লাদাখের রোদটা কেমন জানেন? আমি যাইনি তবে শুনেছি ধারালো, কিন্তু ঠান্ডা। মনে রাখবেন ঠান্ডার দেশের ওই আলোয় কয়েকটা ক্ষ্যাপা দুপুরকে আপনি হাতে ধরতে পারেন না—তার আগেই আলোর ধার কেটে যায় বরফের প্রান্তে। এই আলোর ভেতরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সোনাম ওয়াংচুক—শিক্ষা-উদ্ভাবক, পরিবেশকর্মী, সাম্প্রতিক কালে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। যেদিন থেকে লাদাখ আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলো, পুরোনো রাজ্য-বন্ধন কেটে গেল, সেদিন থেকেই লাদাখের মানুষের মধ্যে একটা রক্তচাপ তৈরি হয়েছে—রাজ্য মর্যাদা, জনসংখ্যার সুরক্ষা, ‘সিক্সথ সিডিউল’-এর মতো সাংবিধানিক বলয়। এই চাপের সূচকটা গত ২৪ সেপ্টেম্বর ফেটে যায়—লেহ-র রাস্তায় দাবির ঢেউ, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, আগুন, আতঙ্ক, আর অন্তত চারটি মৃত্যু। সন্ধে নামার আগেই কারফিউ, আর ইন্টারনেট বন্ধ।
তার দু’দিন পর, ২৬ সেপ্টেম্বর, পুলিশ ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করে—যে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি যাচ্ছিলেন, সে পথে। অভিযোগ, তাঁর উসকানিমূলক বক্তব্যে ভিড় উত্তেজিত হয়েছে, সহিংসতা বেড়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সাসপেন্ড রাখার কথাও নিশ্চিত করা হয়। একদিকে আগুনে ধরে যাওয়া গাড়ি, অন্যদিকে ক্ষুব্ধ তরুণেদের স্লোগান—এই দুইয়ের মাঝখানেই বলা হলো, “দাঙ্গা উসকে দেওয়া হয়েছে।”
কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়, বরং এখান থেকেই গল্প শুরু হলো। গ্রেপ্তারের পর ওয়াংচুককে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা এনএসএ-র আওতায় আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—মানে এটা ‘প্রিভেন্টিভ’ আটক, স্বাভাবিক জামিনের পথ নেই। আইনটা যেভাবে কাজ করে, তাতে বিচার করার আগে বা কোন কিছু প্রমাণের আগেই আটক করে রাখার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকে। এই আইনের প্রয়োগ নিয়েই আজ প্রশ্ন উঠছে—রাষ্ট্র কি সত্যিই সুরক্ষা দিচ্ছে, নাকি কণ্ঠস্বর চেপে দিচ্ছে?
একই সময়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত সংগঠন এসইসিএমওএল-এর বিদেশি অনুদান গ্রহণের লাইসেন্স বাতিল করা হলো। সংগঠনের অক্সিজেন কমে গেল একদম। দাবিগুলো যত জোরালো হলো, প্রশাসনের কাঁচি তত গভীর হলো।
এরপর শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। লেহ থেকে সরাসরি সোনাম ওয়াংচুককে নিয়ে যাওয়া হলো জোধপুর সেন্ট্রাল জেলে। পাহাড়ের মানুষকে বন্দি করা হলো সমতলের এক কড়া নিরাপত্তা বলয়ে। উচ্চ প্রোফাইল কয়েদিদের তালিকায় নতুন নাম যোগ হলো। সলিটারি সেল, সিসিটিভি নজরদারি—যেন তাঁর চারপাশে একটা দৃশ্যমান খাঁচা। পাহাড়ের কণ্ঠস্বরকে দূরে, আলাদা করে রাখা হলো।
এ সময়েই আরেকটি কাণ্ড ছড়িয়ে পড়ল সোশ্যাল মিডিয়ায়। একটা ভিডিও, যেখানে দাবি করা হলো—গ্রেপ্তারের নির্দেশ রাজনৈতিক। পরে সরকারি তথ্য যাচাই জানাল—ওটা ভুয়ো। আজকের রাজনীতিতে মিথ্যেই অনেক সময় সত্যের পোশাক পরে হাজির হয়। ফলে তথ্যের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
ওয়াংচুকের পরিবার বলছে—সব অভিযোগ নিছক অপপ্রচার। স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো সরাসরি লিখেছেন, এটা গণতান্ত্রিক অধিকারের শ্বাসরোধ। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন—যিনি আজীবন অহিংস আন্দোলনের কথা বলেছেন, বরফ দিয়ে জল বাঁচিয়েছেন, শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্ভাবন এনেছেন, তিনি হঠাৎ কীভাবে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ হয়ে গেলেন?
