পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিধানসভা নির্বাচন ২০২১ ও নারী

  • 08 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 2462 view(s)
  • লিখেছেন : শতাব্দী দাশ
তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের ৫১% মহিলাদের। আর পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ভোটারের ৪৭% তাদের ভোট দিয়েছেন, যেখানে বিজেপিকে ৩৭%। ২০১৬ সালের বিধান সভা ভোটে নাকি তাদের প্রাপ্ত ভোটের ৫২% ছিল মহিলা ভোট, আর তখন নাকি পশ্চিমবঙ্গের ৪৮% মহিলা ভোটার তাঁদের ভোট দেন।

চেষ্টার খামতি ছিল না৷ মোদী-শাহ-নাড্ডা-আদিত্যনাথ জেলায় জেলায় গিয়েছিলেন। বিক্রি হচ্ছিলেন তাবড় সব নেতা-নেত্রী। প্রচুর টাকা ছড়ানো হচ্ছিল। জাতীয় সংবাদ মাধ্যমকেও প্রায় কিনে নেওয়া গেছিল। তবু মুখরক্ষা হল কই? বিধান সভা নির্বাচন সচরাচর হয় রাজ্য সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে। এক্ষেত্রে দীর্ঘ দশ বছরে যে অনাচার, দুর্নীতি, অপশাসন, বেকারত্ব ছিল না, তাও তো নয়। শাসক-বিরোধী ক্ষোভও তাই যথেষ্টই ছিল। অথচ ফল যখন বেরোলো, তখন দেখা গেল, প্রাক্তন শাসক দল প্রায় ৪৮% ভোট ও ৭৩% সিট দখল করেছে। এমনকি বামেরাও স্বীকার করলেন, ভোট হয়েছে বিজেপি-র পক্ষে বিপক্ষে, যদিও বিজেপি শাসক ছিল না, ২০১৬ সালে বিধান সভা নির্বাচনে সে প্রধান প্রতিপক্ষও হয়ে ওঠেনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে সে শাসকের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছিল মাত্র। নিজেকে বাংলার ত্রাতা হিসেবে সে প্রচারও করেছিল লাগাতার। কংগ্রেস ও বাম শাসন দেখা গেছে, তৃণমূল শাসনও দেখা গেল, এবার তাদের সুযোগ দেওয়া হোক 'সোনার বাংলা' গড়ার, এই ছিল তাদের দাবি৷ তাদের সজোরে প্রত্যাখান করা হল। নারীরা সেই প্রত্যাখ্যানে কী ভূমিকা নিলেন?

ভোটার সংখ্যার অনুপাত যদি দেখি, পশ্চিমবঙ্গের ৭.৩২ কোটি ভোটারের মধ্যে ৩.৭৩ কোটি পুরুষ ও ৩.৫৯ কোটি নারী৷ তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না৷ অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নারী ভোটার। তাঁরা ভোটে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মহিলা মতদানকারীর সংখ্যা প্রতি ভোটেই বাড়ে। তাই যে কোনো পার্টিই বিধান সভা দখল করতে চাইলে মহিলাদের সমর্থন পেতে তৎপর হবে। তৃণমূল বিজেপি কেউই এ ব্যাপারে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। তৃণমূলের বেশ কিছু নারীকল্যাণমুখী স্কিম আগে থেকেই চলছিল।'কন্যাশ্রী' আর 'রূপশ্রী' প্রকল্প যথাক্রমে মেয়েদের পড়াশোনা আর বিয়ের জন্য দেওয়া হয়৷ 'সবুজ সাথী'-র মাধ্যমে গ্রামের মেয়েরা পায় সাইকেল। কিছু শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থাও আছে। ২০১৩ সালে 'কন্যাশ্রী' প্রকল্প চালু হয়েছিল মূলত মেয়েদের স্কুল-ড্রপ আউট ও বাল্যবিবাহ রোখার জন্য। বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত এই স্কিম, তা ২০১৭ সালে ইউনাইটেড নেশনস-এর পাব্লিক সার্ভিস পুরস্কারেও ভূষিত হয়ছে। তা সত্যিই বাল্যবিবাহ রুখতে পেরেছে কিনা তা বিচার্য। অনেকেই বলেন, পুরোপুরি সমাধান না হলেও এতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। 'রূপশ্রী' প্রকল্প মেয়েদের বিয়ের জন্য টাকা দিয়ে পরোক্ষে পণপ্রথাকেই সমর্থন করা হয়৷ কিন্তু তা জনমোহিনী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে যে 'স্বাস্থ্য সাথী' নামক বীমা প্রকল্প চালু হল, তাতেও কার্ডটি দেওয়া হচ্ছে বাড়ির বয়ঃজ্যোষ্ঠ মহিলার নামে। কার্ডের মাধ্যমে পরিষেবা পাবেন পুরো পরিবার, কিন্তু কার্ডে থাকবে মহিলার নাম। সংসারে যে নারী থাকেন প্রায় অগোচরে, এতে তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকৃতিই দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ বছরের ম্যানিফেস্টোয় তৃণমুল লিখেছে পরিবারের বয়োবৃদ্ধ মহিলাটিকে ৫০০-১০০০ টাকা মাসিক ভাতা দেওয়ার কথাও। দোরে দোরে র‍্যাশন পৌঁছনোর কথাও বলা হয়েছে। দরিদ্র বা শ্রমজীবী নারীর কাছে এসব আশ্বাসের গুরুত্ব আছে।

