পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চিলির নাইন ইলেভেন

  • 11 September, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1754 view(s)
  • লিখেছেন : বিস্ময় বসু
আজকের ভারতের সময়ের সঙ্গে চিলির কি অদ্ভুত মিল। সেইসময়েও পিনোশে ক্ষমতায় থাকাকালীন সরকারী খনিগুলিকে বেসরকারী করা করা, সামাজিক সুরক্ষা ভেঙে দেওয়া হয়, আর ভূমি সংস্কার উল্টে দিয়ে গরিব কৃষকদের জমি কেড়ে আমেরিকার বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই অর্থনৈতিক ত্রাসের সাথে সাথে চলেছিল রাজনৈতিক নিধন যজ্ঞ - যার পোশাকি নাম ‘অপারেশন কন্ডর’।


৪৭ বছর আগে আজকের দিনে (১১ সেপ্টেম্বর), চিলির রাষ্ট্রপতি ডাঃ সালভাদোর অ্যালেন্দেকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে আমেরিকার CIA নিয়ন্ত্রিত চিলির সামরিক বাহিনী। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন অ্যালেন্দে। ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত মার্ক্সবাদী রাষ্ট্র প্রধান। তার প্রচারের মূল বিন্দু ছিল খনিজ সম্পদের সরকারিকরণ, ভূমি সংস্কার আর সামাজিক সুরক্ষা কে মজবুত করা। ক্ষমতায় এসেই অ্যালেন্দে তাঁর নির্বাচনী প্রচার প্রতিশ্রুতি অনুসারে সমস্ত খনি সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনেন। আপাদ মস্তক ভূমি সংস্কার করে ভূমিহীন কৃষকদের হাতে জমি তুলে দেন। অনগ্রসর জনজাতির ছাত্রদের বিশেষ বৃত্তি দেওয়া, পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রত্যেক স্কুলে দুধ বিতরণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া - এই বিশাল পরিধি জুড়ে সংস্কার চালান তিনি। ঠিকা শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হয়। আবাসিক প্রকল্প চালু হয় গৃহহীনদের জন্যে। তাঁর এইসব পদক্ষেপে, বলাই বাহুল্য আমেরিকার ধনকুবেরদের ‘ব্যবসায়িক স্বার্থ’ ক্ষুন্ন হয়। আসলে অ্যালেন্দেকে হারাতে আড়াই মিলিয়ন ডলার নিয়োগ করে বিরোধী প্রার্থীর প্রচারে। খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন CIA কে এই বিষয়টা 'দেখতে' নির্দেশ দেন।
নির্বাচিত হয়ে যাবার পরেও থেমে থাকেনি আমেরিকা। টাকা দিয়ে সরকার বিরোধী ধর্মঘট করানোর কথা খোদ CIA নিজে তাদের ডকুমেন্টে স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
আর কোনো উপায় না দেখে CIA আলেন্দে কে হত্যা ও অপসারণের চক্রান্ত শুরু করে।


১৯৭৩ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর। সিআইএ সমর্থিত এই অভ্যুত্থানের পরে জেনারেল অগাস্টো পিনোশে ক্ষমতায় আসে। পিনোশের চিলি ছিল নয়া উদার অর্থনীতির প্রথম প্রয়োগ ক্ষেত্র। এই অর্থনৈতিক নীতিগুলির প্রথম বাস্তব জীবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি পড়া একদল ইকোনোমিক হিটম্যানকে চিলিতে পাঠানো হয়। আর তাদের পালের গোদা ছিল মিল্টন ফ্রিডম্যান। শুরু হয় ফ্রিডম্যানের শক থেরাপি। আপাদমস্তক রক্ষনশীল অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন ফ্রিডম্যান। স্কুল হাসপাতাল থেকে, সরকারি মালিকানায় আসা খনি, আলোর গতিতে বিক্রি করা শুরু করে পিনোশের সরকার। সামাজিক সুরক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যেসব সামাজিক আমাসন তৈরি হয়েছিল অ্যালেন্দের আমলে, সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়।

