পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভাসানদীঘির আশেপাশে

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : আবু সঈদ আহমেদ
"একটু দাঁড়িয়ে যাবেন সুবোধদা, আজ গাড়ি আনা হয়নি। সারাতে দিয়েছি। ভাবছি আপনার বাইকেই আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো।" সাধারণত এমআর বা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সামনে ডাক্তারবাবুরা বেশ গম্ভীর হয়েই থাকেন।

কেবলমাত্র অহমিকা এর কারণ নয়, যাতে করে দুর্বলতার সুযোগ কেউ না নিয়ে নেয় তার জন্য একটা ভারিক্কীভাব একটু রাখতেই হয়। সেটা যেকোন পেশার ক্ষেত্রেই সত্যি। কেউ সেখানে বাড়াবাড়ি করে ফেলে বদনাম কুড়ান, আর কেউ কেউ সেখানে একেবারেই আলগা দিয়ে বিপদ ডেকে আনেন। সুবোধ বিশ্বাসের সাথে ডঃ সুমন্ত্র রায়ের সম্পর্ক ঠিক সেরকমটা নয়। ডঃ রায় দাদা সম্বোধন করেই ডাকেন গ্রামসম্পর্কের জামাইবাবু সুবোধ বিশ্বাসকে।
"এতো খুব ভালো কথা স্যার। আপনি এতদিন পর গ্রামে ফিরছেন জানতে পারলে তো পুরো পাড়া ভেঙে পড়বে। একবার আমাদের বাড়িও ঘুরে যান তাহলে।"
"আমাকে তো কাল সকালেই কলকাতা ফিরতে হবে।"
পশ্চিমবঙ্গের একটি শহরের প্রান্তে, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়েই গড়ে ওঠা একটি বস্তি। একটি সরু, ব্যস্ত গলির ধারে ছড়ানো বাড়িগুলো। ঢেউ খেলানো টিনের চাল, কাঠের তক্তা এবং ত্রিপল দিয়ে জোড়া লাগানো অস্থায়ী ঘরগুলি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অলিগলির ঘন গোলকধাঁধা তৈরি করতো। এখন সেগুলোর অনেকগুলোতেই বাড়ি উঠে গেছে। তারই একটার তলায় হয়েছে ওষুধের দোকান। তারই মধ্যে একটা ক্লিনিক। আর তাতেই হচ্ছে ডঃ সুমন্ত্র রায় আর সুবোধ বিশ্বাসের এই কথোপকথন।
এই ছোট শহরের একটু দুরেই আছে ডঃ রায়ের ছোটবেলার গ্রামটা। বাবা-মাকে নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাটে চলে আসার পর গ্রামের বাড়িটার বেশিরভাগ অংশেই জ্ঞাতি আত্মীয়রা ঘর তুলে দিয়েছিলেন। তবুও বাড়ির এক অংশে দুটো ঘর তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে। যদি রায় পরিবারের কেউ এসে থাকে কখনো সখনো, এই অপেক্ষায়।
সুমন্ত্র রায়ের দাদাদিদিরা অবশ্য শহরেই থাকেন। ডঃ রায়ের ক্লিনিক থেকে বেশি দূরে নয়। তবুও আজকে রাতটা ডঃ রায় গ্রামেই যেতে চাইলেন এখন পরীক্ষার মরশুমে ভাইপো-ভাইঝি-ভাগ্না-ভাগ্নীদের অসুবিধা হবে বলে। দিনের বেলা এখানে এলে দেখা যাবে রাস্তার পাশে বাতাসে রান্নার সুবাস বয়ে বেড়াচ্ছে - খোলা আগুনের উপর মশলাদার ডাল ফুটছে এবং রাস্তার পাশের দোকানগুলিতে তৈরি হচ্ছে তাজা চা। খালি পায়ে কিন্তু প্রাণশক্তিতে ভরপুর শিশুরা ভিড়ের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের হাসি দূরের ট্রেনের গুঞ্জনের সাথে মিশে যাচ্ছে। ছোট দোকানগুলিতে মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র - চাল, তেল এবং বিস্কুট - পাওয়া যায়। ফেরিওালারা খদ্দের আকর্ষণ করার জন্য ছন্দময় কণ্ঠে ডাকে। