পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মহেঞ্জোদারোর আকাশ

  • 19 September, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1402 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস ভট্টাচার্য
ধুসর রঙের পর্দাগুলো উড়ছে। কেউ যেন বাতাস লেলিয়ে দিয়েছে ওগুলোয়। প্রলয় বাতাস। একজন নিঃসঙ্গ ঘোড়সওয়ার দাঁড়িয়ে পড়েছে দূরে। আমি তবু এগিয়ে যাচ্ছি এক-পা এক-পা করে। আকাশ থেকে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে আলো। একখণ্ড মেঘ উড়ে এল কোথা থেকে। নেমে এল যেন একটা প্রাচীনকাল। দেখলাম ঘোড়সওয়ারটা এবার পালাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে। যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকেই পালাচ্ছে। আকাশ থেকে কী পড়ছে ওগুলো! এক-একটা ইতিহাসের পাতা! উড়ে যাওয়া সেই পাতা থেকে খসে খসে পড়ছে সাদা কাপড়ের মোড়ক।

আমার পায়ের কাছে উড়ে এসে পড়ল একটা। কাপড়টা একটু ফাঁক করে দেখলাম ওর ভেতরে রয়েছে একটা মৃতদেহ। এইরকম আরও ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সাদা রঙে ভয়ংকর হয়ে গেল জায়গাটা। আমি ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে এগোতে লাগলাম। সেই ঝোড়ো হাওয়ায় মোড়কের কাপড়গুলো থেকে ফরফর শব্দ হচ্ছিল। যেন মৃতেরা ঘুম থেকে উঠে একসঙ্গে কাঁদছে। আমি জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম। আমার মাথায় টুপি, আর হাতে স্টিক। ট্রাউজার্সের ওপর ফুলস্লিভ জ্যাকেট। পায়ে শু। ওই টিলাটার ওপর উঠতে চাইছি। কিন্তু রাস্তাটা শেষ হচ্ছে না। ওই ধূসর রঙের পর্দাগুলো আগুনের শিখার মতো এসে লাগছে গায়ে। আমি হাতের স্টিকটা দিয়ে প্রাণপণ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি ওগুলো। সাদা মোড়কগুলোর ওপর কী উড়ছে ওগুলো! উঃ কী অন্ধকার ডানা ওদের। টিলাটায় এসে দাঁড়ালাম অনেক কষ্টে। হাঁফাচ্ছিলাম আমি। স্টিকটায় ভর দিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম জোরে জোরে। কী হচ্ছে এসব চারদিকে! হঠাৎ কানে এল ঝাঁক ঝাঁক পাখির কলতান। আনন্দে মুখরিত আজ ওদের ডানাগুলো। এত হাসছে কেন আজ ওরা! এত কাকলি কেন আজ ওদের! এখন কি এই উচ্ছ্বাসের সময়? নিচে লক্ষ লক্ষ মৃত মানুষ! একটা সভ্যতা স্তব্ধ। আর ওরা হাসছে! তাহলে কি ওরা উপহাস করছে আজ! মনে হল তাই হবে। আজ ওরা জয়ী, আমরা পরাজিত। একটা শ্রেষ্ঠ প্রাণী আজ পরাজিত। আমাদের খাদ্যলালসায় রেহাই দিইনি ওদের। আজ তো ওরা হাসবেই। দেখলাম আকাশের বুক চিরে একটা ঈগল ছুটে এল বিশাল শূন্যতায়। ঈগলটার পায়ের নখে অটিকে রয়েছে মানুষের খুলি! একটা উন্নত মানব-মস্তিষ্ক। অজান্তেই নিজের মাথাটাতে হাত বোলালাম আমি। অন্য পায়ের নখটা থেকে ঝুলছে একটা মহাকাশযান! ওই খুলিটাই একদিন যেটা তৈরি করেছিল। তাহলে খুলিটার আজ এই দশা হল কেন? উড়ন্ত সেই ঈগলের নখে একটা ভয়ংকর ছবি ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশে। মনে হচ্ছে নিচের দুঃসময়ের ওপর বৃত্ত এঁকে দিচ্ছে ঈগলটা। সভ্যতার এই দুর্দিনকে সভ্যতার দূরত্ব থেকে ভয়ে ভয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে নড়বড় করছে টিলাটা। ঈগলটা এবার আমার মাথার খুব কাছ দিয়ে উড়ছে। খুলিটা আর একটু হলেই লাগত আমার টুপিতে। ওই আবার আসছে। এবার আরও নিচু। আমি হাতের স্টিকটা তুলে আটকানোর চেষ্টা করছি ওকে। পারলাম না। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ঈগলটা। আমি গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি টিলাটা থেকে। একটা কিছুতে আটকে গেল আমার পা। একটা নাবালক উদ্ভিদ। ওটাকেই আঁকড়ে ধরলাম। দেখলাম অদ্রীশটা এদিকেই আসছে। বললাম, ‘কী রে, তুই!’ অদ্রীশ বলল, ‘খাবারের সন্ধানে যাচ্ছি। সব দোকান বন্ধ। সারাদিন কিছু খাইনি।’ বললাম, ‘কেন? খাসনি কেন?’ ও বলল, ‘যে ছেলেটা খাবার দিয়ে যেত তাকে ওরা ঢুকতে দিচ্ছে না।'

