ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস ! এগারোজন বিজয়ীর সাফল্যের উদযাপনের লাখ লাখ ভক্তদের উল্লাসে মিশে গেল আরও এগারোটি তাজা প্রাণের বলির কান্না। ফ্রি পাসের গুজবকে কেন্দ্র করে বুধবার, ৮ই জুন, বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে বিরাট কোহলিদের আইপিএল জয়ের বিজয়োৎসব পরিণত হল মৃত্যুমিছিলে। পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল এক তরুণী সহ ১১ জন মানুষের। আহত প্রায় ৭৫। সবাই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর (আরসিবি) ভক্ত ছিলেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং কর্ণাটক রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (কেএসসিএ) আয়োজিত এই যৌথ ইভেন্টে বিশৃঙ্খলার জন্য কর্ণাটক সরকার ব্যাঙ্গালুরু্র পুলিশ কমিশনার বি দয়ানন্দ সহ একাধিক আইপিএস অফিসারকে বরখাস্ত করেছে এবং কর্ণাটক ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসনিক কমিটি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। এই ঘটনায় রাজনৈতিক দোষারোপের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে এটিকে "ভিড় ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতা" বলে অভিহিত করেছে।
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া কুম্ভের তুলনা টেনে বল্যছেন, “এই ধরনের ঘটনা অনেক জায়গায় ঘটেছে। কুম্ভমেলায় ৫০-৬০ জন মারা গিয়েছিলেন। তবে আমি সেই ঘটনার সমালোচনা করিনি”
এই ঘটনা আমাদের সাম্প্রতিক অতীত এর কয়েকটি স্মৃতি উস্কে দেয়।
কুম্ভ মেলা ২০২৫, পদপিষ্ট হয়ে নিহত ৩০ জন, সরকারি হিসেবেই কমপক্ষে ৬০ জন আহত
দিল্লি স্টেশন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মহাকুম্ভে যাওয়ার পথে নয়া দিল্লি স্টেশনে হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হল কমপক্ষে ১৮ জনের। আহত শতাধিক।
হাথরস, জুলাই, ২০২৪ । উত্তর প্রদেশে হাথরস জেলায় এক প্রখ্যাত ধর্মগুরুর কাছে যাওয়ার চেষ্টায় হুড়োহুড়ি শুরু হয়। পরে সেখানে পদদলনে অন্তত ১২১ জন মানুষ মারা যান।,
তারও আগে থেকে ধর্মীয় আয়োজন বা কোনও সমাবেশকে ঘিরে ভারতে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ পদদলনের ঘটনা রয়েছে। দেশটিতে গত ২০ বছরে মর্মান্তিক পদদলনের ঘটনাগুলো তালিকাবদ্ধ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
স্থান |
সময় |
নিহত, আহতের সংখ্যা |
কারণ |
মান্ধারদেবী মন্দির মহারাষ্ট্র
|
জানুয়ারি, ২০০৫ |
নিহত ২৬৫, আহত শতাধিক |
রাস্তায় পা হড়কে পদদলনে |
হিমাচল প্রদেশের নয়না দেবী মন্দির |
অগস্ট, ২০০৮ |
১৪৫ জন |
ভূমিধসের গুজবে পদপিষ্ট |
রাজস্থানের চামুণ্ডাগর মন্দিরে |
সেপ্টেম্বর, ২০০৮ |
২৫০ জন |
নবরাত্রি উদযাপনে পদপিষ্ট হয়ে |
উত্তরপ্রদেশের হিন্দু মন্দির |
মার্চ ২০১০ |
৬৩ জন, শিশু সহ |
বিনামূল্যে খাবারের ভিড়ে পদপিষ্ট
|
মধ্যপ্রদেশের রতনগড় মন্দিরে |
অক্টোবরে ২০১৩ |
১১৫ জনের শতাধিক আহত |
নবরাত্রি উদযাপন |
মুম্বাইয়ের প্রভাদেবী রেলওয়ে স্টেশন |
সেপ্টেম্বর ২০১৭, |
২৩ জন |
ওভার ব্রিজ এ ধাক্কাধাক্কি তে |
জম্মু ও কাশ্মীরের বৈষ্ণোদেবী মন্দির |
জানুয়ারি, ২০২২ |
১২ জনের মৃত্যু |
বিশাল ভিড়ে পদপিষ্ট |
অন্ধ্রপ্রদেশে একটি মন্দিরে |
জানুয়ারি, ২০২৫ |
৬ জন মৃত, ৩৫ আহত |
বিনামূল্যে দর্শনের ভিড় |
গো য়া , শিরগাই মন্দির |
৩রা মে, ২০২৫ |
