পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অনুপ্রবেশের মিথ এবং বাঙালির বিপদ

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 204 view(s)
  • লিখেছেন : অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
আমরা আমাদের সারাদিনে খুব বেশী হলে ৫০ জন লোকের সাথে কথা বলি। সেখানে একজন বা দুজন বাংলাদেশির সাথে আমাদের কথা হলে আমরা ভাবি দেশ বোধ হয় অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেল। কিন্তু এইসব ভাবনা আসলে বিশ্বাস যার পেছনে কোন তথ্যের ভিত্তি নেই। বিশ্বাস নিয়ে আসলে আমার সত্যি কিছু বলার নেই। বিশ্বাস মানুষ অনেক কিছুতে করে – ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, চাঁদের চরকা কাটা বুড়ি। এসবের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই, এটুকুই বলা যায়। অনুপ্রবেশ ও একটি বিশ্বাস কিন্তু ভিনরাজ্যে বাঙালি হেনস্থা ঘোর বাস্তব।

১ অনুপ্রবেশের আতঙ্কঃ মিথ ও মিথ্যার জাল

হঠাৎ করেই দেশজুড়ে আবার অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে শুরু হয়েছে কর্মসূত্রে বিভিন্ন রাজ্যে থাকা বাঙ্গালিদের ওপর নির্যাতন। দুঃখের বিষয় অনেক বাঙালিও এই নির্যাতনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করছেন এই বলে যে সত্যি তো পশ্চিমবঙ্গ অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে। রাজ্য সরকার যেহেতু কিছু করবেন না তাই কেন্দ্রীয় বা অন্য রাজ্যের সরকারই একমাত্র ভরসা। আপনি যদি এই সব মতের সমর্থকদের জিজ্ঞেস করেন যে অনুপ্রবেশের কী প্রমাণ তাঁরা জানেন তাহলে প্রত্যকেই নিজের চোখে দেখা অনুপ্রবেশকারীর গল্প শোনাবেন। সেইসব গল্প হয়ত সত্যি কিন্তু যেটা ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে সত্যি সেটা কি রাজ্যের জন্যও সত্যি? সেটা বোঝার একমাত্র উপায় জনগণনার দিকে তাকানো। অনুপ্রবেশের হার যদি খুব বেশি হয় তাহলে জনগণনায় সেটা ধরা পড়বে। কিন্তু কিভাবে? জনসংখ্যা তো জন্মহার মৃত্যুহারের থেকে বেশী হলেই বাড়ে। তার মধ্যে কোনটা অনুপ্রবেশের জন্য আর কোনটা নয় সেটা বোঝা যাবে কি করে? আমাদের (অর্থাৎ সুজয়ের) প্রাথমিক অনুমান হল পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটছে। সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে অনেক বেশী হবে। সেটা বোঝার জন্য আমরা রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাদ দিয়ে একটি নতুন চলক তৈরি করলাম। এর মান যদি শূন্যর থেকে বেশী হয় তাহলে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা বেশী.শূন্যর থেকে যদি কম হয় অর্থাৎ রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে কম হয়, তাহলে অনুপ্রবেশ ঘটছে না, বা ঘটলে তা খুব উল্লেখযোগ্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি আমরা আসাম আর গুজরাটের জন্যও একই ভাবে চলকটি নির্মাণ করলাম। আসাম, কারণ জাতীয় নাগরিক পঞ্জির দাবি উঠেছিল আসাম থেকেই এবং তার পেছনেও ছিল অনুপ্রবেশের ভয়। আর গুজরাট কারণ গুজরাটে অনুপ্রবেশ হচ্ছে এরকম দাবী কেউ কখনো করে নি।

 

