ইউজিসি-র সাম্প্রতিক সার্কুলারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাসে সাভারকারের লেখা ঢোকানোর নিদান দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপির ফ্যসিবাদী সরকার লাগাতারভাবে শিক্ষার গৌরীকিকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সার্কুলারটি তারই একটা উদাহরণ। নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ -তে যখনই তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ (IKS) বা ‘ভারতীয় জ্ঞান প্রক্রিয়া’ নিয়ে প্রভূত বাগবিস্তার করা হয়েছিল এবং পঠনপাঠনের সর্বস্তরে একে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তখনই বোঝা গেছিল যে, বিজেপির সরকার সিলেবাসে তাদের ঘৃণ্য রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক মতামতগুলিকে ঢোকানোর চেষ্টা চালাবে। এই তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান প্রক্রিয়া এতই ভাসাভাসা যে এর মধ্যে দিয়ে যা খুশি তাই করা যায়। তাদের ইচ্ছামত যে কোনো বিষয়কে তারা ভারতীয় জ্ঞান বা ভারতের ইতিহাস বলে সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিতে পারে। সাভারকারের অন্তর্ভূক্তি এমনই একটা বিষয়।
উদার মানুষেরা বলতেই পারেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাভারকার পড়ালে ক্ষতি কি? আজকাল এই ধরণের প্রশ্ন করার লোকের অভাব নেই। আজকাল দিন পাল্টেছে। সাম্প্রাদায়িক বা ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এক সময়ে সাধারণ মানুষের মনেই যে পরিমাণ ঘৃণা ছিল আজকাল তা অনেকটাই তরল হয়ে এসেছে। সুতরাং, সাভারকার পড়ালে ক্ষতি কী তা শুধাবার লোকের অভাব হবে না।
সাভারকার পড়ালে ক্ষতি আছে। কী ক্ষতি তা নিয়ে দু একটি কথা বলা দরকার।
বিনায়ক দামোদর সাভারকার কে ছিলেন তা অনেকেই জানেন। অনেকে জানেন না। যাঁরা জানেন তাঁরাও সবাই খুব ভালভাবে বিষয়টা অবগত নন। প্রথম জীবনে সাভারকার ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী। এই সময়কার সাভারকারের জীবন ছিল রোমাঞ্চকর। শুধু দামোদর সাভারকারই নন, তাঁরা তিন ভাই-ই ছিলেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করা অসংখ্য মারাঠা ছাত্রযুবদের কাছে একটি অনুপ্রেরণা। কিন্তু ইংলন্ডে গ্রেপ্তার হয়ে সাভারকার যখন ভারতের আন্দামান জেলে বন্দী হন তখন ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই পরিবর্তনের বীজ অবশ্য সাভারকারের মধ্যে বহু আগে থেকেই উপ্ত ছিল। ছোটোবেলায় সাভারকার একবার একটি মসজিদ আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তাঁর মনে মুসলমান বিদ্বেষ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের সেনানী হিসাবে তাঁর এই মনোভাব অনেকদিন পেছনে চলে গিয়েছিল। আন্দামান জেলে বন্দী হয়ে জেলজীবনের দুর্বিসহ ভার সহ্য করতে না পেরে এবার সাভারকার আবার তাঁর পুরনো মনোভাবকে জাগিয়ে তোলেন আর ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে মুক্ত হবার পরিকল্পনা তৈরি করেন।
এর পর থেকেই ক্রমশ সাভারকার হয়ে ওঠেন অন্য এক মানুষ। বারংবার মুচলেকা দিয়ে অবশেষে জেল থেকে ছাড়া পান দামোদর সাভারকার। আন্দামান জেল থেকে সাভারকার ব্রিটিশের কাছে মোট পাঁচবার ক্ষমা প্রার্থনা করে মুচলেকা দিয়েছিলেন। যথাক্রমে ১৯১১, ১৯১৩, ১৯১৪, ১৯১৮ এবং ১৯২০ সালে। এর সবগুলি সহজলভ্য নয়। এই মুচলেকাগুলির একটিতে তিনি পরিষ্কারই বলেছিলেন যে, মুক্তি পেলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাথে যে কোনো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তাঁর ভাষায়,
“I am ready to serve the Government in any capacity they like, for as my conversion is conscientious so I hope my future conduct will be.” অর্থাৎ, “আমি সরকারের সাথে যে কোনো সহযোগিতা, তাঁরা যেমন চাইবেন, করতে রাজি আছি। যেহেতু আমার এই পরিবর্তন সম্পূর্ণ বিবেকতাড়িত তাই আমি আশা করি যে, আমার ভবিষ্যৎ আচরণও অনুরূপ হবে।”
