পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লাল গোপালের গোমন!

  • 06 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 952 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
খবরটা শুনে চটাদার কাছেই প্রথম ছুটে গেলাম। অনেক কাল ধরেই রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, এদিক ওদিক মতামত দিচ্ছি, নানা রকম তর্কবিতর্ক শুনছি, নিজেও যেখানে যা পারি বলছি, কিন্তু সত্যিই বলছি, জীবনে এতটা ধাক্কা কখনও খাইনি। এর থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে, এর পেছনকার রহস্য উদ্ঘাটিত করতে ভূভারতে কেউ যদি পারে, সে শুধু চটাদাই পারবেন। প্রচুর অভিজ্ঞতা থেকেই এটা আমার দৃঢ় উপলব্ধি।

কোথায় যাব, ভাবতে বেশি সময় নিলাম না। এখন এই বেলা এগারোটা বাইশ মতলব ওনাকে ধনেশ চক্কোত্তি স্ট্রিটের পেয়ারাতলার মোড়ে তারুকাকার চা সিঙ্গারার দোকানের বাইরে গাছতলার নীচে পেতে রাখা একটা বাতিল ল্যামপোস্ট রূপী বেঞ্চেই পেয়ে যাব বলে নিশ্চিত জানি। অতএব সাইকেল নিয়ে সেদিক পানেই ত্বরিত রওনা দিলাম। অন্য আলোচনায় মজে যাওয়ার আগেই ধরতে হবে। নইলে হয়ত লাইনে দাঁড়িয়ে কম পক্ষে তিরিশ চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে আমার প্রশ্ন তুলবার জন্য।

কথাটায় বিশ্বাস করলেন না? দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞানের রহস্য এখন এই একটি লোকের আঙুলের ডগায়, কিংবা বলতে পারেন, মুখের ভেতরকার আলজিভে। আপনাকে শুধু দুটি কাজ করতে হবে। প্রশ্নটা রাখবার আগে তারুদার ঝুড়ি থেকে দুটো গরম সিঙ্গারা তুলে আনতে হবে জ্ঞান প্রাপ্তির মাশুল হিসাবে চটাদার হাতের নাগালের মধ্যে, সেই সঙ্গে চাও বলে আসতে হবে, হালকা চিনি যুক্ত লাল চা। আর তুরন্ত জিজ্ঞাস্য বিষয়টাকে নিবেদন করে ফেলতে হবে। দেরি করলেই আপনার নিবেদিত সিঙ্গারার বিনিময়ে অন্য কেউ জ্ঞানোপকৃত হয়ে যেতে পারেন। বহু লোক আমারই মতো চটাদার কাছে দৌড়ে আসেন বিপদে পড়লেই। প্লেটে সিঙ্গারা নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন।

বুঝতেই পারছেন, ঘনশ্যাম দাস আর সিধু জ্যাঠা—এই দুজনের অমরলোকে চলে যাওয়ার পরে আর কেউ নেই এখন ধরাধামে যিনি মানুষের অগুনতি কৌতুহল মেটাতে পারেন এত সস্তায়। যখন তখন। উত্তর তৈরিই থাকে। প্রশ্ন করাটাই যা বাকি! ফলে ভিড় তো হবেই।

যাক, বাঁচা গেল। দূর থেকেই দেখলাম, ফাঁকাই আছেন। আমি সাইকেল থামিয়ে নামতে না নামতেই দুই গাল হেসে বললেন, চলে এলি? তর সইল না? টিভিতে এখন ব্যাপক বাইটিং চলছে, আরও কিছুটা শুনে এলে পারতিস!

তুমি হাসছ বটে। আমার মনের অবস্থাটা ভেবে দেখেছ?

অমন সিঙ্কিয়ারা টানেলের মতো মন হলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনো দিক তো খোলা রাখিস না। খবর পবন ঢুকবে কোথা দিয়ে?

শুরুতেই ঝটকা। কী বললে? কাদের চ্যানেলের কথা বলছ?

চ্যানেল নয় রে কচি, টানেল। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর মোদী চারধাম টানেলের কথাও ভুলে গেছিস? তোরা থাকিস কোন দেশে?