এই রেখাচিত্রের সব তথ্যই এসেছে ভারতীয় জনগণনার ওয়েবসাইট থেকে। এখানে তিনটি রাজ্যের জন্য আপেক্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে। যদি আপেক্ষিক বৃদ্ধির হার শূন্যের ওপরে থাকে তাহলে রাজ্যগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে বেশি আর যদি তা শূন্যের কম হয় তাহলে রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে কম। যদি খুব আশঙ্কাজনক হারে অনুপ্রবেশ হয় তাহলে সেই রাজ্যের জনসংখ্যা জাতীয় হারের থেকে অনেক বেশি বাড়ার কথা। যদিও উল্টোটা সত্যি নাও হতে পারে, জনসংখ্যা বাড়লেই তা যে অনুপ্রবেশের জন্যই তা বলা যায় না। উপরের ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে ১৯৪১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তিনটি রাজ্যের জনসংখ্যা বেড়েছে জাতীয় হারের থেকে বেশী হারে। গুজরাটের জনসংখ্যাও বেড়েছে,কিন্তু আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের থেকে কম হারে। কিন্তু এই যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি তা কী সত্যি অনুপ্রবেশের পরিসংখ্যানকে ধারণ করে? কারণ গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে যদি আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নি তাহলে নানান স্বাভাবিক কারণেও রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে বেশী হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনের দুটি বড় পর্যায় ছিলভারতের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে পরেই হয় ১৯৫১’র জনগণনা। সেখানে আসামে জাতীয় হারের চেয়ে বেশী হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলেও (১৯.৯%), পশিম বঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধি কিন্তু জাতীয় বৃদ্ধির (১৩.৩%) সঙ্গে প্রায় সমানই ছিল। এই বছর গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারও (১৮.৬৯%) অনেকটাই বেশী ছিল জাতীয় বৃদ্ধি হারের তুলনায়। এক্ষেত্রে কিন্তু গণনা প্রক্রিয়ার সমস্যার সম্ভাবনা পুরোটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যেহেতু নব্য স্বাধীন একটি দেশে জনগণনার মত একটি বিশাল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা খুব সহজ নয়। এই সম্ভাবনার স্বপক্ষে একটি অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ হল ১৯৬১ সালের জনগণনায় পশিম বঙ্গের জনসংখ্যার বৃদ্ধি হার (৩২.৮%) জাতীয় হারের (২১.৫%) থেকে অনেকটাই বেশী। ১৯৬১ র জনগণনায় আসামের বৃদ্ধি হারও ছিল অনেকটা বেশী (35%)। এমনকি গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আসাম বা বাংলার মত না হলে জাতীয় হারের থেকে বেশী ছিল (২৭%)। একই ভাবে আমরা যদি ১৯৭১ এর জনগণনা দেখি তাহলেও দেখব আসামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (35%) জাতীয় হারের (25%) থেকে বেশী। পশ্চিম বঙ্গও বেশী (২৭%), কিন্তু আসামের মত অত বেশী নয়। সুতরাং, শরণার্থী (নাকি অনুপ্রবেশকারী?) আগমনের এই দ্বিতীয় পর্যায়েও জনসংখ্যাতে তার একটা ছাপ পাওয়া যাছে। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত তা কেউই বলবে না, কিন্তু অনুপ্রবেশ পরিমাপের এর থেকে তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ উপায় আর নেই। যাঁরা অনুপ্রবেশের জুজু দেখাচ্ছেন তাঁদের কাছে কিন্তু আদৌ কোন তথ্য নেই, পুরোটাই কিছু ধারণা।এখন আমরা যদি সময় সারণীতে আরও এগিয়ে আসি তাহলে দেখব ১৯৮১ থেকেই আসাম আর পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে কম এবং শেষ দুটি জনগণনাতে গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে বেশী। তাহলে অনুপ্রবেশ যদি কোথাও হয়ে থাকে গুজরাটে হচ্ছে!

 

 

২।  বাংলা কি অনুপ্রবেশের করিডর?

 

, “আসলে পশ্চিমবঙ্গের জনগণনায় অনুপ্রবেশের ব্যাপারটা ধরা পড়ছে না কারণ অনুপ্রবেশকারীরা পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ঢুকে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। এই তো, আমার মামাতো ভাই, সুরজিত, গুরগাঁওতে থাকে। ওদের বাড়ির যে রান্নার মাসি – সেই তো বাংলাদেশি”। এরকম কথা শোনা যায় প্রায়ই। প্রবন্ধের প্রথম অংশে দেখিয়েছিলাম সাম্প্রতিক অতীতে গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশী। এমন কী  হতে পারে যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা পশ্চিমবঙ্গকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে গুজরাট বা গুজরাটের মত অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে? যার ফলে গুজরাটের (বা তার মত অন্য রাজ্যের) জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা পরিসংখ্যানে অনুপ্রবেশ ধরা পড়ছে না? এই করিডোর তত্ত্বের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কি কোন প্রমাণ আছে? আমি শুরু করলাম ২০১১ তে গুজরাটের পরিযান পরিসংখ্যান দিয়ে। গুজরাটে, ২০০১ আর ২০১১ এর মধ্যে, কাজের সন্ধানে এসেছেন প্রায় সাড়ে ছ লাখ মানুষ (৫,৩৪,৫৪৫ অন্য রাজ্যের গ্রাম থেকে আর ১,২২,২৪১ অন্য রাজ্যের শহরাঞ্চল থেকে)। বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা যদি পশ্চিমবঙ্গ হয়ে গুজরাটে গিয়ে থাকে তাহলেও তাদের ধরা আছে এই সাড়ে ছ-লাখের মধ্যেই। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় এক কোটি (সঠিক সংখ্যা ৯৮,৬৭,৬৭৫)। আমরা যদি কাজের প্রয়োজনে গুজরাটে আসা মানুষদের (যার একটা অংশ বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে লোকের বিশ্বাস) বাদ দিয়েও ২০০১ থেকে ২০১১ এঁর মধ্যে গুজরাটের জনসংখ্যাবৃদ্ধি হিসেব করি তাহলে তা দাঁড়ায় ১৮.১৯% যা গুজরাটের প্রকৃত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (১৯.২৮%) এর থেকে কম হলেও ২০১১-২০১১ সাময়কালে ভারত (১৭.৭%), পশ্চিমবঙ্গ (১৩.০৮%) এবং আসাম (১৭.০৭%) -- এর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশী। অর্থাৎ, করিডোর তত্ত্ব দিয়ে গুজারাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তার থেকেও বড় কথা, পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশীরা অন্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে অন্য রাজ্যের জনসংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে – এই করিডোর তত্ত্বের স্বপক্ষেও কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

 

কিন্তু এই হিসেবে দুটো সমস্যা আছে। একদিকে যারা কাজের প্রয়োজনে বাইরের রাজ্য থেকে আসছেন তাঁরা সবাই যে অনুপ্রবেশকারী এমন তো নয়। পশিমবঙ্গের অধিবাসীদের যদি বাদও দেন, তাহলেও বিহার, উত্তর প্রদেশ, বা কেরালা থেকেও তো বহু মানুষ যেতে পারেন গুজরাটে কাজের সন্ধানে। তাহলে রাজ্যে বাইরে থেকে আসা কতজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী তা বোঝা যাবে কী করে? যিনি বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশ করেছেন তিনি তো আর ঘোষণা করবেন যে আমি বাংলাদেশী! অন্যদিকে, করিডর তত্ত্ব সত্যি হয়, তাহলে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা ছড়িয়ে যাচ্ছে নানা রাজ্যে। তাহলে শুধু গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধি দেখে লাভ নেই – এরকম একটা আপত্তি উঠতে পারে। এই দুই সমস্যার সমাধানের জন্য কোন রাজ্যে যাঁরা আসছেন তাদের কতজন বাংলাদেশি তার একটা হিসেব পাওয়া দরকার আর তারপর এই হিসেবটা বিভিন্ন রাজ্যের জন্য করে দেখা দরকার।

 

প্রথম সমস্যার কোন পূর্ণাঙ্গ সমাধান নেই। ঠিক কতজন বাংলাদেশি রাজ্যে ঢুকছেন এটা বোঝার সরাসরি কোন উপায় নেই। তার বদলে, আমি ভারতীয় জনগণনা পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখার চেষ্টা করেছি কোন রাজ্যে কতজন মানুষ আছেন যাদের মাতৃভাষা বাংলা। যেমন গুজরাটে ২০০১ সালে বাংলাভাষী লোক ছিলেন ৪০,৭৮০ আর ২০১১ তে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ৭৯,৬৪৮। অর্থাৎ, ২০০১ থেকে ২০১১ এঁর মধ্যে গুজরাটের জনসংখ্যায় বাংলাভাষীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০,০০০। মনে রাখতে হবে, এই ৪০,০০০ এর মধ্যে তিন ধরণের লোক আছেন – পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি আর গুজরাতে বংশানুক্রমে বাস করা প্রবাসী বাঙ্গালি। এখন ৪০,০০০ এর  মধ্যে কতজন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী এটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কোনভাবেই ৪০,০০০ এর বেশী হতে পারে না। অর্থাৎ, ৪০,০০০ হল ২০০১-২০১১ এঁর মধ্যে বাঙ্গালি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যার ঊর্ধসীমা। আসলে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা এর থেকে কমই হবে। ২০০১ থেকে ২০১১, এই ১০ বছরে গুজরাটের জনসংখ্যা বেড়েছে ৯৮,৬৭,৬৭৫। অর্থাৎ ২০০১-২০১১ এই সময়কালে, গুজারাটের জনসংখ্যাবৃদ্ধিতে বাংলাভাষীদের অবদান মাত্র .০৬%। ২০০১-২০১১ মধ্যে গুজরাটের  বাংলাভাষীদের সংখ্যাবৃদ্ধি যদি অনুপ্রবেশের জন্য হয় তাহলেও মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে তার অনুপাত খুবই সামান্য।

গুজরাটের জন্য করা এই হিসেবটা (অর্থাৎ কোন রাজ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেই রাজ্যের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাত) আমি অন্য রাজ্যের জন্যও করে দেখেছি। এটা সব রাজ্যের জন্যই করা যায়, কিন্তু আমি আপাতত সেই রাজ্য গুলিই নিলাম যার জন্য অনুপ্রবেশকারীদের বিভিন্ন গল্প আমি শুনেছি – উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, দিল্লি রাজধানী অঞ্চল, আর মহারাষ্ট্র। সঙ্গের রেখাচিত্রে, এই অনুপাতটি দেখানো হল। অনুপাতগুলি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে রাজ্যগুলিকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের গন্তব্য বলে আমরা শুনতে পাই সেগুলির সবকটিতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির অতি সামান্য অংশই বাংলা ভাষী জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। যেমন ধরা যাক কর্ণাটক। ২০০১ সালে কর্ণাটকে বাংলাভাষী ছিল ৪১২৫৬ যা ২০১১ তে বেড়ে হল ৮৭৯৬৩। সুতরাং এই ১০ বছরের মধ্যে কর্ণাটকের বাংলা ভাষীর সংখ্যা বেড়েছে ৪৬,৭০৭ (যার মধ্যে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্কার, ম্যানেজমেন্ট কর্মীরাও আছেন)। ওই একই সময়ের মধ্যে কর্নাটকের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৮2 লাখ (৮২,৪৪,৭৩৫)। অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০১১ এঁর মধ্যে কর্নাটকের জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাত্র ০.৫৬% বেড়েছে বাংলাভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে।

 

বিভিন্ন রাজ্যের বাংলাভাষী জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও রাজ্যের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাত (২০০১-২০১১)

 

 

৩ শেষের কথা

 

তাহলে কী দাঁড়ালো? কে ঠিক? বিভিন্ন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা? না ভারতীয় জনগণনার নৈর্ব্যক্তিক তথ্য? আগের বার যা বলেছিলাম সেটাই একটু অন্যভাবে বলি। আসলে কেউই ভুল নয়। আমরা আমাদের সারাদিনে খুব বেশী হলে ৫০ জন লোকের সাথে কথা বলি। সেখানে একজন বা দুজন বাংলাদেশির সাথে আমাদের কথা হলে আমরা ভাবি দেশ বোধ হয় অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেল। কিন্তু এইসব ভাবনা আসলে বিশ্বাস যার পেছনে কোন তথ্যের ভিত্তি নেই। বিশ্বাস নিয়ে আসলে আমার সত্যি কিছু বলার নেই। বিশ্বাস মানুষ অনেক কিছুতে করে – ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, চাঁদের চরকা কাটা বুড়ি। এসবের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই, এটুকুই বলা যায়। আর যা বিশ্বাস তা ব্যক্তিগত থাকাই বাঞ্ছনীয়, তা রাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হয়ে ওঠা কখনোই কাম্য নয়।  আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছিভাষা বা খাদ্যাভ্যাস দেখে তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার নিদান আসতে শুরু করেছে দেশের ক্ষমতায় থাকারাজনৈতিক দলের নেতা বা কোন কোন রাজ্যের প্রশাসনের দিক থেকে। যেকোন জনবিরোধী আইনেরই প্রথম বলি হয় গরিবরা। বিমুদ্রাকরণ থেকে নাগরিক পঞ্জি – সব ক্ষেত্রেই এমনটাই দেখা গেছে। কিন্তু অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণের সহজ উপায় বাংলা ভাষা হয়ে দাঁড়ালে উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙ্গালিরাও কিন্তু সে আগুণ থেকে রক্ষা পাবেন না।

 

0 Comments

Post Comment