পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভাষা ব্যাকরণের ‘পুরুষ’ এবং আমরা

  • 09 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1245 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
ভাষা ব্যাকরণের উদাহরণ টেনে মাঝে মাঝেই বলা যায় কিছু কথা, পুরুষ তিন প্রকার। আমি, আমরা, আমাদের- এসব হল উত্তম পুরুষ। (ইংরেজিতে First Person)। তুমি, তোমরা, তোমাদের- হল মধ্যম পুরুষ (Second Person)। আর সে, তাহারা, তাহাদের- হল প্রথম পুরুষ। (অর্থাৎ Third Person)।

কয়েক বছর আগে একটি বিখ্যাত সংবাদপত্র গোষ্ঠীর দেওয়া খুব নামি পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। গ্রাণ্ড ওবেরয় হোটেলে। কয়েকশো জন আমন্ত্রিতদের মধ্যে সম্ভবত আমি একা পায়ে হেঁটে ঢুকেছিলাম ওই বিখ্যাত হোটেলে। খ্যাত অখ্যাত আর যাঁরা আমন্ত্রিত ছিলেন, প্রায় সকলেই গাড়ি চড়ে প্রবেশ করেছিলেন।

যাইহোক, অনুষ্ঠান শেষে দরবার হলে রইস-ই নাস্তাপানি সহ কফি পান করে আমি একা হেঁটে হেঁটে গিয়ে উঠেছিলাম বেশ ক্ষানিকটা দূরের হোটেল ব্রডওয়ের পানশালায়। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন আমার দুই বন্ধু।

কথাপ্রসঙ্গে আমি সেই বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা- এই যে এত মানুষের আপ্যায়নে এত খরচ! এসব না করে সেই অর্থ উদ্যোক্তারা যদি লেখকের প্রাপ্ত পুরস্কার মূল্যের সঙ্গে জুড়ে দিত তাহলে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের সংসারের হাল ফিরত না কি?

এক বন্ধু বলেছিল, হয়ত ফিরত। কিন্তু উদ্যোক্তারা সেটা করবে না।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন?

বন্ধুটি বলেছিল, তাহলে যে লোক-দেখানো ব্যাপারটাই থাকবে না আর। এমন লোক-দেখানো ব্যাপারে যে একটা অশ্লীল আনন্দ থাকে। সচরাচর আমরা সেটা টের পাই না। কিন্তু বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি।

প্রসঙ্গটি মনে পড়ল এই করোনাকালে মদের দোকান খোলাকে নিয়ে। তা নিয়ে চলছে তর্কবিতর্ক। ঠিক না বেঠিক। সংবাদ চ্যানেলগুলি মদের দোকানের সামনের ভিড়, হুড়োহুড়ি, পুলিশের লাঠি চালানো দেখাচ্ছে। শুধু দেখাচ্ছে না, অভিভাবক হয়ে প্রশ্ন করছে। এসব দেখে কেউ রাগছে। কেউ বিবেকের যন্ত্রণায় নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ বা আবার নিদান দিচ্ছে। যারা মদের দোকানে লাইন দিচ্ছে পারলে তাদের যেন রেশন-পানি বন্ধ করে দেয়। এমনকি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলে আপত্তি তো দূরের কথা, তারাও হয়ত নিজেরাই খুশিতে দু-পেগ মদ গিলে উল্লাসে মেতে উঠবে।

হ্যাঁ, এরাই হচ্ছে জনগণ। এরা ইতিহাস ভুলে যায়। রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন। পুলওয়ামায় যখন নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গী হামলা হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ফিল্ম স্যুটে ব্যস্ত ছিলেন। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে ইতিহাসের পাতায়। কেউ মনে রাখে না। মনে রাখার চেষ্টাও করে না। তাই তো এই করোনাকালে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বাড়াতে কেউ যখন থালি বাজায়, মোমবাতি জ্বালায়, হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালের ছাদে ফুল ছড়ায়, ঠিক তখনই আবার কেউ নিজের বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়া ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের উচ্ছেদ করে।

ঠিক একই ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে থাকা এক শ্রেণির মানুষকে উড়োজাহাজে উড়িয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। সাংসদ-পত্নী উড়জাহাজে বসে বাড়ি ফিরে আসেন সেলফি তুলতে তুলতে। অথচ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের বেনাহাক ভুলে থাকে। কেউ মনে করিয়ে দিলে রাষ্ট্র ওই অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে রেলভাড়া দাবি করে। সত্য সেলুকাস- কী বিচিত্র আমার এই দেশ!

তা বাদেও লকডাউন মেনে সাধারণ মানুষ যখন পেটে কিল মেরে আতঙ্কে ঘরে বসে দিন গুজরান করছে তখন নেতা, মন্ত্রী, আমলারা নিজেদের বাড়িতে বাড়িতে জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, নামকরণ, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ছাড়াও আরও কত রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে- তার ইয়ত্তা নেই। শুধু সাধারণ মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা অসুস্থের জন্য ওষুধ ক্রয় করতে রাস্তায় বেরোলে রাষ্ট্র সজাগ হয়ে উঠছে। তাদের ওপর রাষ্টের পুলিশ লাঠি চার্জ করছে। উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে থানায়। কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে অভিবাসী শ্রমিকেরা হয় দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে দম বন্ধ হয়ে কিংবা ট্রেন চাপা পড়ে মারা পড়ছে। তবু প্রশ্ন, কী দরকার মদের দোকান খোলার? কী প্রয়োজন রাস্তায় বেরনোর? কী বাড়িতে ফিরে আসার?

এই সব কিছুর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের ভাষা ব্যাকরণে। আমার আব্বা ভাষা ব্যাকরণের উদাহরণ টেনে মাঝে মাঝেই বলতেন, পুরুষ তিন প্রকার। আমি, আমরা, আমাদের- এসব হল উত্তম পুরুষ। (ইংরেজিতে First Person)। তুমি, তোমরা, তোমাদের- হল মধ্যম পুরুষ (Second Person)। আর সে, তাহারা, তাহাদের- হল প্রথম পুরুষ। (অর্থাৎ Third Person)।

তখন আব্বার কথা বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমাদের যত সমস্যা এই Second Person আর Third Person-দের নিয়ে। বাজারে ভিড় করলে এরাই করছে। মদের দোকান খুললে এরাই বেলেল্লার মতো লাইন দিচ্ছে। এদের জন্যই করোনাকে আটকানো যাচ্ছে না।

আসলে সবটাই হচ্ছে ভাষা ব্যাকরণের ওই ‘পুরুষ’ কা খেল-এর ব্যাপার। কে জানে হয়ত সেদিনের বলা বন্ধুর কথাই ঠিক- “ এমন লোক-দেখানো ব্যাপারে যে একটা অশ্লীল আনন্দ থাকে। সচরাচর আমরা সেটা টের পাই না। কিন্তু বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। ”

0 Comments

Post Comment