মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এর উপস্থিতিতে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনউপস্থিতিতে দিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠক হয়ে গেল গত ২৪ তারিখ। কাশ্মীরের পেহেলগাম উপত্যকায় বৈসরনে উগ্রপন্থী হামলায় ২৭ ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুতে সারা দেশ স্তব্ধ। সর্বদলীয় বৈঠক ছিল গোপন বৈঠক, সেইভাবে সরকার পক্ষ কি আলোচনা করেছেন বিরোধীপক্ষ কি আলোচনা করেছেন তার স্পষ্ট তথ্য সামনে আসেনি। সরকারি বার্তায় এটা প্রকাশ হয়েছে যে সমস্ত দল এই বর্বরচিত হামলার প্রতিবাদ করেছেন এবং সরকারের সমস্ত পদক্ষেপে পাশে তারা থাকবেন।
এ বিষয়ে স্পষ্ট যে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বদল এক সুরে বাধা। এখানে বলে রাখা ভালো উল্লেখযোগ্য ভাবে এই ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদে সব থেকে বেশি মুখর কাশ্মীরের সাধারণ জনতা। দশকের পর দশক কাশ্মীর তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারছেই না। কাশ্মীরিদের আজাদী বা জেহাদি যে পরিভাষায় সন্ত্রাসবাদকে বুঝি না কেন পর্যটকদের ওপর হামলা বিরল। হিন্দু ধর্ম জেনে হামলা এও অভিনব। কাশ্মীরি অর্থনীতিতে আয়ের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পর্যটন। প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা আয় হয় এই পর্যটন থেকে। মনে রাখতে হবে এই আয় কেবলমাত্র বড় কর্পোরেট হোটেলের আয় নয়। সাধারণ দোকানদার, গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত, শিকারা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, ঘোড়া পালনকারী এরকম আরো নানান রকম সাধারণ মানুষ এই পর্যটন ব্যবসায় জুড়ে আছেন। একটি ঘটনা সঙ্গে সব সময় মনে রাখা জরুরী ওই ঘটনায় লাভ কার হচ্ছে ? পেহেলগামের এই হত্যালীলার ফলে কাশ্মীরি সাধারণ মানুষের লাভ তো নয়, এমনকি সাধারণ মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত কাশ্মীরিয়ত ও প্রশ্নের মুখে।
এমতবস্থায় এই নারকীয় হামলার প্রতিবাদে ভারত সরকার যে সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করেছে বলে খবরে এসেছে, তার মধ্যে একটি অন্যতম হলো সিন্ধু নদের জল বন্টন চুক্তি স্তগিদ। ১৯৬০ সালে হওয়া এই চুক্তি ৬৫ বছর ধরে অপরিবর্তনীয় থেকে গিয়েছে মাঝের ভারত-পাকিস্তানের তিনটি যুদ্ধ হয়ে গেলেও।ভারত সরকারের অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলির বিষয়ে একজন ভারতবাসী হিসাবে আমাদের আলাদা করে কিছু বলার নেই। কিন্তু একজন নদী কর্মীর নৈতিকতার জায়গা থেকে নদীকে অক্ষ ধরে যে সর্বজন মঙ্গলের রাজনীতির কথা আমরা ভেবে থাকি বা চর্চা করে থাকি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, সিন্ধু নদের জল বন্টন চুক্তি সম্পর্কে কিছু কথা বলার অবকাশ তৈরি হয়।
