পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তৃণমূলের রাজনীতি বিজেপির রাজনীতির নকলমাত্র!

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 203 view(s)
  • লিখেছেন : শংকর
হিন্দু ধর্মের মধ্যে যে বৈচিত্র আছে, তাকে ব্যবহার করার মুন্সীয়ানা দেখাতে হবে বিজেপি বিরোধীদের। তবেই, হিন্দু ঐক্য গড়তে চাওয়া বিজেপির রাজনীতিকে কার্যকরী ধাক্কা দেওয়া সম্ভব। তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিনরা সেটা করছেন। কিন্তু বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের সেসব বোধবুদ্ধি নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি পয়সায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে ভাবছেন, কি দারুন দিলাম! এদিকে এতে করে তারা যে, ধর্ম নিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করা বিজেপির রাজনীতির সঙ্গেই অভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেলেন তা বোঝার ক্ষমতা তার নেই।

তৃণমূল এবং বিজেপির দ্বৈরথ বর্তমানে এক অদ্ভুত অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই দ্বৈরথ অতি তীব্র, কিন্তু অতি সূক্ষ্ম। এমনই সূক্ষ্ম যে কখনও কখনও কে তৃণমূল আর কে বিজেপি তা আলাদা করে চেনা যায় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবলভাবে বিজেপির বিরোধী। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকাতে তিনি সমস্ত ধরণের পন্থাই ব্যবহার করতে দ্বিধাহীন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতির বিরোধী নয়। ক্ষমতায় বিজেপির না থাকলেই চলবে। বিজেপির কাজ তৃণমূল করে দেবে। এ এক আশ্চর্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অবশ্য সমগ্র ভারতই এক আশ্চর্য দেশ, এ কথা নিশ্চয়ই সবাই মানবেন। ফলত, এমন ‘আশ্চর্য’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা দেশের নানা প্রান্তেই শোনা যায়। কয়েক বছর আগে এমনই এক আপাত মজাদার কিন্তু প্রবলভাবে এই আশ্চর্য ভারতীয় রাজনীতির বার্তাবাহক কথা শুনেছিলাম হরিয়ানায়, সেখানে বেশ কিছুদিন কাটানো এক বন্ধুর মুখে। হরিয়ানায় তখন কংগ্রেস শাসন চলছে। বিজেপি ক্ষমতায় আসতে প্রবল প্রচার চালাচ্ছে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে। সেই সময়ে হরিয়ানার কংগ্রেস নেতারা তার পাল্টা নাকি বলতেন যে, হরিয়ানা এমনিতেই ‘হিন্দুরাষ্ট্র’। হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে আলাদা করে বিজেপির কোনো দরকার এখানে নেই!

পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে তাই। বিজেপি হনুমান পুজো করছে, তো তৃণমূলও করছে। আরও বেশি করে করছে। রামনবমী করছে, তো তৃণমূলও করছে। বিজেপি রামমন্দির করছে, তো মমতা বন্দ্যোপাধায় জগন্নাথ মন্দির করছেন। শুধু তাই নয়, পাড়ায় পাড়ায় ব্যানার পোস্টার ঝুলছে, “দীঘায় জগন্নাথ মন্দির করার জন্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন –--- অমুক চন্দ্র তমুখ”, ইত্যাদি। দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ নাকি বাড়ি বাড়ি বিলিও করা হবে।  এক কথায় মমতা যে বিজেপির থেকেও আরও অনেক বড় হিন্দু তা প্রমাণ করার জন্যে মরীয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল। প্রশ্ন হচ্ছে বিজেপি যদি ক্ষমতায় না থাকে কিন্তু রাজ্যে বিজেপির নীতিই অনুসৃত হয় তাহলে তৃণমূলের শাসনকে কি বিজেপি বিরোধী শাসন বলা যাবে?