আজকের দিনে ভাবতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি যে পঞ্চাশের আর ষাটের দশকে বাজারি অর্থনীতিকে লোকে হাস্যাস্পদ গোঁড়ামি ছাড়া বেশি কিছু মনে করতো না। গ্রেট ডিপ্রেসন আর যুদ্ধের স্মৃতি তখন তাজা। সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন। পুঁজির নিগড় থেকে বেরিয়ে তৃতীয় বিশ্বের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে তখন। কাজেই কম পয়সায় মাল বানিয়ে রপ্তানি করে বাজার মাত করবো, (বা এক্সপোর্ট প্রমোশন) এই ধারণার হাত ধরে গেলে যে আবার পরাধীন হতে হবে, সে স্মৃতি তখনও মিলিয়ে যায়নি। বরং উল্টো দিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশের তখন স্বপ্ন হলো ভাবার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর- স্বনির্ভর হওয়ার। কাজেই জোরদার শিল্পায়ন চলছে তখন এইদেশ গুলিতে; যাতে প্রথম বিশ্বের থেকে আমদানির উপর আর নির্ভর না থাকতে হয়। ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতিবিদেরা (চিলির বিখ্যাত অর্থনতিবিদ রাউল প্রেবিসের একাডেমিক নেতৃত্বে ) সাবধান করে চলেছেন যে নিজের পায়ে না দাঁড়ালেই সমূহ বিপদ, উপনিবেশ শেষ হয়ে গিয়ে থাকলেও উপনিবেশবাদ নয়। প্রথম বিশ্ব কেইন্স ময়। সরকারের কাজ হল পুনর্বন্টন। আর তা না করলেই আবার ডিপ্রেসানের মুখে পড়তে হবে, এ বিষয়ে মোটামোটি একটা আপামর সম্মতি বা কোনসেনসাস চলছে।
ঠিক এই সময়ে মিল্টন ফ্রিডম্যান পারি দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মূল বক্তব্য একটাই। বাজার হল সকল রোগের একমাত্র দাওয়াই। যেকোনোরকম সরকারি নীতি প্রণয়ন আসলে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। তাই সরকারের কাজ হলো বাজারকে তার কাজ করতে দেওয়া। মানে সমাজের মধ্যে, ঐতিহাসিক বা, স্ট্রাকচারাল বা অন্য কোনোরকম বৈষম্যের অস্তিত্ব মানতেও নারাজ ছিলেন তিনি ও তাঁর গজদন্ত মিনারবাসী ছাত্ররা। তাকে ঘিরেই শুরু হল রক্ষণশীলতার ঘরওয়াপসি। কিন্তু ছাত্র জুটবে কোত্থেকে?শুরু হলো তৃতীয় বিশ্বের ছাত্রদের জন্যে বিশেষ, ফেলোশিপ। এক কথায় মার্কিন লগ্নিপুজির ফেরত আসার মরিয়া প্রচেষ্টা।
মিল্টন ফ্রীডম্যান ও তার সঙ্গে পাঙ্গরা কি ধরনের মানুষ ছিল তা জানতে দুটো বই পড়ে দেখা যেতে পারে।
১. ডেভিড হার্ভে সম্পাদিত এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ নিও লিবেরালিজম, আর
২. নাওমি ক্লেইনের লেখা দ্য শক ডকট্রিন
এই তথাকথিত ‘শিকাগো বয়েস’ দের পরামর্শ মেনে অর্থনীতি নির্ধারণ শুরু করেন পিনোশে। সরকারী খনিগুলিকে বেসরকারী করা করা, সামাজিক সুরক্ষা ভেঙে দেওয়া হয়, আর ভূমি সংস্কার উল্টে দিয়ে গরিব কৃষকদের জমি কেড়ে আমেরিকার বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই অর্থনৈতিক ত্রাসের সাথে সাথে চলেছিল রাজনৈতিক নিধন যজ্ঞ - যার পোশাকি নাম ‘অপারেশন কন্ডর’। ‘পিনোশে’স হেলিকপ্টার’ কথাটা একটু গুগল করে দেখলেই বোঝা যাবে কোন স্তরের বীভৎসা চলেছিল।

0 Comments

Post Comment