পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সাঁওতাল দার্শনিক কলেয়ান মুর্মু প্রথম পর্ব

  • 03 July, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 2068 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
১৮৫৫ সালেই যে সাঁওতাল হুলের সূচনা তা নয়, এর আরও ৭৫ বছর আগে ১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মুরমু (যিনি তিলকা মাঞ্জহী নামে পরিচিত)-র নেতৃত্বে শোষকদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল গণসংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথম সাঁওতাল মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৭৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর তিরের আঘাতেই ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁর ফাঁসি হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১১ সালে বিভিন্ন সাঁওতাল নেতার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার সাঁওতাল গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।

সিন্ধু ঘাটিরে বাবা রে রিয়াএ লা, মহনজুদরো হরপা ঘাটিরে বাবা রে রিয়াএ লা...
এই গানের অর্থ হল কোথা থেকে আর্তচিৎকার আর কান্নার শব্দ আসছে -- সিন্ধু উপত্যকা, মহেনজোদারো, হরপ্পা উপত্যকা থেকে আসছে ওই কান্নার রোল। হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসী সমাজ সিন্ধু উপত্যকার কান্না নিয়ে প্রচলিত গানটি গেয়ে থাকে। অনার্য সিন্ধু সভ্যতার ওপরে আর্যদের আক্রমণ এবং যুদ্ধের কথাই বলা হয়েছে ওই গানে।
হুলের ইতিবৃত্ত লিখেছেন যে মহান মানুষটি, সেই কলেয়ান গুরুর বয়ান থেকে উঠে এসেছে এমন কথা। হুল কী?
হুল কথার আসল অর্থ হল শান্তিপূর্ণ আলোচনা। ক্রমে তা দ্রোহে পরিণত হয়েছে। হুল হল ধনুকের হুল। আবার হুল মানে হোম করা।
১৮৫৫ সালেই যে সাঁওতাল হুলের সূচনা তা নয়, এর আরও ৭৫ বছর আগে ১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মুরমু (যিনি তিলকা মাঞ্জহী নামে পরিচিত)-র নেতৃত্বে শোষকদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল গণসংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথম সাঁওতাল মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৭৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর তিরের আঘাতেই ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁর ফাঁসি হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১১ সালে বিভিন্ন সাঁওতাল নেতার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার সাঁওতাল গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
১৮৫৫-৫৬-র বেশ কিছু কাল পর, ১৮৭১ সালে ইংরেজরা আইন বানিয়েছিল। আদিবাসীদের, অরণ্যবাসীদের অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল আইনীভাবে। মধ্য ও পূর্ব-মধ্য ভারতের বন-জঙ্গলে আদিবাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। ওই ভূমিপুত্রদের সমস্ত অধিকার কেড়ে অরণ্যের অধিকার আইনীভাবে তুলে দেওয়া হল ঠিকাদার-দালাল আর জমিদারদের হাতে, অরণ্যবাসীরা যাদের ‘দিকু’ বলে ডাকতো। জনজাতিরা কিন্তু তাঁদের অধিকার ছাড়লেন না। এখানে বলা দরকার, লর্ড মেয়ো ১৮৭১ সালে ওই আইন করেন। কয়েক দিন পর বন্দিদের কিছু সমস্যা মেটাতে লর্ড মেয়ো আন্দামানে গেলে শের আলি আফ্রিদি নামের এক কয়েদী বড় লাট মেয়োকে হত্যা করেছিল। হুলের পরেও জারি ছিল লড়াই।
১৮৯৫ সাল। আরম্ভ হল উলগুলান। এলগিন তখন বড় লাট। জনজাতি বিদ্রোহ শুরু হল। বীরসা মুণ্ডা তার নেতা। শাসকের গুলি আর অরণ্যবাসীর তীর-ধনুকে উলগুলান তখন সর্বত্র। অকথ্য অত্যাচার চলতে লাগলো বিদ্রোহীদের উপর। বীরসা মুণ্ডা ধরা পড়লেন, তাঁর ফাঁসি হল।
২০০৬ সালে মনমোহন সরকার আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার ফেরত দেওয়ার নিমিত্ত আইন তৈরি করে। এটি কোনও দয়া বা দাক্ষিণ্য ছিল না। কারণ সরকার বুঝেছিল, অরণ্যের সংরক্ষণ একমাত্র ভূমিপুত্রদের দ্বারাই হতে পারে। শুরু হয় পাট্টা দেওয়া। অনেকেই সেই পাট্টার আবেদন করেননি বা করতে পারেননি।