 

অথচ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সুযোগ ছিল বিজেপির এই উত্তর ভারতীয় একশিলীভূত ভারত নির্মাণের ধারণা ও অপচেষ্টাকে বাঙালীর নিজস্ব বৈচিত্র‍্য দিয়ে আঘাত হানার। একটা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার। এই প্রতিরোধের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক –--- ভাষা ও ধর্ম। এই উভয় দিকেরই প্রচুর বৈচিত্র্য বাংলার আছে। বিজেপি যেভাবে একদেশ, একনেতা, এক আইন প্রভৃতির ধারাবাহিকতায় হিন্দু বিশ্বাস ও আচারের মধ্যেকার বিভিন্নতা ও বৈচিত্র‍্যকে ধ্বংস করতে চায় তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধী লড়াইকে একটা অন্য মাত্রা দেওয়ার সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে পারেন নি। আসলে তা করার জন্যে যে উচ্চতায় পার্টির বোধশক্তি থাকতে হয় তা তাঁর পার্টির নেই। অথচ, তামিলনাড়ুকে খেয়াল করুন। স্ট্যালিনের বহুবিধ নীতির বিরুদ্ধে মুখ তোলার যথেষ্ট জায়গা আছে এবং সেসব নিয়ে লড়াই চলবে। কিন্তু ভাষা ও ধর্মের প্রশ্নে যেভাবে তামিলনাড়ু বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তা থেকে পশ্চিমবাংলারও অনেক কিছু শেখার আছে। বিজেপির অথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের ধারণাকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে এবং হিন্দিকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেওয়াল খাড়া করে স্ট্যালিন এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন।

বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক মুখপাত্র, আরএসএসের রাজনৈতিক অভিব্যাক্তি। আরএসএস প্রধানত চিৎপাবন ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী দল। ফলত প্রথম থেকেই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান'-এর ধারণা আরএসএসের সাংস্কৃতিক মননকে গঠন করেছে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। অধিকন্তু এই সংগঠনটির চরিত্র প্রথম থেকেই ফ্যাসিবাদী হবার কারণে এরা ভারতের বৈচিত্র‍্যকে অগ্রাহ্য করে একটি এককেন্দ্রীক ও একমাত্রিক দেশ গড়তে চেয়েছে যার পতাকা হবে গেরুয়া, সংবিধান হবে মনুস্মৃতির আদলে তৈরি, আর ভাষা হবে হিন্দি।