ও হো! বুঝে গেছি। আমি তাড়াতাড়ি সাইকেলটাকে ছায়া দেখে দাঁড় করিয়ে তারুকাকার থেকে খান চারেক সিঙ্গারা ঠোঙায় ভরে নিয়ে এলাম। চটাদার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসলাম, তুমি মাঝে মাঝে এমন ঘাবড়ে দাও যে বলার নয়।

তুই আসলে আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে বিগড়ে আছিস। একটা অতি পেয়ারের লোক মোহনবাগানে সই করলে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার ছোকড়াদের যেমন রাগ হয় সেরকম আর কি! কী বল?

খোঁচাটা চুপচাপ হজম করে নিলাম। এখন অন্য কথায় গেলে হবে না। সটান জিগ্যেস করলাম, এরকম কেন হল, কিছু বুঝতে পেরেছ?

হল মানে? কবে হল? চটাদাও প্রশ্ন করছেন! কী মুশকিল। তবে একটা সিঙ্গারার হাফ মুখের গর্তে ঢোকাতে ঢোকাতেই।

এই আজ শুনে এলাম, উনি হুগলী নদীর ধার থেকে সরে গিয়ে হলদি নদীর ধারে বসতে চাইছেন।

তুই আজ শুনে জানলি। আমি তো সাত আট মাস আগে থেকেই জানতাম।

তুমি জানতে এমন করবেন উনি? আমার হাত একটা সিঙ্গারা তুলেও মাঝপথে আটকে গেল।

পুরো। শুধু আমি কেন, তোরও জানা থাকা উচিত ছিল।

কী করে জানব? আমি কি জ্যোতিষী নাকি?

আমি কী করে জানলাম? আমি কি তোর মতে আজকাল ঝোতিছিগিরি করি? জ যে ঝ-এর মতো আর ষ যে ছ-এর মতো শোনাল, তার জন্য অবশ্য তারুকাকাই দায়ী থাকবেন ভবিষ্যৎ ইতিহাসের কাছে।

আমিও নাছোড়, সেটাই তো বুঝতে চাই। তুমি অত কাল আগেই কীভাবে বুঝে গিয়েছিলে?

চটাদা বোধ হয় আমার উপর কিঞ্চিৎ সদয় হলেন, যা, চা নিয়ে আয়, বুঝিয়ে দিই। এ সবই অ্যালজেব্রা, বুঝলি, সিম্পল অ্যালজেব্রা। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইকোয়েল টু এ-স্কোয়ার প্লাস বি-স্কোয়ার প্লাস . . .

টু এবি—আমি বলে ফেললাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা কি এত সরল?

যদি অঙ্কটা জানিস, তবে একদম সরল। আর যদি এই মাত্র যেটা আমাকে বললি, সেটা আমাদের অন’বল পিএম-এর মতো হাথরাসে হাতড়ে বেড়াস, তবে গোলমাল হবে।

দেখ চটাদা, আমরা তোমার কাছে কঠিন জিনিসগুলোই বুঝতে আসি। তোমার কাছে হয়ত জলের মতো সহজ, আমার তো মাথায় ঢুকছেই না, এরকম একটা ঋজু চরিত্র, এতটা কড়া কড়া জাজমেন্ট যাঁর, তিনি সেই পদ্মগোখরোদের দলে গিয়ে নাম লেখাবেন এবং তার জন্য ছ মাস আগেই চেয়ার ছেড়ে দেবেন! এস-এস-সি প্যানেল নিয়ে ওনার যে অবস্থান, আজও ভাবলেই আমার শ্রদ্ধায় . . .

মাও সে-তুং কী বলেছেন জানিস? ও হো, তোরা তো আবার মাওকে একটু ট্যারা চোখে দেখিস, সরি সরি . . .

না না, ট্যারা চোখে দেখার কী আছে? বল কী বলছিলে।

মাও বলেছেন, শত্রু শিবির যখন আমাদের পক্ষে বলতে থাকে, বুঝতে হবে, আমরা ভুল পথে হাঁটছি। আর যখন আমাদের বিরুদ্ধে বলে, তখন বুঝতে হবে, আমরা ঠিক রাস্তায় আছি। শুনেছিস এই বচনটা?