অবাক করেছে বিজেপির ম্যানিফেস্টোও। তারা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল, এ রাজ্যের মহিলারা বিজেপির পিতৃতান্ত্রিক নীতির বিরোধী স্বভাবগত ভাবেই। নাহলে তাদের ম্যানিফেস্টোয় মহিলাদের জন্য এত ঢালাও প্রতিশ্রুতি থাকবে কেন? এ কথা অনস্বীকার্য যে নারী-কেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতিতে তারা অন্য দলগুলির থেকে এগিয়েই ছিল। নারীদের জন্য ছিল বিনামূল্যে সরকারি পরিবহণ ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি, সরকারি চকরিতে ৩৩% সংরক্ষণের আশ্বাস ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে লেখাপড়ার ব্যবস্থার কথা। কিন্তু তাতে বাঙালি মেয়েদের মন ভরেনি। সম্ভবত সরকারি চাকরি, শিক্ষা বা পরিবহণ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি তাদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ সকল সরকারি পরিষেবারই বেসরকারিকরণে বিজেপি সারা দেশ জুড়ে তৎপর। তাই ম্যানিফেস্টো তাদের সাধারণ আচরণের পরিপন্থী।

বিজেপি আদর্শগত ভাবে আরএসএস-এর নীতি মেনে চলে আর আরএসএস যে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও মনুবাদী তা বলাই বাহুল্য। তাদের নারী বিষয়ক মতবাদ প্রাচীনপন্থী৷ তা নারীকে সন্তান উৎপাদক, গৃহকর্ম সম্পাদক ও যৌনবস্তুর বাইরে ভাবতে অপারগ, তা বারংবার প্রমাণিত হয় আদিত্যনাথ যোগী বা সাক্ষী মহারাজদের বক্তব্যে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারীদের অবস্থা খুব সুখকর নয়৷ বিশেষত উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান ভয়াবহ। দলিত নারীর ধর্ষণ আরও নিত্যনৈমিত্তিক। হাথরসে পুলিশের ধর্ষিতার মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার স্মৃতি এখনও টাটকা। সেই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যখন বাংলায় এসে বলেন, বাঙালি নারী অসুরক্ষিত, বিজেপি এসে তাদের রক্ষা করবে, তখন বাঙালি নারী যারপরনাই অবাক ও বিরক্ত হতে বাধ্য বক্তব্যের অসারতায়। বরং তারা সন্দেহ করে, সুরক্ষায় অছিলায় নারীদের আবার চার দেওয়ালে ঠেলে দেওয়া হবে না তো? কারণ বিজেপি নেতাদের বক্তব্যে বারবার উঠে আসে এই তত্ত্ব যে নারীর প্রকৃত স্থান গৃহে। খেটে খাওয়া নারী তার চলাচল ও পেশার স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন। বাঙলায় তাই অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড করার পরিকল্পনা নেহাতই উলটো ফল দেয়।

বিজেপির নির্বাচন ক্যাম্পেইনেও ঢালাও ব্যবহার করা হয়েছে নারীবিদ্বেষী ভাষা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন নেহাতই রাস্তার ইভিটিজারের মতো ' দিদি ও দিদি' ডেকে ওঠেন নারী মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে, তখন তা শুধু রাজ্য জুড়েই না, দেশজুড়ে সমালোচিত হয়৷ কলেজ ছাত্রী-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী-চাকুরিরতা বা গৃহশ্রমিক, সকলেই ভাবতে বাধ্য হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে এভাবে অপমান করা গেলে সাধারণ নারীর কী অবস্থা হবে? দিলীপ ঘোষ মমতার পোষাকের শালীনতা তুলে কথা বললে বা তাঁকে বারমুডা পরতে বললে যে নারীবাদী কর্মীরা মমতার গুণমুগ্ধ হন, তাঁরাও প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন।