সাভারকারের ভবিষ্যৎ আচরণ ‘অনুরূপ'-ই হয়েছিল। ব্রিটিশদেরকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি একদিনের জন্যেও ভঙ্গ করেন নি সাভারকার। জীবনে আর কখনও তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও তিনি করেন নি। এর পর বেশ কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন এবং হয়ে ওঠেন মহাসভার প্রধান নেতা এবং তাত্ত্বিক। এই পর্বেই তার একাধিক লেখা এবং বক্তৃতায় তিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হয়ে ওঠেন। কেন্দ্রের ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকারের বকলমে ইউজিসি যে সাভারকারকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে সেই সাভারকার হলেন এই পরিবর্তিত সাভারকার যিনি আর মহারাষ্ট্রের স্বাধীনতাপ্রিয় যুবদের অনুপ্রেরণা ছিলেন না, পথপদর্শক ছিলেন তাদের যারা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই নয় বরং তাদের সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে ভারতের শাসনক্ষমতায় ভাগ বসাতে চাইছিল, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মধ্যে দিয়ে একটা অগ্নিগর্ভ দেশের জমি হিন্দুত্ববাদী আদর্শে ও পরিমন্ডলে কর্ষণ করতে চাইছিল।
ধর্মীয় রেখায় ভারত বিভাজন যদি হয় এই পরিমন্ডলের একটা পরিণতি তাহলে মহাত্মা গান্ধীর হত্যা ছিল এই পরিমন্ডলের অন্য একটা পরিণতি। আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার পরিকল্পনা ছিল মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা। সাভারকারের বাড়িতে মিটিং করে এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপদান করা হয়েছিল। গান্ধী হত্যা মামলায় সাভারকার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কিন্তু আদালতে ঠিক সময়ে নিজের সহকর্মীদের তিনি চিনতে পারেন নি। এক প্রকার তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকারের কাছে আবারও একদফা মুচলেকা দিয়ে সাভারকার গান্ধীহত্যা মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হন। সুতরাং, স্বাধীন ভারতে হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণপুরুষ হলেন সাভারকার।
আজ সারা দেশের অবস্থা কী? হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় মেরুকরণ উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। ফ্যাসিবাদী আরএসএস/বিজেপি তাদের হাতে থাকা রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে মুসলমানদের উপর সব ধরণের আক্রমণ নামিয়ে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি মুসলমান বিদ্বেষের ওপর ভর করে এক ধরণের প্রতিক্রিয়াশীল গণ-আন্দোলন তৈরি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংস্র মব লেলিয়ে তাঁদের আক্রমণ করা হচ্ছে। একেবারে খোদ রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে মুসলমানদের বে-নাগরিক করার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। নতুন উপসর্গ হল, বর্তমানে বাঙালী এবং বাংলা ভাষার ওপর বিজেপির আক্রমণ। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলায় কথা বলা লোকেরা যদি মুসলমান হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাঁদের বাংলাদেশী বলে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করে হোক বা না করে, তাঁদের বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় কট্টর মুসলমান বিরোধী সাভারকারকে সরকারি স্বীকৃতি কী ঘটাতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সাভারকারের যে কথাগুলো এতদিন মানুষের কাছে আধুনিক ভারতরাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে অন্তরায় বলে মনে করা হত ইউজিসির সিলেবাসে সাভারকারকে ঢোকানোর ফলে তা যে সরকারি বৈধতা পেয়ে যায় তা নিশ্চয় কারুর অজানা নয়।