অথচ, ভারতবর্ষ হল একটি অসাধারণ বৈচিত্র্যময় দেশ। প্রকৃত বিচারে ভারত আসলে বহু দেশের সমষ্টি যাকে একটি কেন্দ্রীয় শাসনের নিচে নিয়ে আসার বহু প্রচেষ্টা ইতিহাসে হয়েছে। সম্রাট অশোকের সময় থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত লাগাতার এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থেকেছে কিন্তু সর্বদাই এই প্রচেষ্টাগুলি উল্টোদিকের কেন্দ্রাতিগ বলের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এই কেন্দ্রাতিগ বলের ইতিবাচক উপাদান হল এই যে, তা ভারতের বৈচিত্র‍্যকে রক্ষা করতে চেয়েছে, তার ওপর জবরদস্তি একমাত্রিকতার স্টীমরোলার চালাতে দেয় নি। ফলে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান'-এর ধারণা উত্তর ও মধ্য ভারতের কিছু অঞ্চল ছাড়া ভারতের অন্যত্র কখনই জনপ্রিয় হয় নি। ভারতের ইতিহাসের একটা লম্বা সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে বিরাজ করা কংগ্রেস যার ফলে এই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ -কে মন থেকে খারিজ করতে না পারলেও তা কট্টরভাবে অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিল না। কিন্তু ফ্যাসিবাদ তো ফ্যাসিবাদই। আরএসএস এই ধারণাকে কট্টরভাবে লাগু করার পক্ষপাতী ছিল প্রথম থেকেই। যার ফলে আরএসএস বা বিজেপি দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ভারতের মাটিতে কখনই তার শিকড় তৈরি করতে পারে নি। ‘হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্তান'-এর ধারণা ভিত্তিক এই এককেন্দ্রিক ভারতভাবনার বিরুদ্ধে তাই দক্ষিণ ও পূর্ব ভারত তীব্র লড়াই চিরকাল দিয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে সময় বদলেছে। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আরএসএস কিন্তু কখনই হাল ছেড়ে দেয় নি। গত একশ বছর ধরে তাদের লাগাতার প্রচেষ্টা বর্তমানে তাদের চালকের আসনে বসিয়েছে একথা যেমন সত্যি, তেমনই তাদের এই সাফল্যের পেছনে দক্ষিণ এবং বিশেষ করে পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির ইতিহাস চেতনার অভাব, স্বাভিমানের অভাব এবং আত্মমর্যাদার অভাব অনেকাংশেই যে দায়ি একথাও তেমনই সত্য। দক্ষিণে এই লড়াইটা যদিও এখনও চলছে কিন্তু পূর্ব ভারতে তা বিজেপির অনুকূলে শেষ হয়ে গেছে তা বলা বাহুল্য। উড়িষ্যা এবং আসামে বিজেপি ইতিমধ্যেই তাদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। বাকী আছে পশ্চিমবঙ্গ। তার অবস্থাও আজ অত্যন্ত খারাপ তা আমরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছি। পশ্চিমবঙ্গে জবরদস্তি হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা কখনই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন নি। নয়া শিক্ষানীতি ২০২০-র মাধ্যমে বিজেপি একদিকে যেমন শিক্ষায় গৈরিকীকরণ বাড়িয়ে তুলেছে, কর্পোরেট শিক্ষাকে বাধাহীন করে তুলেছে তেমনই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে হিন্দিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাদের তিন ভাষা ফর্মুলার আসল উদ্দেশ্য সেটাই। দক্ষিণে তামিলনাড়ু কিন্তু কড়া ভাবে এই তিন ভাষা ফর্মুলাকে বিরোধিতা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের হুমকি ধমকি বা প্রলোভন কোনোটাই তামিলনাড়ু সরকারকে টলাতে পারে নি। মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, ওখানে দুই ভাষা ফর্মুলাই চলবে —- তামিল এবং ইংরাজি। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এই সামান্য প্রতিরোধটুকুও করেন নি। নির্বিবাদে হিন্দিকে মেনে নিয়েছেন। এখন দেখুন অবস্থা এমন জায়গায় গেছে যে, হলদিরামের মত প্রতিষ্ঠান যারা বাংলায় প্রচুর ব্যবসা করে খাচ্ছে তারা প্রকাশ্যেই চাকরীর বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে যেখানে বলে দিচ্ছে হিন্দি ভাষীদেরই তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয় হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার চুপ! তাদের মুখে কোনো কথা নেই।

 

একই অবস্থা ধর্মের ক্ষেত্রেও। বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্বের সামনে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করার মরীয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন যে তিনি এবং তাঁর দল কম হিন্দু নয়। এখানে আবার তামিলনাড়ুর কথা উঠবে। সেখানকার শাসক পার্টির নেতারা যেখানে সাম্প্রদায়িক সনাতন ধর্মকে তীব্র সমালোচনা করেছেন সেখানে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা বিজেপিকে নকল করার চেষ্টা করছেন। এখানেও হনুমান পুজো, রামনবমী ইত্যাদি জোর কদমে চালাবার চেষ্টা চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে একটা অন্য সুযোগ ছিল। উত্তর ভারতীয় রামকেন্দ্রীক নিরামিষাশী হিন্দুধর্মের সঙ্গে বঙ্গের শৈব শাক্ত ভিত্তিক হিন্দুধর্মের যে সংঘাত আছে তাকে ব্যবহার করতে পারতেন তারা। কিন্তু সেসব করার কথা তারা ভাবতেও পারেন না। এই ব্যাপারটা সামান্য ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

