পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

রাষ্ট্র কি ধর্ষণ রুখতে চায়?

  • 30 November, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2405 view(s)
  • লিখেছেন : অভিষেক সরকার
ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা অন্যান্য কড়া শাস্তি কখন হবে? ধর্ষণ ঘটে যাওয়ার পর? নাঃ, ধর্ষণ প্রমাণিত হলে। আদালত অবধি মামলা গড়ালে এবং মামলায় বাদী পক্ষের উকিল ঘুষ নিয়ে প্রমাণ নষ্ট না করলে, পুলিশ যথেষ্ট সংবেদনশীল হলে ? রাষ্ট্র কি চায়?

যে কোনও যৌন নিগ্রহের ঘটনা জানা গেলে সাধারণত তিন রকম কথা শোনা যায় -- এক, মেয়েটা নির্ঘাত...(সম্ভাব্য অভিব্যক্তিগুলি সব্বার জানা, আর লিখলাম না), দুই আমাদের দেশে মেয়েদের মার্শাল আর্ট শেখানো উচিত যাতে আত্মরক্ষা করতে পারে, আর তিন ধর্ষকের কড়া শাস্তি চাই। প্রথম কথাটায় এখানে সকলেরই গভীর আপত্তি আছে ধরে নিয়েই ওদিকে আর যাচ্ছি না।

দ্বিতীয় বিষয়টা দিয়ে শুরু করি। আচ্ছা, যদি কোনও মেয়ের মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছে না থাকে? তার যদি ফুটবলে, ভলিবলে, তীরন্দাজিতে কিংবা গণিতে আগ্রহ বেশী হয়? আমরা কি আবারও কোনও লিঙ্গ-বৈষম্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না? যদি ধরেই নিই, প্রতিটি মেয়ে মার্শাল আর্ট শিখতে ইচ্ছুক, তাহলেও তারা কি সমান পারদর্শী হয়ে উঠবে? যদি ধর্ষক জুডোয় পারদর্শী হয়, এবং তার শিকারের থেকে বেশী দক্ষ হয়? নাকি জুডো বা ক্যারাটে জানা পুরুষ ধর্ষণ করে না? যে মেয়েটির ওপর আটজন পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল সে যদি ক্যারাটে জানত, রেহাই পেত? আত্মরক্ষা করার যাবতীয় দায় কি নাগরিকের নিজের? সাধারণ মানুষের করের টাকায় এই বিরাট প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার মানে কি? দুদিন বাদে কি বলব সীমান্তে জঙ্গি হামলা আটকাতে স্কুলে স্কুলে সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক? গোটা সমাজকে একটা বাহিনীতে পরিণত করতে পারলে কতৃত্বকামী রাষ্ট্রের সুবিধে অনেকরকম। প্রথমত দায় ঝেড়ে ফেলা যায়। দ্বিতীয়ত সেই বাহিনীকে রাষ্ট্রের জিঘাংসা চরিতার্থ করতে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু আমরা কি সত্যিই নাগরিক সমাজের নির্বাসন চাই? security state চাই? যে রাষ্ট্র স্কুলে স্কুলে শিবির গড়ে তুলে এই বিরাট security state নির্মাণ করতে চায়, সে কি সত্যিই ধর্ষণ রুখে দিতে ইচ্ছুক?

এইখানেই তৃতীয় বিষয়টি এসে পড়ছে। ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা অন্যান্য কড়া শাস্তি কখন হবে? ধর্ষণ ঘটে যাওয়ার পর? নাঃ, ধর্ষণ প্রমাণিত হলে। আদালত অবধি মামলা গড়ালে এবং মামলায় বাদী পক্ষের উকিল ঘুষ নিয়ে প্রমাণ নষ্ট না করলে, পুলিশ যথেষ্ট সংবেদনশীল হলে (নাহলে ধর্ষক ধরাই পড়বে না, ফাঁসিতে কাকে ঝোলাবেন?)। National Crime Record bureau-এর হিসেব বলছে ভারতবর্ষে যত ধর্ষণের অভিযোগ নথিবদ্ধ হয় তার 63.3 শতাংশের তদন্ত শুরু হয়, চার্জশিট ফাইল হয় 54.7 শতাংশ, ট্রায়াল শেষ অবধি গড়ায় 42.7, আর শাস্তি হয় 11.26 শতাংশ মামলায়। কড়া শাস্তি? মৃত্যুদণ্ড? কার? আর ওই কয়েকজনের শাস্তি হলেই বা ধর্ষিতার কি যায় আসে? প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নিত্যনতুন উপায় আবিষ্কার করে ভিড়কে স্তোক দেওয়া যায়। নির্বাচনী প্রচার করা যায়। ভোট পাওয়া যায়। justice দেওয়া যায় না।

