উত্তর আসে, প্রতিটি বন্ডে একটি লুকোনো সংখ্যা আছে এবং কে কার জন্য এই টাকা দিলেন, তা বোঝার জন্যেই ব্যাঙ্কের তরফ থেকে এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

 

দেশের সর্বোচ্চ আদালত, এসবিআইকে যে নোটিশ পাঠিয়েছে, তাতে এই সংখ্যা জানানোর কথাই বলা হয়েছে। এই সংখ্যাও যাতে মানুষ জানতে পারে, সেই জন্যেই আদালত এই চিঠি পাঠিয়েছে। এরপর কোন শিল্পপতি কাকে টাকা দিয়েছেন, তা যে খুব সহজে জানা যাবে, তার জন্য খুব বেশী অঙ্ক করতে হবে কি? পুণমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এসবিআই এই সংখ্যা জানাতে এতো টালবাহানা করছে কেন? তিনি বলেছেন, তাঁর জানা নেই, কেন এসবিআই এটা করছে, তবে যেহেতু প্রতিবছর ব্যাঙ্কে যে অডিট হয়, তাতে তাঁদের কাছে এই তথ্য নিশ্চিত আছে, কিন্তু সত্যিটা এটাই যে হয়তো কোনও আরো ওপর মহলের চাপ আছে, যার ফলেই তারা এটা দিতে চাইছেন না, হয়তো কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়তে পারে।

আরো অনেকে এই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে কাজ করছেন। রিপোর্টার্স কালেক্টিভ আছে, নিতীন শেঠী আছেন। এই মানুষদের জন্যেই আমাদের সামনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো আসছে। এই মানুষদের কাজের সম্মান জানানোটা জরুরি। না হলে, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের আর অস্তিত্ব থাকতো না। বড় বড় নামের সংবাদ মাধ্যম গত দশ বছরে যা করে চলেছে, তাকে আর যাই হোক সাংবাদিকতা বলে না। এই ধরনের মানুষ, যাঁরা নানান সময়ে, তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে সরকারকে অস্বস্তির মুখে ফেলছেন, তাঁদের আরো একবার কুর্নিশ।  

   

 

 

0 Comments

Post Comment