পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা আনাই সংবিধানকে রক্ষা করতে পারে

  • 26 November, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 502 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
যে সংবিধান একসময়ে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল, সেই সংবিধানের অপপ্রয়োগ করে সেই মানুষদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়ে, তারপর সংবিধান রক্ষা নিয়ে বড় বড় কথা বললে, কি সংবিধান দিবসের মর্যাদা থাকে? যেহেতু ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম পরিচায়ক, ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা, তাই এখানেও ডাঃ বি আর আম্বেদকরের কথাটিই আবার সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে।

২৬ শে নভেম্বর আমাদের ‘সংবিধান দিবস’ পালন করা হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৫০ সালে ২৬ শে জানুয়ারী, ভারত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বলা হয়ে থাকে যে ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে আর ভারত দ্বায়িত্বশীল দেশ হিসেবে জন্ম নেয় ১৯৫০ সালে। স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীলতা গণতন্ত্র নামক পয়সার দু পিঠের দুটো শব্দ। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়ে কি আমরা বলতে পারি ভারত সত্যি এতটুকুও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে কিংবা ভারত সত্যিই স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে? সংবিধান আমাদের দেশের সেই প্রাথমিক নিয়ম যা আমরা মেনে চলবো বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম ১৯৪৯ সালে, তা কি আমরা আজ পালন করছি?

১৯৪৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যখন সংবিধান সভা গঠিত হয়েছিল, তখন তাঁদের কাছে একটা বড় কাজ ছিল, বহু বছরের প্রাচীন, এই বৈচিত্রময় ভারতীয় সভ্যতাকে কী করে এক সূত্রে বাঁধবেন। যে দেশের ভূগোলে, সংস্কৃতিতে, ভাষায় এতো বৈচিত্র আছে, সেই দেশে একটা সংবিধান তৈরী করা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ ছিল। যখন ঐ সংবিধানের খসড়া পেশ করা হলো, তখন সেই সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ডাঃ বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, সংবিধান কীরকম হয়েছে, তার ওপর কোনও কিছুই নির্ভর করে না, কারা ঐ সংবিধানকে সামনে রেখে দেশ চালাচ্ছেন, তাঁদের সেই সময়ের মানসিকতার ওপর অনেককিছুই নির্ভরশীল। সংবিধান যত ভালোই হোক না কেন, তা খারাপ হতে বাধ্য, যাঁরা ঐ সংবিধান নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা যদি খারাপ হন। তখন ঐ সংবিধান ও একটি খারাপ গ্রন্থে রূপান্তরিত হতে বাধ্য, আর যদি গৃহীত সংবিধান খারাপও হয়, তাহলেও সেটি ভালো হয়ে যেতে পারে, যদি কারও ঐকান্তিক ইচ্ছে থাকে।