সরকারি বক্তব্যও এসেছে—“বিশ্বাসযোগ্য কারণেই” তাঁকে আটক করা হয়েছে। সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই অগ্রাধিকার। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যুক্তি পরিষ্কার। কিন্তু নাগরিকের দৃষ্টিতে প্রশ্ন—এই যুক্তিগুলো কেন বারবার সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়?
এখন বড় ছবি দেখা দরকার। লাদাখের দাবি—রাজ্য মর্যাদা, স্থানীয় চাকরির কোটার নিশ্চয়তা, সিক্সথ সিডিউল—সবই আসলে সম্পদ আর পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ের সঙ্গে বাঁধা। পাহাড়ে জল মানে জীবন। পর্যটনের অনিয়ন্ত্রিত দাপট মানে পরিবেশের ক্ষয়। এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তির পথ শুধু প্রশাসনিক কাগজ নয়, সাংবিধানিক সুরক্ষা। আর সেই দাবি সামনে নিয়ে এসেছেন ওয়াংচুক। স্থানীয়দের চোখে তিনি “আমাদের লোক।”
এখানে এনএসএ-এর প্রয়োগ সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কণ্ঠস্বরকে প্রমাণ আর আলোচনার মাধ্যমে সামলানো উচিত। প্রিভেন্টিভ আটক হয়তো রাষ্ট্রকে সময় দেয়, কিন্তু জনগণকে প্রশ্ন করার অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আইন যতই কঠোর হোক, তা যদি স্বচ্ছ না হয়, তবে তার প্রতি আস্থা কমে যায়।
সব কিছু মিলিয়ে যে তথ্যগুলো এখন নির্দিষ্ট করে ধরা যায়, তা হলো—২৪ সেপ্টেম্বরের লেহ-র বিক্ষোভে মৃত্যু, কারফিউ, ইন্টারনেট স্থগিত—সব সত্য। ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারও সত্য। এনএসএ-তে আটক সত্য। জোধপুর জেলে স্থানান্তরও সত্য। সংগঠনের অনুদান লাইসেন্স বাতিল সত্য। সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও ভুয়ো, এটা সরকারি যাচাই বলেছে। বাকি সবই এখন বিচার ও তদন্তের বিষয়।
এখানেই একটা নৈতিক প্রশ্ন থেকে যায়। পাহাড়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপ অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়। প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। রাষ্ট্র কি শুধুই দেখা দেবে, নাকি শুনতেও চাইবে?
পরিশেষে বলতে ইচ্ছে করে—বরফে জমে থাকা জল শীতে ঠেকানো যায়, কিন্তু গরমকালে সেটা গলবেই। নদী হয়ে বেরোবে। মানুষের কণ্ঠস্বরও তাই—আপনি তাকে যতই আটকে রাখুন, সেলে বন্দি করুন, সে ভেতরে ভেতরে জমে থাকবে। কিন্তু ঋতু পাল্টালে একদিন সে বেরোবে। তখন আর শুধু গলা নয়, তা হবে স্রোত।
আর প্রতিবাদ? সেটা হলো সোজা হয়ে দাঁড়ানো। তথ্য যাচাই করা। মিথ্যেকে চিহ্নিত করা। আদালতের দরজায় কড়া নাড়া। আলোচনার টেবিলে চেয়ার টেনে বসা। পাহাড়ের মানুষ বলছেন—অধিকার কেউ উপহার দেয় না, দাবি করে নিতে হয়। আর সেই দাবি যতবার দমন করা হয়, ততবার নতুন স্রোত তৈরি হয়।
আজকের দিনে সোনাম ওয়াংচুক শুধু এক বন্দি নন, তিনি এক পরীক্ষার নাম। পরীক্ষাটা রাষ্ট্রেরও—কীভাবে আইন প্রয়োগ করবে। পরীক্ষাটা জনগণেরও—কীভাবে নিজেদের কণ্ঠস্বর রক্ষা করবে। বরফ জমছে, জল গোপনে গান গাইছে। একদিন সেই গান পাহাড় ছাপিয়ে সমতলেও পৌঁছাবে। তখন আমরা সবাই শুনব এবং পারস্পরিক কথা বলব। কারণ কথা না বললে বোঝা যাবে না—কে সঠিক আর কে ভুল। দূরে সরে গেলে বোঝা যাবে না, রাষ্ট্রের ভাষা সঠিক ছিল, না জনগণের ভাষা। তাই সোনম ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারিই এখন সেই পরীক্ষাগারে বন্দী।