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম সত্ত্বেও, একটি প্রাণবন্ত চেতনা বাতাসে ভরে ওঠে। হাতে আঁকা স্লোগান এবং রাজনৈতিক দেয়ালচিত্র দিয়ে সজ্জিত দেয়ালগুলি একটি পরিবর্তনশীল শহরে তার স্থান তৈরি করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক সম্প্রদায়ের গল্প বলে। যেখানে কষ্টের মধ্যেও, দয়া বিকশিত হয়। প্রতিবেশীরা খাবার ভাগ করে নেয়, সাহায্যের হাত বাড়ায় এবং আনন্দ ও দুঃখের মুহূর্তগুলিতে একত্রিত হয়। এরকম পরিবেশেই এই বস্তিতে বড় হয়েছিলেন সুবোধ বিশ্বাস। পরে মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টিটিভের চাকরি নিয়ে বিয়ে করেছিলেন সুমন্ত্র রায়ের গ্রামে।
"অনেক দিন পর রাতে এই রাস্তা দিয়ে রাতে ফিরছি, বুঝলেন সুবোধদা?"
"হ্যাঁ, আমরা তো দেখেছি স্যার কিভাবে আপনাদের সাইকেলে বসিয়ে স্কুল থেকে ফিরতেন।"
"হ্যাঁ, বাবাদের সবভাইবোনেদেরই সাইকেলে সামনে পেছনে করে বসিয়ে স্কুল নিয়ে গেছেন। বড় হতে দাদা নিয়ে যেত আর আরও বড় হতে আমরা নিজেরাই চালিয়ে নিয়ে যেতাম।"
"স্যার তো সারাজীবনই এভাবে কস্টই করে গেলেন।"
"সেজন্য এখন কলকাতায় নিয়ে চলে এসেছি। তবুও গ্রামের মায়া কাটেনি। সুযোগ পেলেই ফিরে যেতে চান। দাদাদিদিদের ওখানেও তো রইলেন কয়েকবছর।"
এখন যদিও রাতের অন্ধকার তবুও দিনের আলো থাকলে দেখা যায় গাঢ় নীল আকাশের নীচে সবুজ এবং হলুদ জলাভূমি পেরিয়ে একটি দীর্ঘ পিচঢালা রাস্তা। দিগন্তে তার সবুজের রেখা। একদিকে, নরম সূর্যের আলোয় জলাভূমি ঝলমল করছে, তাদের জলরাশি দুলছে যেমন বক ও সারস, মাছের সন্ধানে অগভীর জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বাতাস ভেজা মাটি এবং বুনো ঘাসের গন্ধে ভরপুর। অন্যদিকে, সবুজ সমুদ্রের মতো বিস্তৃত অন্তহীন ধানক্ষেতে ধানগাছগুলি বাতাসে মৃদুভাবে দোল খাচ্ছে। কৃষকরা তাদের ফসলের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। তাঁদের কণ্ঠস্বর পাতার মর্মরধ্বনি এবং দূরের পাখির কলরবের সাথে মিশে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়গুলির সরু ডালপালা ছোট ছোট পথের উপর প্রাকৃতিক খিলান তৈরি করে পথগুলোকে ঘন সবুজের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে দেয়। পুকুরগুলি আকাশের প্রতিচ্ছবি বুকে করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গোলাপী রঙের সূক্ষ্ম ছায়ায় পদ্ম ফুল ফোটে, যখন শিশুরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের হাসি ব্যাঙের ছন্দময় ডাকের সাথে মিশে যায়। এই পুকুরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ভাসানদীঘি। আগে মাঝে মাঝে একটি দুটি গরুর গাড়ি তার পাশ দিয়ে ধীরগতিতে যাত্রা করে গ্রামীণ জীবনের শান্ত ছন্দ যোগ করতো। আজকাল সেগুলোতে মোটরগাড়ি চলে। এখন সেখান দিয়েই ডঃ সুমন্ত্র রায়কে গ্রামে নিয়ে চলেছেন সুবোধ বিশ্বাস।