গত সাত দশকের বেশী সময় ধরে ভারতের সংবিধান, ভারতকে বেঁধে রেখেছে। সংবিধানের যে প্রস্তাবনা, সেটাই আসলে সংবিধানের সৌন্দর্য্য। গত বছর দেশ জুড়ে সংবিধানের পঁচাত্তর বছর উদযাপিত হয়েছে। এই বছরেও বহু নেতা এবং মন্ত্রী অনেকেই বলবেন সংবিধান আজ বিপন্ন এবং তাঁকে রক্ষা করতে হবে। প্রস্তাবনাতে উল্লিখিত শব্দগুলো অর্থাৎ ভারত একটি  সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এই কথা আবার ঘুরে ফিরে আসবে। হয়তো বহু মানুষ তার বিরোধিতা সামনাসামনি হয়তো করবেন না, কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বা ঐ শব্দগুলোকে আক্রমণ করা হবে।  ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্যতা এবং সৌভাতৃত্ব, এই প্রতিটি শব্দই আসলে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা দিয়ে সংবিধানকে বোঝা সম্ভব, যার কোনও একটি যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয় বা না থাকে, তাহলে সংবিধানের সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতা ব্যহত হবে, তাও হয়তো অনেকে বলবেন। কিন্তু তাও কি সবটা বলা হবে? রোজ যে দেশের নানান প্রান্তে সংবিধানের ঐ শব্দগুলোর অবমাননা হচ্ছে, সে কথা কি শাসকদের কানে পৌঁছবে? বেশ কিছু স্বশাসিত সংস্থার কথা ছিল, নিজেদের স্বাধীন সত্ত্বাকে বব্জায় রাখার, তার বদলে গত এক দশকে আমরা দেখেছি, সেই সব সংস্থা শাসকদলের কথায় চলছে। সবচেয়ে বেশী কথা উঠেছে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কার নিয়ে, না হলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, আমাদের সংবিধানের ভূমিকা কী?  প্রতিটি নির্বাচনে, প্রতিটি অভিযোগে সংবিধানই ছোট হচ্ছে, যে সংবিধানের কথা ছিল গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হওয়ার, তাকেই হেয় করা হচ্ছে রোজ। আমরা দেখলেও বুঝতে পারছি কি? নির্বাচন কমিশন তাঁর নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে প্রতিদিন ব্যর্থ হচ্ছে সেই জন্যেই সেই কমিশনের সততা রক্ষা করা এবং সংবিধানকে বাঁচানো সমার্থক হয়ে যাচ্ছে আজ এই সংবিধান দিবসের পঁচাত্তর বছরে।  

প্রথমত, নির্বাচন কমিশন, দেশের নির্বাচনে কালো টাকা ব্যবহার করার প্রবণতা বন্ধ করতে পরিপূর্ণ অসফল হয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনে টাকা খরচ করার ঊর্দ্ধসীমা বেঁধে দিয়ে বলেছে, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে যে কোনও প্রার্থী তাঁর নিজের প্রচারের জন্য যথাক্রমে ৭৫ লক্ষ এবং ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করতে পারবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, কিন্তু তা কি হচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, সংসদীয় নির্বাচনে এবং বিধানসভা নির্বাচনে বেশ কিছু প্রার্থী প্রায় ৪০ কোটি এবং ৬ কোটি টাকা অবধি খরচ করেছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, ক্যাশ টাকা বাজেয়াপ্ত হবার ঘটনা কম দেখা গেলেও, মদ এবং অন্যান্য নেশার জিনিষ প্রচুর ধরা পড়েছে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে। নির্বাচন কমিশন, কোথাও কোথাও এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলেও, মোটের ওপর তাঁরা কালো টাকা বন্ধ করা এবং এই বিষয়েও খুব কিছু ভালো দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, যতবার নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ বানানো জরুরি, ততবারই তাঁরা সেই সমস্ত কিছুতে আমল দেয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত একসময়ে বলেছিল, ইভিএমে স্বচ্ছতা আনতে গেলে ভিভিপ্যাট মেশিন, অর্থাৎ একটি যন্ত্র লাগাতে হবে, যাতে কোন নির্বাচক কাকে ভোট দিয়েছেন দেখা যায়, কিন্তু তা নিয়ে পরবর্তীতে প্রশ্ন উঠলে নির্বাচন কমিশন তাতেও আমল দিতে চায়নি। আদালতে বহু মামলা হয়েছে একশো শতাংশ ভিভিপ্যাটের স্লিপ এবং ইভিএমে প্রাপ্ত ভোট মিলিয়ে দেখার জন্য, কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাতে রাজি হয়নি। উল্টে তাঁরা বলেছে, এতে নির্বাচনের ফল ঘোষণায় দেরি হতে পারে। যেখানে স্বচ্ছতার প্রশ্ন এসেছে, যেখানে সংবিধানকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরার প্রশ্ন এসেছে, সেখানেই তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।