হিমালয় সৃষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি মধ্যে অন্যতম সিন্ধু নদ। মানস সরোবরে উৎপন্ন হয়ে সিন্ধু তিব্বত (চীন), ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান দেশের অববাহিকার জল নিয়ে আরব সাগরের দিকে বয়ে চলেছে। 'সিন্ধু' থেকে 'হিন্দু', 'হিন্দুস্তান' নামকরণের এক চিরাচরিত কাহিনী ভারতে প্রচলিত। যদিও এইসব দেশ তো দূরে আদিম লেজহীন বানর পৄথিবীতে আসার অনেক অনেক আগে সিন্ধু নদ সৃষ্টি। প্রায় সাড়ে চার কোটি বছর ধরে সিন্ধু এই ভূখণ্ডের ভূমিরূপ সৃষ্টি করে প্রবাহিত হচ্ছে। যদি বলে নেওয়া ভাল, সিন্ধু আসলে একটি নদী নয়। আরো পাঁচ নদী মিশে ছয় নদীর একটি নদী ব্যবস্থাপনা।. ১৯৬০ এর চুক্তি অনুসারে আর্টিকেল ৩ এর ১ উপধারা অনুসারে পশ্চিম থেকে বয়ে চলা চেনাব, সিন্ধু, ঝিলাম ও পূর্ব বয়ে চলা রাভি, বিয়াস, শতদ্রু জল বন্টনের নির্দিষ্ট নিয়ম নির্ধারিত করা আছে। পশ্চিমে তিন নদীর জল জল পাকিস্তানে। আর পূর্বের তিন নদীর জল ব্যবহার করতে পারবে ভারত। ২০১১ সালের একটি রিপোর্ট বলছে ভারত ভূখণ্ডে এখন পর্যন্ত ৩৯ টি ড্যাম ১৩ টি ব্যারেজ ও ১৮ টি ওয়ারিয়ার তৈরি করতে পারা গেছে। ভারতের অংশের প্রায় ৯০ ভাগ জল ভারত ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসঙ্গত ২০২৩ এ বিয়াস নদীর বন্যার ছবি ভারতবাসী মনে আছে। হিমাচল প্রদেশের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি শহর থেকে দিল্লী পর্যন্ত সেই জলের দাপট প্রত্যক্ষ করা যায়। নিম্ন গাঙ্গেয় অংশের মানুষেরা আমরা জানি নদীতে বাঁধ দিয়ে তাকে সম্পূর্ণরূপে অন্য পথে প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। বাঁধ নির্ভর নদী ব্যবহারের ধারণা পদ্ধতি আমাদের নদী এবং নদী পাড়ের জৈব বৈচিত্র্য, সর্বোপরি মানুষের জন্য সর্বোত্তম মঙ্গল হয়ে উঠতে পারেনি। বরঞ্চ বাঁধ- ব্যারেজ ফিরে ফিরে আসা সংকটের কারণ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে "ম্যানমেড বন্যা" এক পরিচিত রাজনৈতিক শব্দবন্ধ। এবার দেখা যাক সিন্ধু নদ কে। সিন্ধু নদের ৩২১২৮৯ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ ৯.৮ শতাংশ ভারত ভূখণ্ডে অবস্থিত। আবার পশ্চিমের তিন নদীর জল প্রবাহ পূর্বের তিন নদীর প্রায় চার গুণ। পাশাপাশি লাদাখ-কাশ্মীর হিমালয়ের অংশ। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে পশ্চিমের নদী নিয়ন্ত্রণ করা এক দুরূহ কাজ। আজ যদি ধরেও নেওয়া যায় পশ্চিমের নদীগুলির জলকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নেওয়া হবে, তবে পাঠকদের জেনে রাখা দরকার ভাগিরথী নদীর উপরে তেহেরি ড্যামের মতো অন্তত ৩০ টি বাঁধ তৈরি করতে হবে সরকারকে। যার কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি হয়নি কোথাও। অথচ প্রচার সর্বস্ব এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমন ভাবে সন্ত্রাসবাদী হামলা ভারাক্রান্ত ভারতবাসীর মনে জল চুক্তি স্থগিতের আবেগকে দিয়ে এক কাল্পনিক রাষ্ট্রবাদের প্রচার করে নিতে পেরেছে। ঘটনাক্রমে আমরা স্মরণ করে নিতে পারি ২০১৬ সালে উরি সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে একই রকম কথা প্রচারিত হয়েছিল। যার বাস্তব কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি এতদিনে। এই সময় আমাদের সমাজ ইতিহাসের পাতা উল্টে নেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে IWT (ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি) বা সিন্ধু জলবন্টন চুক্তি কোন রাষ্ট্র বা জননেতার মহানুভবতায় তৈরি হয়নি। ধারাবাহিক লড়াই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য থেকে এই চুক্তি সম্ভব হয়েছিল ।