- কেন?

- আমি সারাদিন এত এত রোগী দেখছি। কাল একা আড়াইশোর বেশি রোগীকে দেখেছি। ওদের ধারণা আমার শরীরে নাকি অনেক ভাইরাস। খাবার দিতে আসা ছেলেটাকে তাই ওরা ঢুকতে দিচ্ছে না।

মনে মনে ভাবলাম কোন ভাইরাসটার বিরুদ্ধে আগে লড়ব আমরা? অদ্রীশ এগিয়ে এসে সাহায্য করল আমাকে। একটা মৃত্যুভূমিতে দাঁড়িয়ে জীবিত হাতের স্পর্শ পেলাম। অদ্রীশ বলল, 'চলি রে। বড্ড খিদে পেয়েছে।' বললাম, ‘আয়। তোর জন্যে কষ্ট হচ্ছে খুব।' ও বলল, 'এখন ওসব কথা ছাড়। আগে লড়াইটা শেষ হোক।' বললাম, “জানিস অদ্রীশ, একটা ভয়ংকর ঈগলকে দেখলাম। খুব নিচু দিয়ে উড়ছে!' অদ্রীশ বলল, 'দেখেছি, তুইও লড়াইটা চালিয়ে যা।' চলে গেল অদ্রীশটা। কাকগুলো কা কা করছে। সাদা কাপড়ের ওপর কাকগুলোকে মনে হচ্ছে এক একটা জেগে ওঠা অন্ধকার। ছোট ছোট উড়ছে পুরো ডানা না খুলে দেখলাম মেঘের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে সূর্যটা। ওর যেন আজ আর কোনও কাজ নেই। উচ্চতা থেকে নামছে খাদের দিকে। অসুখের রঙের মতো দেখাচ্ছে সূর্যটাকে। পৃথিবীভ্রমণ সমাপ্ত করে এত ক্লান্ত ওটাকে কোনওদিন দেখিনি। গড়িয়ে পড়ছে বিন্দুটা। ওটা খাদের মধ্যে পড়ে গেলেই ছায়াগুলো সৰ পোশাক খুলে ফেলবে। একটা একটা করে চোখ জ্বলে উঠবে চারপাশে। অদ্রীশ বলে গেল লড়াইটা চালিয়ে যেতে। কিন্তু আমার হাতে কোনও অস্ত্র নেই৷ আলো যত কমবে তত আজ কেঁপে কেঁপে উঠবে তারাগুলো। শস্যহীন অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে বেড়াবে ধু-ধু প্রান্তরে। ঈগলটা আবার উড়ে আসছে দূর থেকে। দেখলাম একটা পায়ের নখ থেকে ছুড়ে দিল মহাকাশ যানটাকে। যানটা তীব্রবেগে ছুটছে সূর্যের দিকে। ওই তো ক্লান্ত সূর্যটাকে ফুটো করে বেরিয়ে গেল! সূর্যের শরীর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত! উঃ! কী ভয়ংকর দৃশ্য! আলোর শিরদাঁড়া বেয়ে টপটপ করে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা তরল! একদল মানুষ হইহই করে ছুটে গেল সেই দিকে। মনে হল ওরা ক্ষুধার্ত। ওই ঈগলটাকে আমি ছাড়ব না। আমি স্টিকটা তাক করলাম এবার ওর দিকে। এবার ও অন্য পায়ের নখ থেকে খুলিটা ছুড়ল আমাকে লক্ষ্য করে। তীব্রগতিতে ছুটে আসছে একটা মাথার খুলি। দু-হাত তুলে বাঁচাতে চাইছি আমার মাথাটাকে। খুলিটা প্রচণ্ড গতিতে এসে লাগল আমার মাথায়। পড়ে গেলাম। ঢালু বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছি নিচে। একটা সাদা মোড়কে এসে ঠোক্কর খেলাম। মোড়কের ভেতর থেকে মানুষটা বলে উঠল, “আঃ, ধাক্কা মারছ কেন? একটু শান্তিতে ঘুমোতে দাও।” আমি ছিটকে সরে এলাম। দেখলাম নিজেই তাড়াল ওর বুকের ওপরে বসা শকুনটাকে। ধীরে ধীরে বার করল মুখটা। দেখলাম লোকটির চোখের কোটর দুটি মৃত্যুকে বিশ্বাস করতে পারেনি এখনও। বললাম, ‘তুমি তো মৃত! কথা বলছ কী করে?’ উত্তেজিত হয়ে উঠল ওর শ্বাস-প্রশ্বাস। বলল, 'আমার জীবনের একচল্লিশটা পাতা মৃত। বাকি জীবিত পাতাগুলো দেখতে পাচ্ছ না? এই দেখো। কাপড়ের ভেতর থেকে একখণ্ড বাকি জীবন তুলে দেখাল ও। মনে হল অনেক অসমাপ্তকে দেখাল। বললাম, 'আমাকে মার্জনা করবেন। ক্ষমা করবেন আমাকে। দেখলাম লোকটি ওর অসমাপ্ত পৃষ্ঠাগুলোকে যত্ন করে গুছিয়ে রাখল কাপড়ের ভেতর। কেমন মেঘাচ্ছন্ন সেই গুছিয়ে রাখা। চোখ দুটি তখন ছলছল করছিল ওর। অন্ধকার ভিজে যাচ্ছিল সেই জলে। সরলরেখায় চেয়ে আছি আমরা দুজন। মনে হল ও যা দেখতে পাচ্ছে আমি তা পাচ্ছি না। ওর চোখের দৃষ্টি শক্তি, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে হল। মৃত্যুর পরও যে সব ফুলের গন্ধ শুকোয় না, ওর চোখ

