পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নয়া শিক্ষানীতি কি মেয়েদের অর্থনৈতিক রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলবে

  • 12 August, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1523 view(s)
  • লিখেছেন : জিনাত রেহেনা ইসলাম
শিক্ষার লক্ষ্য মানুষকে সমমর্যাদার জীবন গড়ে দেওয়া। শিক্ষিত সেই মানুষটি সমাজ, পরিবার ও দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে। সেই জন্য চাই তার আর্থিক সংস্থান। ৩৪ বছর পরে নেওয়া শিক্ষানীতি মেয়েদের সেই লক্ষ্যপূরণে কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সে প্রশ্ন থেকেই গেল।

বৈদিক যুগেই আর্যরা ঝুলিয়ে দিয়েছিল মেয়েদের শিক্ষার অধিকারে তালা। নিরক্ষরতা ও অজ্ঞানতা সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়েছে মেয়েরা। শুরুটা খারাপ হলেও স্বাধীনতার পর অতি সামান্য সাক্ষরতা নিয়েই ছিল পথচলার সূচনা। দেশের সামাজিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক পুনর্নির্মাণের ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ে দেশের অর্ধেকের বেশি পড়ে থাকা মানব সম্পদের ব্যবহারের ভাবনা। কমিশন, কমিটিতে উঠে আসে মেয়েদের শিক্ষা সম্প্রসারণের কথা। কোঠারি কমিশনে মেয়েদের গার্হস্থ্য ভূমিকা বড় হয়েছে। মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনে দর্শানো হয়েছিল এই যুক্তি— ‘বাড়ির উন্নতি ও শিশুচরিত্র গঠনের জন্য ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের শিক্ষার উপর জোর দেওয়া।’ মানব সম্পদের পূর্ণ বিকাশের কথাও ছিল যুক্ত। ঠিক ৩৪ বছর পর এল ‘নয়া শিক্ষানীতি-২০২০’। বার্তা শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো বদলের। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের বেটার আক্সেসেকে সামনে রেখে আলাদা করে হয়ত কিছুই ভাবা হল না। লক্ষ মানুষের সঙ্গে কথা বলে নীতি নির্মাণের বিনম্র দাবি করা হলেও মেয়েদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা হয়েছে কিনা তা অন্ধকারের থাকল। তার মূল কারণ হয়ত, ১৯৫১ সেন্সাসে ৮.৮৬% (গ্রামে-৪.৮৭ ও শহরে ২২.৩৩%) মহিলা সাক্ষর ছিল ও ২০১১ তে ৬৫.৪৬% (গ্রামে ৫৮.৮০% ,শহরে ৭৯.৯০%)। স্পষ্ট যে, অনেকটাই বেড়েছে। তাই প্রদীপের তলার অন্ধকার নিয়ে আলোচনার অবকাশ হয়ত কমছে।

সমাজ কাঠামোয় মেয়েদের অর্থনৈতিক ভূমিকা বাড়ানোর জন্য যে সিলেবাস ও সহযোগিতা দরকার তা নিয়ে স্পষ্ট কিছুই বোঝা গেল না এনইপি-২০ ঘোষিত শিক্ষানীতিতে। সবচেয়ে বড় বিষয় এই যে, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় নানা দেশে বিশ্বমানের কার্যনির্বাহি দল গঠন করেছে সরকার। সেখানে আশ্চর্যভাবে মেয়েদের সংখ্যা কম। প্রশ্ন এটাই তবে মেয়েরা পড়বে কেন? যোগ্যতায় তারা যদি লিঙ্গ অসাম্যের শিকার হয় তবে তাদের সামনে অনুপ্রেরণা কি রইল? জেন্ডার ইনক্লুসিভ পলিসি কোথাও দৃশ্যমান নয় নিপ-২০২০ তে। এমনকি মেয়েদের নিয়ে আলাদা করে ইকুইটি ও কোয়ালিটি এডুকেশনের বিষয় নিয়ে স্পষ্ট কিছু বোঝা গেল না।

মেয়েদের তিন বছর বয়সে প্রি-স্কুলে পাঠাতে গেলে একটি নির্দিষ্ট নিরাপত্তার ভাবনা দরকার। সেক্ষেত্রে মেয়েদের স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষায় পাঁচ বছর পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে কোডিং শিখবে মেয়েরা? এ এক তেপান্তরের মাঠের গল্প। এখনও বাড়িতে কাজ করে বিদ্যালয় যাওয়া এবং ফিরে এসে ঘরের কাজে সাহায্য করা প্রান্তিক এলাকার মেয়েদের কপালে বাঁধা নিয়ম। নিজের বাড়িতে একটা স্মার্টফোন বরাদ্দই কঠিন। তারপর আবার কম্পিউটারের ভাষা শেখা ও চর্চার ভবিষ্যৎ কষ্টকল্পিত।

মুখস্থ নয়, স্কিল হবে বাহন। তারজন্য প্রথমেই আসে পেশার জেন্ডার বিনির্মাণের সামাজিক ভাবনা। ষষ্ঠ শ্রেনি থেকে ভোকেশন্যাল কোর্সে কার্পেন্টার, গার্ডেনার, পটার আর্টিস্ট প্লাম্বারের দক্ষতা মেয়েদের অর্জন করা কি সহজ হবে? প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েরা কতটা শিখবে? পেশার সঙ্গে বিয়ের নিবিড় যোগ আছে। এই পেশায় আসা মেয়েদের বিয়ে দেওয়া সমস্যা হবে ভেবেই গ্রামের মেয়ের পরিবার এগিয়ে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করবে । এখনই গ্রামে ছেলেদের স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে হবে বলে মেয়েদের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েদের স্কুলগুলিতেও আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা না থাকায় বন্ধ হয় বেশ কিছুদিন স্কুল। তাই স্কিল দিলেও তা গ্রহণ ও প্রয়োগের প্রতিবন্ধকতা অনেক বেশি।