৬ জ্ন, শতাধিক আহত |
বিশাল ভিড়ে পদপিষ্ট |
বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ মহাকুম্ভ মেলা অতীতেও পদপিষ্টের ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। ১৯৫৪ সালের প্রথম কুম্ভমেলা থেকে ২০২৫, তালিকাটা খুব একটা ছোট নয়। সরকারি মতে ১৯৫৪ সালের প্রথম কুম্ভমেলাতেই ৮০০ লোক পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন। তার পর ১৯৮৬ সাল হরিদ্বারে, ২০০ জন। ২০০৩ সালে নাসিকে ৩৯ জন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। ২০১০ সালে হরিদ্বারে ১৪ এপ্রিল ‘শাহী স্নান’ –এর পদপিষ্টে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৩ সালে মেলাপ্রাঙ্গণে নয়, এলাহবাদ স্টেশনে ব্রিজের রেলিং ভেঙে পড়ায় ৪২ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন পদপিষ্টের ঘটনায় ও আহত হয়েছিলেন অন্তত ৪৫ জন।
বিগত ২৫ বছরের ইতিহাসে এরকম পদপিষ্টের সংখ্যা হিসেব করলে নিহত প্রায় দশ হাজার এবং আহত লক্ষাধিক হবে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এভাবে সমূহ মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। দেশে এমন দুর্ঘটনা ও প্রথম নয়। এর আগেও ধর্মস্থানে ভিড় বা অন্য কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেনকখনও বৈষ্ণোদেবী, কখনও লোকনাথধাম—পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ফি-বছর লেগে রয়েছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার আসল কারণটি কী? শুধুই কি প্রশাসনিক গাফিলতি? নাকি উন্মত্ত জনতার অনিয়ন্ত্রিত আবেগ?
এক কথায় বলতে গেলে এই ধরনের দুর্ঘটনা শুধুমাত্র প্রশাসনিক অ-ব্যবস্থাপনার ফল নয়, এর পিছনে কাজ করছে হিংসা আর উন্মাদনা উসকে দেওয়া রাজনীতি এবং সেলিব্রিটি উপাসনার সমসাময়িক ব্যাধি যার উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন সভ্যতার সূচনা থেকেই উপজাতি যোদ্ধাদের মধ্য দিয়ে। মানুষের জৈবিক বিবর্তনের ভিত্তিই হল এমন কোনও কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যা জাগতিক এবং সাধারণের ঊর্ধ্বে বলে মনে হয়। অতীন্দ্রিয় বোধের কারনে সে সহজেই এমন কিছুতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে যা নিজের চেয়ে উচ্চতর বলে মনে করে। প্রাচীনকালের রোমান কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের জন্য উল্লাস করা উন্মত্ত দর্শকদের থেকে বর্তমান উন্মত্ত প্রজন্ম সবাই “হিরো” বা “ব্যাক্তি” বা সেলিব্রিটি উপাসনার অনুরূপ এবং এই সেলিব্রিটি আবেগই সামাজিক সম্পর্ককে গড়ে তুলছে এক নতুন মোড়কে যেখানে জীবন-সংগ্রামে প্রতিদিন পিষ্ট হওয়া অফিস কর্মী বা দরিদ্র শ্রমিক কিংবা সেলস বয় নয়, সাধারণ মানুষের কুয়াশাচ্ছন্ন জীবনের বদলে কেবল তারকার ঝাঁ চকচকে লাইফস্টাইলই জায়গা করে নেয় ভক্তদের মনের অন্দরে। সেলিব্রিটিরা তাদের দুর্দান্ত কৃতিত্ব, ক্যারিশমা নিয়ে সাধারণ মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাগালের বাইরে তাদের একমাত্র নায়ক হয়ে ওঠেন এবং জনগণ তাদের খ্যাতির দ্বারা সম্মোহিত হয়ে এই সত্যটি ভুলে যায় যে সেলিব্রিটিরা ও অসম্পূর্ণতা এবং দুর্বলতা সহ সাধারণ মানুষ, পিচের ভিতরে এবং বাইরের বিরাট কোহলির স্বত্তা মিশে যায় ভক্তদের মনের স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অঞ্চলে।