শুনব না কেন? এক সময় তো এই সব কথা রাস্তায় ঘাটে লেখা থাকত। আমি রেগে গিয়ে বললাম, এই মন্তব্যের সঙ্গে আমাদের এখনকার ব্যাপারটার কী সম্পর্ক? আর উনিই বা আমাদের শত্রু হতে যাবেন কেন? উনি তো আমাদের পক্ষেই রায় দিচ্ছিলেন!

অর্থাৎ, লেনিন সাহেবের রাষ্ট্র ও বিপ্লব নামক বইটার কথাও তোরা বাষ্প করে দিয়েছিস। তাই না?

বা রে বা! কোথায় এস-এস-সি-র মামলা, আর কোথায় লেনিনের স্টেট অ্যান্ড রেভলিউশন! কী হল চটাদা তোমার? আজ কি একটা বেগুনিও দিতে বলব তারুকাকাকে?

তাহলে তোদের মার্ক্সবাদে আদালত এখন আর বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অঙ্গ নয়? বিচারকরা এখন শুধু ভালো আর মন্দ? জাজমেন্ট মানে শুধু আমাদের পক্ষে নয়ত আমাদের বিপক্ষে। সত্যিই, তুই কী সরল হয়ে গেছিস ভাই আমার! 

চটাদার এই খোঁচাটাও টুক করে গিলে নিতে হল। অসাবধানতা বশত একটা লুজ বল দিয়েছি, ছক্কা তো হাঁকাবেই। সিঙ্গারাটা পুরো খেতে একটু সময় নিলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে একটু ভেবেও নিলাম। চটাদার জ্ঞানগম্যিকে এক মুহূর্তের জন্যও তাচ্ছিল্য করা ঠিক হবে না। যুক্তি সাজায় না দাবা খেলে বলা কঠিন। এই সব সময়ে আমি দেখেছি, বিনয় খুব কাজে দেয়। সেভাবেই এগোলাম, বুঝতে পারছি, তুমি কী বলতে চাইছ। আমি অত শত ভেবে বলিনি কথাটা। শিক্ষার জগতে অত বড় একটা ক্যাচাল হয়ে গেল, কয়েকশ যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে কিছু লোক স্রেফ ঘুস দিয়ে চাকরি পেয়ে গেল, এই নিয়ে যখন মামলা হল, উনি এক একটা স্টেপে সিবিআইকে গাইড করে কত তথ্য উদ্ধার করে আনছিলেন, তখন আমার কিন্তু ভালো লেগেছিল। মার্ক্সবাদের তাত্ত্বিক কচকচিগুলো তখন মন থেকে সরিয়েই রেখেছিলাম। আর আমাদের মাথা তোমার মতো অত শার্পও নয়। ফলে . . .

বুঝতে পেরেছি। মার্ক্সবাদটা এখন তা’লে তোদের পার্টির মাসিক স্টাডি ক্লাসের ফ্লোরে আটক। ক্লাস থেকে বেরলেই মার্ক্সবাদও ফুরুৎ! তাই না?

আমি চুপ করে রইলাম। এখন চটাদাকে থামানো যাবে না। তবে এই গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তেই উনি ঠিক আবার ক্লাস নিতে শুরু করবেন: তোরা ভাবলি, তোদের অপোনেন্ট পার্টিকে এই সব চুরি দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে সরকার ফেলে দেবার মতো একটা পরিস্থিতি তৈরি করবি। দুর্নীতি মামলার জালে ছোট থেকে মাঝারি হয়ে বড় বড় বোয়াল ধরা পড়বে। তারপর কোনো একটা সময় তোরা রাজ্যপালের কাছে গিয়ে সরকার ফেলে দেবার সুপারিশ করবি। এরকম না?

মানতেই হল, আমরা অনেকেই এরকমই ভেবেছিলাম।

ফলে আদালতটা কাদের, ওখানে বিচার কাদের স্বার্থে হয়, এই সব তথাকথিত শ্রেণিবিচার আর তখন তোদের মাথায় কাজ করেনি, তাই না?

মৌনং সম্মতি।

ফলে ওনার জাজমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে ধেয়ে আসা কমেন্টগুলি আর লক্ষ করিসনি। ঠিক বলেছি না?