এই সুবোধ বিশ্বাসের আরেক পরিচয় তিনি সেই ছোট শহরের ততধিক ছোট একটি ক্লাবের একজন ছোটখাটো তালেবর সদস্য। নিজগুণে বড়বড় মানুষের সাথে মিশে ক্লাবের পুজোর জন্য চাঁদা জোগাড় করে আনতে পারার গুণের কারণে তাঁর মতো অভাজনও ক্লাবের মিটিংএ সুবিধাজনক অবস্থানে জাঁকিয়ে বসতে পারেন। এই চাঁদাদেনে-ওয়ালাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সুমন্ত্র রায় ও তাঁর ডাক্তারবন্ধুরাই সিংহভাগ জুড়ে আছেন। তাঁদের সূত্র ধরে কুড়িয়ে বাড়িয়ে মন্দ হয় না। আজকে ক্লাবের মিটিংএ অন্যদিনের মতো সুবোধ বিশ্বাস বেশ জাঁকিয়ে বসলেও মুখে এক চিন্তা ও বিষাদের ছাপ। কেবল তাঁর একার নয়, ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ট্রেজারার সকলেরই মুখ দেখলে তাঁদের মনোভাব কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে। এর কারণ আক্রাম দুবাইয়ে কাজ নিয়ে চলে যাচ্ছে। দেশভাগের সময় ও তারপরে সচ্ছল খানদানগুলো ওপারে চলে যাওয়ার পরে যেকটা প্রান্তিক মুসলিম পরিবার এখানে থেকে গেছিল তাদের মধ্যে এই আক্রামদেরটাও পড়ে। এই আক্রাম এমন কিছু গণমান্য ব্যক্তি নয় যে তার বিশেষ কিছু কদর হবে। তবুও তার কিছু খাতির ছিল কারণ সে ক্লাবের পুজোর বিসর্জনের সময় গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেত। পুজো আয়োজকরা চাঁদা চাইতে এলে গৃহস্থের মুখের ভাব অনেকটাই মলিন হয়ে যায়। অন্যদিকে চাঁদা তুলতে আসা আয়োজকদের কতটা গলদঘর্ম হতে হয় তা কেবল তাঁরাই জানেন। এই আয়োজকদের বিসর্জনের সময়ও ব্যাপক চিন্তায় থাকতে হয় 'কখন কি ঘটে' এই আশঙ্কায়। আক্রামের সুচারু চালনায় গাড়ি চলার সময় প্রতিমার কোনও অংশ খসে পড়েনি, কিম্বা বিদ্যুতের তারে আটকে যায়নি। অন্যান্য ক্লাবের কেউ স্পর্শকাতর এলাকায় অত্যুৎসাহী হয়ে বেসামাল কিছু করে ফেলায় অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে অনেকবার। কিন্তু আক্রামের গাড়ি নির্ভয়ে এগিয়ে গেছে জাতিধর্ম নির্বিশেষে যে কোন এলাকার মধ্যে দিয়ে। কোনও দিনও কারো কোন অসুবিধা না করে। তাই এহেন আক্রামের বিদায় যেকোন পুজোর আয়োজকদেরই চিন্তায় ফেলবে।
আক্রামের গাড়ি ক্লাব থেকে ঠাকুর তুলে সারা শহর ঘুরিয়ে শহর থেকে সুবোধদের গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ধরে ভাসানদীঘির দিকে যেত। এটা সেই এলাকার যেকোন পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জনেরই দীর্ঘদিনের রীতি। শোনা যায় বহুদিন আগে কোনও এক জমিদার এই দীঘি খনন করার সময় গঙ্গাজল অর্পণ করে কি কি যেন আচার-অনুষ্ঠান করিয়ে ছিলেন। তারপর থেকেই নিরঞ্জন কর্ম অন্য কোন জলাশয়ে না হয়ে এখানেই সম্পন্ন হয়ে আসছে। ভাসানদীঘি নামের অর্থও এই থেকেই বোঝা যায়। এই ভাসানের জন্যই শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার পাশের এই জলাশয় এখনো রিয়াল এস্টেটের কবলে পড়েনি। সেই জন্য কেবল এই দীঘিটাই নয়, আশেপাশের অনেক জলাশয়ই কেবল মাছচাষ নয় এই ভাসানদীঘির মাহাত্ম্যেই বেঁচেবর্তে আছে।