আমেরিকান সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল জে. বুরস্টিন বলেছিলেন, “The hero created himself, media created the celebrities” অর্থাৎ নায়ক নিজেই নিজেকে তৈরি করেছেন, মিডিয়া সেলিব্রিটি তৈরি করেছে, সেটির সত্যতা বোঝা যায় আজকের তরুণ প্রজন্মকে দেখলে। সুনীল গাভাস্কার, লতা মঙ্গেশকার বা জাকির হোসেনের ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা কম ছিলনা কিন্তু গণমাধ্যম এতটা পণ্যনির্ভর ছিলনা। শতাব্দীর শুরু থেকে বিশেষত প্রথম দশকের পরে সেলিব্রিটি শব্দটি একটি আমূল পুনর্নির্ধারণের মধ্য দিয়ে গেছে। ফেসবুক, টিকটক, ইউ টিউবে, ইনস্টা-এর লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কেউ সেলিব্রিটি বা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। বতমান যুগে ধর্মীয় ভাবাবেগ কে কাজে লাগিয়েও সোশ্যাল মিডিয়া তে জায়গা করে নিচ্ছেন ধর্মগুরুরাও এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানও ভক্তদের এই অতিরিক্ত অতিরিক্ত উৎসাহ ও আবেগের জন্য ভিড়ের মধ্যে আরও বেশি ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়। সেলিব্রিটিরাও এই আবেগকে পুরোপুরি কাজে লাগান, যার ফলে লক্ষ লক্ষ লোক তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করে এবং তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরজীবী সম্পর্কের মত ভক্ত অনুসারীদের ব্যক্তিগত জীবন, অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে যায়। ধনী সেলিব্রিটির ডোপামাইন প্ররোচনায় অনুসারীরা এই ভেবে বিভ্রান্ত হন যে জীবনের এক এবং একক উদ্দেশ্যই হল গ্ল্যামারাস এবং নির্দোষ নিখুঁত ত্রুটিহীন দেহের অধিকারী হওয়া, ট্রেন্ডিং নিখুঁত ইনস্টাগ্রাম মুখ দেখে ভক্তরা এমন প্রভাবিত হন যে তারা যে সেলিব্রিটিদের উপাসনা করে আত্ম-পরিচয় থেকে বঞ্চিত পরোক্ষ পরজিবী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, দৃশ্যমান থাকে, এক স্বপ্নময় জীবনদর্শন। তারা বুঝতেও পারেন না যে এই অনুষ্ঠানগুলি তৈরি করা হয় সুধুমাত্র ফ্যান ফলোয়ার দের উপর এবং তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে এবং তাদের অজান্তেই তারা তাদের দুর্বলতা বিক্রি করে বসেন মঞ্চে, মাঠে বা রূপালী পর্দায় সেলিব্রিটি ব্যক্তিত্বদের শুধুমাত্র একবার কাছ থেকে দেখার জন্য বা তাদের হাত নাড়ানো দেখার জন্য, বা একবার তাদের ছোঁয়ার জন্য এবং তখনই সব বাধা ভেঙ্গে ঘটে যায় বিপত্তি, দুর্ঘটনা এবং তারা নিজেরাই নিজেদের মৃত্য ডেকে নিয়ে আসেন এই মরীচিকার ফাঁদে।
ভারতের মত এত বড় ১৫০ কোটি জন সংখ্যার দেশে নিঃসন্দেহে এই ধরনের বড় সমাবেশ পরিচালনার জন্য আয়োজকদের যথাযথ পরিকল্পনা, ভিড় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং দায়িত্বশীল প্রশাসনের দরকার তবেই এরকম দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু শুধুমাত্র পরিকল্পনা এবং আরও ভাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও যতদিন সেলিব্রিটিকে ঘিরে এই মহাযজ্ঞ, মিথ গঠনের এই প্রক্রিয়া ও পুঁজিবাদী সেলিব্রিটি সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের অন্তঃচেতনায়, স্বপ্নে, আকাঙ্ক্ষায়, থাকবে ততদিন এই লাগামছাড়া উন্মাদনাও চলতেই থাকবে ও থেকে যাবে এই ভীড়ের রাজনীতি।
কিন্তু প্রশ্ন হল বাস্তবতা থেকে বিভ্রমকে আলাদা করে দেখিয়ে সংস্কৃতির “পণ্য” এই উন্মত্ততা তৈরির দায় কার? সাধারন মানুষের? না ভক্তদের? নাকি সমগ্র রাস্ট্রের ?