যাঁরাই একটু খোঁজখবর রাখেন তাঁরাই জানেন যে, হিন্দুধর্ম জুডাইজম, ইসলাম বা খ্রীষ্ট ধর্মের মত আব্রাহামীয় ধর্মের মত একমাত্রিক নয়। হিন্দু ধর্মের গড়ে উঠার ইতিহাস অন্যরকম। অতীতে হিন্দুধর্ম বলে কিছু ছিল না। বস্তুতপক্ষে হিন্দুধর্ম নামটি অতি আধুনিক। ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যে বৈদিক আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেন তাঁরা ছিলেন ইন্দ্র, মিত্র, বরুন, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের উপাসক। উপনিষদের সময়ে এসে ব্রহ্ম উপাসনা শুরু হয়। ইন্দ্র, মিত্র, বরুন, অগ্নি প্রভৃতি দেবতারা ক্রমশ অতীতের ব্যাপারে পর্যবসিত হন। বৈদিক আর্যদের ধর্মকে যদি আমরা বৈদিক ধর্ম বলে চিহ্নিত করি তাহলে বলা যেতে পারে যে, বৈদিক ধর্ম ক্রমশ বহু দেবতা কেন্দ্রীক ধর্ম থেকে এক দেবতা কেন্দ্রীক ধর্মে পর্যবসিত হয়। যদিও এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইন্দ্র, মিত্র, বরুন, অগ্নি প্রভৃতি দেবতারা সেই অর্থে ঈশ্বর ছিলেন না। অর্থাৎ, তাঁরা জগতসৃষ্টির কর্তা ছিলেন না। তাঁরা মানুষের মতই ছিলেন, মানুষের বন্ধু (সখা) ছিলেন কিন্তু সাধারণ মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা চরিত্র ছিলেন। সাধারণ মানুষ যা পারে না তাঁরা তা পারতেন। বেদে জগতসৃষ্টিকর্তা হিসাবে প্রথমে ‘হিরণ্যগর্ভা’, পরে প্রজাপতির কথা বলা হয়েছে। ধীরে ধীরে এই প্রজাপতি সুস্পষ্টভাবে ব্রহ্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়। উপনিষদের সময় থেকেই বৈদিকরা প্রবলভাবে হয়ে ওঠেন ব্রহ্মবাদী। ব্রহ্মচর্চাই ছিল মূলত তাঁদের ধর্মালোচনা। যজ্ঞই ছিল প্রধান ধর্মীয় আচার।

এই যাজ্ঞিক বৈদিক ধর্মের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসাবে ভারতে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে উৎপত্তি হয় বৌদ্ধ আন্দোলনের। এই আন্দোলন ছিল বৃহত্তর শ্রামণিক ধারার অন্তর্গত। এই ধারার অন্যান্য আন্দোলনগুলি যথা জৈন, আজীবক প্রভৃতি গৌতম বুদ্ধের আগে থেকেই বর্তমান ছিল। কিন্তু তা সেভাবে বৈদিক ধর্ম আন্দোলনকে কখনই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে নি। আর ছিল নাস্তিক চার্বাক মতামত। কিন্তু বৌদ্ধ আন্দোলনের উৎপত্তির সাথে সাথে বিভিন্ন কারণের ফলে বৌদ্ধ আন্দোলনই অত্যন্ত সফলতার সাথে যাজ্ঞিক বৈদিক ধর্মাচরণের প্রচন্ড প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। ভারতে ধর্মের ইতিহাসে এই সময়কালটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতুহলোদ্দীপক সময় যখন ভারতের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধর্মালোচনা ছিল প্রধানত জ্ঞান নির্ভর, আচার নির্ভর নয়। বহু দেবতার অস্তিত্ব ছিল না। মূর্ত জগতের বিমূর্ত তত্ত্বায়ন করাই ছিল ধর্মীয় আলোচনা ও ধর্মীয় অনুশীলনের প্রধান দিক। এটিই ছিল মূলধারা। এই মূলধারার বাইরে অপ্রধান ধারা হিসাবে বিভিন্ন বিশ্বাস ও অনুশীলন অবশ্যই ছিল কিন্তু তা ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল।