বন্যপ্রাণপ্রেমীদের কয়েকটি সংগঠন অরণ্যের অধিকার নামক আইনের বৈধতা নিয়ে অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টের মামলা করে। জঙ্গলের জমিতে চাষবাস করার জন্য যাদের পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে, তাদের উৎখাত করারও দাবি জানানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির শুনানিতে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের ১৬টি রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে, পাট্টার আবেদন খারিজ হওয়া পরিবারগুলিকে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে উৎখাত করতে হবে। এর জেরে ১০ লক্ষ বনবাসী (এখন শোনা যাচ্ছে, ২৩ লক্ষ) পরিবারের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এর কোনও বিরুদ্ধতা না করে বুঝিয়ে দিল যে এই সরকার আসলে জলা-জঙ্গল-জমি সব দিকু তথা আম্বানীদের হাতেই তুলে দিতে চায়। এই জন্য কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে বোবা দর্শক হয়ে রয়েছে।
আমাদের দেশে অরণ্যের যা পরিমাণ তাতে সমস্ত ভূমিপুত্র ও কন্যাদের বাসস্থানের জন্য মাত্র ২ শতাংশ জঙ্গলই পর্যাপ্ত। কিন্তু ওই আদিবাসীরা বনে বাস করলে বন সুরক্ষিত থাকবে। আদানি আম্বানিদের মতো দিকুরা তা চায় না। রাজার যজ্ঞে এত গরীবের রক্ত আর পুষ্টি খেয়ে তাদের অগ্নিমান্দ্য রোগ দেখা দিয়েছে। তাই ওই দিকুরা এখন অরণ্য সাফ করতে চায়। মহাভারতে খাণ্ডব দহনের কথা মনে পড়তে পারে।
এই হুল বা বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় সিপাহী বিদ্রোহ থেকে তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সেই একই চেতনা কাজই করেছে সব আন্দোলনে—অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ। লড়াইয়ের ফলে সাঁওতাল তথা আদিবাসিদের জমি হস্তান্তরের ব্যাপারে যে অধিকার তাঁরা পেয়েছিলেন এখন অবশ্য তা প্রতি পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাঁদের খাদ্যাভাসের উপর আঘাত নেমে এসেছে। আদিবাসিদের জমি অধিকার করে চলছে রিসোর্ট ও আমোদ ফূর্তির ব্যবসা। সেখানে সাঁওতাল কিশোরটি দৈনিক অল্প পয়সার বিনিময়ে বাবুদের ফাইফরমায়েশ খাটে, মেয়েরা সন্ধ্যা হলে নাচতে যায়। তাই আদিবাসি গ্রামগুলোয় গেলে দেখা যায়, তাঁরা রাগে ফুঁসছেন! এই কি তবে হুলের ফলাফল! এখন আবার আসছে এনার্সি, আর এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কা। যেহেতু সাঁওতাল অথা আদিবাসীরা হিন্দু নন, ফলে নাগরিকত্ব আইনের প্যাঁচেও পড়বেন তাঁরা।
হুলের যে চেতনা, তার যিনি কাণ্ডারী সেই কলেয়ান গুরুর কথা কিছু বলা দরকার।
মানভূমের প্যাণ্ডরা নামক এলাকার পাবেয়া গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। এখন ধানবাদ জেলার মধ্যে পড়ে। তিনি ছিলেন সিধু কানুদের গুরু। তাই তাঁকে সকলে কলেয়ান গুরু বলে। তাঁর আসল নাম কলেয়ান হাড়াম বা কলেয়ান মুর্মু। সাঁওতালদের অন্যতম প্রধান দার্শনিক তিনি। পাশাপাশি কলেয়ান গুরু ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসের লিপিকার এবং সাঁওতালদের গুরু। তিনি তাঁর "হড়কোড়েন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কথা" শীর্ষক একটি রচনায় সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত রেখে গেছেন। এই ইতিবৃত্তে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু ও কানুর সংগ্রাম-ধ্বনি, যথাঃ "রাজা-মহারাজাদের খতম করো", "দিকুদের (বাঙালি মহাজনদের) গঙ্গা পার করে দাও", "আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই" প্রভৃতি লিপিবদ্ধ আছে।

স্কেচ: দামা সোরেন

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন ঃ https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/a-santhal-philosopher-kaleyan-murmu-part-ii

0 Comments

Post Comment