দুটি সেইরকম। লোকটি আবার ঢুকে গেল মোড়কের মধ্যে। যাওয়ার সময় আরও খানিকটা আলো নিয়ে চলে গেল। আরও নিভৃত হয়ে গেল চারপাশ। শূন্যরঙের অন্ধকারে ছমছম করে উঠল দেবদারুগুলো। পাশের মোড়কটা এবার নড়ছে। একটা হাত বেরিয়ে এল। হাতটা দেখে মনে হল অনেকক্ষণ ধরে কড়া নেড়েছিল দরজায়, কেউ খোলেনি। দূর থেকেই বললাম, ‘আমাকে ডাকছেন?’

- হ্যাঁ। তোমাদের ভুলে আজ আমি ইতিহাসের শিকার। অন্তত কুড়িটা বছর কেড়ে নিলে তোমরা। একটা মোড়কের ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল! মনে হল এই কান্নায় যদি ক'টি ফুল স-যত্নে অঞ্জলি দিতে পারতাম। কাঁদতে কাঁদতেই ও বলল, ‘ও কোথায় আছে বলতে পারো?’ বললাম, ‘কার, কার কথা বলছেন?’

- ওই যে গো, গত তিন সপ্তাহ ধরে একটা পোকা বাসা বেঁধেছিল ওর শরীরে। যারা শুধু সভ্যতাই খায়। দেখো, একটা নীলরঙের গাউন পরে আছে। দেখো না একটু। নাও, এই বাতিটা নাও। যদি খুঁজে পাও বোলো আমি এখানে শুয়ে আছি। ঠিক ওই শুষ্ক, ফ্যাকাশে তারাটার নিচে। ও ঠিক আসবে। নাও ধরো।

কী ভয়ংকর একটা কাজ দিল হাতটা আমায়। একটা খুঁজে দেখাকে আজ এত ভয় করছে। যাকে খুঁজতে চাই সেই অজ্ঞত চোখ হয়ত দেখছে আমায়। কিন্তু তার হদিশ করব কীভাবে? তবু বাতিটা হাত বাড়িয়ে নিলাম। বৃদ্ধাটি যেন হাতটা সামান্য উঁচু করে বললেন, ‘গড ব্লেস ইউ। যাও, আমার জন্যে একটু কষ্ট করো।'

বিশাল প্রান্তর। সংক্ষিপ্ত আলো। আমি এগিয়ে যাচ্ছি। একটা নীল গাউন খুঁজছি আমি। দেখলাম অদ্রীশ আবার আসছে। আমাকে দেখে নিচু করে নিল মাথা। বাতিটার আলোয় ওকে দেখে মনে হল একটা ডুবন্ত জাহাজ থেকে নাবিক পালিয়ে যাচ্ছে। বললাম, 'কী রে অদ্রীশ। তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?' অদ্রীশ বলল, 'জানি না।' বললাম, “আজ খেয়েছিস?’ ও বলল, 'কী খুঁজছিস তুই?’

- একটা নীল গাউন।