উপনিষদের সময়কাল থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সূচনাপর্ব পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর এই অবস্থা চলার পর বৈদিক ধর্ম পৌরানিক ধর্মে অভিযোজিত হতে শুরু করে। বৈদিকদের ব্রহ্মবাদী তত্ত্ব এবং যজ্ঞকেন্দ্রীক অনুশীলন বৌদ্ধ আন্দোলনের শক্তিশালী আঘাতে প্রায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উক্ত তত্ত্ব এবং অনুশীলনের ওপর নির্ভর করে বৈদিক ধর্মের পক্ষে আর এগোনো, এমনকি টিঁকে থাকাও সম্ভব ছিল না। ফলে তা আবার বহুদেবতার ধারণায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। মনে রাখতে হবে এই রূপান্তর রাতারাতি হয় নি। গুপ্ত যুগের শুরুর সময় থেকে আরও পাঁচ ছশো বছর লেগেছিল এই রূপান্তরের জন্যে।

বৈদিক ধর্ম শুরুতে ছিল বহু দেবতাকেন্দ্রিক । পৌরানিক যুগে এসে তা আবার সেই চরিত্রে ফিরে গেল। কিন্তু এখানে একটা লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন ঘটল। ইন্দ্র, মিত্র, বরুন, অগ্নির মত দেবতারা কিন্তু আর এই পর্বে ফিরে এলেন না। এই সময়ে দেখা দিলেন নতুন দেবতারা। শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, কালী, ইত্যাদি। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই নতুন দেবতারা কেউই বৈদিকদের মূল ভূখন্ড আর্যাবর্ত অর্থাৎ উত্তর (ও উত্তর পশ্চিম) ভারতে জনপ্রিয় নন। এই নতুন দেবতারা তার বাইরের ভূখন্ড, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয়। এর অর্থ হল যে, বৈদিক ধর্ম ভারতের অপরাপর ধর্মমতগুলিকে গিলে খেয়ে প্রসারিত হয়েছে, ব্যপ্ত হয়েছে এবং পৌরানিক ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। পৌরানিক পর্বে উত্তর ভারতে যার ফলে এক নতুন দেবতা হিসাবে রামায়নের রামকে একমাত্র গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে, উত্তর ভারতীয় রামকেন্দ্রিক  হিন্দুধর্মের সাথে বাংলার শৈব শাক্ত ধর্মমতের তীব্র বিরোধিতা আছে।

এই বিরোধিতাকে ব্যবহার করার মুন্সীয়ানা দেখাতে হবে বিজেপি বিরোধীদের। তবেই, হিন্দু ঐক্য গড়তে চাওয়া বিজেপির রাজনীতিকে কার্যকরী ধাক্কা দেওয়া সম্ভব। তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিনরা সেটা করছেন। কিন্তু বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের সেসব বোধবুদ্ধি নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি পয়সায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে ভাবছেন, কি দারুন দিলাম! এদিকে এতে করে তারা যে, ধর্ম নিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করা বিজেপির রাজনীতির সঙ্গেই অভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেলেন তা বোঝার ক্ষমতা তার নেই।

 

আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের গোটা রাজনীতিটাই বিজেপিকে নকল করে তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। এই নকল হিন্দুত্ব দিয়ে বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্বকে পরাস্ত করা অসম্ভব। উড়িষ্যার মতই বাংলাতেও বিজেপি আজ নয়ত কাল জিতেই যাবে যদি অন্য ধরণের রাজনৈতিক বয়ান এখানে তৈরি না হয়।

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment