পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গুজরাত : ধর্ম বদলেছে নিপীড়িত দলিত

  • 11 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 971 view(s)
  • লিখেছেন : সুমিত দাস
গোরক্ষক আছে। আছে জ্যান্ত বা মরা গরু। গোরক্ষকের মারের ভয়ে গোয়াল-হারা গরু গেল কোথায়? গরুর মাংস রফতানি করে ভারত যখন তৃতীয়, তখন, অস্পৃশ্যতার অপমানে লাগাতার নির্যাতিত উনার দলিত ত্যাগ করে জাতপাতের ধর্ম।

 

রমেশ সারভাইয়া। চেনেন? নাম মনে আছে? হয়তো আছে কারো কারো। সিংহভাগের মনে থাকার কথা নয়। সারা ভারতে, বিশেষত উত্তর ভারতে নানারকম হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও গোরক্ষকদের লাগাতার তাণ্ডবে একের পর এক সংখ্যালঘু মুসলমানের মৃত্যু হচ্ছে তখন। একের পর এক জায়গার নাম, লাশের নাম ছড়িয়ে পড়ছে।  দাদরির মহম্মদ আখলাখ, নাগপুরের আন্দুল গফ্ফর কুরেশি, সাহারনপুরের নোমান হয়ে ঝাড়খন্ডের মজলুম আনসারি। তালিকায় স্হান ও পাত্র দীর্ঘ হবার দিনে গুজরাটের গির সোমনাথ জেলার উনা শহরের নাম ভেসে উঠলো আলোচনায়।  মরা গরুর ছাল ছাড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করা দলিত চর্মকারদের গাড়িতে বেঁধে মারলো গোরক্ষকরা। এর পরে অবশ্য সময় যেতে যেতে সারা ভারতের 'সনাতনী' গোরক্ষকদের হাতে নির্যাতিতদের তালিকায় আরো নাম জুড়বে। আলাওয়ার, রাজস্হানের পহেলু খান,দিল্লির নাম না জানা তিন সংখ্যালঘু, হরিয়ানার জুনেইদ, বাংলার দক্ষিণ দিনাজপুরের সমিরুদ্দিন, নাসির, ঝাড়খন্ডের নাসিরুল, রাজস্থানের ভরতপুরের উমর মহম্মদ। দীর্ঘ সে তালিকা।

দমন, নিয়ন্ত্রণ ও সবক শেখানোর নয়া রীতির মাঝে ভারত বিগত ৫ বছর লাগাতার গরুর মাংস রফতানিতে তৃতীয়। ব্রাজিল ও আমেরিকার পরে। আর গরুর মাংস রফতানিতে শীর্ষে যোগিরাজ্য। উত্তরপ্রদেশ একাই ৭০% গরুর মাংস রফতানি করে। রমেশ সারভাইয়ারা অবশ্য গরুর মাংস উৎপাদন করতেন না। মরা গরুর চামড়া ছড়িয়ে যোগান দেওয়াই ছিল তাদের 'সনাতনী' মানে পরম্পরার কাজ।

কী ঘটেছিল? ১১ জুলাই, ২০১৬, উনা শহরে মরা গরু নিয়ে যাবার সময় রমেশ সারভাইয়া সহ ৭ জনকে ঘিরে ধরে জনা চল্লিশের গোরক্ষক। গাড়িতে বেঁধে লোহার রড দিয়ে চলে বেধড়ক মার। সারা ভারতে নানা প্রতিবাদের পর, এবং অবশ্যই বহুজন ও দলিত ভোটের লোভে ৪৩ জন সন্দেভাজনকে গ্রেফতার করে গুজরাট পুলিশ। ৩৫ জনের দ্রুত জামিনও হয়ে যায়। কিন্তু ঘটনার নানারকম রেশ চলতে থাকে।

 

'জাতপাতের হিন্দুত্বই নির্যাতনের কারণ।' এমন অভিজ্ঞতায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার করা রমেশরা এরপর ধর্মান্তরিত হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রমেশ বলেন, 'হিন্দুরা তাদের গ্রহণ করে না।' এ সময়  তাঁরা জামিন পাওয়া গোরক্ষকদের হাতে লাগাতার অত্যাচারিত হচ্ছিলেন । পুলিশ-প্রশাসন যেন দেখেও দেখছে না।

রাস্তায় অভিযুক্তদের হাতে রমেশের দাদা-ভাইয়ের হেনস্থা, ভিনজাতির মহিলার সঙ্গে অটোতে সওয়ারী হওয়ায় হেনস্তা, এমন নানান ঘটনার পর ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ সালে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন অপমানিত রমেশরা।

মাঝে পেরিয়ে গেছে ৭ বছর। বছর কুড়ির রমেশ এখন সাতাশের। তার এক তুতোভাই বছর আঠাশের জিতু সারবাইয়া ধর্মান্তরিত হবার পর বলেছিলেন,- 'কাজের জায়গায় জল খাবার জন্য আলাদা গ্লাস নিয়ে যেতে হয়। এমনকি তাঁর গ্রামের মন্দিরে ঢোকার অধিকারটুকু নেই। তাই আম্বেদকরের দেখানো পথে বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ।'

না, বছর সাতেক আগে, উনার দলিত নিপীড়ন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জিতু সারভাইয়া বলেছিলেন, -'ধর্ম বদলে অস্পৃশ্যতা শেষ হল না, স্রেফ হিন্দু দলিত না, নতুন পরিচয় হল বৌদ্ধ, আশা করা যায়, নতুন পরিচয় জানার পর কেউ জাত জানতে চাইবে না। বদল এটুকুই।'

উনার ঘটনার পরের দু-বছরে, গুজরাটে আয়োজিত ৫ টি বড় অনুষ্ঠানে ৬০,০০০ দলিত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। গুজরাট দলিত সংগঠন জানায়, 'ঘোষণা করে ধর্মান্তর-অনুষ্ঠান করা যায় না। কারণ নাকি, বুদ্ধের দেশ হলেও,  জানাজানি মাত্র উঁচু জাতের লোকজন অত্যাচার শুরু করে।' সত্যিই তো, নিচু জাত না থাকলে উঁচু তো থাকা যাবে না!
চামড়ার জুতো, জ্যাকেট, সোফাসেট, বাদ্যযন্ত্র সবই আগের মতই বাজারে সাজানো আছে। গোরক্ষকদের ভয়ে ছেড়ে দেওয়া গরু কোথায় গেল শেষমেশ, খোঁজ রাখা হয়নি। কৃষিতে ব্যপক যন্ত্রের প্রয়োগে গরুশূন্য গ্রাম বাড়ছে। বাড়ছে দুধের আকাল। বেঁচে থাকার সবটাই কর্পোরেট হয়ে গেল। গরু জীবিত হলেও গোরক্ষক, মরলেও গোরক্ষক, আসলে বদলে ফেলা হল গ্রামীণ অর্থনীতিতে গরুর গুরুত্ব। বিশ্বাস আর খাদ্যাভ্যাস নিয়েই শয়েশয়ে বছর পার করা ভারতে  স্রেফ সরল মনের সনাতনী গোরক্ষকরা অনাচার ঘটিয়ে দিল? সম্ভবত না। বিশ্বের তৃতীয় গরুর মাংস রফতানিকারীদের ডবল ইঞ্জিন তা জানে। আর জানে 'সনাতন' বা রমেশ। যে সনাতনকে ভাতে ও জাতে মারে চিরকালীন সনাতনী।

0 Comments

Post Comment