আক্রাম চলে যাওয়ার কয়েকমাস পরের কথা। আবার পুজো এসে গেছে। কিন্তু সব জোগাড়যন্ত্র হয়নি। বিশেষ করে বিসর্জনের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা। প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের আধিপত্যে পরিচালিত আয়োজক কমিটিই সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেয়—প্যান্ডেলের থিম থেকে শুরু করে তহবিল বরাদ্দ পর্যন্ত। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কলকাঠিতেই বিসর্জনের দিনটা একটু পিছিয়ে নেওয়া গেছে।
যাঁরা ক্লাব পরিচালয়ার সাথে পরিচিত তাঁরা জানেন, পর্দার আড়ালে কেমন আলোচনা চলে: ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ, রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে অনুগ্রহ আদায় এবং ক্লাব সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার সূক্ষ্ম ভারসাম্য পরিচালনা, সবই আছে তার মধ্যে।
এখানে আবার তরুণ সদস্যরা আধুনিকীকরণ এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণার জন্য জোর দেন, অন্যদিকে সিনিয়র সদস্যরা প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলার উপর। ক্লাবগুলির মধ্যে নির্বাচন উত্তপ্ত হতে পারে, সময়ের সাথে সাথে দলাদলি তৈরি হয় আর নয়া সমীকরণ আসে। একটি সফল দুর্গাপূজা একজন ক্লাবসদস্যকে নেতার মর্যাদা উন্নীত করতে পারে, অন্যদিকে অব্যবস্থাপনা একেবারে ডুবিয়ে দিতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলি সূক্ষ্মভাবে নিজেদেরকে দৃশ্যপটে জড়িয়ে নেয়, নিজেদের জনসংযোগ এবং সমর্থনের বিনিময়ে তহবিল প্রদান করে।
ক্লাবের সদস্যরা যখন তাঁদের শেষ দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়ে বিতর্ক করছিলেন, তখন সন্ধ্যার আর্দ্র বাতাসে ধূপ এবং ভাজা খাবারের গন্ধ ভেসে আসছিল। বাজেট নিয়ে মতবিরোধের কারণে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে উঠছিল, ঠিক তখনই একটি জোরে হর্নের শব্দে সবাই চমকে উঠল। শহরের যানজটে ধুলোয় ঢাকা মালবাহী গাড়িটি ক্লাবের প্রবেশপথে থেমে গেল। আক্রাম বেরিয়ে এল—তার স্কার্ফ কাঁধে ঝুলছিল। তার হঠাৎ আগমন জনতার মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে দিল।
কোন কথা না বলে, আক্রাম তার টুপি ঠিক করে, চারপাশের মুখগুলো ভালো করে দেখে মুচকি হেসে দুষ্টুমিতে ভরা গলায় বলল, "কেমন আছো সবাই?"
সেক্রেটারী সাহেব, অপ্রস্তুত অবস্থায় গলা পরিষ্কার করলেন। "তুমি হঠাৎ এখানে কেন?"
আসল কারণ যাই হোক না কেন, তার আগমন ক্লাবের মেজাজ বদলে দিয়েছে।
ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাচ্ছিল, আবার কেউ কেউ স্বস্তির চোখে। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট ছিল—জনতার মনে এখন আক্রাম ছাড়া অন্য কোন চিন্তা নেই। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আক্রাম বলে উঠলো,
"পুজোর ভাসান হবে আর আমি থাকবো না। এটাতো ভাবতেই পারছিলাম না। এইজন্যই ছুটি নিয়ে তোমাদের কাছে চলে এলাম।"

0 Comments

Post Comment