কমেন্ট? কোন কমেন্টের কথা বলছ?

তা’লে আমি ঠিকই ভেবেছি। শুনেই ভুলে মেরে দিয়েছিস। এই ধর, স্কুল চালাতে না পারলে আদানিকে দিয়ে দিন। বলেছিলেন না তোদের এই হুগলীর ধার?

হ্যাঁ, তা বলেছিলেন। মেনে নিতেই হল আমাকে একটু তেতো লাগলেও।

ইউপি থেকে বুলডোজার আনতে পরামর্শ দিয়েছিলেন—মনে আছে নিশ্চয়ই?

চুপ করে থেকে বুঝিয়ে দিলাম, এটাও আমার মনে পড়েছে।

এই সব বাণীগুলির কিছু মানে বুঝেছিলি? না, কিছুই খেয়াল করিসনি।

স্বীকার করতেই হল, এই সব মন্তব্যের উপরে কোনো গুরুত্বই দিইনি। বরং তখন মনে হয়েছিল, দুর্নীতি সম্পর্কে ওনার মনোভাব একেবারে অনমনীয়। বলেছিলেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন। কিসের শেষ কোন দিকের শুরু তা নিয়ে মাথাই ঘামাইনি।

আমি এই পেয়ারাতলায় বসে বসেই সেদিন আন্দাজ করেছিলাম, ইনি পায়ে পায়ে আদানির বিচরণ ক্ষেত্র, বুলডোজার রাজের কুম্ভ তীর্থের দিকে এগোচ্ছিলেন। অনেককেই আমি সেই সব দিনে সাবধান করে বলেছিলাম, দেখে নিস, ইনিও চূড়াদালতের সেই মহোদয়ের মতো পোস্ট রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট নিয়ে চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। তোদের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আবার সেই সুযোগে আমাকে দিয়ে হাওয়াই চপ্পলও চাটিয়ে নিয়েছিল! মনে আছে?

লজ্জা পেলাম। সত্যিই চটাদা এরকম সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন অনেক কাল আগেই। আমরা কেউই খুব একটা পাত্তা দিইনি। বরং আমাদের দলের দুচারজন কমরেড মাথা গরম করে চটাদাকে নাম ধরে ব্যঙ্গ করে যা-তা বলেছিল। আমিও যে তখন বাধা দিয়েছিলাম তেমন নয়। কেমন যেন একটু রাগই হয়েছিল চটাদার উপর।

চটকা ভেঙে গেল ওনার পরের কথায়। তবে আমারও বুঝতে ভুল হয়েছিল।

ভুল হয়েছিল? আপনার? কী ভুল?

আমি সত্যিই ভেবেছিলাম, পোস্ট রিটায়ারমেন্ট পদসঞ্চার হবে। অবসর গ্রহণের আগেই বেড়িয়ে পড়বেন, এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

এখন কী মনে হচ্ছে?

চটাদা বললেন, আসলে পার্লামেন্ট ভোট এসে যাচ্ছে। চেয়ারে বসে চেহারা দেখানোর পালা মোটামুটি শেষ। এখন আরও বড় কিছু করে দেখানোর তাগিদ—ইয়ে মানে—তোরা যে বলিস খিদে, সেটা প্রবল হয়ে উঠেছে।

নিজে থেকেই আরও দু গ্লাস চা নিয়ে এলাম কাকার কাউন্টার থেকে। তারপর গদগদ গলায় জিগ্যেস করলাম, কী করে এত দূর বুঝলে বল তো? যদি আপত্তি না থাকে . . .

আপত্তির কী আছে? চটাদা চায়ের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক মেরে বললেন, তোরা যেটাকে স্টাডিক্লাসে ফেলে আসিস, আমি আবার ওটা দিয়েই ঘটনাবলি বোঝার চেষ্টা করি। আবেগ যেদিকেই টানুক, অবজেকটিভ থাকার চেষ্টা করি। তাতেই এই সব কম বেশি ধরা পড়ে যায়!

সাইকেলের দিকে পা বাড়ালাম।

 

 

     

 

0 Comments

Post Comment