মেয়েদের বেশি পরিমাণে শিক্ষাঙ্গনে উৎসাহিত করা ও এগিয়ে আসার জন্য ওম্যান সেন্ট্রিক সিলেবাসের দরকার। পুরুষতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য ব্যাগবিহীন ক্লাসের আলাদা ব্যবস্থা দরকার। এগুলো ভাবনার মধ্যে আনা জরুরি ছিল। মহিলা শিক্ষকের ঘাটতি, আর্থিক বৈষম্য, সামাজিক সচেতনতার অভাব— এই বিষয়গুলি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ভাবাই হয়নি।

তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার পরে অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা শেষে চার বছর স্ট্রিম ছাড়া পড়ার সুযোগ মেয়েরা কতটা পাবে এটা বেশ পর্যবেক্ষণের বিষয়। আগামী দিনে কি করতে চায় না জানলে পড়বে কি নিয়ে?

গ্রাজুয়েশনে মাল্টিপল এন্ট্রি-একজিটে মেয়েদের বিয়ের হিড়িক পড়ে যাবে। এতদিন পরিবারকে ডিগ্রী পাওয়ার হিসেব দেখিয়ে মেয়েরা কিছুটা সময় পেত। এবারে পরিবারের একটিই যুক্তি থাকবে, বিয়ের পর পড়ার। প্রথম বছরেই সার্টিফিকেট ও দ্বিতীয় বছরে ডিপ্লোমা এবং তৃতীয় বছরে ডিগ্রীর মাঝে প্রস্তাব— পাকা দেখা চলতেই থাকবে। এমএ কমপ্লিট করা একটা বড় চ্যালেঞ্জে হবে সেই মেয়েদের। সেটা এক বা দুই বছর। যাই হোক না কেন!

রেজাল্টের নয়া মুল্যায়ণ পদ্ধতিও বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। নম্বরপ্রাপ্তির পর শিক্ষক ও নিজের মূল্যায়ণের সঙ্গে থাকবে বন্ধুদের মূল্যায়ণ। এক্ষেত্রে মেয়েদের সমস্যা বাড়বে। কোএড স্কুলে নানা কারণে বন্ধুদের মূল্যায়ণে মেয়েদের সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

শিক্ষায় ৬% জিডিপির কত শতাংশ মেয়েদের শিক্ষার জন্য রাখা হবে তা নির্দিষ্ট করা জরুরি। শিক্ষার লক্ষ্য কি? মানুষকে সমমর্যাদার জীবন গড়ে দেওয়া। শিক্ষিত সেই মানুষটি সমাজ, পরিবার ও দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে। সেই জন্য চাই তার এক আর্থিক সংস্থান। মেয়েদের সেই লক্ষ্যপূরণে ৩৪ বছর পরে নেওয়া শিক্ষানীতি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেই নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়েই যাচ্ছে।

দপ্তরের নাম বদল ও এক কেন্দ্রিয় অথরিটির প্রতিষ্ঠা পরিকাঠামোর বদল ঘটায়। কিন্তু আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বদল আনতে পারে না। তাই হোলিষ্টিক আপ্রোচ কে আরও ডিফাইন করা দরকার।

মাল্টিডিসিপ্লিনারি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের জন্য গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন সোশ্যাল সারকামস্টান্সের উপর তাই সেটা মেয়েদের পক্ষে কতটা অনুকূল হয়ে উঠবে ২০৪০ সালে তা বোঝা বেশ মুশকিল।

পরিকাঠামোর সঙ্গে পরিবেশের সাযুজ্য না থাকতেই একদিন সাবিত্রীবাঈ ফুলেরা কোমর বেঁধে পথে নেমেছিলেন শিক্ষার জন্য। সেই ফুলেদের বেছে বেছে তৈরি করার প্রেরণা বিদ্যালয়ের মধ্যে থেকেই মেয়েদের দিতে হবে। দেশের মাত্র ১ শতাংশ সম্পদের অধিকারী ও এক তৃতীয়াংশ রাজস্ব ভাগ বহন করা মহিলা এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ সাক্ষর মেয়েদের জন্য এই শিক্ষানীতি আলাদা করে কিছুই আশার কথা শোনাল না। বিশ্বায়নের দ্রুত আর্থ -সামাজিক পরিবর্তনের দিনে শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষের

শেষ বেঞ্চে মেয়েদের বসিয়ে কোনও ফলপ্রসূ ভাবনার পরিবেশ তৈরি সম্ভব নয় সেটাই বুঝিয়ে দিল। নীতি নির্ধারণে মূল ফোকাস মেয়েদের উপর রেখেই দেশ ও জাতির উন্নতিতে তাদের ভূমিকা স্থির করা দরকার। তাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার পাঠ দেওয়া দরকার। নয়া শিক্ষানীতি সেই গুরু দায়িত্ব এড়িয়ে বাঁচলো।

0 Comments

Post Comment