এমন নানাবিধ কারণে মমতা ব্যানার্জির পক্ষে ভোটারের সহানুভূতি আদায় সহজ হয়ে পড়ে। অনায়াসে তৃণমূল তাঁকে 'প্রজেক্ট' করে দুর্মুখ ছাপান্ন ইঞ্চির সব অত্যাচারী পুরুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক একাকী নারী হিসেবে। আবার 'ভাঙা পা' বিষয়টির সর্বাধিক ব্যবহারও করা হয় রাজনৈতিক লাভের জন্য। ভোটারদের সহমর্মিতার পাল্লা ভারি হতে থাকে। তার ফল ফলে ইভিএমে।

প্রায়শই আশা করা হয়, পরিবারের নারীটি ভোট দেবেন স্বামী বা পিতার পছন্দের চিহ্নে। কিন্তু ফলাফলের অভিমুখ বলে, সেই যুগ বদলাচ্ছে ধীরে ধীরে। গ্রামের মহিলারা হয়ত রাজনৈতিক তর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না, কিন্তু পরিবারের পুরুষটি যেখানে ভোট দেন, তার থেকে আলাদা চিহ্নেও তিনি ভোট দিয়ে আসতে পারেন। এই 'মৌন ভোটার'-দের তৃণমূলের প্রধান শক্তি বলেছিল বিজেপি ২০১৯ সালে।

মমতা ব্যানার্জির মুসলমান ভোট ব্যাংক নিয়ে যত কথা হয়, তত কথা হয় না তাঁর মহিলা ভোট ব্যাংক নিয়ে। অথচ ২০১৯ সালে সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভলপিং সোসাইটিজ-এর তত্ত্বাবধানে লোকনীতি সংস্থা এক ভোট পরবর্তী সমীক্ষা করে জানায়, ভারতবর্ষের মধ্যে তৃণমূলই একমাত্র দল যা পুরুষদের চেয়ে

মহিলাদের ভোট পায় বেশি। তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের ৫১% এসেছে মহিলাদের থেকে। আর পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ভোটারের ৪৭% তাদের ভোট দিয়েছেন, যেখানে বিজেপিকে দিয়েছেন ৩৭% মহিলা। ২০১৬ সালের বিধান সভা ভোটে নাকি তাদের প্রাপ্ত ভোটের ৫২% ছিল মহিলা ভোট, আর তখন নাকি পশ্চিমবঙ্গের ৪৮% মহিলা ভোটার তাঁদের ভোট দেন। তৃণমূলের মহিলা প্রার্থীর সংখ্যাও ক্রবর্ধমান। এবারেই প্রার্থী তালিকায় ছিলেন ৫০ জন মহিলা। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে মহিলা প্রার্থী ছিলেন ৪১% সিটে। আপাতভাবে, এ সবই আশার কথা। কিন্তু শুধুমাত্র ভোট ব্যাংক হিসেবে মানুষকে দেখারও আছে কিছু সীমাবদ্ধতা। সেক্ষেত্রে ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে যে তৎপরতা দেখা যায়, কর্তব্য পালনে ততটা দেখা যায় না। নতুন সরকারের উচিত নারীদের এই অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। কী কারণে, কীসের আশায় তাঁরা ভোট দিলেন, তা অনুধাবন করা ও সেই কর্মসূচিগুলি, সেই আশ্বাসগুলি বাস্তবায়িত করা৷ নারীদের যে তৃণমূল সম্পর্কে অভিযোগ নেই, তা তো নয়। বেকারত্ব নারীরও সমস্যা, তা নিরসন হওয়া প্রয়োজন৷ কামদুনি বা পার্কসাকার্সের ক্ষেত্রে এই সরকারের ভূমিকা ছিল নঞর্থক। সে সব ভুল স্বীকার করে আর পুনরাবৃত্তি না করার আশ্বাস প্রয়োজন। নারীদের যে সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, মাসিক ভাতা বা স্বাস্থ্য বীমা, তা পূরণ হওয়া প্রয়োজন। আত্মতুষ্ট সরকারের থেকে আত্মসমালোচক সরকার নাগরিকের পক্ষে বেশি মঙ্গলজনক।

0 Comments

Post Comment