১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ তৈরি বাঁধ ব্যারেজ এর সাহায্যে ভারত পাকিস্তানের খালগুলিতে জলপ্রবাহ বন্ধ করে। ফলে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আন্দোলনে সোচ্চার হন। এখানে মনে রাখা দরকার নিম্ন সিন্ধু অববাহিকার অর্থাৎ পাকিস্তানের বৃহৎ অংশের মানুষ সিন্ধু অববাহিকার জল নির্ভরশীল। পাকিস্তানের প্রধানত ৪০% কৃষিজীবী মানুষ সিন্ধু নদ নির্ভরশীল। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রসঙ্ঘের সামনে সিন্ধু নদের জল বন্টন বিষয়টি উত্থাপন করে। এর পর প্রায় ৯ বছর লেগে যায় চুক্তি শর্তে সহমতে পৌঁছাতে। আবার এর মধ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মধ্যস্থতা অন্যতম ফ্যাক্টর। এটা আসলে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। কারণ ওয়াল্ড ব্যাঙ্ক আর্থিক দায়ভার গ্রহণ করার ফলেই এই চুক্তি হতে পেরেছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে এককভাবে এই যুক্তি স্থগিত রাখা সম্ভব নয়। এটা ডাহা মিথ্যা একটি প্রচার। এর সঙ্গে পাকিস্তান এই কাজকে 'অ্যাক্ট অফ ওয়ার' হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এই সমস্ত কারণে বৈসারণ উপত্যকার এই নারকীয় ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতেও আগ্রহ তৈরি করেছে। কিন্তু তা কি ধরনের আগ্রহ তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছে দুই দেশকে আমি চিনি। কাশ্মীরের এই বিতর্ক দেড় হাজার বছর ধরে চলছে। ভারতীয় সভ্যতার নদীকে না জানলে দেশকেও জানা সম্ভব নয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কি এমন ভুল তথ্যের মধ্য দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মনে রাখতে পারেন ?
এমন অনেক কথাই প্রশ্ন আকারে সামনে আসা জরুরী। ২০০১ সালে জম্বু কাশ্মীর বিধানসভার সামনে হামলা, ২০০৬ ডোডা অঞ্চলে, ২০১৭ সালের অমরনাথ যাত্রীদের আক্রমণ এবং ২০১৯ এর পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এর রিপোর্ট যথার্থ বিচার ব্যতীত ধারাবাহিক এই সন্ত্রাসবাদী হামলা মোকাবিলা সম্ভব নয়। অন্য দিকে বৈসরনের ঘটনা কে সাধারণ কাশ্মিরী মানুষেরা যখন তাদের কাশ্মরীয়তে আঘাত বলে মনে করছেন। সেই সময় সাধারণ কাশ্মীরি মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে এই সন্ত্রাসবাদের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এই সময় কাশ্মীর বয়কট সারা দেশজুড়ে যে সমস্ত কাশ্মীরি ছাত্র-ছাত্রীরা ভারতীয় মূল স্রোতে প্রবেশের আশায় বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করছেন। তাদেরকে ও জুড়ে নেওয়া এই সময় কাজ হয়ে ওঠা উচিত বলে আমার মনে হয়। অথচ উগ্র রাষ্ট্রবাদের নামে, ধর্মীয় বিভেদের নামে এক নৈরাজ্য সৃষ্টির নিরন্তর চেষ্টা চলছে দেশ জুড়ে। এই সময় ভালোবাসা দিয়ে, নৈতিকতা দিয়ে আমাদের সমাধান সূত্র বের করে নেওয়া দরকার বলে আমার মত।