বিজেপি/আরএসএসের প্রচারযন্ত্র, বিশেষ করে মূলধারার গণমাধ্যমকে দখলে নিয়ে এসে তাতে লাগাতার প্রচার, ইতিমধ্যেই সাভারকারের তত্ত্বায়নকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ভারতে কারা থাকবে বা ভারত দেশটা কার? —- এর উত্তরে সাভারকারের পরিষ্কার অভিমত ছিল যে, যাদের পিতৃভূমি এবং পূণ্যভূমি ভারত তারাই ভারতের অধিবাসী, তারাই ভারতীয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে বর্তমানে নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকত্বের ধারণা নিয়ে সারা ভারতে যে বিতর্ক চলছে তাতে বিজেপি ঘুরিয়ে সাভারকারের বক্তব্যকেই প্রতিধ্বনিত করে চলেছে এবং বর্তমানে লাগাতার প্রচারের ফলে তাতে সায় দিচ্ছেন দেশের এক বড় অংশের মানুষ। এমনকি বিচারপতিরা আদালতে বসেই এই ধারণার ওপর নির্মিত রাজনৈতিক ভাষ্যগুলিকেই বৈধতা দিচ্ছেন। এখান থেকেই বোঝা যায় যে, গত আটাত্তর বছরে আমরা কতটা পিছিয়ে এসেছি। ভারতের স্বাধীনতা এবং দেশভাগের সময়কালে, ১৯৪৭-৪৮ পর্যায়ে, সমগ্র উপমহাদেশজুড়ে অসংখ্য ছোট বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও, সাম্প্রদায়িক বিষে আচ্ছন্ন ভারতবর্ষেও সাভারকাররা খুব একটা দাঁত ফোটাতে পারে নি। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ১৯৪৬ সালেই গণপরিষদ তৈরি হয়ে গেছিল। তাতে আলোচনাও শুরু হয়ে গেছিল। সেখানে হিন্দু মহাসভার মত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র। দেশভাগের পরেও গণপরিষদ কোনোভাবেই ভারতকে শুধুমাত্র হিন্দুদের দেশ হিসাবে মান্যতা দেয় নি। পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছিল যে, যে সংবিধান আমরা পেতে চলেছি তাতে কার “পূণ্যভূমি” কোথায় সেটা নাগরিকত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি হবে না। হতাশ এবং মরীয়া হয়ে আরএসএস এর সকল দায়ভার মহাত্মা গান্ধীর ওপর ন্যস্ত করে এবং শুধু তাতেই ক্ষান্ত না হয়ে তারা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সাভারকারের বাড়িতে মিটিং হয়, গান্ধীহত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় এবং সেই অনুযায়ী নাথুরাম গডসে গুলি করে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে। কিন্তু তাতেও তাদের সুবিধা হয় নি। বরং, উলটো ফল হয়। স্বাধীন ভারতে আরএসএস নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সাভারকার আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকবেন না —- এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান। তারপর তিনি নিষ্ক্রিয়ই থাকেন। এবং তিনি যখন মারা যাচ্ছেন তখন আরএসএস এবং সার্বিকভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি পরাজিত, কোনঠাসা, জনমানসে ধিকৃত, জনপরিত্যাক্ত।
আর আজ? তারপরে আটাত্তর বছর কেটে গিয়ে এই ২০২৫ সালে গোটা রাজনৈতিক অবস্থাটাই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে আবার পেছনের দিকে চলে গিয়েছে। মানুষ পেছন থেকে সামনে যায়, অন্ধকার থেকে আলোয় যায় কিন্তু আমরা আলো থেকে অন্ধকারে এসে পৌঁছেছি তাদেরই রাজত্বকালে যারা নিজেদের গর্বিত হিন্দু বলে দাবি করে এবং যাদের ধর্মগ্রন্থাদি “অসতো মা সদগময়:/ তমসো মা জ্যোতির্গময়:/ মৃত্যোর্মা অমৃতম গময়:” (আমায় অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে চল, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চল, মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে চল) বলে চীৎকার করে এসেছে!
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাভারকারের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে ইউজিসি-র সাম্প্রতিক নির্দেশ এই অন্ধকারকেই আরও প্রগাঢ় করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইউজিসি এখানেই থামে নি। ঐ একই নির্দেশনায় তাঁরা রসায়নশাস্ত্রের বইপত্রে সরস্বতী বন্দনা যুক্ত করারও নিদান দিয়েছেন। (https://www.news18.com/education-career/ugc-to-add-saraswati-vandana-in-chemistry-savarkars-book-in-history-sparks-row-9529848.html) আমরা আজকাল আর এতে আশ্চর্য হই না। রসায়নশাস্ত্রের কোন অগ্রগতি পুরানের দেবী সরস্বতী ঘটিয়েছিলেন যে রসায়ন পড়তে গেলে সরস্বতী বন্দনা দিয়ে শুরু করতে হবে তা এক আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু আগ্রহী ব্যক্তিরা যদি সারা ভারতের সাধারণ মানুষের মনোভাব নিয়ে কিঞ্চিত গবেষণা করেন তাহলে এটা খুব সহজেই বোঝা যাবে যে, এতে আজকাল লোকে কিন্তু খুব একটা আশ্চর্য হন না, বরং এটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করেন। এই পশ্চাৎগতির কথাই আমরা আলোচনা করছিলাম।
বিজেপি আরএসএসের ফ্যাসিবাদ দাঁড়িয়েই আছে এই পশ্চাৎগমনের ওপর। ইউজিসির সাম্প্রতিক নির্দেশনা তারই একটা রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়।