কোনও উত্তর দিল না অদ্রীশ। হেঁটে যাচ্ছে একটা ফাঁকা ক্যানভাসের দিকে। ওর নীরবতাকে মনে হল এই মৃত্যুপুরীর পরিমিত সংলাপ। চিৎকার করে বললাম, 'তুই চলে যাচ্ছিস অদ্রীশ! তুই চলে গেলে...”

ঘুরে দাঁড়াল ও। বলল, ‘আমার কাজ শেষ। ভাইরাসটাকে আপাতত ঘিরে ফেলেছি। কিন্তু ওই ভাইরাসটা অন্য আরও অনেক ভাইরাসের জন্ম দিয়েছে।তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আরও কঠিন। তোদের জন্য শুভেচ্ছা রইল। এখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’ রহস্যময় হাত নেড়ে অদ্রীশ বলল, 'চলি বন্ধু, আবার দেখা হবে।'

অনেকগুলো ভাইরাস কোন জল হাওয়ায় ছড়াল! যা ভাইরাসের পক্ষে অনুকূল, সভ্যতার পক্ষে একেবারেই নয়। শুধু চমক দিয়ে কি এগুলোকে ধ্বংস করা যাবে?

সেই ধু-ধু প্রান্তরের মাঝখান থেকে ভেসে উঠছে একটা শব্দ। পৃথিবী যেন নিজেই ডাকছে নিজের নাম ধরে। ভয়সংকুল সেই ডাক। আমার শরীর ঘেঁষে ঘেঁষে চলে যাচ্ছে এক-একটা হাওয়ার অবয়ব। সারা প্রান্তর জুড়ে আলো বলতে শুধু একফালি চাঁদ। ওজনহীন যেন ঝুলে আছে মহাশূন্যে। মৃত্যু থেকে মৃত্যুর অনুসন্ধান করছে ছায়াছায়া সেই বিজোড় আলো। মনে হচ্ছে মহেঞ্জোদারো নগরীর ওপর দিয়ে পথ হাঁটছি।

আমার সমদূরত্বে কুয়াশার ভিতর ধীরে হেঁটে যাচ্ছে নীল গাউন পরা এক মহারথী। যার মাথায় হাজার হাজার বছরের ঝাপসা আকাশ৷ শৈত্য বাতাসে উড়ছে ন্যায়যুদ্ধের ধূলি। এখন পৌঁছতে হবে ওই নীল পোশাকে একাকার হয়ে থাকা আমার প্রত্যাশায়। আলখাল্লার মতো উড়ছে ওর পোশাক। দূর থেকে ভেসে আসছে এক অশরীরী অট্টহাসি। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছে আমার। গতি বাড়াচ্ছি। কিন্তু এ কী! ছিটকে পড়লাম হোঁচট খেয়ে। প্রবল একটা ঝাকুনি। ঘুম থেকে জেগে উঠলাম আলো অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে।

0 Comments

Post Comment