India's Daughter দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছিল জ্যোতিকে নিয়ে তিহাড় জেলে বসে ওই ধর্ষক যা যা বলছে, যা যা বলছে তার উকিল, এর সবটা আমার চেনা, জানা। অথচ আমি ভদ্দরলোকের বাড়িতে বড়ো হয়েছি। শালীন/অশালীন পোশাকের তফাত আমায় শিখিয়েছেন আমার গুরুজনেরা, বাড়ির মেয়ে এবং রাস্তার মেয়ের তফাতও। মনে আছে আমারই এক সমবয়সী তার বাড়িতে বলেছিল, 'মেয়েদের' সিগারেট খাওয়ায় তার প্রবল আপত্তি এবং তার কম্যুনিস্ট পরিবার জনে জনে বুক ফুলিয়ে সেই গপ্পো শুনিয়ে বেড়াত। এ হেন পরিবারের বা প্রতিবেশীর হাতেই কি তবে ধর্ষণ বন্ধ করার দায়িত্ব দিতে হবে? আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় ধর্ষিতার নাম বা ছবি আড়াল করার চেয়ে বরং তাঁকে প্রকাশ্যে এনে দাঁড় করানো হোক। আমরা মঞ্চ গড়ে তুলি কিন্তু সামাজিক সচেতনতার মুখ হোন নির্যাতিতা নিজেই। কোনও তত্ত্ব কথা নয়। তাঁর গল্প, তাঁর ভয়, তাঁর যন্ত্রণা। আমরা শুধু ভরসা দিই। বলি, কোনও লজ্জা নেই, লজ্জা আপনার নয়, আমাদের -- আপনার জন্য রইল সংগ্রামী অভিনন্দন। সচেতনতা শিবির হোক পাড়ায় পাড়ায়। শুধু পড়ুয়া নয়, পরিণত বয়স্ক বাবা-মা, শিক্ষককে, পাড়ার দাদাকে সচেতনতা শিবিরে ডাকা হোক। বলে দেওয়া হোক -- আপনি ভুল ভাবছেন। আপনিও এই rape society-এর অঙ্গ। আপনার মেয়ের শরীরের দিকে যে হাত এগিয়ে আসছে তাতে আপনারও ইন্ধন আছে। আর সেটা আমি বললে বোধ হয় বিশ্বাসযোগ্য হবে না। নির্যাতিতা নিজেই বলুন। দুনিয়ার সমস্ত নির্যাতিতা একজোট হোন। একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটা সিস্টেমই লড়তে পারে। আপাতত একজন দুজন, এক শহর দুই শহরেই হোক না। ক্ষতি কী? Suzette Jordan পারলে উন্নাওয়ের ধর্ষিতাই বা কেন পারবেন না? অথবা সেই যুগল যারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে উন্মত্ত ভিড়ের আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করছিল দমদমের মেট্রো স্টেশনে? কথায় কথায় মনে পড়ে গেল আমার এক বন্ধুকে। তার কথা চ্যানেল, মন্ত্রী, সমাজকর্মী কেউ জানে না। বিহারে লন্ডা নাচতে গিয়েছিল কোনও বিয়ে বাড়িতে। ছেঁড়া পায়ুছিদ্র নিয়ে কোনও মতে ট্রেনে উঠেছিল। এই অবধি জানি। তার প্রিয় শহরে সে আর ফিরে আসেনি। শরীরী লিঙ্গে সে পুরুষ। তাকেও খুঁজে আনি আমরা। বাড়ি বাড়ি যাই। মহিলা নয়, পুরুষকে ডেকে বলি ধর্ষিত হলে কী করে নিজেকে বাঁচাতে হয়। ঘা লাগুক পৌরুষে। শিকারের জুতোয় পা গলাতে শিখুক শিকারি নিজেও।

পুনশ্চঃ আচ্ছা ক্যারাটে শিবিরের বদলে নেতা-মন্ত্রী ও তাঁদের পরিবারের এই সচেতনতা শিবিরে হাজিরা দেওয়া কি কল্যাণকামী রাষ্ট্র বাধ্যতামূলক করতে পারে?

0 Comments

Post Comment