তৃতীয়ত, যে প্রসঙ্গটা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রশ্ন। সরকার যখন অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আসলে তা এই নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং সততা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। তারপরে একটি মামলায়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করবে একটি কমিটি, যে কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি। পরবর্তীতে সরকার অবশ্য সেই রায়তে বদল এনে জানায়, প্রধান বিচারপতির বদলে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঐ কমিটিতে রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে ১৪৬ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করে ঐ আইন আনা হয়। গত ২০২৩ সালের শীতকালীন অধিবেশনে যখন ঐ আইন আনা হয়, সেখানে আরো একটি ধারা যুক্ত করা হয়, যে কোনও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে, তা তিনি কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত যাই হোন কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। যদিও বিষয়টি নিয়ে আবার মামলা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে, কিন্তু সেই মামলার এখনো শুনানি হয়নি। বর্তমান  সরকারের এই সিদ্ধান্ত আবারো ডাঃ আম্বেদকরের কথাকেই সত্যি প্রমাণিত করে, সংবিধান যত ভালোই হোক না কেন, খারাপ ব্যবহারকারীর হাতে পড়লে, তা খারাপ হতে বাধ্য।

প্রতিটি নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, টাকার বিনিময়ে নির্বাচকদের কেনা হচ্ছে (মহারাষ্ট্রেও সেইরকম ছবি এবং ভিডিও দেখা গেছে)। সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনে তো সরকারি ঘোষণা করে নির্বাচন চলাকালীন মহিলাদের অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদ্ধতি চলতে থাকলে কোনও সরকারকে আর কখনো নির্বাচনে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানো থেকে শুরু করে, ভোট গণনাতে স্বচ্ছতার অভাব এই সমস্ত কিছুই আসলে একজন নির্বাচকের পছন্দকে গুরুত্বহীন করে দেয় এবং শেষ বিচারে তা নির্বাচন কমিশনকেই আরো হীনবল করে দেয়। লোকসভার বিরোধী দলনেতা সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রমাণ সহ দেখিয়ে দিয়েছেন,  নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় ভোটার তালিকায় কারচুপি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে লোকসভা নির্বাচনের পরে যে সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, তাতে অসংখ্য ভুয়ো ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং সঠিক ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সাহায্যে। এই সাংবাদিক সম্মেলনের অভিযোগকে কিন্তু নির্বাচন কমিশন নাকচ করতে পারেনি। উল্টে সেই প্রক্রিয়াকেই আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী করার প্রস্তাব এনে। বিহার সেই প্রক্রিয়ার প্রথম পরীক্ষাগার ছিল, যাতে দেখা গেছে প্রায় ৪৭ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ গেছে, যাঁদের অধিকাংশই মহিলা, প্রান্তিক, দলিত মানুষ।

যে সংবিধান একসময়ে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল, সেই সংবিধানের অপপ্রয়োগ করে সেই মানুষদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়ে, তারপর সংবিধান রক্ষা নিয়ে বড় বড় কথা বললে, কি সংবিধান দিবসের মর্যাদা থাকে? যেহেতু ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম পরিচায়ক, ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা, তাই এখানেও ডাঃ বি আর আম্বেদকরের সেই কথাটিই আবার সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং এটা আবার বোঝা জরুরি, নির্বাচন কমিশনকে শুধুমাত্র যদি ভূষিত করে দেওয়া যায় যে এটি একটি স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং স্বশাসিত সাংবিধানিক সংস্থা এবং কোনও শাসক দলের এই কমিশনকে পিছন থেকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা নেই, তাহলেই সংবিধান ‘ভালো’ হয়ে যায় না। যাঁরা এই সংস্থার মাথায় বসে আছেন, তাঁদের আরও বেশী দায়িত্ব বর্তায়, এই সংস্থার সূচিতাকে রক্ষা করার এবং গণতন্ত্রকে আরও প্রসারিত কী করে করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার।  

 

  

.

.









.



 

 

 

0 Comments

Post Comment